গরমের ছুটিতে বসিরহাটের আড়বালিয়াতে থাকতাম। আমরা বলতাম দেশে যাওয়া। সকালে বড়জেঠুর সঙ্গে দুধ আনতে যেতাম। বড়জেঠু বণিকপাড়ায় বাজার করত। আমরা বলতাম বেনেপাড়া। দুপুরে বড়জেঠু গোল ল্যাংড়া গাছে উঠত, লম্বা বাঁশের ডগায় তিনকোণা জাল। জায়গামত টান দিতে পারলেই জালের মধ্যে চার-পাঁচটা আম চলে আসত। নিচে আমি ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, অনেক উঁচুতে আমের ডাল আর পাতার আড়ালে বড়জেঠু অদৃশ্য, খসখস আওয়াজ, পাতার ফাঁকে রোদ্দুর চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মনে একটু একটু ভয় হত, বড়জেঠু কই? তারপরই পাতার আড়াল থেকে ডাক পড়ত, মনা ধরবি। ওপর থেকে নামছে প্রতিবারে পাঁচ-ছ’টা আম। ঝুড়িতে ক্যাচ লুফতে পারলে আম ফাটবে না। মাটিতে পড়ে গেলে দৌড়ে দৌড়ে কুড়িয়ে নিতাম। নাতনি হবার আগে অবধি আমি ছিলাম বড়জেঠুর ‘মনা’। যখন বড় হয়ে গেলাম, আর বড়দিদির কোলে আমাদের পরের প্রজন্মের প্রথম কন্যা এল, সেই স্বাতীই হল পরিবারের নতুন নক্ষত্র, ঐ মিষ্টি তারাকে মনা নামটা ছেড়ে দিয়ে আবার হলাম ‘টুম্পা’। আমার বোনের ঝুম্পা নামটা অনেক দিন আগেই ঝুমু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার নাম বদলায়নি। শুধু বড়দাদা টুমু বলে ডাকত।
ভাইবোন প্রায় সবারই বিভিন্ন নাম ছিল। যেমন, সেজ তরফে ছোড়দার নাম মৃণাল, কিন্তু সেজজেঠু ডাকত ঝুকু। বড়তরফে সেজদা, ন’দা ছিল সুজিত আর অভি। কিন্তু আমার বাবা ডাকত ভুটে আর ভোকো। আর সবচেয়ে ছোটো ভাই - তার প্রতি বাড়িতেই আলাদা নাম। বড় তরফে রিন্টু, মেজতরফে ভন্টা, নিজের বাড়িতে বাবু আর ছোটো তরফে বুকু।
চার বাড়ির রঙতামাশা
সবাই চেয়ে দ্যাখ।
বাড়ি যখন চারটে,
তবে নাম কি হবে অ্যাক? - কক্ষনো হবে না।
সেজদা আর ন’দা আমাকে সুপুরি পাতায় বসিয়ে টেনে নিয়ে যেত। দাওয়ার সামনে ঝাঁকড়া খেজুর গাছ। সকালে তার তলাটা খেজুর বিছিয়ে গদি হয়ে যেত। পাতার গাড়ি থেকে কুড়িয়ে নিতাম একমুঠো, ছোট্ট হাতে যে ক’টা ধরে। উঠোন থেকে বেরনোর মুখে, ভাঙা পাঁচিলে একটা দরজা ছিল, সেই জায়গাটা পাতা সমেত কোলে করে দাদারা পার করে দিত। বাজারেও নিয়ে যেত – কোলে করে – কারণ আমায় হাঁটিয়ে নিয়ে গেলে ওদের দেরি হয়ে যাবে। বিশুর মিষ্টির দোকানের সামনে এলেই বায়না করতাম। দাদারা পকেট থেকে নয়া পয়সা গুনেগেঁথে হিসেব কষে তিলকাঠি কিনে দিত। চুষতে চুষতে বাড়ি আসতাম, দাঁতে চিটচিটে তিল আটকে যেত। আর একটা খুব বায়নার জিনিস ছিল, কাঠির মাথায় গোল ফ্রেমে ঘেরা, লাল অনচ্ছ কাগজ মোড়া – কটকটি বাজনা।
