৫
আমাদের খিড়কি পুকুরে ঝুঁকে ঝুঁকে জল দেখে, মাছের খেলা দেখে, রোদের চিকচিক ভেসে যেতে দেখে কবেকার বুড়ো একটা তেঁতুল গাছ। তার সারা ডালপালা বেয়ে নেমেছে লম্বা লম্বা ঝুরি। আমাদের ডানপিটে রঞ্জা ঝুরিগুলো গিঁট বেঁধে পুকুরের ওপরে দোল খায়। দুলে দুলে মাঝ পুকুরের আকাশ অবধি ঘুরে আসে। আমি পড়ি কি মরি করে দৌড়োই। ওরে ফিরে আয়, পুকুর পাড়ের গাছ, শেকড়ের জটাজুটো বেরিয়ে পড়েছে, কখন ওপড়ায় তার ঠিক নেই। কানের কাছে চকিতে হাওয়ায় ভেসে আসে, ‘আ–মি সাঁ–তা–র জানি’, সঙ্গে খিলখিল তরঙ্গ। বাবারে বাবা! একে সামলানো দায়। কর্ণাকে নিয়ে অত ঝামেলা নেই, ঘর থেকে বেরোতে বেশি চায় না, শুধু গল্পের বই হাতে থাকে। বই নিয়ে খায়, ঘুমোয়, বই ওর সব। এমন সময় দ্রুতপদে এক প্রতিবেশী বালিকা এসে দাঁড়ায়। আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইতেই সে অভিযোগের সুরে বলে ওঠে,
- পাড়ার পুও সবু দলো বাঁধিকি পানিফড়ো সবু খাউচি। লড়িয়া ফাড়ি দাঁড়িকি দেখুচি। কিছি কউচিনি।
- অ্যাঁ, বলিস কীরে?
- দেখো, কী করি পারো।
ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার আমার কাছে। পেটে গুড়গুড়িয়ে ওঠা হাসি গোপন করে একটা ভীষণ আরোপিত গাম্ভীর্য ধারণ করে দু’পা সদর পুকুরের দিকে এগিয়ে যাই।
- অ্যাই কে রে? কে পুকুরে নেমে পানিফল খাচ্ছিস? লড়িয়া, ব্যাপার কীরে? ডাকব বাবাকে?
হাঁক দিতেই দেখি আমাদের গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার রুণাদার ছেলে লড়িয়া সমেত বাকি ছেলের দল আদুড় ভেজা গায়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে। তাদের গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা প্যান্টগুলো খোঁচা খোঁচা উঁচু হয়ে আছে – কারণ মনে হয় পানিফলের শিঙগুলো। রুণাদা ভিটের মধ্যেই ছোটো করে সবজি চাষ করে। বেগুনবাড়ি করে, ঘরের চালে লাউকুমড়ো লতিয়ে দেয়, লাল লাল টমেটো, ঝাল ঝাল লঙ্কা ফলায়। এবারের বর্ষায় সদর পুকুরে রুণাদা পানিফলের চাষ করেছিল। কিছু তোলা হয়েছে, কিছু এখনো আছে। সেগুলোই রুণাদার ছেলে লড়িয়া বন্ধুদের নিয়ে ডাকাতি করছে। লড়িয়ার আসল নাম অচিন্ত্য দাস। কিন্তু ছোটবেলায় সর্ষের বালিশ মাথায় দেওয়া হয়নি। মাথার আকৃতি এমন, যেন ঝুনো নারিকেলটি। সেই থেকে তার ডাকনাম হল নড়িয়া অর্থাৎ কিনা নারিকেল। নড়িয়া মুখে মুখে হয়েছে লড়িয়া বা লড়ু। এখন জানলাম গাঁয়ে বন্ধুবান্ধবদের কাছে তার নাম লড়িয়া ফাড়ি, অর্থাৎ ফালি নারকেল। আমার কর্তা অবশ্য ভদ্র করে ওকে নারিকেল দাস নামে ডাকে। তা দল জুটিয়ে বাবার পানিফল ধ্বংস করছে যখন, ওকে একটা উপাধি দেওয়া যেতে পারে -
নারিকেল দাস - পানিফল ত্রাস। আর ওর জন্য কানমলাটাই হল তুরুপের তাস।
