১৫
আজ লক্ষ্মীপুজো। লকডাউনে যা হোক করে নমো নমো করে সারতে হল। বইতে পড়েছিলাম লৌকিক শস্যের দেবী আর শাস্ত্রীয় দেবী মিশে গিয়ে এই লক্ষ্মী পুজোর প্রচলন হয়েছে। আমার শ্বশুর বাড়িতে শস্য পুজোর আর একরকম অদ্ভুত প্রথা আছে, তা হল মেই পুজো। চাষের সময়ে গরু বাঁধার খুঁটি হল এই মেই। মেইপুজোর কথা আমি আগে কক্ষনো শুনিনি। কৃষিজীবী পরিবারের কতরকম উৎসব - শুনলে অবাক হতে হয়। যথাসময়ে এই অদ্ভুত পুজোর গল্প বলব।
লক্ষ্মীপুজোর এই কোজাগরী পূর্ণিমাতে যেমন চন্দ্রদেবতা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, তেমনই আরও তিনটি পূর্ণিমা আছে - শ্রাবণী পূর্ণিমা বা ঝুলন পূর্ণিমা, কার্তিকী পূর্ণিমা বা রাস পূর্ণিমা আর পৌষ পূর্ণিমা বা শাকম্ভরী পূর্ণিমা - এই তিনটি পূর্ণিমার অনুষ্ঠানেও রয়েছে চাঁদের মাহাত্ম্য।
আমাদের কর্তা গিন্নি দু'জনের জীবনেই ঝুলন পূর্ণিমার স্মৃতি মনের ঝিলের গভীর স্তরে সাজানো আছে। আমার স্মৃতিতে ভরে আছে - কাঠকলে গিয়ে বস্তা করে কাঠের গুঁড়ো আনা, সেগুলো নানারকম রঙ করা, গ্রাম, শহর, জঙ্গল সব পাশাপাশি, একধারে পাহাড়, নদী, ঝরনা - সেই পাহাড়ের মাথায় শিব ঠাকুর। প্যাকিং বাক্স ওপরে ওপরে রেখে, কাদা জলে ছোপানো কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পাহাড়, কায়দা করে শিব ঠাকুর বসানো। নিচে বড় মোটর সাইকেলের পাশেই ছোট ছোট হাতির সারি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে করা একরত্তি পুকুরে উত্তরাধিকারে পাওয়া এক মস্ত পোর্সেলিনের হাঁস। আর ঝুলন যেদিন শেষ হয়, সেদিন হল রাখী। একমাস ধরে সারা দিন রাত শিফন সুতো হাতে পেঁচিয়ে, কেটে, পুরোনো টুথব্রাশ দিয়ে ব্রাশ করে করে আমরা রাখী বানাতাম, বন্ধু আর ইস্কুলের দিদিমণিদের পরাব বলে। কার হাতে কটা রাখী সেটাই ছিল স্টেটাস সিম্বল। কিন্তু কর্তার স্মৃতিটা একেবারেই অন্যরকম - কোনভাবেই আমার সঙ্গে মেলেনা, কারণ ওর স্মৃতি জুড়ে বসে রয়েছেন স্বয়ং গোপীনাথ। কর্তা বলেন আমাদের গোপীনাথের দুটো সিংহাসন ছিল। বড় সিংহাসনে তিনি সারাবছর বিরাজ করতেন। ছোটটি কাজে লাগত রাসে আর ঝুলনে।
রাস উৎসবে রাসমঞ্চে ছোট সিংহাসনের ওপরে গোপীনাথ আর রাধারানী বসতেন। তাঁদের ঘিরে বাড়িতে রাস উৎসব হত। সাত গাঁয়ের লোকের নেমন্তন্ন থাকত। একদিকে একাধিক কীর্তনের দল অষ্টপ্রহর রাসমঞ্চ ঘিরে ঘিরে নৃত্যগীতে মেতে থাকত আর অন্যদিকে চলত নিরামিষ ভোজন। রাসের এই ভোজনের খরচ চালাতেন কলকাতার চৌরঙ্গী কেবিনের মালিক রজনীকান্ত সিংহ। ভোজন আজকের নিরিখে আহামরি কিছু ছিলনা। অন্ন, ডাল, নটেশাকভাজা, চার পাঁচ রকম সব্জি আর চাটনি। সব্জির মধ্যে একটা বিশেষ রান্নার কথা জেনেছিলাম শাশুড়ি মায়ের কাছে। সেটা হল পালং শাক আর গাঁটি কচু দিয়ে ঘন্ট। এদিকে গাঁটি কচুকে বলে সারু। গ্রাম দেশের ব্যাপার তো - নানা ধরণের কচু দিয়ে হামেশাই হরেকরকম পদ রাঁধার চল আছে। শাশুড়ি মা নিজে রান্না করতেন নারকেল দিয়ে সারু কচুর দম। আঙ্গুল চেটে খেতাম আমরা। এই সারুর মাথাটাকে বলে মুঢ়া। ওটা সেদ্ধ হতে চায়না। গ্রামের সম্পন্ন লোকে কিনতে চায়না। কিন্তু গরীব মানুষ ঐ মুঢ়া কেটে কুটে সব্জির সঙ্গে টক রান্না করে। মুঢ়ার গায়ে আবার গোল গোল মুখি কচু জন্মায়, এখানে বলে বেঁজি। এই বেঁজি দিয়েও আলুর দমের মতো দম হয়। শহুরে মানুষের চোখে এসব পদ হয়তো ব্রাত্য, তবে বিয়ের পরে আমি এইসব দিশি সোয়াদেই মজেছি। প্রসাদে মেন কোর্সের পরে মিষ্টান্নের আয়োজন ছিল মনকাড়া। নানারকম মরশুমী ফলের সঙ্গে থাকত মাখন, মিছরি, নাড়ু, তালের বড়া আর মালপোয়া।
ঝুলনে উৎসব হত একটু অন্যরকম। ছোট্ট সিংহাসনের দু'পাশে শিকল বেঁধে দিতেন ঠাকুর মশাই। সেই শিকল মন্দিরের পাশে বেদীর দুদিকে দুটো বড় খুঁটিতে শক্ত করে বাঁধা হত। এবারে খুব সাবধানে সেই সিংহাসন ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সজনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিরিঝিরি বাতাস বইত। সেই বাতাস পাশের মন্দির-পুকুরের ঢেউয়ের মনের কথা পৌঁছে দিত দক্ষিণ সাগরে। তার তরঙ্গের মাথায় মাথায় ঝিলমিল করত জোছনার রুপোলি মুকুট। সেই বুনোফুলের গন্ধ মাখা বাতাসে, জলে জোছনার রাংতা বিছিয়ে রাধারানীকে পাশে নিয়ে দোল খেতেন গোপীনাথ। তাঁর পরনে আজ গাঢ় হলুদ ধুতি, সোনালি পাড় বসানো, গায়েও হলুদ উড়নি। মাথায় মুকুটে গোঁজা নতুন ময়ূরের পালক। রাধারানীকে পরানো হত উজ্জ্বল গোলাপি বস্ত্র, জরিতে চকমকি। দুজনের গলায় থাকত হলুদ গাঁদার মালা। খুঁটির দুপাশে দুটো লন্ঠন, আর সঙ্গে জ্বালানো হত অজস্র প্রদীপ। কর্তা বলেন গোপীনাথের সেই বেশ, সেই রূপ - চোখ ফেরানো যেতনা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই অপরূপ ঝুলনের সাক্ষী হতে। আকাশে বাতাসে ভরে থাকত এক মাতাল করা আনন্দের রেশ। সেই রেশ টিকিয়ে রাখতে রান্নাঘরে বানানো শুরু হত বিশেষ একটি পদ - কাঁজি। এটি একধরণের পান্তা ভাতের জল বলা যায়। তবে যে সে চালের ভাতে কাঁজি হয়না। ঘরের আমন ধানের ভাতে জল ঢেলে পান্তা করে রাখা হয়, তিনদিন তিনরাত। এবারে ঐ টকজলটা ওপর থেকে আলাদা পাত্রে