আমরা ছুটছি দু-পাশে ইউক্যালিপটাস বন, বিলের জল, ফাঁকা মাঠ সবকিছু ফেলে। বাতাস দু-পাশে কেটে আমরা ছুটে চলছি সদ্য বানের জল শুকিয়ে জেগে ওঠা পথ ধরে। আমরা ছুটে চলছি বাড়ির দিকে।
চিঠিটা আসার পর থেকেই মায়ের মুখে বিষাদ বাসা বেঁধেছিলো। আর অন্তর্মুখী বাবাও কেমন আনমনা হয়ে থাকতো সবসময়। কিন্তু হুট করে আসা বানের জল সেই বিষাদের জায়গায় উদ্বিগ্নতার ছায়া ফেলেছিলো।
এবারই প্রথম জানলাম আমি—জল শুধু ভাসিয়ে নিয়েই যায় না, মাঝেমাঝে স্থবিরও করে দেয়।
যে চিঠিখানা পাওয়ার পরপরই আমাদের ছুটে চলে যাওয়া উচিত ছিল, অথচ বানের জল এসে আমাদের থামিয়ে দিয়েছিলো। যমুনার স্বেচ্ছাচারিতার কাছে অসহায় সমর্পণ করতে হয়েছিলো সময়কে। তাই তো সপ্তাহ দুয়েকের জলবন্দি-দশা থেকে মুক্ত হতেই আমরা ছুটে চলেছি বাড়ির দিকে।
হ্যাঁ, চিঠিটা আমি একদিন হঠাৎ করেই আবিস্কার করেছিলাম মায়ের বালিশের তলা থেকে। মনিপিসির লেখা। খুব ছোট কয়েক লাইনের চিঠিতে শুধুই ঠাকুমার শরীরের কথা।
শরীর ভালো নেই ঠাকুমার…
আজ তাই আমার অলক্ষ্যে একলা পড়ে থাকছে পথের চিলতে পদ্মপুকুর, একলা পড়ে থাকছে মাঠের ভেতর মৌন কুঁড়েঘরটা, একলা পড়ে থাকছে প্রকাণ্ড বটগাছটা। আজ কোনোকিছুতেই আমার মন নেই। আমি শুধু দেখছি সামনের অনন্ত পথটুকু। জানি না পথের কোন মোড়ে আমি খুঁজে পাবো আমার বাড়ি।
আমরা জল থেকে সদ্য মাথা তোলা এবড়োখেবড়ো পথে আজ। এ পথে যাত্রা কখনই মসৃণ হয় না। তাই তো বাসের ঝক্কিগুলো শরীর পেরিয়ে মনেও পৌঁছে যাচ্ছে। বানের জল এমনিতেই আমাদের দেরি করিয়ে দিয়েছে। আর এখন এই বিলম্বিত লম্বা পথ। আচ্ছা, ঠাকুমার শরীর কতটা খারাপ? ঠাকুমা কি বড়ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে? নাকি, খারাপ শরীরেও দাঁড়িয়ে আছে বাইরবাড়িতে?
প্রশ্নগুলো খানিক পরপরই আমাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দু-পাশের জমিভরা কালো কাদা ফেলে আমরা শুধুই এগুচ্ছি আর এগুচ্ছি। ইউক্যালিপটাসের ছায়া জমে থাকা ডোবার জল ফেলে, মাটি ছুঁয়ে যাওয়া ঝুড়ির প্রকাণ্ড পাকুড় গাছ অদেখা করে আমরা তাড়াহুড়ো করছি বাড়ি পৌঁছাতে।
তবে সে তাড়াহুড়ো শুধুই আমাদের অন্তরের, বাস চলছে এবরোখেবরো পথে থেমে থেমেই।
তবে ওই যে কথা আছে না—পথ যত দীর্ঘই হোক, যদি গন্তব্য নির্ধারিত থাকে, তবে তাতে ঠিকই পৌঁছানো যায়। তাই আমরাও পৌঁছালাম, বিকেল ডোবার আগেই। আমরা পৌঁছালাম বাড়ি। আমাদের বাড়ি।
এ বাড়ি অচেনা বাড়ি, এ বাড়ি অন্যরকম বাড়ি। মাত্র এ-কদিনে কীভাবে এমন অচেনা হয়ে গেলো আমার বাড়ি?
শহর থেকে আমরা ফিরলাম এত এতদিন পর, অথচ ঠাকুমা দাঁড়িয়ে নেই বাইরবাড়ি। দেবদারু বাগানের তলায় তাঁতঘরটাও নিথর আর নিঃস্তদ্ধ আজ। আর বিকেলের সেই রমরমা বাইরবাড়ির বারান্দার আড্ডা, সেটাও আজ উধাও।
এটা কি সত্যিই আমাদের বাড়ি?
