সুপারিবাগানের গা ঘেঁষা গোলেনূর দাদির তাঁতঘরটা আজ বিকেল হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের তাঁতঘরও বন্ধ আজ। আর তাঁতঘর বন্ধ হওয়া মানেই আমাদের পাড়ার ঝিমিয়ে পড়া। তাঁতমাকুর শব্দ নেই, তাঁতঘর থেকে ভেসে আসা গানের সুর নেই, কারণে-অকারণে তাঁতিদের হৈ-হট্টগোল নেই, আর নেই কলিমচাচার বাঁশির সুর।
কলিমচাচা সবসময় আসেন না। কিন্তু ঈদ বা অন্য কোনো পরবের আগে কলিমচাচা ঠিক ঠিক এসে হাজির হয় আমাদের পাড়ায়। কিচ্ছু না, শুধু পরবের দিনে কখনও ঝোলাভরে নাড়ু, খৈ অথবা পেটভরে সুগন্ধি চালের ঘি-ভাত আর লাল সুরুয়া পেলেই তাঁর চোখদুটো চকচক করে ওঠে, “বুবু রে দোয়ায় হাত উঠাইলেই তোগো কথা মনে হয়, তোরাই আমার আসল শরিক রে বুবু”।
কলিমচাচার কাছে এই পাড়ার সবাই হয় বুবু, নাহয় বড় ভাই। তবে দাদুকে ডাকেন বড়বাবু বলে। মানুষটা সারাবছর কোথায় থাকে – তা এ পাড়ার কেউ জানে না। তবে সবাই অন্তত এটুকু নিশ্চিত, যে, পরবের আগে না হলেও, পরবের দিন মানুষটি ঠিকই এসে হাজির হবে।
আর এসেই কেমন যেন পাড়ার সবার আত্মীয় হয়ে ওঠেন। কোনো বাড়িতে সকালের জলখাবার, তো কোনো বাড়িতে রাতের খাবার তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়। তবে যতদিন থাকেন, সন্ধ্যার চা ঠাকুমার উনুনেই ওঠে তাঁর জন্য।
এবার বিশ রোজা হয়ে যাবার পরপরই কলিমচাচা এসে গেছে। তাঁর থাকার জায়গা হয়েছে গোলেনূর দাদির তাঁতঘরে। সারাবছর না হলেও রোজার সময়ে তাঁতিদের একটু আধটু ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আর রোজা রেখে দুপুরের পর থেকেই তাঁতিদের শরীরে আলস্য জেঁকে বসে। তাঁতমাকুর আওয়াজে ঢিমে তাল এলেই সুর ওঠে কলিমচাচার বাঁশিতে। আর সেই সুরে গলা মিলিয়ে তাঁতিরা গেয়ে যায়,
“ওকি গাড়িয়াল ভাই কত কান্দিম, মুঁই পন্থের দিকে চাইয়ারে।
ওকি মইশালরে ছাড়িয়া না যান মোক কাগাশিয়ার ঘরে রে।
কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্ধুরে……”
সুরের পরতে পরতে জড়াতে থাকে তাঁতমাকুর অবিচ্ছিন্ন খটাস খটাস শব্দ।
এ জন্য রোজার সময় পাড়াজুড়ে এক অদ্ভুত আলোড়ন থাকে। কিন্তু আজ বিকেল হওয়ার আগেই সব কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। সারা পাড়ার চঞ্চলতা আজ জড়ো হয়েছে গোলেনূর দাদির উঠোনে। কখনও বাজারের ফর্দ নিয়ে গোলেনূর দাদির হাঁকডাক, আবার কখনো ঈদের জামা নিয়ে সুমির আহ্লাদ। সবকিছুই আজ অন্যরকম ও বাড়িটায়। এসবের মাঝেই একটু ফুরসত পেতেই কোহিনূর ফুপু এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের বাইরবাড়িতে, “মনিপিসিকে ডাক, থানাঘাটে যাব”।