বিকেল হলে ছোড়দিদি আর ছোড়দার সঙ্গে বাড়ির পিছনে জমিতে নামতাম। ছোড়দিদি আমাদের খেজুর পাতার ঘূর্ণি বানিয়ে দিত। কখনও ঢেসকুমড়ো হয়ে ছোড়দিদির পিঠে চড়তাম। তারপর একটা খেজুর ছড়ি হাতে, মরা গাছের গুঁড়িতে ছোড়দিদি শিবাজী হত। রোজ রোজ শিবাজীই বা হত কেন, সেটা অবিশ্যি আজও জিজ্ঞেস করা হয়নি। যাই হোক, আমরা হতাম শিবাজীর বিশ্বস্ত অনুচর। কোনো-কোনোদিন দলবেঁধে সব ভাইবোন বড়পোলে যেতাম। জলকড়ের মধ্যে দিয়ে আলপথে সাবধানে লাইন করে জলের মাঝখানে চওড়া জায়গা দেখে পশ্চিম মুখে বসে সবাই গল্প করতাম। জলের মধ্যে সূর্য ডুবত। লাল কমলা আকাশের ছায়া পড়ে জলে, তার সঙ্গে মিশে যেত দিনের শেষ রোদ্দুরের সোনালি। কোনোদিন আবার আইসক্রিম-ওলা আসত মাথায় বাক্স নিয়ে। বরফের মধ্যে কাঠি হিসেবে গাছের নরম ডাল, বা ডাবের খোলার সরু অংশ লাগানো থাকত। ছোড়দিদি শিখিয়ে দিয়েছিল, আইসক্রিমের শেষটা খাবি না। ঘষে ঘষে ঘামাচিতে লাগাবি। খুব আরাম।
সারাদিন হুটোপাটি করে সন্ধেবেলায় ঘুম আসত। দাদারা পড়তে বসত। আমি আর বোন তো ছুটিতে গেছি, লেখাপড়ার বালাই ছিল না। তবে মাঝে মাঝে সেজজেঠুর ঘরে, অঙ্কের শিবির বসত। এক মাদুরে যে যার লেভেলে অঙ্ক কষত। আমার তো খাতা নেই। ছোড়দা ওর খাতার মাঝখান থেকে পাতা ছিঁড়ে আমায় দিল। আর তাতে কী অঙ্ক করছি, নষ্ট করছি কি না – নজর রাখতে লাগল। আমিও যতটুকু জানি, যোগ বিয়োগ বানিয়ে নিয়ে করছি। ছোড়দা বলল, ও! শুধু যোগ বিয়োগ জানিস, আয় তোকে সরল শিখিয়ে দিচ্ছি। সরল আবার কি? যা শেখাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ জটিল। ইস্কুলে শেখায়নি, আমি তো কিছুতেই শিখবো না। শেষে ছোড়দা নিরস্ত হল, কারণ রাত্তিরে খাবার ডাক পড়ে গেল। বড়জ্যাঠাইমার বাঁশে ঘেরা রান্নাঘর, মাটির মেঝে নিকোনো। মাটির মধ্যে গর্ত করে উনুন। শুকনো কাঠ আর পাতার জ্বালানে রান্না হত। মা বলত কাঠে রান্না শহরের কুকিং গ্যাসে রান্নার মত, এমন আঁচের তেজ – খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয়। আর অদ্ভুত নৈপুণ্যে বড়জ্যাঠাইমা