আসলে তখনও আমার জানা ছিল না—বাড়ি মানে শুধুই কতগুলো ঘর আর আঙিনা নয়, বাড়ি হয় নিজের মানুষ দিয়ে। বাড়ি হয় অন্তরের অনুভব দিয়ে। বাড়ি হয় নিজের মানুষগুলোর সাথে কাটানো টুকরো টুকরো মুহূর্ত দিয়ে। বাড়ি হয় নিজের মানুষের চেনা ঘ্রাণ দিয়ে।
নিস্তব্ধ তাঁতঘরের সামনে আজ আমাদের অপেক্ষায় ছিল দাঁড়িয়ে ছিল দাদু। শুকনো মুখে যেটুকু হাসি ফুটে উঠেছিলো তা আমাদের রিক্সা দেখে,
গিন্নি…
বুক থেকে উঠে এসেছিলো এই ডাক। তবুও আমার চোখ দাদুকে এড়িয়ে চলে যায় বাইরবাড়ির বিরান বারান্দায়। না, ওখানেও ছিল না ঠাকুমা।
গিন্নি, কত বড় হয়ে গেছো তুমি! আর কয়েকদিন পর তো আমাকে ছাড়িয়ে যাবে…
আমি জানি দাদু মিথ্যা বলেছে। আমি কখনই দাদুকে ছাড়িয়ে যেতে পারবো না। মুখ উঁচু করে আমি তাকিয়ে ছিলাম দাদুর দিকে। দাদুর অমন মনমরা মুখ আমি কি আগে কখনো দেখেছিলাম?
কী জানি। উত্তর খোঁজার আগেই মনিপিসি এসে দাঁড়িয়েছিলো দাদুর পেছনে। আর চিরচেনা মনিপিসির মতোই আমাকে হ্যাঁচকা টানে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছিলো,
মনি, কত বড় হয়ে গেছিস তুই! শহরের জল বাতাসে কি মানুষ এমন হুট করে বড় হয়ে যায় রে?
মনিপিসির উচ্ছ্বলতা আমাকে একটু সহজ হবার সুযোগ করে দিতেই বলে উঠেছিলাম,
ও মনিপিসি, ঠাকুমা…
মনিপিসিও হয়তো বুঝেছিলো আমার অস্থিরতা। তাই হাত মুখ ধুইয়ে দিতে দিতে বলেছিলো,
তোকে দেখলেই ঠিক তড়বড়িয়ে উঠবে…
আমি বড়ঘরের দিকে চোখ রাখতেই মনিপিসি আমাকে আস্বস্ত করেছিলো,
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। চলে আসবে একটু পর।
তখন থেকে সেই অপেক্ষাতেই আছি। ঠাকুমা ছাড়া এ বাড়ির কোনো স্মৃতি আমার নেই। তাই এতদিন পর এলেও বাড়িটা এখনও আমাকে আগলে নেয়নি। যেন অচেনা বাড়ির লাল বারান্দায় আমি অপেক্ষায় আমার ঠাকুমার।
আমার সামনে কাঁসার জামবাটি ভরা মুড়ি-মোয়া। মনিপিসি কেরোসিনের স্টোভে চা বসিয়েছে। গুঁড়ো চায়ের এই ঘ্রাণ অনেকদিন পর আমার গায়ে জড়িয়ে গেলো। বড় বৌমা চিনামাটির প্লেটে সাজিয়ে দিলো নাবিস্কো বিস্কুট। আর সঞ্জীবকাকু হাতে ধরিয়ে দিলো কাঠি লজেন্স। এতকিছুর পরেও আমার মন পড়ে আছে বড়ঘরের ওই প্যান্ডোরার বাক্সের কাছে। যে বাক্সের চাবি শুধু আমার ঠাকুমার কাছেই থাকে।
বেলা বসলো, সন্ধ্যা প্রদীপ পড়লো তুলসীমঞ্চে। শুক্লাদের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে শঙ্খের আওয়াজ। সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে মাগরিবের সুর আমাদের বাড়ির থমকে যাওয়া উঠোনে হিল্লোল তুলছে।
হ্যাঁ, এটাই তো আমার বাড়ি। বাড়িতে এলেই তুলসীমঞ্চের টিমটিমে প্রদীপ, মাগরিবের আজান, শঙ্খের সুর সবকিছু ছুটে এসে আমাকে ছুঁয়ে দেয়। কিন্তু এসবের ভিড়েও কিসের যেন শূন্যতা। এই শূন্যতাই আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