আমার ডাকার অপেক্ষায় থাকে না মনিপিসি। কোহিনূর ফুপুর গলা শুনেই বড়ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, “চল, বেলা পড়ার আগেই ঘুরে আসি”।
আমাকে যেন কারো চোখেই পড়ছে না, “ও মনিপিসি, আমিও যাবো মেহেন্দি পাতা আনতে”।
ঈদের আগেরদিন সন্ধ্যার পর গোলেনূর দাদির বড়ঘরের বারান্দায় বসে মেহেন্দি পরার আসর। পাড়ার অন্য কেউ না থাকলেও, আমি আর মনিপিসি সেই আসর ভাঙার আগ-অবধি সেখানে থাকি। থাকব না-ই বা কেন? সবচেয়ে বেশি মেহেন্দি পাতা তো আমিই কোঁচড়ে ভরি। সেইসব পাতা কোহিনূর ফুপুকে দেবার একটাই শর্ত, “আমার হাতেও ঈদের চাঁদ এঁকে দিতে হবে মেহেন্দি পাতা দিয়ে”।
আজও তার ব্যত্যয় হল না। কোঁচড় উপুড় করে মেহেন্দি পাতা ঢেলে দিতে না দিতেই কোহিনূর ফুপু বসে গেল শিলপাটা নিয়ে। আর মনিপিসি নিয়ে এল ঠাকুমার পানবাটা থেকে খয়ের। খয়ের মিশিয়ে মেহেন্দি পাতা বাটলে হাতের নকশায় রঙ দ্বিগুণ ধরে।
বেলা বুজে আসতেই আমাদের বাড়ির ধূপদানিতে ধূপের গুঁড়ো পড়ল। কোহিনূর ফুপু মেহেন্দি পাতা আধাবাটা রেখেই উঠে পড়ল। সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান।
গোলেনূর দাদির বাড়িতে সবাই রোজা খুলতে বসে যায়। মনিপিসি বসে যায় কোহিনূর ফুপুর আধাবাটা মেহেন্দি আরও মিহি করে বাটতে।
সন্ধ্যা একটু গাঢ় হতে না হতেই শুক্লা, ইতু, সুমি সবাই চলে আসে বাইরবাড়িতে। সারা আকাশজুড়ে খুঁজতে থাকি সবাই ঈদের চিলতে চাঁদ। ওই তো সুপারি বাগানের মাথায় এক চিলতে রূপোলি চাঁদ। চাঁদ উঁকি দিতেই অদ্ভুত আনন্দের জোয়ার উঠল গোলেনূর দাদির বাইরবাড়িতে।
গোলেনূর দাদির উঠোন পেরিয়ে পরবের আনন্দ আজ আমাদের বাইরবাড়িতেও। এ পাড়ায় ঢোকার পথ আসলে এই একটাই। তা হল আমাদের বাইরবাড়ি। তাই পরবের আনন্দ এই পথ পেরিয়েই সবার বাড়ি ঢুকছে।
গোলেনূর দাদির উনুনে আজ আঁচ পড়ে গেছে চাঁদ দেখার পরপরই।
দুধ সেমাই, জয়দানা সেমাই, মিছরির পায়েস আর ক্ষীরের পিঠা আজ রাতেই বানিয়ে রাখবে গোলেনূর দাদি। নয়তো কাল সকালে ঈদের জামাত শেষ হতে না হতেই আত্মীয়স্বজনে উঠোন ভরে যাবে গোলেনূর দাদির, তখন এতকিছুর আয়োজন করা কঠিন হয়ে যাবে।
