দেবদারু বাগানের তলায় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে গরুর গাড়ি এসে দাঁড়ানো মানেই আমার জন্য প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়া।
—ও আইনুল চাচা, আমার নই কই? আমার জন্য চালভাজা এনেছো? ঝুড়িভাজা কই পেল চাচী বানিয়েছে?
আইনুল চাচার হাত থেকে কলাপাতায় মোড়ানো একেকটি জিনিস আমার চোখেমুখে নানরঙের আনন্দ বুলিয়ে দেয়। সেসব আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে যখন হুট করে আইনুল চাচার গামছার গিঁট থেকে বেরিয়ে আসে চকচকে একখানা টিফিনবাটি। তার ঢাকনা খুললেই কখনো ক্ষীরের পিঠা আবার কখনো নতুন গুড়ের শিরনি।
জমিতে আমন ধান বোনার সময় এলেই চাচী রাত জেগে গুড়ের শিরনি রান্না করে। মাদলা গ্রামের সব ঘরে এই শিরনি বিলিয়ে তবেই ভোরবেলায় জমিতে ধানের বীজ ফেলে আইনুল চাচা। তবে গ্রামের সব ঘরে সেই শিরনি গেলেও আমাদের বাড়িতে তা না পৌঁছানো পর্যন্ত আইনুল চাচার শান্তি নেই। আর যদি কোনোভাবে মাদলা গ্রামে খবর পৌঁছায় শহর থেকে আমি এসেছি বাড়িতে, তবে তো সক্কাল সক্কাল জমির সব কাজ সেরে আইনুল চাচা গরুর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য ওই আমাদের বাইরবাড়ি।
আজ ভোর থেকেই আকাশে কালো মেঘের বাড়াবাড়ি। তাই উঠোনের অন্ধকার ফুরিয়ে সকাল আসতে দেরি হয়ে গেছে বেশ। তবে সে সকাল কেবল নামেই, বেলার গা জুড়ে আলসেমো যেন জেঁকে বসে আছেই। তাই তো আজ সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে ভোরের আজান ভেসে আসতেই ঠাকুমা বিছানা ছাড়লেও পূর্ণির মায়ের টোকা ফটকে পড়লো অনেক পড়ে। আর বাসি উঠোনে গোবরজলের ছরা পড়ে গেলেও বরইগাছের কোঠর থেকে চড়ুইগুলো ডেকে উঠল বেশ বেলা করেই।
—ও ঠাকুমা, ফুলের সাজি আনব?
পূর্ণির মা এঁটেল মাটিতে উঠোন নিকানো শুরু করলেই ঠাকুমা বাইরবাড়ির দিকে পা বাড়াল। পেছন পেছন আমি ফুলের সাজি হাতে।
আজ ঠাকুমা সাহাপাড়ার দিকে পা না বাড়িয়ে থানাঘাটের পথ ধরল।
—ও ঠাকুমা, আজ সাহাপাড়ায় যাবে না?
আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এখন সময় নেই ঠাকুমার। বেলার গায়ে আকাশের অন্ধকার যতই ছায়া ফেলে রাখুক না কেন, ঠাকুমার কড়ে সময় ঠিকই এগোয় হিসেব মতো,
—ও দিদি, তিথি তো প্রায় ফুরিয়ে এল। পা চালাও তাড়াতাড়ি।
ঠাকুমার পেছন পেছন প্রায় দৌড়ে পোস্ট অফিসের মাঠ পেরিয়ে এখন আমরা হাইস্কুলের মাঠে। আর একটু এগোলেই থানাঘাট। আকাশের গায়ে এখন আরেক পোঁচ মেঘ জমল। সাথে একটু সরসরে হাওয়াও এল গাছের পাতা কাঁপিয়ে।
ঠাকুমা দ্রুত পায়ে গিয়ে নামল থানাঘাটের পাড়ে। একহারা করোতোয়ার পাড়। ও’পাড়ে কালীমন্দির আর মন্দির ঘেঁষা প্রাচীন বটগাছ। যার ঝুরিগুলো সুযোগ পেলেই গাছ থেকে নেমে মাটিতে আসর পাতে।
—ও ঠাকুমা, জলের অত কাছে যেও না, নদীও কেমন অন্ধকার হয়ে আছে দেখেছ?
