এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দুর্গাপূজোর অন্য গল্প (৮)

    Mousumi Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৫১৯ বার পঠিত
  • সেদিন মণ্ডপ থেকে মনে অনেক আনন্দ নিয়ে ফিরেছিলাম। বাড়ি পৌঁছে পাশের নবরাত্রি পূজোতে যাওয়ার কথা হল। রাত হয়ে গিয়েছে বেশ। পরদিন অফিসের তাড়া নেই। আছে শুধু উৎসবের আনন্দ। বাবা, মা আর বেরোতে চাইলেন না স্বাভাবিকভাবেই। বোনকে নিয়ে আমরা বেরোলাম।

    এই পূজোর সাজসজ্জা অনেক বেশী ঝলমলে।  বড় সংখ্যার অবাঙালীদের সম্মিলিত পূজো এটি।  রাস্তা আলোর সাজে আলোকিত।  মণ্ডপও অনেক বড়। মণ্ডপের  কাছাকাছি যেতেই বাঁড়ুজ্যেদের অফিসের কয়েকজন এগিয়ে এলেন।   তখন ইন্টারনেট তো দূরের কথা, কেব্ ল চ্যানেলের সবেমাত্র জন্ম হয়েছে ভারতবর্ষে। নবরাত্রি পূজো সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না।  অনেক বড় মণ্ডপে  ফুট ছয়েকের  মা দুর্গা, শেরওয়ালি মাতা একাই দাঁড়িয়ে আছেন দেখে কেমন একটু লাগল। মন কেমন দমে গেল।  মাইকে ভজন চলছে।  কর্মকর্তারা আমাদের তিনজনকে  জোর করেই বসানোর ব্যবস্থা করলেন। আরতির প্রদীপ নিয়ে  আমাদের সকলের কাছে তাঁরা ধরলেন। সঙ্গে প্রসাদ,– চিরোঞ্জিদানা।  ক্লান্তও ছিলাম। ঠাণ্ডাও পড়ছে বেশ। বাড়ি ফিরতে হবে বলে উঠে দাঁড়ালাম।  কর্মকর্তারা জানালেন নবমীর রাতে অর্কেস্ট্রা আছে। অবশ্যই যেন আমরা যাই।

    পরেরদিন সকালে মণ্ডপে একটু থেকেই ফিরে এলাম। বিকেলে আমরা সকলে এবং আর এক বন্ধু পরিবার মিলে একই গাড়িতে করে ২৬ কিমি দূরে নাগপুর শহরের দুর্গাপূজো দেখতে যাব বলে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে।  দুপুরে বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোন হবে।

    বিকেল চারটে নাগাদ বেরোন হল। নাগপুর শহরে বড় মাপের সাত আটটি প্রবাসী বাঙালী গোষ্ঠীর পূজো হয়। সবকটি পূজোতেই  মণ্ডপ,  আলোকসজ্জা এবং অবশ্যই প্রতিমা  যথেষ্ট ভালো হয়।  প্রতিটি পূজোই প্রধানতঃ কোনোও বড় মাঠে হয় । সব  মণ্ডপেই একটি অংশে বড় বেদীতে সপরিবারে মা দুর্গা, তার পাশে বড় স্টেজ ---পূজোর কদিন বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য। যথেষ্ট উচ্চমানের অনুষ্ঠান এই দিনগুলিতে বিভিন্ন মণ্ডপে হয়ে থাকে।  নামী নাট্য সংস্থা, নামী সঙ্গীত শিল্পীর উপস্থিতি  উৎসবের রোশনাইয়ে আলাদা মাত্রা যোগ করে। এছাড়া থাকে  খাবারের স্টল। প্রবাসে পূজোর  একটি  বিশেষ আকর্ষণ  হল  গোল করে চেয়ার নিয়ে বসে আড্ডা। যত রাত বাড়ে তত আড্ডার পরিধিও  বাড়তে থাকে। তবে অফিস, স্কুল চলে বলে  রাত বারোটার পরে সব শুনশান। চেনাশোনা মানুষের ঘোরাঘুরি এইসব মণ্ডপে হয়েই থাকে।  দেখা হলেই --   অমুক পূজো দেখলেন?  .... সেখানে কি প্রোগ্ৰ্যাম চলছে? ..... ইন্দ্রাণী সেন কবে আসছেন..... তমুক ক্লাবে চিত্রাঙ্গদা  অথবা কলকাতার গ্ৰুপ দাদা....ভালো তো হবেই!  এসব মন্তব্য করতে করতে চেয়ার টেনে বসে পড়া।  ছেলে মেয়ের  স্কুলের বন্ধুর বাবা, মা, বা টীচার ....সকলেই সেদিন এক ভূমিকায়। ছাত্র বা ছাত্রীর সামনেই  ম্যাথসের  গম্ভীর ম্যাম  হয়তো কতগুলো ডিমের চপ কিনে ফেললেন ভালোবেসে।  শুধু কি তাই?  তিনিও গোল হয়ে বসার দলে যোগ দিলেন। বলেও ফেললেন আলুর চপ, ডিমের চপের প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা ছাত্রের সামনেই। এছাড়া আরোও একটি ব্যাপার খুব বেশী ঘটে থাকে এই গোল আড্ডাচক্রের দৌলতে। যেমন,  নাগপুরের  ...মাসীমার বাড়িতে  দিল্লী থেকে  তাঁর ভাই সপরিবারে ছুটিতে এসেছেন। মাসীমার পরিবারের সঙ্গে পাড়ার পূজোতে ভাইও সপরিবারে উপস্থিত।  আড্ডাতেও তাঁদের সঙ্গে ...মাসীমার নাগপুরতুতো দেওর , তিনি হয়তো অন্য পাড়ার বাসিন্দা ---  এলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই  চেয়ার জুটিয়ে এনে  গোল বড় করা হল। তারপরই হয়তো ঐ দেওরের মেয়েটি সেজেগুজে আসতেই দিল্লীবাসী ভাইয়ের বৌয়ের  চোখে ও মনে ধরে গেল সেই সুশ্রী মেয়েটিকে।  হ্যাঁ, এই মেয়েটিকে পুত্রবধূ করলে কেমন হয়?  যেমন ভাবা তেমন কাজ।  এই ভাবনার ফলস্বরূপ হয়তো পরের ফাল্গুনেই চারহাত এক হয়ে গেল।