আঁচ কমা-বাড়া নিয়ন্ত্রণ করত। সবাই আসন পেতে খেতে বসতাম, থালার পাশে মাটিতে নুন নিতাম। যেদিন বড়জ্যাঠাইমা আস্ত কাঁচালঙ্কা দিয়ে গরম গরম বড়ি সেদ্ধ করত, সেদিন ভাতের স্বাদ ডবল হয়ে যেত। আমি এখনও বড়ি সেদ্ধ করি, লোক দিয়ে বড়ি করাতে হয়। তবে স্বাদে বড়জ্যাঠাইমার মত হয় না। আর আড়বেলের ঐ বড়ি ছাড়া দোকানের কেনা বড়ি দিয়ে বড়ি সেদ্ধ করা যায় না। প্রথমে বড়ি হাল্কা ভেজে নিতে হয়। তারপর তেলে অল্প পাঁচফোড়ন আর কয়েকটা কাঁচালঙ্কা দিই। ঐ তেলে হলুদ নুন জল দিয়ে ঝোল ফুটলে, তাতে বড়িগুলো দেওয়া হয়। ঝোলের রং কাঁচা সোনার মত হবে। বড়ি ফুটে ঝোলে বেশ টোপলা হবে। খুব বেশি ঝোল থাকবে না, আবার শুকনোও হবে না। নুনের স্বাদ দেখে, কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামাতে হয়। বাজারের কেনা বড়ির সহ্যক্ষমতা কম। ফুটলে ভেঙে যায়। ছোটবেলায় শীতকালে আমাদের বাড়িতেই বড়ি হত। সে এক যজ্ঞ। পুরোনো বাড়ির টালির চালে চালকুমড়ো থাকত। সব বাড়ির কোটা হিসেব করে বিউলির ডাল আসত। ডাল বাটতে বড়ি দেওয়ার আগের রাতে লোক আসত। তাকে কেজি-প্রতি টাকা দিতে হত। আমাদের ঠাকুরদার আদি বাড়ি ছিল টালির চালের। সেই চালে প্রচুর চালকুমড়ো হত। কিছু চালকুমড়ো রেখে দিয়ে পাকানো হত। বড়ি দেওয়ার আগের দিন সেই শুকনো বুড়ো চালকুমড়োগুলো খুব ভালো করে কোরানো হত। ডালবাটার পরে প্রথম পর্যায়ে ডালটা ফেটানো চলত বেশ কিছুক্ষণ। রাতে ভালো করে কাপড় ঢাকা দিয়ে ডালবাটা আর চালকুমড়ো কোরা রেখে দেওয়া হত। খুব ভোরে মেজজেঠুদের ছাদে বাড়ির সব মেয়েরা বড়ি দিতে বসত। কাঁসিতে ভাগ ভাগ করে মণ্ড নিয়ে সব মেয়েরা একেবারে মেশিনের মত হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডাল ফেটাত আর একটু একটু করে চালকুমড়ো কোরা মেশানো হত। সবার পাশে একটা জলের বাটি থাকত। ঐ বাটির দু’টো কাজ। হাত শুকিয়ে গেলে হাতটা জলে ভিজিয়ে নেওয়া যেত, আর ডাল ফেটাতে ফেটাতে একটুখানি জলে ফেলে দেখতে হত মণ্ডটা ঠিকমত জলে ভাসছে কি না। ফেটানো ঠিকমত হলে, ডালের মণ্ড চোখে পড়ার মত সাদা হয়ে যেত। প্রতিবারই আমি যখন চোখ-মুখ ধুয়ে ছাদে উঠি, তখন অর্ধেক কাজ শেষ। হাত ধুয়ে শখ করে বড়ি দিতে বসি। বড় বড় ধুতি টানা লম্বা করে পেতে, তার নানাদিকে মেয়েরা বড়ি দিচ্ছে। আমি খুঁজে পেতে সেজজ্যাঠাইমার পাশে একটু জায়গা করি। কিন্তু ঐ পিচ্ছিল মণ্ড বাগে আনা কি অতই সোজা! যতই চেষ্টা করি, হাতে মাখামাখি হয়ে যায়, আর বড়ি শুয়ে পড়ে। কিছুতেই মাথা ওঠে না। সেজজ্যাঠাইমা চোখ টিপে বলে, অ্যাই টুম্পা, তুই ওদিকটায় বড়ি দে। এদিকে তো ভরে এল। আমি অগত্যা ঠেলেঠুলে আবার ছোড়দিদির পাশে যাই। অবাক হয়ে দেখি, বড়জ্যাঠাইমা তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝখান দিয়ে পুটুর পুটুর করে একবারে ছোট্ট ছোট্ট বড়ি দিয়ে যাচ্ছে, সব এক মাপে। ছোড়দিদি কিছুক্ষণ চেষ্টা চালায়, যাতে আমি একটু একটু মণ্ড নিয়ে বাটির কানায় আকৃতিটা আনতে পারি, তবু ঠিক হয় না। শেষে হাল ছেড়ে বলে, তুই ওখানটায় বড়ি দে। আমার দেওয়া চ্যাপ্টা বোতাম বড়িগুলো যার কাজের পাশে থাকবে, তারই বদনাম। ঘুরে ঘুরে যে বড়ি দেখব, তার উপায় নেই – কারণ বড়িতে ছায়া পড়বে। বড়িতে ছায়া দিতে নেই। দুপুরের ঝনঝনে রোদ খাওয়ানোর পর, বড়ি সমেত ধুতি গুলো টাঙিয়ে দেওয়া হত, যাতে উল্টো দিকটাও শুকিয়ে যায়। বিকেলের রোদ ঢলে যাবার আগে ধুতিগুলো নামিয়ে এনে দাওয়ায় কাপড় শুকোনোর দড়িতে টাঙিয়ে দেওয়া হত। শিশির লেগে গেলে বড়ি ঘেমে যাবে। রোদ খেয়ে ঝকঝকে সাদা বড়িগুলো যেন জুঁই ফুল। আমি আর বড়জেঠু পুট পুট বড়ি ছাড়িয়ে কৌটোয় পুরতাম। তখন আর কেউ বারণ করত না। ঐ কাজটায় শিশুর আঙুল সুবিধেজনক।
সকলে টানা বারান্দায় আসন করে খেতে বসতাম। দাদারা খাওয়া হয়ে গেলে পরিবেশন করত। আমি ঘুরঘুর করতাম, কিন্তু কেউ ডাকত না। শেষে একদিন মেজজ্যাঠাইমা বলল, দাদা জল চাইছে, জল দে দেখি – কেমন পারিস। মনের আনন্দে পেতলের সরু মুখ জলভরা জগ থেকে জল দিলাম মাটির গেলাসে। সে দেওয়ার এমনই বেগ, যে গেলাস থেকে জল ঠিকরে বড়দাদার কোলে পড়ে গেল। মা তো রৈ রৈ করে উঠেছে। আর আমি লজ্জায় মৃত। কিন্তু বড়দাদা বলল, টুমু ঠিকই দিয়েছে। জল প্রথমে গেলাসেই পড়েছিল, এভাবেই হবে। যাই হোক, মায়ের শাসনে সে যাত্রা পরিবেশনের ইতি হল। এইভাবে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে ঘরের কাজ কিছু শিখলাম বটে, তবে প্রশ্রয়ের চোটে আজও দড় হতে পারলাম না।