নারিকেলের পানিফল কাণ্ডের একটা লাভ তো হল, রঞ্জা তার অ্যাডভেঞ্চারাস দোলনা থেকে নেমে নারিকেলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করল, যাতে নানা অকাট্য প্রমাণ যোগাড় করে ওকে বেশি করে বকুনি খাওয়ানো যায়। তবে তদন্ত চলল স্থলপথে। জল ও আকাশ পথে দোলন - ঘূর্ণনের চেয়ে নিরাপদ।
গল্প শুনেছি আমার কর্তাদের ছোটবেলায় এ বাড়ির ভিটেতে অনেক রকম ফসলের চাষ হত। ফলপাকুড় শাকসবজি নাকি বাজার থেকে কেনার দরকার পড়ত না। ধান যা মাঠে হত, তাতেই সম্বৎসরের গোপীনাথের ভোগ আর বাড়ির লোকের খাওয়া দাওয়া কুলিয়ে যেত। মাটির বাড়ির পরিত্যক্ত দেওয়ালগুলো নাকি খুব উর্বর হয়, আর সেখানে কোনো সবজি লাগালে, একেবারে বাম্পার ফলন। আর বাড়িতে গরুও ছিল অনেক। গরু অবশ্য এখনও আছে। এ বাড়ির লোকেরা দেখি খুব গরুর দুধ খায়, একেবারে গেলাস গেলাস। শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে থাকতে তাঁদেরও খেতে দেখেছি। আসলে আগে এলাকায় রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। তাই হাটবাজারও বসত না। গ্রামের মধ্যে যেটুকু পাওয়া যায় তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হত। সেজন্যই শাশুড়ি মা অদ্ভুত কিছু রান্না জানতেন, যেগুলো অন্য কোথাও শুনিনি। তার মধ্যে যেটা খেয়ে আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, সেটা হোল তরমুজের চচ্চড়ি। তরমুজের খোসার সাদা অংশটা ঝিরিঝিরি করে কেটে সেদ্ধ করে পেঁয়াজ কুচো, রসুন থেঁতো আর গোলমরিচ দিয়ে তিনি চচ্চড়ি বানাতেন। বেশ লাগত খেতে, নতুন রকম। আজকাল অবশ্য এ ধরণের রান্না এ বাড়িতেও উঠে গেছে। তাই তরমুজের চচ্চড়ি শুনে মেয়েরা অবিশ্বাসের হাসি হাসে।
রুণাদা আরও গল্প করে, যে ইংরেজ আমলে পুলিশ এসে আমাদের বাড়ি লুঠ করেছিল, বাড়িতে আগুন দিয়েছিল দু’-দু’বার, কারণ দাদাশ্বশুরমশাই বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন। তখন রান্না করার জন্য উপকরণ তেমন কিছু নেই, এদিকে বড় পরিবার, বেঁচে তো থাকতে হবে। এ তল্লাটে সর্ষের তেলের ঘানি আগে তেমন ছিল না। হয় দীর্ঘ পথ হেঁটে নতুবা ওড়িশা কোস্ট ক্যানাল সাঁতরে পার হয়ে অন্য জায়গা থেকে তেল কিনে আনতে হত। এদিকে ঘি যে তৈরি হবে, গরু গোয়াল সব আগুনে শেষ। তাই যখন তেলের ভাণ্ডার কমে আসত, তখন রান্নার পদ্ধতিও যেত বদলে। সব আনাজ কেটে ধুয়ে শুকনো কড়ায় তাপ কমিয়ে ভাজা হত। তারপরে মশলাপাতি, নুন হলুদ মিশিয়ে একটু একটু জল দিয়ে কষা হত। তরকারি নামানোর আগে ওপর থেকে অল্প তেল ছড়িয়ে ফুটিয়ে নেওয়া হত। ঐভাবে রান্না করলেও নাকি তরকারিতে স্বাদ পাওয়া যায়। কারণ রুণাদা বলে তেলের তো আলাদা কোনো স্বাদ নেই। স্বাদ থাকে মশলায় আর সুবাস থাকে ফোড়নে। কথাটা তো ভুল নয়। যখন ভাজা মশলার গুঁড়ো লাগে, তখন মশলাগুলো তো শুকনো