    নাগপুরের একটি অন্যতম  পূজো, ধন্তোলির পূজো। ধানতুলি বা ধন্তোলি পুরনো বাঙালী পাড়া। কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, বড় বাংলা লাইব্রেরী  সব  ধন্তোলিতেই।  এমনকি  ধন্তোলির  সরকারি হাই স্কুলে বাংলা একটি বিষয় হিসাবে পড়ানোও  হয়।  স্কুলের পাশের বিরাট খেলার মাঠে নাগপুরের সবথেকে পুরনো পূজোটি অনুষ্ঠিত হয়। পূজোর সঙ্গে মেলা, বিভিন্ন আধুনিক রাইড ইত্যাদির জন্য এই পূজো সকলের কাছেই বিশেষ আকর্ষণীয়। চিরচেনা উৎসবের আর এক রূপে দেখে সকলেই আনন্দ পেয়েছিলাম। এরপর সকলে মিলে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতে  বেশ রাত হয়ে  গিয়েছিল।

    ততক্ষণে নবরাত্রির পূজো প্যাণ্ডেলে অর্কেস্ট্রার বাজনা শুরু হয়ে গিয়েছে।  মা, বাবা ঘুমাতে চলে গেলেন। বোনকে নিয়ে আমরা গেলাম অনুষ্ঠানে। এইবার বোঝা গেল অত বড় স্টেজ বানানোর উদ্দেশ্য কি! পুরো স্টেজ জুড়ে বিভিন্ন বাজনদারেরা নানা যন্ত্র বাজিয়ে চলেছেন।  এরপর এল আসল চমক। গান শুরু হল। পুরনো হিন্দী ছবির গান সঙ্গে নাচও।   আমাদের তিনজনকে আলাদাভাবে বিশেষ সম্মান দিয়ে বসান হয়েছে ।  খোলা আকাশের নীচে সকলেই।   তারই মধ্যে 'পিয়া তু অব তো আ জা' শুরু হল।  জমজমাট ব্যাপার।  শ্রোতাদের  মধ্যেও অনেকে গাইতে শুরু করেছেন ততক্ষণে।  গ্ৰাম গঞ্জে যাত্রাপালা যেমন হয়ে থাকে অনেকটা তেমন পরিবেশ। 'মোণিকা ও মাই ডার্লিং' বলতেই দেখলাম  স্টেজে আরও  একজনের প্রবেশ! বেশ নাটকীয় ব্যাপার।  শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত। বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। আমরা বেরিয়ে এলাম এরপর। জ্ঞানবধি কলকাতায় বড় হওয়া আমাদের  দুই বোনের এক নতুন অভিজ্ঞতা  যা আজ এত বছর বাদেও স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে।....
     
    ক্রমশঃ

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন