থমকে যে ঐ রয়েছে সময়,
ডাকছে যেন পিছু।
মনের কথা বলবো ভাবি,
শুনবে কিছুমিছু?
বোন হওয়ার পরে পাইকপাড়া ছেড়ে আমরা পাতিপুকুরের সরকারি আবাসনে উঠে এলাম। পাতিপুকুরে এসে মা বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনে বিএ-তে ভর্তি হল। আর বাবার তো ঠাকুরদার মত ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। সে তো হল না। বাবা সেই আশা কিছুটা হলেও পূরণ করার জন্য সরকারি হোমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি হল। শুরু হল সংসার, চাকরি আমাদের বড় করে তোলা আর সঙ্গে পড়াশোনা। আমরা একটা ঘরে থাকতাম। খাটটা ছিল উঁচু, তার তলায় সর্বস্ব। পাঁচ/সাত খাটের মাঝখানে আমি আর বোন দু’দিকে মাথা করে, পায়ে পা ঠেকিয়ে শুতাম। দু’পাশে বাবা, মা। বাবা আমার দিকে মাথা করে শুত আর মায়ের মাথা বোনের দিকে। গভীর রাতে যদি ঘুম ভেঙে যেত, দেখতাম খাটের একপাশে বা মেঝেতে হারিকেন জ্বালিয়ে বাবা মা পড়াশোনা করছে। আলোটা এপাশে খবরের কাগজ দিয়ে আড়াল করা, যাতে আমাদের চোখে না পড়ে।
উঠতি ঘরের ছেলে
আর পড়তি ঘরের মেয়ে,
বিদ্যেদেবী থাকেন তাদের
সারা জীবন ছেয়ে।
ঐ খাটের পাশে মা স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করত। বাবা বসে কুটনো কুটে দিত। দেওয়ালে চারটে বড় বড় তাক ছিল। সেই তাকে বাসন কোসন, মশলাপাতি সব থাকত। ওখানে থাকত কনডেন্সড মিল্কের টিন। মা ওটা রুটিতে মাখিয়ে রোল করে দিত, আমরা দু’বোন খেতাম। আড়বেলে থেকে পাটালি আসত। আমরা গুড়-রুটিও খেতাম।
বাবা, মা দু’জনেই খুব মেধাবী ছিল। কিন্তু মা যে কোনো বিষয়ে খুব উদ্বেগে ভুগত, আর বাবা নিরুত্তাপ। মা – পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন হয়তো ঠিকমত প্রস্তুতি হয়নি – সেই ভেবে ভেবে বমি-টমি করে একশা। পরীক্ষার দিন বাবাকে ছুটি নিতে হল, অসুস্থ মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা কিন্তু অফিস, সংসার সামলেও চুপচাপ প্রথম পরীক্ষা দিয়ে দিল, তেমন কোনো ঢেউ উঠল না। শুধু প্র্যাকটিকাল খাতার আঁকাগুলো আমার মাসি, কাবেরীকে দিয়ে আঁকাত। মাসিমণি খুবই ভালো আঁকত। বাবা সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে ঐ আঁকার উপর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো ঠিক করে নিত আর স্কেল দিয়ে লাইন টেনে লেবেলিং করত। আমি চুপচাপ একটু দূর থেকে ড্যাবডেবিয়ে দেখতাম, বাবা কী করছে। বাবার একটা ট্রাঙ্ক ভর্তি করে হাড় থাকত। সেই হাড়গুলো নিয়ে বাবা পড়াশোনা করত। ঐ হাড়ের বাক্স চানঘরের ওপরে লফ্টে রাখা থাকত। আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল ঐ ট্রাঙ্কের ওপর। ট্রাঙ্ক নামলে আমি আর দূরে থাকতে পারতাম না। বাবার পিঠের ওপর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখতাম। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতাম। ঐ দেখে দেখে চিনে গিয়েছিলাম, কোন হাড়টা শরীরের কোথায় থাকে। নিজের শরীরে স্পর্শ করে ঐ হাড়গুলো অনুভব করতাম। তবে সবচেয়ে ভালো লাগত ওপরের পিঠে, কাঁধের নীচের তিনকোণা স্ক্যাপুলা। ওটা নিয়ে খেলতাম। বোনকে বলতাম, অ্যাই, আমার স্ক্যাপুলায় একটু চুলকে দে তো। মাকে বলতাম, মা-আ! আমার টিবিয়া আর ফিবুলার মাঝখানটা ধরে টিপে দাও। খুব ব্যথা করছে। আমার রোজ রোজ সন্ধে হলেই পা ব্যথা করত। মা চুল বাঁধার কালো দড়ি দিয়ে পা জড়িয়ে বেঁধে দিত। প্রথম পরীক্ষার পর রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, বাবা পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। আর ফাইনালে বাবা তৃতীয় হয়েছিল। অনেক পরে যখন বাবার সঙ্গে গিয়ে কোনো অ্যালোপ্যাথি নামকরা ডাক্তার দেখিয়েছি, তখন দেখতাম বাবা গিয়ে প্রণাম করত। ওঁরা ছিলেন বাবার স্যার। যাই হোক, মা গ্র্যাজুয়েট হল, আর বাবা হোমিওপ্যাথিতে ডাক্তারি পাশ করল। আমি ততদিনে বাগবাজার মাল্টিপারপাসে কেজি ওয়ানে ভর্তি হলাম।
স্কুলের দিনগুলো খুবই আনন্দে কাটত। কিন্তু বাড়ি এসে চাপা টেনশন। বাবা ফিরত রাত দশটা পার করে। আমাদের খাইয়ে দাইয়ে, শুইয়ে দিয়ে মা ঘরবার করত। ঘুম আসত না আমার। খালি চোখ পিটপিট করে দেখতাম। শুনতাম কী সব জরুরি অবস্থা হয়েছে আমাদের দেশে, জরুরি মানে খুব দরকারি। তাই বাবার অফিসে ওভারটাইম হয়, বাবাকে দেশের খুব দরকার। আনন্দবাজারে রোজ হেডলাইনের নীচে বড় করে কুট্টির কার্টুন বেরোত। বাবা-মা ব্যস্ত থাকার জন্য, আমরা প্রায়ই কাছেই মামার বাড়ি থাকতাম। মা সাতসকালে রান্না করে টিফিন গুছিয়ে দিয়ে যেত আমাদের সঙ্গে। দুটো রুটি, আধখানা ডিম সেদ্ধ – এইরকম। আর তখন মামা বসে বসে কুট্টির কার্টুনের মানে বোঝাত আমাকে।
- এই দেখ টুম্পা, এখানে এই যে কাপড় মুড়ি দিয়ে গণতন্ত্র শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আর এই দেখ দরজা দিয়ে সিদ্ধার্থ বেরিয়ে যাচ্ছে।
-কেন মামা?
- আরে সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বললাম মনে নেই?
- হ্যাঁ-অ্যাঁ
- যশোধরা ঘুমোচ্ছিল, আর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বেরিয়ে গেল না?
- হ্যাঁ হ্যাঁ
- আরে, সেটাই কুট্টি এঁকেছেন দেখ।
- কী?
- আরে সিদ্ধার্থের মুখটা দেখ, নাক বের করা, তোলা চুল। এটা বুদ্ধদেব নয়, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, মুখ্যমন্ত্রী। এই দেখ ভেতরের পাতায় ছবি। মিল পাচ্ছিস? একে বলে কার্টুন। নামের মিল বলে এইভাবে দেখাচ্ছে।
- বুদ্ধদেবকে আঁকেনি কেন?
- আর একটু বড় হ। বুঝতে পারবি কেন আঁকেনি।
এর মধ্যে আবার মায়ের এক পিসতুতো ভাই মারা গেল। কলেজে পড়ত। তার মা রান্না করে ছেলেকে ডাক দিলে। ছেলেও দুপুরে ভাত খেতে বসেছিল, বাইরে থেকে কারা ডাকল। উঠে গেল। নামতে গিয়ে সিঁড়িতেই ছেলের গলা কেটে দিল। আর তার মা মানে মায়ের মেজপিসি বোবা হয়ে গেল, আর কথা বলে না।
- কে গলা কেটে দিল মা?
- নকশাল
- নকশাল কে? খুব দুষ্টু লোক? এখানে আসবে না তো?