কোহিনূর ফুপু বসে গেছে বাটা মেহেন্দিতে নকশা আঁকতে। সবার আগে সুমির হাতে পড়ে মেহেন্দির কালচে-সবুজ রঙ। তাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ফুলপাতার নকশা আঁকে কোহিনূর ফুপু। এরপর আমার পালা, “ও কোহিনূর ফুপু, আমার হাতের নকশা সবার চেয়ে সুন্দর যেন হয়”।
একগাল হেসে কোহিনূর ফুপু ফুল আঁকায় মনোযোগ দেয়।
“ও কোহিনূর ফুপু, চাঁদ আঁকলে না তো! গোলেনূর দাদির হাতে মেহেন্দিতে আঁকা চাঁদটায় সেবার সবচেয়ে বেশি রঙ ধরেছিল। তখন থেকেই ভেবে রেখেছি এবার আমার হাতেও চাঁদ আঁকব”।
মেহেন্দি পাতার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আর সেই ঘ্রাণে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে জয়দানা সেমাইয়ের ঘ্রাণ। উঠোনের উনুনের আগুনের আঁচে গোলেনূর দাদির ফর্সা গালটা লাল হয়ে উঠছে।
সন্ধ্যা গিয়ে মেশে রাতের অন্ধকারে। তা বলে কী হবে, কোহিনূর ফুপুর মেহেন্দির আসর কিন্তু এখনো ভাঙেনি। পাড়ার সবার হাতে নকশা আঁকা শেষ হতেই কোহিনূর ফুপুর অপেক্ষা শুরু করে গোলেনূর দাদির জন্য।
গোলেনূর দাদির হাতে নকশা এঁকেই শেষ হবে আসর।
কাল সকালে দেখব, কার হাতে মেহেন্দি পাতার রঙ কত গাঢ় হল, কার নকশা সবচেয়ে সুন্দর হল।
এ এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা।
রাত বাড়ছে। গোলেনূর দাদির উঠোনে পরবের আয়োজন রেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বাড়ি ফিরতে হল।
মা তাড়া দেয় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। তা কী করে হবে? কাঁচা মেহেন্দি না শুকোলে ঘুমোই কেমন করে? আমার অসহায়ত্ব আর কেউ না বুঝলেও ঠাকুমা ঠিকই বুঝে ফেলে, “দিদি তুমি ঘুমাও। আমি হাতপাখার বাতাসে তোমার মেহেন্দি শুকিয়ে দেব”।
এবার আমি নিশ্চিত। আমার হাতে সবচেয়ে গাঢ় মেহেন্দির রঙ হবে – এই আশায় ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
ভোরের আজানের শব্দে ঠাকুমার ঘুম ভাঙলে ফুরিয়ে যায় আমারও ঘুম। আর আজ তো ঘুম ভাঙার অজুহাত আছেই, “ও ঠাকুমা, আমার হাতটা ধুয়ে দেবে একটু? দেখো মেহেন্দি শুকিয়ে সারা বিছানায় গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়েছে”।
ঠাকুমার সাথে আমিও নেমে আসি উঠোনে। বরইগাছের মাথা ছুঁয়ে থাকা আকাশটাই আলো ফুটছে একটু একটু করে। সেই আলো মিশে যাচ্ছে শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড়ে। চারপাশের নীরবতার সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে উঠি, “ও ঠাকুমা, পূজার ফুল তুলবে না আজ?”