গড়িয়ে নেওয়া হয়। ভাতটা বাড়ির লোক খেয়ে নেয়, কিছুটা ঘরের গরুকেও খাওয়ানো হয়। তিনদিনের বাসি টক হয়ে যাওয়া পান্তার জল রাখা হয় মাটির হাঁড়িতে। তার সঙ্গে সেদিনের সদ্য করা গরম ভাতের ফ্যান মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় মিশ্রণটি রাখা হয় চারদিন। প্রতিদিন রান্নার শেষে মরা আঁচে হাঁড়িটা বসিয়ে মিশ্রণটা গরম করে নেওয়া হয়। শেষ দিনে ওতে নুন হলুদ আর বড় বড় করে কাটা নানারকম সব্জির টুকরো ফেলে দেওয়া হয়। যেমন লাউ, মুলো, মিষ্টি কুমড়ো - এইসব। ক্ষেতের কচি মুলো ঝুঁটি সমেত হাঁড়িতে দেওয়া হত। সব্জি সেদ্ধ হতে হতে আলাদা ফোড়ন কড়ায় সর্ষের তেল গরম করে পাঁচ ফোড়ন, গোটা রসুন আর শুকনো লঙ্কা ভেজে হাঁড়িতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ভেজে রাখা মশলা বড়ি। এইভাবে শুরুর আটদিনের মাথায় কাঁজি বানানো শেষ হয়। কর্তা বলেন একবার কাঁজির স্বাদ পেলে নাকি ভোলা যায়না। হবেও বা। আমি স্বচক্ষে না দেখেছি এমন ঝুলন, না পেয়েছি কাঁজির স্বাদ। অগত্যা কল্পনা করা ছাড়া উপায়টাই বা কী!
ঝুলন হল বর্ষা কালের উৎসব। আর ঐ ঋতু হল ধান রোপণের আদর্শ সময়। শ্রাবণের রোপণে আর পৌষমাসে ধান কাটার সময়ে নাকি বাড়িতে মজুর খাটতে কেশিয়াড়ি, গগনেশ্বর আর জঙ্গলমহল থেকে আসত আদিবাসীর দল। তারা থাকত আমাদের মাটির দুর্গা মণ্ডপে। আমার কর্তা বলে যে ওরা দুই ভাই এই আদিবাসীর দল এলেই তাদের সঙ্গে জুটে যেত। বড়দের সঙ্গে কখনও সখনো তাদের নাবালক ছেলেরাও আসত। তাদের মিশকালো অবয়বে ছোট্ট কৌপীন, প্রকৃতির সাথে সহজ সখ্য, বনের সবুজের সঙ্গে অবাধ মিলমিশ এদের চোখে নেশা ধরিয়ে দিত। বড়রা সকাল সকাল হাঁড়ি ভরে পান্তা খেয়ে মাঠের কাজে নামত। আর ছোটদের ছিল অখণ্ড অবসর। ওরা নানান ছাঁদে ফাঁদ পাতত কখনও পুকুরে, তো কখনও মাঠে, জঙ্গলে। তাদের নিপুণ হাতে আদিম মাছ ধরার কৌশল দেখে এদের তাক লেগে যেত। মাঠে গেলে ওরা গর্ত থেকে মেঠো ইঁদুর বা বনবাদাড় থেকে খরগোশ ধরতে জানত অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায়। কিন্তু আমাদের বাড়িতে যতদিন তারা থাকত, ততদিন শিকার করার ওপরে থাকত কড়া বিধিনিষেধ। আর তিনবেলা পেট ভরে খাবার পাওয়ায় শিকার করার দরকারও হতনা। সহজাত প্রবৃত্তিতে কখনও শিকার করে ফেললে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে ওরা রান্না করে খেত। জমিদারের দুই বেটা সুযোগ পেলেই ইস্কুল পালিয়ে ওদের ছায়াসঙ্গী হত। যা হোক এবার মেইপুজোর গল্প বলি।