- চুপ চুপ। বাড়িতে যা বললে বললে – বাইরে, ইস্কুলে এ সব কথা উচ্চারণ করবে না।
রাস্তা দিয়ে মিছিল যেত। জানালা দিয়ে দেখে দেখে আমি আর বোন খাটের ওপরে মায়ের লাল ব্লাউজ নিয়ে মিছিল করতাম, চেঁচাতাম – ভোট দিন বাঁ-চতে, ত্-তা-রা হাতুড়ি কাস্তে। ইন-কি-লা-ব, জিন্দা-বা-দ। খাট থেকে নামা আমাদের বারণ ছিল। কারণ ঐ খাটের পাশে মেঝেতে স্টোভ জ্বলত, ভাত ফুটত। আমরা মেঝেতে দৌড়োদৌড়ি করলে কী থেকে কী হয়ে যাবে, তাই এই ব্যবস্থা। শোবার ঘরই তখন আমাদের রান্নাঘর, বসার ঘর সবকিছু।
রান্নার সময়ে কেন আমাদের খাট থেকে নামা বারণ ছিল, তার পেছনে একটা মজার, কিন্তু নিদারুণ গল্প আছে। আমরা তখনও নিজেদের কোয়ার্টার পাইনি। দরখাস্ত করা হয়েছে সবে। একজন দিদার কোয়ার্টারে দু’-কামরা। আমরা তার একটা ঘরে থাকতাম। দিদা কোয়ার্টারের রান্নাঘরে রান্না করত। মা ঘরে করত। একদিন হয়েছে কি, দিদা ছোট ছোট চিতি কাঁকড়া এনেছে রান্না করবে বলে। ব্যাগে ছিল। কিন্তু ওটা কাত হয়ে কাঁকড়ার দল বেরিয়ে পড়ল। মা গেছে চান করতে। জ্যান্ত কাঁকড়াগুলো চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, দু’-চারটে হেঁটে হেঁটে আমাদের ঘরেও ঢুকছে। আমরা তো চিনি না এটা কী জিনিস। আমাদের খাটটা তিনটে ইট দিয়ে উঁচু করা ছিল। আমি তখন একটু বড়। একলাফে ইটে পা দিয়ে বেয়ে বেয়ে খাটে উঠে গেলাম, বোন পারল না। চিতি কাঁকড়ার দল ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। আর যত জোরে পারি, দু’জন গগন ফাটাচ্ছি। মা ঐ চিৎকার শুনে ভিজে কাপড়ে বেরিয়ে, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভিলেন পোকার ওপরে মারল ঝাঁটার মোক্ষম বাড়ি। দুটো নির্দোষ চিতি কাঁকড়া স্বর্গে গেল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখছি লাইভ পোকেমনের সঙ্গে মায়ের লড়াই। যদিও পোকেমন নামটা তখন জানতাম না। নারকেল কাঠির ঝাঁটার বাড়ি মেরে মায়ের মতি আবার মাথায় ফিরে এল। মা তো নিজেও কখনো এমন কাঁকড়া খায়নি। কিন্তু ধারণা করে ঐ দিদাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা, আজ বাজার থেকে কী এনেছেন?” তারপর আর কি, মা খুবই অপ্রস্তুত, ক্ষমা-টমা চেয়ে নিল। আমি সুড়সুড় করে আবার নেমে এসে দিদার রান্না দেখতে লাগলাম।
দিদা আর তার মেয়ে বেবি পিসি দু’জনের মত তরকারি হল – চিতি কাঁকড়ার ঝাল। মা যেমন মাছের ঝাল করে, তেমন নয়, মশলাদার। প্রথমে ডুমো আলু ভেজে নিল দিদা। তারপর নুন হলুদ মাখিয়ে চিতি কাঁকড়াগুলো ভেজে নিল। এবারে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, লঙ্কা দিয়ে কষে ঝোল বানিয়ে নিল, তারপর আলু আর কাঁকড়া-ভাজা ঝোলে দিয়ে ফুটিয়ে নিল। শেষে মেশাল কাঁচা গরম-মশলা বাটা।
বিয়ের পরে আমি চিতি কাঁকড়া খেয়েছি। এখানে তেঁতুল দিয়ে টক রান্না করা হয়। কাঁচা বা পাকা দু’রকম তেঁতুলেই হয়। কাঁচা তেঁতুল দিলে, ওগুলো আগে সেদ্ধ করে শাঁস বের করে নিতে হয়, আর টকে মিষ্টি পড়ে না। কিন্তু পাকা তেঁতুলে করলে মিষ্টি পড়ে। আর ফোড়নেও একটু তফাৎ আছে। পাকা তেঁতুলে পাঁচ ফোড়ন, শুকনো লঙ্কা আর কাঁচা তেঁতুলে সর্ষে ফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা। সে যাই হোক, ঐ ঘটনা ঘটার পরে রান্নার সময়ে আমাদের খাট থেকে নামা বন্ধ হল। তাই ঐ জানলাই ছিল আমাদের জগৎ। আইসক্রিম-ওলা, ঘুঁটে-উলি, বাসন-উলি – যে-ই রাস্তা দিয়ে যেত, তাকে দু’জনে ডাকতাম। কেউ হাসত, কেউ রাগ করত।
