পরদিন বিজয়া দশমী । একটু বেলা হল সকালে উঠতে। তৈরী হয়ে গেলাম মণ্ডপে। দশমী পূজো শেষের দিকে। এইবার শরীর ও মনে ক্লান্তি উঁকিঝুঁকি মারছে। মায়ের মুখখানা আজ যেন কেমন লাগছে! মা তো আজ কৈলাসে পাড়ি দেবেন । দেবাদিদেব রয়েছেন তাঁর অপেক্ষায়। তবুও কেন বিষণ্ণ মুখ তাঁর? নাকি উমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ফেলেছি? নিজেরও কি মনে হচ্ছে সেই আজন্ম পরিচিত ঘরকে ফেলে আসার দিনের কথা?আরতি শুরু হল। ঢাক, কাঁসর ঘন্টা, শঙ্খ, ধুনোর গন্ধ সবই এই কয়েকদিনের মতোই । তবুও আজ কেন দু চোখ ছাপিয়ে জল আসছে?পুরোহিতমশাই ক্ষমা প্রার্থনা করছেন মায়ের কাছে, সকলের হয়ে। তারপরেই ঘট নাড়িয়ে দিলেন। দর্পণ নিয়ে মায়ের মুখের সামনে ধরে প্রতিবিম্ব দেখে বড় আবেগতাড়িত কন্ঠে মন্ত্র পড়ছেনঃ"ওঁ উত্তরে শিখরে দেবি ভূম্যাং পর্বতবাসিনী।ব্রহ্মযোনি সমুৎপন্নে ... ...
সেদিন মণ্ডপ থেকে মনে অনেক আনন্দ নিয়ে ফিরেছিলাম। বাড়ি পৌঁছে পাশের নবরাত্রি পূজোতে যাওয়ার কথা হল। রাত হয়ে গিয়েছে বেশ। পরদিন অফিসের তাড়া নেই। আছে শুধু উৎসবের আনন্দ। বাবা, মা আর বেরোতে চাইলেন না স্বাভাবিকভাবেই। বোনকে নিয়ে আমরা বেরোলাম।এই পূজোর সাজসজ্জা অনেক বেশী ঝলমলে। বড় সংখ্যার অবাঙালীদের সম্মিলিত পূজো এটি। রাস্তা আলোর সাজে আলোকিত। মণ্ডপও অনেক বড়। মণ্ডপের কাছাকাছি যেতেই বাঁড়ুজ্যেদের অফিসের কয়েকজন এগিয়ে এলেন। তখন ইন্টারনেট তো দূরের কথা, কেব্ ল চ্যানেলের সবেমাত্র জন্ম হয়েছে ভারতবর্ষে। নবরাত্রি পূজো সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না। অনেক বড় মণ্ডপে ফুট ছয়েকের মা দুর্গা, শেরওয়ালি মাতা একাই দাঁড়িয়ে আছেন দেখে কেমন একটু লাগল। মন কেমন দমে গেল। মাইকে ভজন চলছে। কর্মকর্তারা আমাদের ... ...
মহাষ্টমীর সকাল। স্নান সেরে বাঁড়ুজ্যে ছাড়া আমরা সকলেই মণ্ডপে। বাঁড়ুজ্যেদের অফিস তো ছুটি নেই। একটাই ছুটি দশমীর দিনে, দশেরার ছুটি। করবার কিছুই নেই। সম্ভব হলে অফিস থেকে সময়মতো এসে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে যাবে। নাহলে অফিস চত্বরেও নবরাত্রি পূজো হচ্ছিল, সেখানেই সেরে নেবে। তারপর দুপুরে সরাসরি মণ্ডপে পৌঁছে যাবে। ... ...
সপ্তমীর পূজোর শেষে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সেদিন। এছাড়াও পাঁচ কিলোমিটার দূরে রেলওয়ে কলোনির পূজোয় নিমন্ত্রণ ছিল। পূজো প্যাণ্ডেলে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা তখনও কলকাতায় শুরু হয় নি। বাংলার বাইরে যে কোনোও রাজ্যে তখন এমনভাবেই পূজো হত। যে কোনোও পরিবারের আত্মীয়, বন্ধুসহ এইসব পূজোয় জড়ো হওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। ভিনরাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালীরা উৎসবের দিনগুলিতে এমনভাবেই স্বজন বন্ধুদের সাহচর্য পেতে চাইতেন। ... ...