আমার এসব কথা অন্তত আজ আমলে নেবার সময় নেই ঠাকুমার। ঠাকুমা তরতর করে হাঁটুজলে নেমে গেল। হাত দিয়ে এগিয়ে নিল খানিক কচুরিপানা। সেখান থেকে ছিঁড়ে নিল ক’খানা কচুরিপানার ফুল। এরপর ভেজা কাপড়ে পাড়ের মাটি নিংড়ে আমার কাছে ফিরে এল ঠাকুমা,
—দিদি, জোলাপাড়ার দিকে একটু যাব। হাঁটতে পারবে এত?
ঠাকুমার কথা মাটিতে পড়ার আগেই আমি পথ ধরি।
—ও ঠাকুমা, চল তাড়াতাড়ি – ও বাড়ির মানুষগুলো উঠে গেলে ছাতিম গাছে হাত দিতে দেবে না।
ঠাকুমা পা চালিয়ে জোলাপাড়ায় গেল ঠিকই, কিন্তু ছাতিম গাছে হাত দেবার আগে মজনু জোলার বাড়ির দরজায় টোকা দিল। এ পাড়ায় এই একটিই ছাতিম গাছ। সে গাছটি বাড়ি পেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে অজস্র সাদারঙের ফুল সাথে নিয়ে। জোলাপাড়ায় ঢুকতেই তাই নাকে ধাক্কা দেয় ছাতিম ফুলের সোঁদা ঘ্রাণ,
—আমি একগাছা ফুল নেবো বৌ, দেবে?
ঠাকুমার এমন আবদারে জোলাপাড়ার সবচেয়ে মুখরা বৌ কেমন যেন বিনয়ী হয়ে ওঠে,
—জিজ্ঞেস করতি হবিনা জ্যাঠিমা, যা লাগে লিয়া যান।
না, ঠাকুমা দু’হাত ভরে ফুল তোলে না, বরং আমার বায়না তোয়াক্কা করে মাত্র একগাছা ছাতিম ফুল ছিঁড়ে সাজিতে ফেলে।
এরপর আর দাঁড়াবার সময় কই? আকাশের গা থেকে একটু আধটু আলো মাটিতে আসার আগেই মেঘের গায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। তা বলে তো বেলা বসে থাকছে না।
—ও ঠাকুমা, সাহাপাড়া যাবে না?
না, ঠাকুমা সাহাপাড়ার দিকে পা বাড়াল না। জোলাপাড়ার রাস্তা ছেড়ে চেয়ারম্যান বাড়ি পেরিয়ে একদম আমাদের তাঁতঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঢুকে গেল তাঁতঘর ঘেঁষাবাগানে। শ্বেতকাঞ্চন, কাঠটগর, জবা, আকাশনিম আর কাঠমালতি ফুল নিল। আর শেষতক আটফুলের হিসেব মেলাতে ঘাসের জঙ্গল থেকে তুলে নিল ক’খানা সাদা কলমি ফুল।
তাঁতঘর খুলে গেছে এর মধ্যেই। একজন দু’জন তাঁতি গামছায় খাবারের বাটি বেঁধে ঢুকছে তাঁতঘরে।
ঠাকুমা আর দাঁড়ায় না। ভেতর বাড়ির নিকানো উঠোনে ফুলের সাজি রেখে ঠাকুমা কলঘরে চলে গেল।
বাড়ির উনুনে আঁচ পড়ে গেছে। কাউনের চালের সবজি বিরন উঠেছে উনুনে।
ঠাকুমা স্নান সেরে নিত্যপূজা সেরেই আজ উঠোনে চলে এল। আটরকম ফুল, গুড়ের কদমা, পাঁচকরম ফল, পাঁচটি হরতকি, পেতলের ঘটি ভরা জল আর ঘি-এর প্রদীপ সাজিয়ে বসল মাঝ-উঠোনে। আকাশে এখনও ভাদুরে মেঘের আলিস্য। ঠাকুমা পূব আকাশে মুখ করে বসে একে একে সব ফুল, মিষ্টি নিবেদন করে ঘি-এর প্রদীপ শিখায় আঙুল ছোঁয়ায়,
—ও দিদি, এদিকে আস
আমি কাছে যেতেই আঙুলের ওমটুকু মুছে দেয় আমার কপালে।