সেটা ১৯৭৫ সাল। মর্নিং ইস্কুল। ভোরবেলায় বাবার সঙ্গে পাঁচমাথার মোড় থেকে হেঁটে ইস্কুলে যেতাম। আর দোকান, দেওয়াল – এ সবে কী লেখা আছে – ড্যাবডেবে চোখ দিয়ে গিলতাম। ইস্কুলে সবার নাম লেখা দুটো করে ন্যাপকিন, থালা, গেলাস ছিল। একটা ভাঁজ করে গলায় গুঁজে ঝোলাতে হত। আর একটা টেবিলে পেতে থালা রাখতে হত। টিফিন ইস্কুল থেকেই দিত – দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট, একটা রসগোল্লা, কোনোদিন বাপুজি কেক। খেতে খুব দেরি হত আমার, আসলে লজেন্স খেয়ে খেয়ে পাশের দাঁতে ব্যথা, সামনের দাঁত দিয়ে কুটকুট করে পাকলে পাকলে খেতাম। খাওয়ার পর সবার ফোল্ডিং খাট ছিল, সেখানে ঘুমোতে হত। তিনজন মিস ছিলেন – মিস চৌধুরী, মিস ব্যানার্জি আর মিস বোস। মাঠে খেলা, নাচ গান, ব্রাশ দিয়ে বালি খেলা আর হাতের কাজ, আঁকা, কাঁচি দিয়ে গোল কাটা – এইসব হত। কিন্তু মনে হত, ইস্কুলটা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত। আর বিকেলে মা যখন নিতে যেত, ভীষণ রেগে মাকে বলতাম, আমার ওভার টাইম হবে না মা? আমার বুঝি কিছু জরুরি নেই? আমাকে দেশের দরকার লাগবে না! মা গম্ভীর হয়ে বলত, সে তো বটেই, তোমাকে দেশের খুবই দরকার। একটু বড় হলেই ওভার টাইম হবে। মায়ের কথা শুনে, বড় হলে, দেশ ঠিক কী করতে বলবে, এসব আকাশ পাতাল ভাবতে বসতাম।
কে জি টু তে উঠে গেলাম। আর কতদিন লাগবে? এখনো তো দেশ কিছুই বলছে না। বললে আমি জানবোই বা কী করে? চিঠি দেবে? রাঁচি থেকে বড়দাদুর চিঠি আসে। আমার চিঠি বাড়িতে আসবে নাকি ইস্কুলে? আমাদের ব্লকে পোস্টম্যান ঢুকলেই লক্ষ্য রাখতাম, আমার নামে কোনো চিঠি এল? কিন্তু এই চিঠির অপেক্ষায় থাকাটা কাউকেই বলিনি, মাকেও না।
আমি ওয়ানে উঠলাম। মা নিবেদিতা ইস্কুলে প্রাথমিক বিভাগে পড়ানোর চাকরি পেল। আমিও মাল্টিপারপাস ছেড়ে নিবেদিতায় ভর্তি হলাম। মায়ের চাকরি পাবার পর আমাদের রোজকার খাবারের প্যাটার্নে একটু বদল এল। এই প্রথম পাঁউরুটি এসে রুটির জায়গা দখল করল। আলুভাতে, ডিমসেদ্ধ দিয়ে ভাত খাওয়াটা ঘনঘন হতে লাগল। খাওয়ার বদলের সঙ্গে বাইরের জগতেও অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছিল। ওয়ানে ভর্তির পর থেকেই দেওয়ালের লেখাগুলো অনেক বদলে যাচ্ছিল। নিবেদিতা লেনের দেওয়ালে লেখা ছিল – বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। সঙ্গে চাষীর ছবি। লাইনটা বেশ মনে ধরল, ছবিটাও। মাকে দেখালাম। মা বলল, ওটা সুকান্ত-র কবিতা। বাবাকে ধরলাম, সুকান্ত কে? বাবা মায়ের দিকে তাকাল। মা সংক্ষেপে দেওয়ালের কথা বলল, আরও জুড়ে দিল – কাগজ আর দেওয়াল পড়ে পড়ে এই সব রাজনীতির দিকে নজর পড়েছে মেয়ের। দিনরাত এটা ওটা প্রশ্ন। বাবা কোনো কথা বলল না। কিন্তু পরের দিন একটা বই ধরিয়ে দিল আমার হাতে। নামটা সুকান্ত সমগ্র। আবার কিছুদিনের খাদ্য পেয়ে গেলাম। মাকে সকালে সব রান্না করে, বাসন মেজে গুছিয়ে, মেঝে মুছে, আমাদের রেডি করিয়ে, নিজে রেডি হয়ে ইস্কুল বেরোতে হত। আবার ফিরে এসে জলখাবার, রাতের রান্না সব একাহাতে করতে হত। মা সবসময়েই খুব তাড়াহুড়োয় থাকত। তার মধ্যে আবার আমি নানান প্রশ্ন করে মাকে পাগল করে দিতাম। ইস্কুল যাওয়ার পথে দেওয়াল জুড়ে রাক্ষসীর ছবি আঁকা থাকত, বড় বড় নখ-ওলা, তাতে রক্ত পড়ছে।
- মা দেওয়ালে এত রাক্ষুসী কে আঁকে বল তো?