দিদি…
আবার কান পাতলাম আমি,
দিদি…
হ্যাঁ, এটা আমার ঠাকুমার ডাক। এভাবে অন্তর জুড়িয়ে আর কেউ আমাকে ডাকে না। আমি মুড়ির বাটি, বিস্কুটের মিষ্টি ঘ্রাণ, প্রদীপের দপদপে আলো সব ফেলে দৌড়ে বাইরবাড়ি চলে আসি।
রিক্সা থেকে ঠাকুমাকে নামিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে গোলেনূর দাদী। একটু কি নুয়ে নুয়ে হাঁটছে ঠাকুমা? সন্ধ্যার অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চোখমুখ ম্লান হওয়া এক শীর্ণ ঠাকুমাকে,
ও ঠাকুমা, ও ঠাকুমা…
যেন কিছু বলার নেই আমার। শুধু ডেকেই চলেছি,
ও ঠাকুমা…
গোলেনূর দাদী আমার হাতে ঠাকুমার হাতটা ধরিয়ে দিলো,
নাতিন আসিছে বউ, শরীরখান ঠিক করতি হবি না? নাতিনের জন্যি নাড়ু মোয়া বানাতি হবি তো বউ…
ঠাকুমার শীর্ণ হাতটা আমার হাত শক্ত করে ধরে। আমি জানি ঠাকুমা খানিক পরেই ওই হাত দিয়েই প্যান্ডেরার বাক্স খুলে বসবে আমার জন্য।
বাড়ির উনুনে আজ ঠাকুমার জন্য মা দুধ বার্লি বসালো। সাথে আমাদের জন্য রুটি আর সবজি। ওষুধের ডোজ না আমার আসা তা জানি না, তবে আজ অনেকদিন পর রাতে ঠাকুমার জ্বর এলো না।
তাই আমিও সুযোগ পেয়েই ভোর রাতে কাঠের দোতলা থেকে নেমে এলাম ঠাকুমার খাটের পাশে। সাহা পাড়ার মসজিদে ভোরের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পূর্ণির মা এসে ফটক খুলে ঢুকে গেছে তাও বেশ সময়। ঠাকুমার ওঠার সময় হলো যে।
তবে ওষুধ আর দুর্বল শরীরের জেরে আজ ঠাকুমার দিন শুরু হলো দিনের আলো বাড়ির উঠোনে আসার পর। বাড়ির উঠোনে ছরা পড়লো, উনুনে আঁচ পড়লো, পাড়ায় নিত্যপূজার জোগাড় পড়লো, কিন্তু আজই প্রথম ঠাকুমা পূজার ফুল তুলতে বের হলো না। আজই আমার দেখায় প্রথম ঠাকুমা স্নান সেরে তিলক পড়ে নিত্যপূজায় বসলো না। সেসব আজ বরাদ্দ ছিল মনিপিসির জন্য। ফুলের সাজিও আজ ভরলো বাড়ির ঐ সাদা টগরেই।
খুব অন্যরকম সকাল। খুব অন্যরকম বাড়ি। মনিকাকুর কারণ-অকারণ জ্বালাতন নেই, মনিপিসির কলেজ ফুরিয়ে গেছে এরমধ্যেই আর দাদুও সেই খানিক পরপর চা খাবার অজুহাত ভুলে গেছে। তাহলে কি সবকিছু বদলে গেছে?
তা কীভাবে যায়? ওই তো দাদুর রেডিও গেয়ে চলেছে সেই আগের মতোই,
অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়
মহা যোগ সে দিনের উদয়
অমাবস্যায় পূর্নিমা হয়
মহা যোগ সে দিনের উদয়
লালন বলে তাহার সময়
দ্বন্দ রয় না
সময় গেলে সাধন হবে না
সময় গেলে সাধন হবে না…
সময় মানুষগুলোকে কতটাই বা বদলে দেয়, যদি না মানুষগুলো না চায়। তাই তো বদলে যাওয়া এ বাড়ির পরিবেশে গোলেনূর দাদী এসে দাঁড়াতেই হৈ হৈ করে এ বাড়ি ঠিক আগের মতো হয়ে উঠলো,
কী রে মনি, ঠাকুমা পিঠা পায়েস কিছু রান্ধিলো, নাকি ফাঁকিত ফেলিলো? চল আমার বাড়ি। আঙিনায় চালের গুঁড়ি শুকাতিছে…
শুধু আমি নই, মনিপিসিও যেন অনেকদিন পর আনন্দের অজুহাত পেলো,
চাচি কি পিঠা বানাবে?