কলঘর থেকে একঘটি জল এনে ঠাকুমা ঢেলে দেয় আমার হাতে। ঠাকুমার আঁচলে ভেজা হাত মুছি আমি। আবছা অন্ধকারে তাকাই আমার হাতের দিকে। মেহেন্দি আঁকা চাঁদটা কেমন জ্বলজ্বল করছে।
ঠাকুমা বারান্দায় রাখা ফুলের সাজি শ্বেতকাঞ্চনে ভরে দেয়। সেখান থেকে কয়েকটা ফুল মুঠোয় করে নাকের কাছে আনতেই ফুলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে নাকে এসে ধাক্কা দেয় মেহেন্দির ঘ্রাণ। আমি ঠাকুমার দিকে তাকাই, “ও ঠাকুমা, আজ ঈদ”।
ঠাকুমা মধুমঞ্জুরীর ঝাড়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “হ্যাঁ দিদি, আজ সেমাই ঈদ”।
আমাদের ভেতরবাড়িতে আজকের দিন নিয়ে তেমন আলোড়ন না থাকলেও বাইরবাড়িতে শুরু হয়ে গেছে পরবের আমেজ। গোলজারদাদা জোব্বা পড়ে একবার রাস্তার দিকে যাচ্ছেন, তো একবার বাড়ির দিকে। গোলেনূর দাদির শরিকেরা একের পর এক আমাদের বাইরবাড়ি পেরিয়ে সে বাড়িতে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ তো আমাদের কাঠের বেঞ্চিখানায় বসে গল্প জুড়ছে দাদুর সাথে। মোটকথা, দু’বাড়ির তাঁতঘরের নিস্তব্ধতা হারিয়ে গেছে নানান মানুষের কলরবে।
তবে অন্যদিনের মত আজকে চাইলেই ছুটে যেতে পারছি না গোলেনূর দাদির উঠোনে। অচেনা অজানা মানুষগুলো বাড়িটাকে কেমন অচেনা করে দিচ্ছে। তাই বাইরবাড়ির বারান্দায় বসেই দেখে নিচ্ছি পরবে মেতে ওঠা ও’ বাড়িটাকে।
তবে তা খুব বেশি সময়ের জন্য না। জামাত শেষ করে সবাই ফিরতেই সুমি নতুন জামা পড়ে চলে এসেছে মনিপিসির কাছে। চুল বেঁধে নেবে বলে, “ও মা, শুধু সুমির চুল বাঁধলে হবে? আমার চুলও তো বাঁধতে হবে”।
আমার আবদার মিটতেই সুমি বায়না ধরে আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যাবার। সে বায়নায় আমার অবশ্য শতভাগ ইচ্ছা জড়িয়ে আছে। কোহিনূর ফুপুর হাতে মেহেন্দির নকশায় কেমন রঙ ধরল – দেখতে হবে তো।
তবে আজ কোহিনূর ফুপুর একটুও ফুরসত নেই। সকালের সেমাই পর্ব মিটে যেতেই দুপুরের উনুনে আঁচ পড়েছে গোলেনূর দাদির বাড়িতে। বড়বাজার থেকে আজ চর্বি-ওলা খাসির মাংস কিনে এনেছেন গোলজার দাদা। আর সাথে হবে বুটের ডালের খিচুড়ি।
কোহিনূর ফুপু শিলপাটায় বাটতে বসে গেছে লাল শুকনো মরিচ। সাথে জিরা, ধনে আর রসুনও।
“ও কোহিনূর ফুপু, তোমার হাতে রঙ কেমন এসেছে দেখি”।
আমার আবদার অগ্রাহ্য করে কোহিনূর ফুপু, “দাঁড়া একটু,মশল্লাগুলো বেটে নেই আগে”।
একে একে আদা, রসুন, জিরে, ধনে আর অনেকটা লাল শুকনো মরিচ বেটে নেয় কোহিনূর ফুপু।
গোলেনূর দাদি হাঁড়িতে মাংস নিয়ে তাতে মেশায় সবরকম বাটা মশলা, তেজপাতা, হলুদ গুঁড়ো, লবণ আর অনেকটা সর্ষের তেল। এরপর অনেকটা কুচানো পেঁয়াজ মিশিয়ে দেয় মাংসের সাথে। কাঁচা মাংসে তেল মশলা পড়তেই একটা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। কোহিনূর ফুপুর সব ব্যস্ততা ভুলে বলে উঠি, “ও কোহিনূর ফুপু, তুমি ঈদে বেড়াতে যাবে না? সারা সকাল তো কাজ করেই চলেছ”।
পান খাওয়া ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে গোলেনূর দাদি বলে, “কী রে মনি, এত মায়া ক্যান তোর শরীরে? এক্কেবারে বৌ-এর মতন হইছিস। শহরে গেলি মনে থাকে তো আমাগের কথা?”