একদিন হল কি, বিকেল বেলা শিবাজীর রাজসভার কাজ সেরে বিকেল গড়িয়ে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার পথে লেবু গাছের তলায় কুড়িয়ে পেলাম বেশ বড় সাইজের রসে টাপুটুপু পাতিলেবু। আর আমার আনন্দ দেখে কে! কালবোশেখির ঝড় উঠলে দাদারা আম কুড়োত। মা আটকে রাখত, আমায় যেতে দিত না। ঝড়ের পরে গেলেও আমি একটাও পেতাম না। সব দাদারা কুড়িয়ে নিত, আর আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘরে ফিরতাম। শেষে ন’দা নিজের থেকে একটা আম নিয়ে বলল, এটা তুই নে। কিন্তু ওভাবে নিলে প্রেস্টিজ থাকে না। তাই আমি বললাম, তুই মাটিতে ফেল, আমি কুড়োব। নদা তখন ধুপ করে আমটা মাটিতে ফেলল, আমিও কুড়িয়ে নিয়ে নাচতে নাচতে ঘরে গেলাম। হরির লুঠের বাতাসাও পেতাম না। পরে যোগাড় করতে হত। সবাই হাসত। সেজজেঠুর বাড়ির গৃহপ্রবেশেও আমি খুচরো পয়সা কুড়োতে পারলাম না। সেজজেঠু সেটা দেখে আমার জন্য আলাদা করে ঝুরঝুর করে পয়সা ফেলল, আর আমি ফ্রকের কুঁচি পেতে নয়া পয়সাগুলো ধরে নিলাম। সামনে যারা ছিল, সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। সেজজেঠু চোখ পাকিয়ে সবার হাসি থামাল। আমি খুব সাবধানে ফ্রকের মধ্যে পয়সা ধরে মাকে দিয়ে দিলাম। পয়সার দরকার ছিল না, কুড়োতে পেরেছি – সেটাই আনন্দ। এ হেন আমি সেদিন কারোর সাহায্য ছাড়াই লেবু কুড়িয়ে পেলাম। সে এক রাজ্যজয়ের সামিল। কিন্তু যেই মেজজেঠুদের খিড়কি দরজা এল, ছোড়দিদি একটানে আমার হাত থেকে লেবু ছাড়িয়ে, দে ছুট। একলাফে ঘরে ঢুকে গেল। আর সেই অপ্রত্যাশিত আঘাতে খিড়কি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ফোঁপাতে লাগলাম। মেজজ্যাঠাইমা তখন বাঁশে ঘেরা রান্নাঘরে রান্না চাপিয়েছে। বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে বেশ দেখা যায়। কতক্ষণ সময় গেল। মনের কালি বাইরে ছড়িয়ে ঝুপসি গাছগুলোতে আঁধার করে এল। এমন সময়ে হাতে অ্যাটাচি নিয়ে ধোপদুরস্ত মেজজেঠু অফিস থেকে ফিরল। আমাকে দেখেই টপ করে কোলে নিয়ে বলল
- কাঁদছ কেন?
এতক্ষণে সহানুভূতির ছোঁয়া পেয়ে আমার কান্নার উচ্ছ্বাস প্রবল হয়ে উঠল। কোনোক্রমে বললাম
- ছোড়দিদি আমার লেবু নিয়ে নিয়েছে।
- লেবু নিয়ে নিয়েছে? ভারি অন্যায়। আজই ছোড়দিকে কেটে ফেলব। ক – ই – গো, দা-টা দেখি।
রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসে
- কেন? রাতবিরেতে দা নিয়ে কি হবে?
- এই যে, মমকে কাটব। ম – ম!