পরদিন ষষ্ঠী। নবরাত্রির পূজোয় রোজকার মতোই শেরওয়ালি মাতার গান বাজছে। বিকেল চারটে বাজলেই রোজ মহিলারা সকলে সমবেত হয়ে ভজন করেন। আমার তখনও যাওয়া হয়ে ওঠে নি মণ্ডপে।প্রতিবেশীরা কেউ কেউ এলেন বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধন। বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের দু একজন এসে মা, বাবা, বোনকে পূজোয় থাকবার জন্য অনুরোধ করে গেলেন। কলকাতায় বারোয়ারী পূজোর পরিবেশ। সেখানে কে আর কাকে ডাকে! বাবা, মা খুব খুশি। বোন তো অবশ্যই। পূজো কমিটির দুই সদস্যা, আমাদের দুই বৌদি এসে নৃত্যনাট্যের একটি বিশেষ পরিচিত গানে গলা মেলানোর জন্য বোনকেও রাজী করিয়ে গেলেন। বাবা আবৃত্তি করেন জেনেছিলেন তাঁরা। ব্যস্, বাবারও নাম অনুষ্ঠানে জুড়ে গেল আর মা র জুটল পূজোর যোগাড়ে অন্যান্যদের সঙ্গে হাত লাগানোর দায়িত্ব ।এদিকে ... ...
পরের দিন প্রতিপদ। পাশের পূজো প্যাণ্ডেলে গান বাজতে শুরু করেছে। হিন্দী ভজন। কিছু পরেই মহিলারা সারিবদ্ধভাবে আম্রপল্লব ইত্যাদি দিয়ে সুসজ্জিত ঘট মাথায় নিয়ে চলেছেন। ঘটস্থাপনা হবে। মূর্তি এসে গিয়েছে শুনলাম। শুনশান ফাঁকা জায়গা এমনিতে। পূজো শুরু হতেই জমজমাট ভাব।পঞ্চমীর সকাল হতেই ব্যস্ততা বেড়ে গেল আমার ঘরে। শশীকলার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখবার মতো সেদিন। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাবা, মা এসে পড়বে। বিকেলে ওদেরকে আনতেও যাব ২৬ কিমি দূরে নাগপুর স্টেশন থেকে। উৎসাহের হাওয়া বইছে আমার প্রতিবেশীদের ঘরেও। এঁরা কেউই বাঙালী ছিলেন না তবুও যেন তাঁদের বাড়িতেই লোক আসছে এমন ভাব। এই মানসিকতা পরবর্তীতে আমাকেও গ্ৰাস করে ফেলেছে। কত জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের লোকজনের সঙ্গে কাটালাম। যেখানেই থেকেছি একই রকম। আশেপাশের কোয়ার্টারে আত্মীয় স্বজন এলে নিজের আনন্দ হয়। তাঁরা চলে গেলে মন ... ...
জোরকদমে বাঙালী অবাঙালী পূজোর তোড়জোড় চলছে। কোয়ার্টারের সামনের রাস্তার পূজো নবরাত্রির পূজো। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পূজোর প্রস্তুতি দেখা বেশ উপভোগ করছি তখন। ঐ পূজো ছিল বাঁড়ুজ্যেদের staff দের পূজো। বেশিরভাগ উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের বাসিন্দা। একদিন সন্ধ্যায় তাঁরাও দল বেঁধে এসে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। অষ্টমীর রাতে অর্কেস্ট্রা হবে। 'ভাভীজী কো লে কে জরুর আইয়েগা সাহাব' --- তাঁরা বলে চলে গেলেন।মহালয়া এসে গেল। জীবনে প্রথমবার মহিষাসুরমর্দিনী ক্যাসেটে শুনলাম সেই বছর। জানতে পারলাম মহালয়া নামটি আমাদেরই, বাংলার। ওখানে 'পিতৃ মোক্ষ অমাবস্যা'। গুরুত্বপূর্ণ দিন একটি। বাচ্চাদের সব স্কুল ছুটি থাকে সেদিন। বেলা বাড়তেই আমার "একান্ত আপন শশীকলা" এক ব্যাগ নিয়ে এসে হাজির, "ভাভী, ইয়ে রখো। নবরাত্রি মে লগেগা।" দেখলাম অনেকগুলো শাঁকালু। জিজ্ঞাসা করে ... ...