শহরের কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না। আমি নিরুত্তর থাকি।
মাংসের হাঁড়ি উনুনে ওঠে। খড়ি ঠেলে আঁচ বাড়ায় গোলেনূর দাদি। মাংস একটু নেড়ে হাঁড়ি ঢেকে দেয়।
ঢাকনার বাধা পেরিয়ে মাংসের ঘ্রাণ উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে জানান দিচ্ছে – এ বাড়ি আজ পরবের বাড়ি।
কলিমচাচা জামাত শেষ হওয়ার পরেই চলে এসেছেন। দুধ সেমাই খেয়ে সুপারি বাগানের তলায় বাঁশিতে সুর তুলছে,
“তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে
তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে…”
গোলেনূর দাদি ঢাকনা তুলে আরও কয়েকবার নেড়ে দেয় মাংস। লাল টকটকে তেল ভাসছে মাংসের উপরে। আরোও কিছুক্ষণ কষিয়ে নেয় মাংসটা গোলেনূর দাদি। এরপর গরম জল কিছুটা ঢেলে দিয়ে আবার ঢাকনা দেয় হাঁড়িতে।
কোহিনূর ফুপু শিলপাটায় বাটছে গরম মশলা। দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, বড় এলাচ আর গোলমরিচ মিশিয়ে বানানো এই গরমমশলা। মিহি করে বেটে নিচ্ছে কোহিনূর ফুপু।
টগবগ করে ফুটে ওঠা মাংসের লাল ঝোলে সেই গরমমশলা মিশিয়ে দিতেই সুঘ্রাণে ভরে যায় সারা বাড়ি।
বাইরবাড়িতে মা এসে দাঁড়িয়েছে। আমার স্নানের সময় হয়ে গেছে তো। কোহিনূর ফুপুর হাতে নকশার রঙ না দেখেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হল। কীভাবে দেখাবে হাতের নকশা কোহিনূর ফুপু? লাল মাংসের সুরুয়া উনুন থেকে নামতেই সেখানে উঠেছে বুটের ডালের খিচুড়ি। কোহিনূর ফুপুর একটুও অবসর নেই আজ।
আজ ঠাকুমার নিরামিষ খাওয়া। বাড়িতে আজ রান্না হয়েছে পুষ্পান্ন। দুপুরের আজান হয়ে গেছে সেই কখন। রেডিওতে দুপুর একটার খবরও শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। এখনো তো লাল বারান্দায় আমার আর দাদুর পাত পড়ল না, “ও ঠাকুমা, ভাত দেবে কখন?”
আমার প্রশ্নের উত্তর আসার আগেই চোখ গেল লাল বারান্দায়। কলাগাছ থেকে কলাপাতা কেটে এনেছে মনিপিসি, “আজ কলাপাতায় খাব আমরা?”
প্রশ্নটা মনে জেঁকে বসার আগেই বাইরবাড়িতে গোলেনূর দাদির গলা, “ও বউ, বাবু আর মনির জন্য একটু লাল সুরুয়া আনছি, খিচুড়ির এখনো হইয়া সারে নাই”।
লাল সুরুয়ার ঘ্রাণ আমার ক্ষিদে বাড়িয়ে দিল।
লাল বারান্দায় কলাপাতায় পাত পড়ল অনেকদিন পর। সেই পাতে ঠাকুমার পুষ্পান্ন আর গোলেনূর দাদির লাল সুরুয়া।
উঠোনে পেয়ারা গাছের ছায়া নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। ডালিম গাছের মাথায় বারবেলার আয়েশি রোদ।
পুষ্পান্নে লাল সুরুয়া মাখিয়ে মুখের কাছে আনতেই নাকে ধাক্কা দেয় মেহেন্দির ঘ্রাণ।
কলিমচাচার বাঁশি এখনও সুর তুলছে,
“মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে জন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই, কহিল যে জন
মানুষের লাগি চির-দীন বেশ নিল যে জন
বাদশা ফকিরে এক শামিল করিল যে জন…”
হঠাৎ খাওয়া ভুলে আমার মনে পড়ে শহরের কথা। ঈদের ছুটি শেষ হলেই তো শহরে ফিরতে হবে আমাকে।