কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে যে বাড়ি গুলোতে জীবনের দিন সব কাটিয়ে এলাম শেষ বেলায় তাদের কথা একটু লিখে যাই। যাই বলছি বটে যাওয়ার নাম গন্ধ নেই। জাঁকিয়ে বসেছি মাটি মায়ের কোল আঁকড়ে। লিখতে অসুবিধা হয়। আস্তে আস্তে লিখবো খণ্ড খণ্ড। সেভ করতে গিয়ে লেখা হারিয়ে ফেলি। অনেকের জীবন এক বাড়িতে কেটে যায়। আমাদের তা হয়নি। ছোটবেলা থেকে কতো বাড়িতে থাকলাম। যেটুকু মনে আছে লিখতে থাকি। সুখে জড়ানো না হোক স্বস্তি শান্তি তো ছিল। মা বাবা ভাইবোন, দুএকজন সহায়ক, গৃহপালিত নিয়ে মধবিত্ত পরিবার। হাসি খুশি মোটামুটি খেয়ে মেখে মন্দ কাটেনি বলতে পারি। যাঁরা পড়বেন জেনে বুঝেই অপ্রয়োজনের আনন্দে পড়বেন। ... ...
স্নিগ্ধার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে ননদ রূপা। তার কাছে শোনা হয়ে গেছে কয়েদিদের মধ্যে খুনীদের একটু কম সন্দেহের চোখে দেখা হয়। নিতান্ত পেশাদার খুনী না হলে তারা হয়তো উত্তেজনার মূহুর্তে অপরাধ করে ফেলে কিন্তু স্বভাব অপরাধী হয় না। চোররা সবচেয়ে খারাপ। ডাকাতরা মাঝারি। নিখিল আবার ঠিক চোরডাকাত কিছুই নয়। ফরেস্টে কাঠ চুরির কেসে ফেঁসে গেছে। কোন কাঠমাফিয়ার হয়ে জেল খাটতে রাজি হয়েছিল, অর্থের বিনিময়ে। মায়ের অসুখ। টাকার খুব দরকার। ভেবেছিল কিছুদিন কয়েদ খেটে ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপর যা হয়, মামলাই উঠছে না।... ... ...
বৌ ঝিয়ারি লগে লইয়া ঠাম্মা যদি আইন হগ্গলরে খুশি করিয়া ধামাইল চৌতাল গাইন। শীতর রাইত চান্দর গাওত কুয়াশার চাদ্দর শিয়াল ডাকরা আনন্দে ওই বাঁশবাগান আদ্দর। কই গেলা বা রাঙ্গা কাকা কান ছিদ্দিক আলি আলু পুড়া ফুরাই গেল লই লাও ভুট্টার হালি। ... ...
তখন আমাদের খুব পিকনিক করার ঝোঁক ছিল। সেদিনের ত্রিপুরায় বেশ কিছু হালকা বনবিতান ছিল অনতিউচ্চ টিলা ছিল, লেক ছিল। দিনের বেলা বুনো হাতি বা হিংস্র প্রাণীর ভয় নেই এমন জায়গা ছিল। আর ছিলেন আমাদের প্রসন্নহৃদয় অধ্যাপকরা। যাঁরা আমাদের অর্থহীন উপদ্রবকে সস্নেহ প্রশ্রয় দিতেন, সময় দিতেন আমাদের চাহিদা মত,যাঁরা সঙ্গে থাকলে অভিভাবকদের ও দুশ্চিন্তা হতোনা। ... ...
পাহাড় থেকে ভূমিপুত্ররা বেচতে আসে জুমের ছোট্ট আর গোলদানার লালচে চাল। বড় সোনালি রঙের পাথরবাটি যেটি দুপুরুষ আগে দ্বারকায় তীর্থ করতে গিয়ে কেনা হয়েছিল তার ওপর নূতন ধোয়া জলগামছা বিছিয়ে গরম ভাত বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর জগন্নাথ দীঘির মিষ্টি জল ঢালবেন। গন্ধরাজ লেবুর ষোলটা পাতা ষোলটুকরা লেবু দিতে হবে।পরের দিন সকালে নারকেল কোরা ছড়িয়ে ছেঁকে নেওয়া পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঠের খুন্তি নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে। গুড়ের ডেলা সাজানো থাকবে কালো পাথরের রেকাবীতে।লাল শাকের টক,গাঁঠিকচু আর সর্ষেপোস্ত,তিল বাটা তিলের মুচমুচে বড়া। আর আছে কাঁচা তেঁতুলের টক। শেষ পাতে আমআদা দিয়ে নারকেল বাটার সন্দেশ। কয়েকদিন ধরে যোগাড়যন্ত্র করে ঠাকুমা ব্যতিব্যস্ত। ... ...
প্রায়ই শহর থেকে বাসে করে স্কুলে আসার সময় শুনি গতরাতে ওমুক গঞ্জ কি তমুক ছড়ার স্কুলে আগুন লেগেছে। বেশিরভাগ টিনের চাল আর বাঁশ বা কাঠের ওপর প্লাস্টার করা স্কুল বাড়ি। দৃষ্টিশোভণ কিন্তু সহজ দাহ্য। একদিন দেখি বাসে একজন বয়স্ক মাষ্টারমশাই নীরবে চোখের জল ফেলছেন, স্কুল পুড়ে গেছে, পুড়ে গেছে তাঁর সার্ভিসবুক। সামনে রিটায়ারমেন্ট। একরকম একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসে উঠে একটা জানালার ধারে সীট পেয়ে গুছিয়ে বসেছি তখনই শুনলাম আগের রাতে আমাদের স্কুলে আগুন লেগে অফিস ব্লকসহ অনেকখানি পুড়ে গেছে। ... ...
রিহার্সাল দিতে দিতে একদিন নূপুর বললো, নাটক করতে গেলে তো গয়না কিনতে হবে - চলো চাঁদা তুলি। ক্লাসের মেয়েরা কতো আর চাঁদা দেবে, তবু কেউ কেউ দিল। সামান্য সেই টাকা নিয়ে নূপুর আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে এলো শহরের বড় ইমিটেশন গয়নার দোকানে। মালিক খুব সস্নেহ ব্যবহার করছিলেন কিন্তু নিজে নিজে গয়না কেনার উত্তেজনায় আমরা কী করে যেন শোকেসের কাঁচ ভেঙে ফেললাম। উনি আর কী করেন, বললেন স্কুলে জানাবেন। উপায়ান্তর না পেয়ে যৎপরোনাস্তি ভীত সন্ত্রস্ত আমরা সবাই গিয়ে দিদিমণিকে বলতেই দিদিমণি ক্ষোভে দুঃখে অস্থির। নূপুর কি করেছো, উইদাউট পারমিশন সরকারি স্কুলে চাঁদা তুলেছো। আমার মানসম্মান জলে গেল, বেআইনি কাজ করেছো তোমরা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐসব নিয়ে একপ্রস্থ লাঞ্ছনা গঞ্জনা হলো। ... ...
ভয়ংকরী কালী সঙ্গে সারা শরীরে শাদা রঙ মাখা জটাধারী শিব সঙ্গে কিছু অনুচর। ড্যা ড্যাং ড্যাং ঢাকের বাদ্যি। একটু রাত করে শিব কালীর তুমুল নাচন। একটু ভয় করে, মজা ও হয়। সিধা দেওয়া হয়, চাল, ডাল, তেল, নুন, আলু আর পয়সা। ঠাম্মা কটা বাতাসা দেন। খুশিতে শিবঠাকুর কালীঠাকুর দুজনেই আটখানা। আরো নাচতে চায়। কেউ প্রশ্রয় দেয়না বেশি। ঢাকি নাচ বেশি ক্ষণ ধরে হলে নাকি বাড়িতে চুরি হয়, শিবের ভূতরা অন্ধিসন্ধি দেখে যায় পরে শিবঠাকুরের সঙ্গীরা সিঁদ কাটে। চোর কি আর সাধারণ চোর? রাত জেগে পড়ছে কোনো পরীক্ষার্থী, লাগাবে ধমক। ওদের কাজের অসুবিধা হচ্ছে যে। ... ...