শুধু যেন এই প্রশ্ন টুকুরই অপেক্ষা ছিল সকলের। এরপরেই শুরু হয়ে গেলো আনন্দযজ্ঞের সকল জোগাড়যান্তি। উপরতলা থেকে নেমে এলো ঝোলাগুড়ের হাঁড়ি, লালবারান্দায় পড়লো কলার মাইজ, গোলেনূর দাদীর উঠোনের উনুনে লেপ পড়লো এঁটেল মাটির আর অনেকদিন পর জ্বরহীন ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঠাকুমা এসে বসলো বাইরবাড়ির বারান্দায়।
ঠাকুমা বারান্দার এই কাঠের বেঞ্চে এসে বসতেই আমার নাকে ধাক্কা দিলো হাকিমপুরি জর্দার ঘ্রাণ। আমি বুক ভরে শ্বাস নেই এই ঘ্রাণে। এটাই তো আমার ঠাকুমার ঘ্রাণ, এটাই তো আমার বাড়ির ঘ্রাণ। চেনা ঘ্রাণ পেয়েই আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে বসি,
ও ঠাকুমা…
কারণ ছাড়াই আমি ডেকে উঠলাম ঠাকুমাকে। আর তা বুঝেই মনে ঠাকুমাও ডেকে উঠলো,
দিদি…
বড়ঘর থেকে এখনো ভেসে আসছে দাদুর রেডিওর আওয়াজ। সকাল আটটার সংবাদ শুরু হলো। শুক্লার ঠাকুমা আর জেঠি ঠাকুমাও চলে আসবে খানিক সময় পর বাইরবাড়ির বারান্দার আড্ডায়। শুক্লা আর সুমি স্কুলে চলে গেলো সামনে রাস্তা দিয়ে। একটা দুটো রিক্সাও যাচ্ছে টুংটাং বেল বাজিয়ে একটু সময় পরপর।
সব আগের মতোই আছে, তবুও আমার কেন যেন খালি খালি লাগছে। কেন এই শূন্যতা তা বুঝিয়ে দিলো মানিক কাকুর সাইকেলের বেল। মানিক কাকু্র ড্রাম মাস্টারি আর করা হয় না। সে এখন পাওয়ার লুমের অল্প কিছু শাড়ি নিয়ে এ হাটে ও হাটে বসে।
আসলে তাঁতমাকুর খটাস খটাস শব্দহীন এই পাড়া সত্যিই খুব বেমানান। তাঁতমাকু থেমে যাওয়া মানেই তো সবকিছু থেমে যাওয়া নয়, তাই তো কদিন পরেই শূন্য তাঁতঘরে নতুন দোকানঘর হবে। সেখানে থাকবে নাবিস্কো বিস্কুট, ঝুরি ভাজা, কাঠি লজেন্স, গন্ধ সাবান আরও কত কী! শুধু থাকবে না নিথর দুপুরে তাঁতঘর থেকে ভেসে আসা পুরোনো কোনো গানের সুর অথবা বিরান বিকেলে ভেসে আসা বাঁশির কান্না,
বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে…
তাই বলে কি বাতাসে জীবন ভাসা বন্ধ হয়ে যায়? না, তা হয় কী করে।
এই তো, এখন বাতাসে গোলেনূর দাদীর সেদ্ধ কামিনী চাল গুড়োর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। সাথে সদ্য কোরানো সাদা নারকেলের ঘ্রাণ মিলেমিশে জানান দিচ্ছে বাইরবাড়িতে আজ জীবনের মেলা বসেছে। মেলা বসেছে সুখ সুখ গল্পের। যে গল্পের গায়ে কখনো অসুখ কিংবা দ্বেষ কোনোটাই আঁচড় কাটতে পারে না।
গোলেনূর দাদীর উঠোনের উনুনে আঁচ পড়েছে বেশ আগেই। তাতে বসেছে সাদা কাপড়ে মুখ বাঁধা এক মাটির হাঁড়ির। তাতে ফোটার জন্য জল। আর বাঁশের চালুনিতে সেদ্ধ চালগুঁড়োয় ছিটানো জল মিশিয়ে চেলে নেওয়া হচ্ছে। চিমটি খানিক লবণও মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে।
কোহিনূর, পিঠার গুঁড়িত খানিক নারিকেল মিশাতি হবি কিন্তু। না হলি সোয়াদ খুলবি নানে…
পূর্ণির মা কলার মাইজ ভরা ধবধবে সাদা নারিকেল কোরা এনে ফেললো গোলেনূর দাদীর ঊঠোনে। আর মনিপিসি শিল দিয়ে ভাঙতে বসেছে খেজুর গুড়ের পাটালি। এই পাটালি নেমেছে গোলেনূর দাদীর মাচান থেকে। সুমির দাদাজান সেই গেলো বছর এনেছিলেন এই গুড়ের পাটা পোড়াদহের হাট থেকে। সেখানকার গুড়ে নাকি মিঠা বেশি।
মাটির হাঁড়িতে জল ফুটছে। সাদা কাপড় ডিঙিয়ে ফুটন্ত জলের ধোঁয়া বাতাসে উড়ছে এখন। একটা ছোট্ট মাটির সরায় লবণ মেশানো চালের গুঁড়ো আর নারিকেল থরে থরে সাজিয়ে দিলো গোলেনূর দাদী। আর সবার উপরের স্তরে সাজালো অনেকটা ভাঙা পাটালিগুড়। এরপর আবার চালের গুঁড়োর স্তর। সেই সরায় খুব যত্ন নিয়ে ভেজা একটা সাদা পাতলা কাপড় জড়িয়ে নিলো এবার গোলেনূর দাদী।
ও গোলেনূর দাদী, এই পিঠা ভাজতে হয় না?