- রাক্ষুসী? ও! ঐ ইন্দিরা গান্ধীকে আঁকে।
- ই-ন্দি-রা গান্ধী! সে তো দারুণ দেখতে। দিল্লীতে থাকে। সিনেমার আগে, যার সিনেমা হয় – সে-ই তো? তার হাতে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে থাকে? রাক্ষুসীর পাশে আঁকা থাকে।
- আমি ওসব বলতে পারব না। বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
বাবা ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিল। মাঠে ফুটবল খেলা হলে যেমন কয়েকটা দল থাকে, দেশ চালাতে গেলেও তেমন। লোকে যাতে চিনতে পারে, তাই সব দলের একটা করে ছবি আছে। যে জিতে যায়, সে দিল্লিতে থাকে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে থাকে, মানে জিতে গেছে। তার ছবি হল গাই বাছুর। আর তারা-হাতুড়ি-কাস্তে হল তার শত্রু। তাই রাক্ষুসী আঁকে। তবে কি বড় হলে ইন্দিরা গান্ধীই চিঠি দেবে আমাকে? কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম ইন্দিরা গান্ধী খেলায় হেরে গেছে। থমথমে মুখে ঘুরতে লাগলাম, আমার চিঠির কী হবে? মা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,
- কী হয়েছে?
আমি এবারে ভেঙে পড়লাম।
- সেই কেজি ওয়ান থেকে অপেক্ষা করছি। ভেবেছিলাম ইন্দিরা গান্ধী চিঠি দেবে ওভারটাইমের জন্য। সে হেরে গেছে। আমি তাহলে দেশের দরকারে লাগব কী করে?
চোখে জল চলে এল আমার। মা একটু সময় নিয়ে ব্যাপারটা বুঝল, আমার সমস্যাটা কী? তারপরে বলল,
- তুমি ভুল বুঝে কষ্ট পাচ্ছ। দেশ ঐভাবে চিঠি দেয় না। দেশ কী চায়, সেটা বইতে লেখা থাকে। আর খেলতে গেলে হারজিত হবেই। কখনো মোহনবাগান জিতবে, কখনো ইস্টবেঙ্গল। এতে দুঃখের কিছু নেই।
আমি কান্না ভেজা গলায় বললাম,
- তা সে কোন বইতে দেশের দরকার লেখা থাকে, সেটা কী তোমার কাছে আছে? আমি পড়তাম তবে।
মা তখন হাতের কাজ ফেলে উঠে খাটের তলায় বইয়ের পাঁজা থেকে একটা বই বার করে গল্প পড়ে শোনাল। বইয়ের নাম রামকৃষ্ণের কথা ও গল্প। ধর্মব্যাধের গল্প। একজন ব্যাধ নিজের সব কর্তব্য পালন করত, কোনো অহঙ্কার করত না, অন্যের ক্ষতি চাইত না। তাই সে সত্যিকারের জ্ঞানী হল, সন্ন্যাসীকে অবধি উপদেশ দিতে পারত। গল্প পড়া শেষ করে মা বলল, যার যা কাজ, সে সেটা মন দিয়ে করলেই দেশ খুশি হয়। দেশকে খুশি রাখাটাই সবার কাজ।
- আমি এখন কী কাজ করে দেশকে খুশি করতে পারি।
- পড়াশোনা করে।
- পড়াশোনা করা দেশের কাজ? সবাই তো করে না।
- বয়েস অনুযায়ী কাজ বদলায়। ছোটদের কাজ পড়াশোনা।
এই বলে মা আর একটা পুরোনো বই বার করল। বলল,
- পড়, কী লেখা আছে।