চাটুতেই ভাজা হয়। রুণাদার কথায় অণুপ্রাণিত হয়ে আমি একবার শহরের বাড়িতে তেল ছাড়া পালং শাকের ঘণ্ট রান্না করেছিলাম। বলে দেওয়ার আগে কেউ বুঝতে পারেনি যে এতে তেল নেই। পরীক্ষানিরীক্ষা করে যা বুঝেছি, তা হল এই, যে কোনো রান্নায় যদি পেঁয়াজ থাকে, তাহলে কম তেলে বা বিনা তেলের রান্না বিস্বাদ হয়ে যায়। ঐভাবে রান্না করলে পেঁয়াজটা বর্জন করতে হবে, তবে রসুনে আপত্তি নেই। বিনা তেলে দিব্যি মানিয়ে নেয়। জিরে-ধনে-মৌরি-মেথি-গরম মশলা – আর যা কিছু আছে, সবাই তেল-নিরপেক্ষ। তেল ছাড়াই নিজের স্বাদ বিকশিত করতে পারে।
আমার কর্তা বলে, যে ওরা প্রায়ই ছোটবেলায় নারকেল তেলে ভাজা লুচি খেত। খুবই স্বাভাবিক। কারণ উপকূল অঞ্চলে নারকেল খুব সুলভ। বাড়িতেই তেল বানানো হত। আমার খুব আগ্রহ ছিল – এই তেল বানানোর পদ্ধতিটা নিজের চোখে দেখব। আমাদের রান্নাঘরের মতি বৌ নারকেল তেল বানিয়ে আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। ব্যাপারটা দেখলাম তেমন শক্ত কিছু নয়। নারকেল কুরে গরম জলে ফেলে দুধ বের করতে সকলেই জানে। এক্ষেত্রে খুব ঝুনো নারকেল যেগুলোর জল শুকিয়ে ফোঁপর বেরিয়ে যায়, অঙ্কুরোদ্গম হয়ে যায়, তেমন কয়েকটা নারকেল ধৈর্য ধরে কুরে নিতে হবে। তারপরে রাঁধুনিরা সেই কোরা নারকেল গরম জলে কিছুক্ষণের জন্য ভিজিয়ে রাখল। আধঘণ্টা-খানেক পর, ঐ জলেই বেশ দু’-তিনবার ভাল করে কোরা নারকেল চটকে দুধ বার করে নিল। এইবার এই দুধটুকু কড়ায় ফোটাতে ফোটাতে জল সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে, তেলটুকু ভেসে উঠবে। রাঁধুনিদের অনুরোধে তেল থেকে ছেঁকে নেওয়া বাদামি রঙের নারকেলের ছিবড়ে খেয়ে দেখলাম। এখানে বলা হয় নারকেলের চড়া। মিষ্টি মিষ্টি বেশ খেতে। মেয়েরাও চড়া খেয়ে খুশি। রুণাদা রান্নাঘরে সাত-সতেরো গল্প করে। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। অতীতের পিছুটান বাড়ছে, যেমন সব মানুষেরই বাড়ে। বাড়িতে দুই মেয়েরই গল্প শোনায় খুব আগ্রহ। কর্ণাবতী তো শান্তশিষ্ট, দুরন্ত রঞ্জাও গল্পের খোঁজ পেলে শান্ত হয়ে যায়।
- রুণাদা, এ বাড়িতে যদি তেল ছাড়া এভাবে রান্না জানাই থাকে, তবে এখানে সকলের এত তেল মশলা খাওয়ার অভ্যেস কী করে তৈরি হল?
রুণাদা হাসে, বলে, “তেল ছাড়া রান্না তো আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য। অবস্থা সামলে গেলে জমিদার কর্তাদের কী আর অমন রান্না পোষায়?” কথাটা নির্জলা সত্যি। মেয়েরা যতই রান্না করুক, কী উপকরণে কীভাবে রান্না হবে তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে ছেলেদের ওপরে।
- জেঠিমা তুমি তো কম তেলে রান্না কর, কিন্তু জেঠু ঝগড়া করে। তুমি তো শোন না? তাহলে সব সময়ে মেয়েদের ছেলেদের কথা শুনে রান্না করতে হয় না। কী বল?
- শোনার মত কথা হলে শুনি, কিন্তু যখন দেখি জেঠুর কথা ঠিক নয়, তখন শুনি না, কারণ আমার জোর আছে, আমি যে স্বনির্ভর। জেঠু আমার খাওয়া-পরা দিলে হয়তো বাধ্য হয়ে শুনতে হত। এ বাড়ির সব রান্নার পিসি নিজের ঘরে কম তেলে রান্না করে। কিন্তু এখানে কর্তাদের প্রশংসা শোনার জন্যে রান্নায় বেশি তেল দেয়।
- স্বনির্ভর না হলে কী হয়?
- না হলে কী হয়? রবি ঠাকুর লিখে গেছেন, অন্যের হাতে অস্ত্র না থাকলে নিজের অস্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়। সেইরকম মেয়েদের ন্যূনতম খাওয়া-পরার জোগাড় না থাকলে বরেরা ইচ্ছেমত গব্বর সিং হয়ে যায়, অন্তত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- তোমার মা-বাবার মধ্যেও কি এরকমই ঝগড়া হত?
- না, না। মা তো কম তেলে রান্না করত, মশলাও কম দিত। বাবাও সেটা পছন্দ করত, কারণ বাবা ডাক্তার।
- বাঃ। তাহলে তো মিলমিশ। আর তোমার বাবা যদি ডাক্তার নাও হত, আশা করি কৃষ্ণার খুব অসুবিধে হত না। কৃষ্ণাও স্বনির্ভর, নিবেদিতা ইস্কুলে পড়াত, তাই না জেঠিমা? আর তোমার দিদা-দাদু?
- লাবণ্য কম তেলে রান্না করতে জানত, কারণ তা না হলে মা অমন রেসিপি শিখতে পারত না। কিন্তু বিকাশচন্দ্র ছিল উল্টো। রাজবাড়ির হেঁশেলে খেয়ে যার অভ্যেস, সে কম তেল খাওয়া জানত না। লাবণ্যকে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছিল। আর লাবণ্য তো স্বনির্ভরও ছিল না।
- কিন্তু মা, সেকালে তো অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। লাবণ্য শিখল কী করে? কুমুদিনী শিখিয়েছিলেন?
- মনে হয় না। বারবার এই কথাই শুনেছি, যে উনি সংসার দেখার সময় পেতেন না।
লাবণ্য শিখেছিল তার মা যূথিকারানীর কাছ থেকে। শাশুড়ির থেকে শেখার সুযোগ হয়নি বলেই আমার ধারণা। লাবণ্যর বিয়ে হয়েছিল পনের-ষোল বছর বয়সে। মায়ের কাছ থেকে রান্না শেখার যথেষ্ট সময় সে পেয়েছিল।
- কিন্তু যূথিকারানীদের অবস্থা কি ভাল ছিল না? কম তেলে রান্না করবে কেন?
- আর্থিক অবস্থার জন্য নয়, পরিবারটা দেখ। যৌথ পরিবারে যূথিকার জ্যাঠামশাই আর.জি.কর, এবং ঠাকুর্দা দুর্গাদাস কর দু’জন নামকরা ডাক্তার। তোদের যে বললাম, আর.জি.করের স্ত্রী আলুভাজার গা থেকে কাপড় দিয়ে তেল মুছে দিতেন।
- ও, তাও তো বটে, যুক্তি আছে।
- আরও একটা প্রমাণ আছে, কর বাড়ির বেশ কিছু মেয়ে সেন বাড়ির বৌ হয়েছিল। তাই ওখানেও পাতলা ঝোলের প্রচলন হয়েছিল বলেই আমার ধারণা।
- এ তো ভারি আশ্চর্য কথা বলছ জেঠিমা। পরিবারের ভিতর দিয়ে রান্নার ঘরানা বয়ে চলে!
- শুধু বয়ে চলে তা নয়, নতুন নতুন ধারা মিশে একটু একটু বদলে যায়। আর্থিক অবস্থা বদল হলে, বা নতুন যুগের নতুন খাদ্যাভ্যাস এলে রকম সকম পাল্টায়। তবে ছাপ থেকে যায়। তোদের ঠাকুমাকে তো পেলি না বেশিদিন। ঠাকুমা অনেক ছড়া কাটতেন মুখে মুখে। এখন আফসোস হয়, যদি লিখে রাখতাম। এমনই একটা স্থানীয় ছড়া শুনেছিলাম মায়ের মুখে, যার মানে – রাজা খায় ভাজা, পণ্ডিতে খায় ঝোল আর মূর্খে খায় টক।
- ইন্টারেস্টিং, এমন কেন হবে?
- এসব ছড়া সাধারণ মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বানায়। রাজার অনেক সম্পদ, তাই সে তেল দিয়ে ঘি দিয়ে ভাজাভুজো বেশি খায়। শিক্ষিত লোক একটু স্বাস্থ্যসচেতন হয়, তাই কম তেল মশলার পাতলা রান্না খায়। আর অশিক্ষিত গরীবগুর্বো লোকে একটু ঝাল-ঝাল করে টক রান্না করে, যাতে অল্প তরকারি দিয়ে অনেকটা ভাত খাওয়া যায়।
নানা কাজের ব্যস্ততায় এক একটা দিন কাটে, রোজই কিছু নতুন দেখি, নতুন শিখি, নতুন ভাবি, তবু পুরোনো কথার নটে গাছটি মুড়োয় না। দিনমানে ব্যস্ত পৃথিবী রাতে বিশ্রাম নেয়। আমার কন্যারা ক্লান্ত হয়ে বিছানায় আমার কাছে ঘেঁসে আসে। ঘুম পায়, তবু তাদের কথা ফুরোয় না।
- জেঠিমা, আমাদের কুমুদিনীর বই দুটো তুমি এনেছ সঙ্গে? একবার দেখতাম।
- দেখতে পাবি যখন ইচ্ছে। মোবাইলেই আছে। বই আনার তো দরকার নেই। উপন্যাসটা গ্রন্থাগার ডট কমে আগে থেকেই ছিল। আর কবিতার বইটা আমি ইন্টারনেট আরকাইভে আপলোড করেছি।
- কিন্তু মা, ক্ষিতীশচন্দ্র আর বিকাশচন্দ্রকে তুমি খারাপ বলছ। এখানে তো দেখছি, তোমার দাদুরাই মায়ের বইয়ের প্রকাশক। আর তাছাড়া তুমি যে বলেছিলে, বিকাশচন্দ্র খুব গর্ব করে সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে মায়ের কাজের কথা বলতেন? বাবলি মাসি নিজে শুনেছে।
- খারাপ মানে ওইরকম তোরা যেমন ভাবছিস, তেমন খারাপ মানুষ নন। তবে মায়ের যোগ্যও নন। ছেলেরা প্রকাশ করেছে বই, কিন্তু ঠিকানাটা কেন রামকান্ত বোস স্ট্রিট? তখন তো ওঁরা ফড়েপুকুরে থাকতেন। ওটা শ্যাম পার্কের পাশে সেন বাড়ির ঠিকানা। আমার তো মনে হয়, বই ছাপিয়েছেন বড় মেয়ে আর জামাই। প্রকাশক হিসেবে নিজেদের নাম গোপন করে ছেলেদের নাম বসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বইয়ের কাজ সব নিজেদের বাড়িতে হয়েছে, তাই ঠিকানাটা ও বাড়ির। আর দাদুভাই সব হারিয়ে শেষ বয়সে খুব নরম হয়ে গিয়েছিল। নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিল। তখন গর্ব করে মায়ের স্মৃতিচারণ করত। কুমুদিনী বেঁচে থাকতে ছেলের পরিবর্তন দেখে যেতে পারেননি।
- সেটা তো হতে পারে জেঠিমা। তার মানে তুমি বলছ, যেটুকু লেখার নিদর্শন আমরা পাচ্ছি, তাও সেন বাড়ির জন্যে?
- অবশ্যই, তা নয়তো কী?
- কিন্তু এসব কথা তো সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর মত হারিয়ে যাবে জেঠিমা। পরের যুগ কিছু জানতেই পারবে না।
- কেন? তোদের তো বলে যাচ্ছি সব। আমার মা যেমন আমাকে বলে গেছে। ওরাল হিস্ট্রি হয়ে বেঁচে থাকবে।
- আচ্ছা মা, তুমি যে এই পূজার ফুল বইটা আপলোড করেছ, সেকেন্ড পাতাটা দেখেছ? রামকান্ত বোস স্ট্রিটের ঠিকানাটা পেন দিয়ে কাটা। এখানে তো ৩৫, রাজা নবকিষেণ স্ট্রিট লেখা আছে। এ তো ফাউন্টেন পেনের কালি। তুমি লিখেছ?
- না রে বাবা, আমি লিখিনি। তবে আন্দাজ একটা আছে, কে লিখেছে।
- কে?
- লাবণ্য, বিকাশের বৌ, আমার দিদা।
- এমন আন্দাজ হবার কারণ? যুক্তি দিতে হবে।
- নিশ্চিত তো নই, সবটাই কল্পনা। লাবণ্যর হাতের লেখা আমি চিনি। মায়ের কাছে দেখেছি। ভেবে দেখ। লাবণ্য তখন কিশোরী, নতুন বৌ। শাশুড়ির লেখা বই। শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা থাকবেনা? তাই মনে হয় ছাপানো ঠিকানাটা পেন দিয়ে কেটে শ্বশুরবাড়ির আসল ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। ও ছাড়া এরকম ছেলেমানুষি কাজ করার লোক তখন বাড়িতে তো আর কেউ ছিল না। আর দেখ, লাবণ্য বইটা হাজার ঝড়ে বুকে করে বাঁচিয়েছিল বলেই না এটা আমি পেয়েছি। ও ছেলেমানুষি করল বলেই শোভাবাজারের বাড়ির ঠিকানাটা আমি জানতে পারলাম।
- ভারি অদ্ভুত তোমার গল্প জেঠিমা। আর যুক্তিগুলোও ফেলতে পারছি না।
- আচ্ছা মা, নিবেদিতার সঙ্গে প্লেগ দূর করার কাজের সময় কুমুদিনীর বয়স কত ছিল? ১৮৭২/৭৩-এ জন্ম ধরলে ছাব্বিশ সাতাশ, তাই না মা? তার মানে নিবেদিতার থেকে উনি পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট। নিবেদিতা মারা যাবার পরের দিনগুলোতে উনি কী কাজ করতেন?
- মা বলত, উনি নাকি লিফলেট ছাপাতেন। তাতে সহজ বাংলায় লেখা থাকত স্বাস্থ্য বিধি, তারপরে মেয়েদের কেন লেখাপড়া করা দরকার, দেশের ভালোর জন্য কী কী করা উচিত – এইসব। বাগবাজারের বিশ্বকোষ লেনে একটা প্রেস ছিল। সেই প্রেসে ছাপানো হত। কুমুদিনীর বই দুটোও ঐ প্রেসেই ছাপানো হয়েছিল। তাছাড়া অন্য লেখালেখি ছিল। পরিবারের সকলেই বলেছে, কিন্তু চোখে কিছু দেখিনি। আর একথাও শুনেছি, লেখালেখির থেকে ওঁর নিজস্ব উপার্জন ছিল। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মা বলেছিল, উনি শোভাবাজার রাজবাড়িতে থাকা কালীনই নিয়মিত সাহিত্যসভা করতেন। সেখানে সমাজের বড় মানুষেরা আসতেন। ধীরে ধীরে সেইসব সংসর্গে আরও অনেক সভা সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। সবগুলো নিরামিষ সাহিত্যের ব্যাপার ছিল না। সেখানে সক্রিয় ইংরেজ বিরোধিতার গল্প ছিল। স্বামী শরৎ মারা যাবার পরে, উনি যে রাজবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তার এটাও একটা কারণ। শরতের দাপটে সব চুপ থাকত। কিন্তু তিনি না থাকাতে পরিস্থিতি ঘুরে গেল।
- তার মানে একশ’ বছর আগে কুমুদিনী স্বনির্ভর ছিলেন! কিন্তু লিফলেট কী কাজে লাগত?
- বাড়ি বাড়ি বিলি করা হত। বাগবাজার, শ্যামবাজার, শোভাবাজার এই সব জায়গায়।
- উনি নিজে বিলি করতেন?
- কিছু নিজে করতেন তো নিশ্চয়ই। তবে এই ছাপানো, বিলি করা প্রধানত দেখাশোনা করতেন ছোট জামাই রবীন মিত্র। আসলে খেলার জগতের সঙ্গে যুক্ত তো, মোহনবাগানের প্রচুর ছেলেপুলে জামাইদের হাতে ছিল, যারা নিঃশব্দে এই বিলি ব্যবস্থা করত। রবীন অকালে মারা যাবার পর এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বড় জামাই শ্রীশ সেন আর মেজ জামাই। এই মেজ জামাই ছিলেন বিডন স্ট্রিটের বিখ্যাত ব্যবসায়ী শোভারাম দত্তের ছেলে। কিন্তু তাঁর নামটা কী সেটা মনে করতে পারছি না। আর বাবলিদিও ভুলে গেছে। জামাইরাই ছিল কুমুদিনীর ভরসা। ওঁর যে দুই ছেলে কাছে ছিল, মানে ক্ষিতীশচন্দ্র আর বিকাশচন্দ্র – তাদের আত্মীয় স্বজন মিলে বাপ ভাই মারা গেছে, আহা উহু করে করে আদরে বাঁদর বানিয়েছিল।
- নিজের দাদুকে আদরে বাঁদর বলছ মা? এমন বলার কারণ কী?
- ওসব পরে হবে। অনেক রাত হল, এবারে ঘুমোতে যা।
- কিন্তু আর একটা কথা জেঠিমা প্লিজ প্লিজ, এটা বলে দাও ঘুমোতে চলে যাব।
- কী কথা?
- কুমুদিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে এলেন কী করে?
- দেখ, ওঁর লেখা কবিতা ছাড়া নথি তো কিছু নেই যে নিশ্চিত করে বলতে পারব, তবে কার্যকারণ কিছু আন্দাজ করেছি।
- কী রকম?
- প্রথমত, ধর উত্তর কলকাতায় থাকা। শোভাবাজার আর বাগবাজার – দূরত্ব তো খুব বেশি নয়। প্রতি বৃহস্পতিবার করে নিবেদিতা ব্রাহ্ম সমাজের সভায় শিক্ষা প্রসঙ্গে বক্তৃতা দিতেন। সেখানে সমাজের আলোকপ্রাপ্ত নারী পুরুষেরা যেতেন। শুধু যে ব্রাহ্মরা যেতেন তা তো নয়। ত্রিপুরার কুমুদিনী, যিনি ১৯১৩ সালে মারা গেলেন, তিনি পরম বৈষ্ণব হলেও ব্রাহ্মসমাজে প্রার্থনা সভায় যাতায়াত করতেন, এমন কথা লেখা আছে। এছাড়া নিবেদিতা বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে খুব অল্প সময়ে শিক্ষিত মহলে ভালরকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সেরকম কোনো সভায় দেখা হয়ে থাকতে পারে।
- হ্যাঁ তা পারে।
- তাছাড়া বোস পাড়া লেনে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার পরে উঠোনে বসে মঠের সন্ন্যাসীরা বিশেষ করে স্বামী সদানন্দ যখন কথকতা বা ধর্মালোচনা করতেন, তখন ঠাকুর দালানে মেয়েরা চিকের আড়ালে বসে সেসব শুনতেন। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি সস্ত্রীক নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এইরকমই কোনো একভাবে হয়তো দু’জনের দেখা হয়েছিল।
- লিফলেট ছাপানোর ব্যাপারটা কীভাবে শুরু হল বল তো? তখনকার যুগের মানুষ এসব জানত?
- এ কী বলছিস? জানবে না? প্লেগের সময়ে বিবেকানন্দ প্লেগ ম্যানিফেস্টো লিখলেন, নিবেদিতা দীর্ঘ পত্র ছাপিয়েছিলেন। এসব স্বদেশী ভাষায় কাগজে ছাপিয়ে তো মঠের সন্ন্যাসীরা বিলি করতেন। তাছাড়া প্লেগের পরেই বঙ্গভঙ্গ। তখন তো আর হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ছিলনা। খবরের কাগজ, ছাপানো লিফলেট, সভা আর বক্তৃতা – এগুলোই তো প্রচারের মাধ্যম। তাই কুমুদিনীর লিফলেট লেখা, ছাপানো – এগুলো কিন্তু সে যুগে অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরে ওঁর কবিতাগুলো দেখাব। অনেক কথা বুঝতে পারবি। এবার আর নয়, রাত বেড়ে যাচ্ছে। ঘুমোতে যা।
- আর ঘুম, যা সব গল্প শোনাচ্ছ জেঠিমা, নার্ভ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।
- এখন আমার দোষ হয়ে গেল। যাঃ, পালা।
বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখি – এক রুপোর নদীতে নৌকো বেয়ে বেয়ে কেবল কুমুদিনীকে খুঁজে ফিরি।