এই মেইপুজো আমি স্বচক্ষে দেখিনি, যেটুকু দেখা সেই কর্তার চোখ দিয়ে। কার্তিক মাসে পেকে ওঠা গেটি ধান কাটা দিয়ে শুরু হত ধান কাটার মরশুম। কার্তিকা গেটি চালের পায়েস গোপীনাথকে ভোগ দিয়ে সকলে মেতে উঠত নবান্ন উৎসবে। ভরা অঘ্রাণে জমির বাকি ধান সব পেকে উঠলে একরকম ধান ঝাড়ার অনুষ্ঠান হত যার নাম ‘পতুল ফেলা’। ধান হত নানা জাতের। ভুঁড়ি ধানের চাল ভেজে বাড়িতে মুড়ি বানানো হত। আবার সম্বৎসরের পুজোয় পায়েস রাঁধার জন্য চাষ হত বাদশা ভোগ ধান। সারাবছর অন্নের যোগান দিত লম্বা লম্বা বড় দানার পাটনী চাল আর মোটা বেঁটে দানার মুগি চাল। ধান কেটে আঁটি বাঁধার পরের কাজ হল ঐ আঁটি থেকে ধান ঝাড়ানো। বড় উঠোন গোবর আর এঁটেল মাটি দিয়ে নিকিয়ে বালি মুক্ত করে প্রায় সমান তল করে ফেলা হত - স্থানীয় ভাষায় এইরকম উঠোনের নাম ‘খোলাবাইর’। কিন্তু দেশী ধানের খড় এত শক্তপোক্ত ছিল যে হাজার আছড়ালেও ধান সহজে ছাড়তে চাইতনা আর খড়ও নরম হতনা। সারাদিন পরিশ্রমের পরে আদিবাসী মজুরের দল গোল হয়ে বসত। কেন্দু পাতায় দোক্তা মুড়ে তারা চুটা বানাত। দোক্তা বাড়ি থেকে কিনে দিতে হত। আর পাতা তারা নিজেরাই নিয়ে আসত। চুটার ধোঁয়া টানতে টানতে কেউ গান ধরত। কেউ বা বাঁশি বাজাত নিজের মনে। হিম জড়ানো হৈমন্তী রাতে তাদের বাঁশির সুর দেবদারু বনে ঘুরে ঘুরে ফিরত।
খড় নরম করার জন্য এক বিশেষ কৌশল করা হত। নিকোনো উঠোন জুড়ে খড়ের আঁটি বিছিয়ে দেওয়া হত। একস্তরের ওপরে আর এক স্তর, সামান্য কোণাকুণি করে যাতে কোনো আঁটি সম্পূর্ণ চাপা না পড়ে। এইভাবে স্তরে স্তরে সাজাতে সাজাতে আঁটির মেলা দু ফুট খানিক উঁচু হয়ে যেত। আর উঠোনের মাঝখানে একটা খুব পোক্ত দেখে বাঁশ বা শাল খুঁটি পুঁতে দেওয়া হত - লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট খানিক। এটাকেই বলে মেই। এতে একটা শক্ত দড়িতে ছয় থেকে সাতটা গরু কিছুদূর অন্তর অন্তর বাঁধা হত। জমির মালিকের সঙ্গতি অনুসারে গরুর সংখ্যা কম বেশি হয়। এবারে বাগালেরা গরু তাড়িয়ে তাড়িয়ে ঐ মেইয়ের চারপাশে তাদের ক্রমাগত ঘোরাত। গরুগুলো এক দড়ি বরাবর বিভিন্ন ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার পথে মেইকে প্রদক্ষিণ করত। তাদের ক্ষুরের চাপে ধানগুলো ঝুরঝুরিয়ে খড়ের নিচে জমা হত আর লম্বা আঁটির খড়গুলো নরম হয়ে যেত। নরম হবার পরেই সেগুলো দিয়ে ঘর ছাওয়া হবে, গরুকে খাওয়ানো হবে। এই পুরো ঘটনাটির নাম হল ‘পতুল ফেলা’। সব শেষে খড়ের আঁটি তুলে পরপর সাজিয়ে খড়ের গাদা বানানো হত। কুচো খড়গুলোকে আলাদা আঁটি বানিয়ে ধান সেদ্ধর জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হত। ধানগুলো নারকেল কাঠির ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করে বস্তায় পোরা হত। তবে এখানেই শেষ নয়। পুরুষ্টু ধানের সঙ্গে কিছু অপুষ্ট দানাও থেকে যায়, তাকে বলে আগাড়ি। দক্ষিণের মাঠে খুব হাওয়া। সেখানে চালের বস্তা থেকে আঁজলা করে ধান তুলে ওপর থেকে ঝুর ঝুর করে নিচে বড় চাটাইয়ের ওপরে ফেলা হত। প্রবল হাওয়ায় আগাড়িগুলো উড়ে যেত, আর আসল ধান নিচে জড়ো হত। এখন অবশ্য যে যার নিজের উঠোনে স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে ধানকে আগাড়ি মুক্ত করে।
সব ধান গোলায় উঠে গেলে পৌষ পূর্ণিমায় মেইকে পুজো করে ধানের মরশুমের বিদায় ঘোষণার পালা আসতো। আকাশে চাঁদ ওঠার পরে মেইতে তেল সিঁদুরের ফোঁটা আর ফুল দিয়ে সাজিয়ে পূজারী ব্রাহ্মণ প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন শেয়াল কখন ডাকবে, কারণ শেয়ালের হুক্কাহুয়া শোনা না গেলে এই পুজো শুরু হবেনা। অন্যদিন অন্ধকার হবার একটু পরেই আশেপাশে বনে বাদাড়ে হুয়া হুয়া করে হুল্লোড় শুরু হয়। ঠিক মেই পুজোর দিনটাতেই ওদের যত দেরী। এদিকে শেয়াল ডাকতে দেরী হচ্ছে দেখে আমাদের মন্টু বামুন মানে মন ঠাকুর বাঁশ গাছের আড়ালে গিয়ে নিজেই মুখে হাঁড়ি চাপা দিয়ে মিহি স্বরে হুক্কাহুয়া করে দেন। আর বাড়িতে হাসির রোল ওঠে। শ্বশুর মশাই বেঁচে থাকতে এই সব ক্ষেত্রে লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে যেতেন, হুঙ্কার শোনা যেত, “কোথায় তুই মন্টু শেয়াল?” আর শাশুড়ি মা টানা শাঁখ বাজিয়ে অবস্থা সামাল দিতেন। বোঝা যেত যে শেয়ালের সঙ্গে গিন্নিমায়ের কিছু বোঝাপড়া আছে। বেশির ভাগ সময়ে নাকি আমার কর্তাই বুক চিতিয়ে সামাল দিতেন -
— মন ঠাকুর পুজোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে, বাবা, কিছু বলতে হবে?
— ব্যাটা শেয়াল ডেকেছে, ভেবেছে ঐ গলা আমি বুঝতে পারবোনা।
— মন ঠাকুর শেয়াল ডেকেছে! তোমার মাথাটা গেছে বাবা।
— বাঁশ ঝাড়ে আমি ঠিক শুনেছি।
— কই আমরা তো তেমন কিছু মানে মন ঠাকুরের গলা শুনিনি। তোমার কী মনের মধ্যে কান গজিয়েছে?
— বাঁশ ঝাড়ে শেয়াল ডাকেনি? মন্টু ব্যাটা পুজো শুরু করে দেবার জন্যে ডাকেনি?
— বাঁশ ঝাড়ে শেয়াল ডাকল তো, সকলেই শুনেছে।
— ভর সন্ধেবেলা ঘরের পাশে এসে একটা শেয়াল একবার ডেকে গেল?
— হতে পারে, ওটা একটা নির্জনে নিঃসঙ্গ একাকী শেয়াল। এই পৃথিবীতে হয় না এমন কিছু আছে?
ওদিকে তুমুল শাঁখ উলুর মাঝে পড়ে বাবার উত্তর আর শোনা যেতনা, পুরো ধামাচাপা দিয়ে দিত সকলে।
যা হোক মেইয়ের পাশে মুলো গাছ রেখে তাকেও পুজো করা হত। কারণ ঐ সময়ে মুলো গাছে সাদা সাদা ফুল ধরে, নতুন মুলোর ফলনে যাতে বাধা না পড়ে, সেইদিন থেকে মুলো খাওয়া নিষেধ। মুলো গাছকে সাজিয়ে দাঁড় করানোর জন্য তার সঙ্গে কেয়ার ডাল, আর ফুলে ভরা সর্ষে গাছ বেঁধে দেওয়া হত। পুজোর আগে প্রস্তুত করে রাখা হত নানা আকারের বেতের ঝুড়ি। তাদের গায়ে এঁটেল মাটি লেপে শুকিয়ে তাতে সুন্দর করে আলপনা দেওয়া হত। এবারে সব কটা বেতের ঝুড়িতে নতুন ধান ভর্তি করে ওপরে ওপরে সাজিয়ে রাখা হত। সবচেয়ে নিচে পনের সেরের ঝুড়ি - নাম ধামা, তার ওপরে দশ সেরের ঝুড়ি - এগুলির নাম বেতি। দশ সেরের উপরে পাঁচ সেরের ঝুড়ি - নাম হল কাঠা আর সবার ওপরে এক সেরের ঝুড়ি - তার নাম কুঁচা। মুলো গাছের গোড়ায় বানিয়ে রাখা হত গোবরের ভূত। এইসব লৌকিক পুজোর সঙ্গে মিশে থাকত আগামী মরশুমে ভালো ফলনের প্রার্থনা আর অনাবৃষ্টি - মন্বন্তরের ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য কৃষক পরিবারের আকুতি।
পূর্ণিমা ছাড়া অমাবস্যার পুজোও ছিল - কালী পুজো। আগের দিন চোদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করে, ভক্তি ভরে পিণ্ড দিয়ে পাটকাঠির গোছায় আগুন জ্বালিয়ে হত অলক্ষ্মীর বিদায়। কালী পুজোর দিন আবার লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন। কালীপুজোর পরদিন গোপীনাথের জন্য হত গিরি গোবর্ধন পুজো। আমাদের বালিয়াড়ি অঞ্চল। পরিষ্কার জায়গা করে সেখানে পোঁতা হত কুন্দ ফুলের গাছ। সেই গাছ তলায় দুটি গর্ত করে, জল ভরে শ্যামকুণ্ড আর রাধাকুণ্ড বানানো হত। মাটি দিয়ে রাধা কৃষ্ণ এবং ছোট্ট পাহাড় বানিয়ে দুই পুকুরের মাঝখানে রেখে পুজো হত, আর পুজোর পরে কুণ্ডেই তাঁদের বিসর্জন হত। ঐদিন রাতে অন্নকূট উৎসবে আত্মীয় প্রতিবেশীকে খাওয়ানো হত।
আজ কোজাগরীর রাতে জানালায় বসে বসে এইসব অদেখা দিনের কথা ভাবি। কত কথা জমে পাথর হয়ে ধাক্কা খায় প্রতিবেশীর বাড়ির দেওয়ালে। আকাশে চাঁদ আছে তবু এই ছোট বাসার জানলায় সে ধরা দেয়না। কবে যে আবার বাইরে গিয়ে মুক্ত হয়ে চাঁদ দেখব - আমার কপালে আদৌ আর মুক্ত হওয়া আছে তো?
খুপরি বাসাতে ঘুরে মরি শুধু
আমার যে নেই ছাদ।
রুফ রাইটটা দেয়নি দলিল
তালা চাবি আছে চাঁদ।
চৌদিক থেকে গলা টিপে ধরে
অনবসরের ফাঁদ।
আর কবে বলো থেমে যাবে এই
মরণ পেঁচার নাদ।