ফ্রক পরা মম এসে দাঁড়ায় মাটির দাওয়ায়। আর লেবুটা ছুঁড়ে দিয়েই পালিয়ে যায়। লেবু আবার আমার হয়। মেজজেঠু বলে – ছোড়দি তো লেবু দিয়ে দিয়েছে, এবারে আর ওকে কাটার দরকার নেই। আমিও লেবু যুদ্ধে জিতে ঘরে ফিরে যাই। মায়ের হাত ঘুরে বড়জ্যাঠাইমার রান্নাঘরে সেটার সদগতি হয়।
গরমকালে কাঠফাটা রোদে পাকা পাকা আম পাড়া হত। জ্যাঠাইমারা উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে আমের শাঁস ছাড়াত। ছোটো চটের টুকরোর এক প্রান্ত বাঁশে বাঁধা থাকত। চটের তলায় চওড়া কানা উঁচু অ্যালুমিনিয়ামের কাঁসি থাকত। বাঁহাতে চটের অন্যপ্রান্ত ধরে, ডানহাতে টুসটুসে আম সেই চটে ঘষত বড়জ্যাঠাইমা, আমি দেখতাম। রসগুলো চটের নিচে কাঁসিতে জমা হত, আর শোঁয়াগুলো চটে আটকে যেত। বড় বড় চাটাইয়ের আসন ধুয়ে মুছে রোদে শুকিয়ে তেল মাখিয়ে রাখা থাকত। যেমন যেমন কাঁসিতে শাঁস জমত, তেমন তেমন চাটাইয়ে একস্তর করে মাখানো হত। ঐ স্তরটা কিছুটা শুকোলে আবার পরের স্তর চাপানো হত। কাজ শুরু হত সকাল সকাল। উঠোনে সারা দুপুর ঝনঝনে রোদ খাওয়ানোর পরে চাটাইগুলো তুলে ছাদের আলসেতে কাপড় শুকোনোর মতো টাঙিয়ে দেওয়া হত। কারণ দুপুর ঢলে গেলে রোদ উঠোনে আর থাকত না, ছাদে উঠত। আর একটা কারণ হল – আমসত্ত্ব পাহারা না দিলে কাক, চড়াই, কুকুর, বিড়াল, ছাগল – আর যে যে আছে, সব ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ করবে। আর সারাদিন আমসত্ত্বের জন্য ছাদে বসে থাকাটা খুব চাপের। বিকেলের রোদ পড়ে এলে, শুকনো কাপড় তোলার মতো আমসত্ত্ব তোলা হত। তারপর শুধু মিনিট গোনা, কখন চার বাড়ির ভাগে ভাগে আমসত্ত্ব পড়বে। আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুরব। এখন দিনকাল বদলেছে। মেজজ্যাঠাইমা বলে দিয়েছে যে আমসত্ত্ব খেতে ইচ্ছে হলে পাকা আমের শাঁস মিক্সার গ্রাইন্ডারে ভালো করে পিষে কড়ায় আঁচে একটু পাক করে নিতে হবে। তাহলে শুকোতে সুবিধে হবে। থালায় তেল মাখিয়ে আমের শাঁসের স্তর মাখানোর নিয়মটা একই। রোদে শুকোনো হবে। কিন্তু থালার সমস্যা হল পিছন দিকটায় হাওয়া লাগে না। তাই তোলার মত হলে উল্টে নিয়ে আবার শুকোতে হবে। ফ্ল্যাটের জানলায় বা বারান্দায় সারাদিন তো রোদ আসে না। কাজেই বেশ কয়েকদিন লাগবে শুকোতে। মেজজ্যাঠাইমা আমের জেলিটা ভীষণ ভালো করে। আমার কাছে পৃথিবীর সব জেলির চেয়ে ভালো ওই জেলি। কাঁচা আম ছাড়িয়ে প্রথমে ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হয়। এবারে সেদ্ধ আম একটু ঠান্ডা করে চটকে নিতে হবে। তার পর কড়ায় চিনির রস পাক করে তাতে পরিমাণমত আদার রস আর নুন মেশাতে হবে। এই রসে এবার আমের শাঁসটা দিয়ে ফোটাতে হবে। ব্যস, তৈরি আমের জেলি।