গোলেনূর দাদীর পান খাওয়া দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো আমার কথায়,
ও বৌ, খালি ভাজা পিঠাই খাওন শিখাইছিস…
কথা শেষ হয় না গোলেনূর দাদীর। তার আগেই ঠাকুমা খুব আস্তে বলে ওঠে,
ও দিদি, এই পিঠা জলের ভাপে সেদ্ধ হয়। খেয়ে দেখো কত স্বাদ!
গোলেনূর দাদীর ধুপি পিঠার ঘ্রাণ শুধু আমাদের বাড়িই নয়, পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাঁড়ির মুখে বাঁধা সাদা কাপড় ডিঙিয়ে আসা ঘন ধোঁয়ায় একে একে সেদ্ধ হচ্ছে ধুপি পিঠা। আর এই সেদ্ধ হতেই যতটুকু সময় এরপর একে একে পড়ছে কলার পাতায়। সকালের রোদে গা সেঁকতে থাকা ধুপি পিঠা কলার পাতা থেকে উঠে আসছে সকলে হাতে।
শুক্লা, ইতু, সুমি আর আমি সেই নারকেলের গন্ধ মাখা ধুপি পিঠার টুকরো ঝোলা গুড়ের বাটিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছি,
ও গোলেনূর দাদী, এই ধুপি পিঠা সত্যিই খুব স্বাদের। কতদিন পর এমন স্বাদের পিঠা বানালে তুমি!
গোলেনূর দাদীর চোখমুখে কি একটু দুঃখ ছুঁয়ে গেলো?
এরকম পিঠা কত্ত বানাই? কিন্তু তোক তো পাই না রে মনি।ঠাকুমা অসুখ শুনিছিস এজন্যি এতদিন পর আসলি শহর থিক্যা…
আমার অবশ্য অতকিছু দেখা বা বোঝার সময় নেই। নিজের ভাগের ধুপি পিঠা শেষ করেই হাত বাড়াই ধোঁয়া ওঠা আরেকটা ধুপি পিঠার দিকে,
ও ঠাকুমা, তুমি খাবে না ধুপি পিঠা?
ঠাকুমা এসে দাঁড়িয়েছে গোলেনুর দাদীর উঠোনে। অনেকদিন পর ঠাকুমা নিজের জোরে একটু একটু হাঁটছে,
ও দিদি, হাতটা পাতো একটু…
আমি ধুপি পিঠার ঘ্রাণমাখা হাত ঠাকুমার সামনে পাততেই তা ভরে গেলো গুড়ের খুরমায়। আমি খুশি চোখে ঠাকুমার দিকে তাকাই। কখন খুললো ঠাকুমা প্যান্ডোরার বাক্স?
ও দিদি, রথের মেলায় কিনে রেখেছিলাম…
আমি ঠাকুমার শাড়ির কোণা ধরে আস্তে টান দেই। এর অর্থ ঠাকুমা জানে। পাশে বসে ঠাকুমা আমার মাথায় হাত বুলায়।
কে বললো ঠাকুমার অসুখ করেছে? এই তো সেই আগের মতো তিব্বত স্নো’র ঘ্রাণ গায়ে মেখে, হাকিমপুরি জর্দার ঘ্রাণ গায়ে জড়িয়ে, সিঁদুরের লেপ্টে যাওয়া টিপ পড়ে সেই আগের মতোই হাসছে আমার ঠাকুমা। আমি জানি আরেকটু পরেই ঠাকুমা বলবে,
ও দিদি, তোমাকে দেখলে আমার সব অসুখ সেরে যায়…