বানান করে দেখলাম লেখা আছে – ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ। মানেটা মা বলে দিল, ছোটদের কাছে বই পড়াটাই সাধনা। দেশের জ্ঞানী ঋষির কথা। বুক থেকে পাথর নেমে গেল। বাড়িতে বসে মন দিয়ে বই পড়লেই দেশ খুশি হবে। এই এত সহজ কথাটাই জানতাম না। মায়ের সঙ্গে আগেই আলোচনা করা উচিত ছিল। মা দেখছি সবই জানে। বাবার ডাক্তারি বই অবধি ঘেঁটে ঘুঁটে দেখতে লাগলাম, বাংলায় কিছু আছে কিনা। পেয়েও গেলাম বাংলা মেটেরিয়া মেডিকা। তারপর একদিন খবরের কাগজের মধ্যে একটা চকচকে বই এল – শুকতারা। বাবা বলল, এবার থেকে তোমার জন্য প্রতি মাসে শুকতারা আসবে। এখন এটা পড়, মেটেরিয়া মেডিকা পরে পড়বে। সেই থেকে মা-বাবার কথামত বই পড়ে চলেছি। বইয়ের বাইরে তেমন করে কিছু আর শেখা হল না। ডাকঘর পড়েছি। রাজার চিঠি আসে কিনা জানি না। ২০১২ সালে যখন কলেজের টিচার ইন চার্জ হলাম, মমতা ব্যানার্জির সই করা চিঠি পেয়েছিলাম নারী দিবসে। নারী প্রশাসক হিসেবে অভিনন্দনের চিঠি, সঙ্গে বড় প্যাকেট মিষ্টি, ফুলের বোকে। কম্পিউটারের ডাটা অ্যালগোরিদমের কারসাজিতে, জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদীর ছবি আর সই দেওয়া ইমেলও পেয়েছি বার দুয়েক। আমি নিজের মনে হাসি, দেওরঝিকে জিজ্ঞেস করি,
- হ্যাঁ রে, দেশ কি সত্যি জানতে পারে, কী কাজ করি আমি?
- পারে জেঠিমা। এই যে আমরা জানছি। আমরাও তো দেশ। এক দেশের মধ্যে আছে অনেক অনেক দেশ।
বক্সি বাড়ির রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একরত্তি মেয়ের মুখে এই কথা শুনে হতবাক হয়ে যাই। ওর গুগল-গোলা মনেও কত পরিণত চিন্তা – এক দেশের মধ্যে আছে অনেক অনেক দেশ।
দেওরঝি বলে,
- জেঠিমা, ছোটবেলায় ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি পাবে ভাবতে পেরেছিলে বলেই না বড়বেলায় অন্তত মমতা ব্যানার্জির চিঠি পেলে। ধন্য তোমার অধ্যবসায়।
আর মেয়ে মুখ টিপে হেসে বলে,
- মা তুমি জয়া ভাদুড়ি
- মানে?
- বুঝতে পারছ না মা, তুমি ধন্যি মেয়ে।
- অ্যাই, মার খাবি এবার।
ততক্ষণে খাওয়া শেষ। পিল পিল করে দুই মেয়ে পগার পার।
দৌড়োতে গিয়েও পিছন ফিরে দেওরঝি বলে যায়, “তুমি সেই কবে তিন বছর প্রশাসক ছিলে, তখন রাজার চিঠি, ফুল, মিষ্টি পেয়েছ জেঠিমা। পঁচিশ বছর ধরে পড়াচ্ছ, শিক্ষক হিসেবে পাওনি। কেউ পোঁছেনি।”
মেয়ে দুটো সত্যি খুব পেকেছে। তবু ওর কথা শুনে ক্ষণিক থমকাই। মনে ভেসে আসে অজস্র রাখি, হাতে আঁকা কার্ড, সিনারি, পোট্রেট, কত লেখা, ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসার উপহার। মুখে বলি,
- ওরে পাগল, শিক্ষকের রাজার চিঠিতে কি প্রয়োজন? জানিস না, কেবল স্বদেশে পুজো পান রাজা আর শিক্ষক সর্বত্র পূজ্যতে!