এরপর ঠাকুমা জলের ঘটি উপুড় করে দেয় পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঘটির জলে ভাসতে থাকে সাদা কলমি আর কচুরিপানার ফুল। ছাতিম ফুলের গোছাটা আটকে যায় পেয়ারা গাছের গোড়ায়। ঠাকুমার দেওয়া গুড়ের কদমা প্রসাদ হাতে নিয়ে আমি এসে দাঁড়াই পেয়ারা গাছের তলায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে হুট করে তুলে নেই কাঁদামাখা ছাতিমফুলের গোছাটা। হাতের মুঠোয় তা পুরে এক দৌড়ে চলে আসি বাইরবাড়িতে।
দেবদারু বাগানের তলায় এসে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে পুঁতে দিই সেই গোছা। সোঁদাঘ্রাণের এই ফুলগাছটা যে ঠাকুমার বাগানে নেই।
আর ঠিক এই সময়ই ক্যাঁচক্যাঁচে আওয়াজ আমার সব মনোযোগ কেড়ে নেয়। আইনুল চাচা এল। গামছার গিঁট থেকে বেরিয়ে এল গুড়ের শিরনি। শেষ রাতে উঠে আইনুল চাচা আমন ধানের বীজ ফেলেছে তো জমিতে।
সকালের পাতে কাউনের চালের সবজি বিরন সবার পাতে পড়লেও আমার পাতে পড়ল নতুন গুড়ের শিরনি আর খৈ।
আজ বাড়িতে নিরামিষ পদ হবে সব। তাই দাদুর আজ বাজারে যাবার তাড়াহুড়ো নেই। বাইরবাড়ির কাঠের বেঞ্চিতে বসে পান চিবোচ্ছে আর আইনুল চাচার সাথে জমিজমার গল্প করছে। তবে দাদুর এই আয়েসী সময়ে ঠাকুমার কাজ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। খানিক সময় পরপর হয় পান সেজে দেবার আবদার নয়তো চায়ের জন্য হাঁকডাক। কিন্তু আজ ঠাকুমার এসব বাড়তি কাজের সময় কই?
আইনুল চাচা যে ঢ্যাপ নিয়ে এসেছে কলাগাছের খোল ভরে। সামনেই তো বড় পূজো।
সকালের পাত উঠে গেলেই ঠাকুমা বসেছে ঢ্যাপ ফল নিয়ে। হাত দিয়ে ফাটিয়ে ভেতর থেকে বের করে আনছে কালো ছোটো বীজ। এরপর ছাই দিয়ে সেই বীজ ঘষে জমিয়ে রাখছে পাথরের খালায়। পাথরের থালা রোদে পড়লেই তবেই না ঠাকুমার অবসর।
না, অবসর আর আসে কই?
আকাশের কালোমেঘকে ফাঁকি দিয়ে একটু আধটু রোদ উঠোনে আসতেই পাথরের থালাখানা সেখানে পড়লো। হাতঝাড়া দিয়ে ঠাকুমা উঠে দাঁড়াতেই মনিপিসি কাঠের দোতলা থেকে নারিকেল নামিয়ে আনলো।
আজ দুপুরে নিরামিষ পদে কুমড়ো দম্পক।
ঠাকুমার বাগান থেকে কচি ঝিঙে নিয়ে আসল পূর্ণির মা। আর রান্নাঘরের মাচা থেকে নামল কমলারঙের কুমড়ো।
মনিপিসি নারকেল কুরিয়ে বাটলে বসে গেছে শিলপাটায়। সাথে অনেকগুলো কাঁচামরিচও।
আইনুল চাচা আমাদের বাড়িতে আসা মানে ঠাকুমার অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠা। তাই তো দাদুকে বাজারে না পাঠিয়েও আজ বাড়ির উনুনে উঠবে কিছু অন্যরকম পদ। সে সব পদ কেবল ঠাকুমার হাতেই খোলে।
মা মিঠে কুমড়ো আর ঝিঙে কুটে দিল ডুমো করে।
আজ দুপুরের পদে হবে ঘ্যাটকোল পাতা বাটা, পাঁচ তরকারি দিয়ে কুমড়ো বড়ির রসা, থোড়ের ঘণ্ট, তিলের বড়া, জালি কুমড়োর টক আর মিঠে কুমড়ার দম্পক।
একে একে সব পদ নামার পর উনুনের ঢিমে আঁচে বসল কুমড়োর দম্পক। ডুমো করে রাখা মিঠে কুমড়ো আর ঝিঙে লবণ, হলুদ আর তেল দিয়ে মেখে হাত ধোয়া জল ছিটিয়ে বসানো হল উনুনে। সাথে সাথে কড়াইয়ে ঢাকনার পড়ে গেল।
উনুনে কোনো গনগনে জ্বলন্ত খড়ি নেই। খড়ি পোড়া কয়লার নিভু নিভু আঁচ সেখানে। সেই আঁচেই কচি ঝিঙে আর মিঠে কুমড়ো থেকে জল বেরিয়ে সবজি গুলোকে মোজাতে শুরু করল।
আইনুল চাচা দাদুর নস্যি কিনতে বাজারে গেছে। স্কুল কামাই করা অলস সময়ে দাদু ঝিমোচ্ছে কাঠের চেয়ারে। পাশেই টেবিলে কুনকুন করে বাজছে রেডিও। তাঁতমাকুর একঘেয়ে খটাস খটাস শব্দে নিথর হয়ে আছে বেলা।
—মনি, স্নান করে নাও…
বারোমাসি আমগাছের তলায় আমার মাথায় তেল দিতে দিতে পূর্ণির মা’র বয়ান,
—মাথাভরা এতক চুলেই তো মনির শরীর শুকোয়ে যাতিছে, দেহের সব পুষ্টি চুলই তো নিয়ে নেই বৌ, চুলগুলান কাটি ছোট করি দিও কলাম, চুলের এত ভার এইটুকুন শরীর সহ্য করতি পারে?
উত্তর দেবার কেউ নেই। বাড়ির প্রতিটা বৌ এখন রান্নাঘরে, তাদের কি পূর্ণির মার গল্পে সায় দেবার সময় আছে?
কলঘর থেকে ক’ঘটি জল ঢেলে আমিও রান্নাঘরে এসে উঠলাম।
কুমড়োর দম্পকের ঢাকনা উঠল। সবজির জল শুকিয়ে তেল বেরিয়ে এসেছে। এবার তাতে পড়ল নারিকেল বাটা আর কাঁচামরিচ বাটা। ভালো করে নেড়েচেড়ে মিশিয়ে আবার ঢাকনা দিল ঠাকুমা। একটা খড়ি দিয়ে উনুনের পোড়া কয়লাগুলো ঘেটে দিল। অল্প একটু ধানের তুষ তাতে ছড়িয়ে আঁচ বাড়াল একটু।
নারকেল মেশানো মিঠে কুমড়োর মিষ্টি ঘ্রাণ রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঠোনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। ভাদুরে বারবেলার রোদ হঠাৎ করেই তেড়েফুরে উঠল এই অবেলায়। দেবদারু গাছের মাথায় মেঘ সরে এখন ঝকঝকে নীল আকাশ ।
উনুন দম্পকের ঢাকনা উঠল আবার। বাটা নারিকেল থেকে তেল বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে মিঠে কুমড়ো আর ঝিঙের সাথে। তাতে একটু চিনি মিশিয়ে আবার ঢাকনা দিল ঠাকুমা।
আইনুল চাচা নস্যি নিয়ে আসার পথে থানাঘাট থেকে ডুব দিয়ে এসেছে। দাদুরও স্নান সেরে আহ্নিক করা হয়ে গেছে।
লাল বারান্দায় দুপুরের পাত পড়ল। পাতে কাদম্বিনি চালের আতপ ভাত, ঘ্যাটকোল বাটা, থোরের ঘন্ট, তিলের বড়া আর ধোঁয়া-ওঠা কুমড়ো দম্পক।
—ও আইনুল, ভালো করে খাও, আরেকটু দম্পক দেব?
আঠালো ভাতে কুমড়ো দম্পকের শেষ গ্রাস মুখে দেয় আইনুল চাচা,
—খুব সোয়াদ মা, কুমড়া জম্মের মিঠা….
আইনুল চাচার মা, মানে ঠাকুমার মুখে তৃপ্তির হাসি। আরেকটু কুমড়ো দম্পক পড়ে আইনুল চাচার পাতে।
—ও ঠাকুমা, আমাকে আরেকটু দেবে না দম্পক?
কেন যেন ঠাকুমাকে নিজের দিকে ফেরাতে বলে উঠি আমি।
তাঁতমাকুর খটাস খটাস শব্দে এখন ঢিমে লয়। কোনো তাঁতি বাঁশীতে সুর তুলেছে,
এই মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার।
লালন বলে মানুষ আকার
ভজলে তারে পাবি….