বড়জ্যাঠাইমা খুব ভালো গুড়-আমের মোরব্বা করতে পারত আর সেজজ্যাঠাইমার মা দারুণ চিনি দিয়ে আমের মোরব্বা করতে পারতেন। মোরব্বার ক্ষেত্রে কাঁচা আমের নির্বাচন যদি ঠিক না হয়, তবে ব্যর্থ হতে হবে। আমের আঁটি হয়নি – এতটা কচি আম যেমন চলবে না, তেমন আঁটি শক্ত হয়ে গেছে – এমন আমও নিলে হবে না। দুইয়ের মাঝামাঝি দরকার, মানে নরম আঁটি যুক্ত আম চাই। এবারে আঁটির কষি বাদ দিয়ে আমগুলোকে লম্বায় চারফালি বা ছয়ফালি করতে হবে। কয়ফালি কাটা হবে, সেটা আমের আকারের ওপর নির্ভর করবে। এবারে বড়জ্যাঠাইমা আমগুলো নুনে জরিয়ে রোদে শুকিয়ে নিত। এবারে কড়াতে পরিমাণমত ঘি দিয়ে ঐ শুকনো আমগুলো ভাজত। ভাজা হয়ে গেলে গাঢ় চিনি বা গুড়ের রসে আমগুলো ফুটবে। কারোর ইচ্ছে হলে ঐ পাকে আদার রস মেশানো যায়। মোরব্বা তৈরি হলে আঁচ থেকে নামিয়ে এলাচ গুঁড়ো মেশাতে হবে।
আড়বালিয়ার নিজস্ব কিছু স্বতন্ত্র রান্না ছিল। যেমন টুসটুসে-লাল, পাকা পুঁই মিটুলির চচ্চড়ি। স্বাদেও যেমন, আর ভাতটা রসে পুরো লাল হয়ে যেত বলে, এই তরকারিটা আরও বেশি বেশি ভালোবাসতাম। শীতকালে কাঁচা টমেটো দিয়ে পুকুরের টাটকা মৌরলার বাটি-চচ্চড়ি হত। আর সজনে গাছ যখন ফুলে ফুলে ভরে যেত, তখন আমি, বোন, ছোড়দিদি আর ছোড়দা সজনে অভিযানে বেরোতাম। আগান বাগান ঘুরে একটা ঠিকঠাক সজনে গাছ খুঁজে বের করা ছিল প্রথম কাজ। তারপর ছোড়দা একটা কচা গাছের ডাল যোগাড় করে সজনে গাছের উঁচু ডালগুলোতে নাড়া দিত। ফুল পড়ে গাছের তলা সাদা হয়ে যেত। ছোড়দিদির হাতে সাজি থাকত। আমি আর বোন ছুটে ছুটে সব ফুল কুড়িয়ে সেই সাজিতে জমা করতাম। ঐ টাটকা ফুল, ডুমো আলু আর টমেটো, জিরে ফোড়ন, হলুদ, নুন, মিষ্টি দিয়ে চচ্চড়ি হত। সজনে ফুলে একটু তিতকুটে স্বাদের রেশ আছে। তবে কুঁড়িতে ঐ স্বাদটা বেশি, ফোটা ফুলের স্বাদ বেশি ভালো। আজকাল তো বিদেশে এই সজনে বা মোরিঙ্গাকে উপকারিতার জন্য সুপার ফুড আখ্যা দেওয়া হয়। সজনে শাক ফোটানো জল ভেষজ পানীয় হিসেবে খাওয়া যায়। সজনে শাক, ডাঁটা, ফুল সবকিছুই ভীষণ উপকারী। আমার কর্তা কাঁচা সবুজ টমেটো, সজনে ফুল – এগুলো খেতে জানতেন না। এখন সবই শিখিয়ে নিয়েছি। আর একটা সবজি ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে টিপিক্যাল ভিলেজ ফুড – সেটা হল বিচিওলা কাঁচকলা বা ডয়রা কলার তরকারি। ঝোলের কাঁচকলার মত প্রথমে কলাগুলো লম্বায় চিরে তারপর ছোটো ছোটো লম্বা টুকরো কেটে নিতে হয়। কলার মাঝখানে লম্বা অক্ষ বরাবর বিচিগুলো সাজানো থাকে। লম্বায় চিরলে কলার সেই বিচিওলা অঞ্চলটা বেরিয়ে পড়ে। এবারে সাবধানে বিচিগুলো ছাড়িয়ে নিতে হয়। কোনো চচ্চড়িতে ডয়রা কলা যোগ করলে, স্বাদে একটা আলাদা মাত্রা যোগ হয়। এছাড়া আমাদের বাড়িতে ঘিয়ে জিরে, মরিচ ফোড়ন দিয়ে শুধু ডয়রা কলার সব্জি তরকারি বানানো হত, বেশ ভালো লাগত খেতে।