পরের দিন শুরু হল নতুন আনন্দে আহ্লাদে, ব্যস্ততা দিয়ে। ঘর গোছগাছ করতে হবে। বাবা, মা, বোন আসছে কলকাতা থেকে। কারোও যাতে কোনোও অসুবিধা না হয়। এক তো প্রায় গ্ৰাম এলাকা। কোলিয়ারির জন্য মফস্বলের ছোঁওয়া। কাছাকাছি সবকিছু পাওয়া যায় না। আমার ঘরে, আমার সুখ, দুঃখের সঙ্গিনী, ঘরের কাজে সাহায্যকারিণী, নাম তার শশীকলা, গ্ৰামের মানুষ, মারাঠি। সে ছিল আমার অনভিজ্ঞ নতুন সংসারের local guardian। সে কলকাতা থেকে লোক আসছে শুনে অতি উৎসাহী হয়ে পড়ল। মহা উৎসাহে ঘর পরিষ্কার শুরু করে দিল। ওদিকে বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনেও খবর চলে গিয়েছে। সেখানেও বেশ হৈ চৈ পড়ে গেল। প্রবাসে, বিশেষ করে এমন ছোটখাট মফস্বলে কারোও বাবা, মা আসছেন শুনলেই অন্যরাও আনন্দে উৎসাহী হয়ে পড়ত। বাড়িঘর, ... ...
বাংলার বাইরে তখন কিছু মাস কাটিয়েছি। প্রথম জড়তা, বিশেষ করে ভাষাগত জড়তা – তখন অনেকটাই কাটিয়ে ফেলেছি। গরমে একবার কলকাতা ঘুরে এসে অবধি মন আবার ছটফট করছে যাওয়ার জন্য। বর্ষার মাঝামাঝি পেরিয়েছে। পূজোর খুব বেশী দেরী নেই সে বছর। কোলিয়ারিতে শুনলাম ঐ একই চত্বরে চারপাঁচটা পূজো হয়। বাঙালীদের আয়োজিত একটি তার মধ্যে। শুনে চমকিত হওয়ার মতো অবস্থা। ধূ ধূ করা জায়গা, রাত হলে রাস্তায় টিমটিমে আলো জ্বলে যেখানে -- সেখানে এতগুলো পূজো! কয়েকমাস মাত্র হল খোদ কলকাতা ছেড়ে আমি প্রবাস বাসে। নিতান্তই অনভিজ্ঞ। শুনলাম বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের পূজো বাঙালী পূজো। বাকি সব পূজো নবরাত্রি পালন। আবার হোঁচট। নবরাত্রি কি রে বাবা? কলকাতায় এখনকার মতো তখন নবরাত্রি ... ...
বিয়ের পর আমার ঠিকানা অন্য রাজ্যে, মহারাষ্ট্রে হয়ে গেলে সেই প্রথম নববর্ষের দিনের শুরু বড্ড মন কেমন করা দিয়ে হল। প্রচণ্ড গরম। লু চলে বছরের ঐ সময়ে। ঘরের দরজা, জানলা বন্ধ। কোনোও লোকজন দেখা যায় না । বাড়ির লোকজন, আত্মীয় স্বজনের আকর্ষণ যে কি সেই প্রথম অনুভব করলাম। চোখের জলে ভেসে দুই বাড়ির বাবা, মা ও বাকি আত্মীয়দেরকে চিঠির মাধ্যমে প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। তবে প্রবাসে বঙ্গ সমাজ কিন্তু মন ভরিয়ে দিয়েছিল শেষেমেশ। গুটিকয়েক বাঙালি পরিবার একজোট হয়ে খাওয়াদাওয়া, হাসি, গান খুব আনন্দের হয়েছিল। ... ...