১
- ও মা! আমি টেবিলের ওপরে আলু কাটছি।
- চপিং বোর্ড নিয়ে নে। নইলে ছুরির দাগ পড়ে যাবে।
- কিন্তু হোটেলে যে টেবিলের ওপরে কাটে দেখেছি।
- সে টেবিলের ওপরে পাতলা মার্বেল লাগানো থাকে, তাই।
- আমরা মার্বেল লাগাইনি কেন? আচ্ছা মা, তোমাদের কলেজের সেই গোল শ্বেত পাথরের টেবিলটা এখনও আছে?
- হুঁ, আছে তো।
- ঐ টেবিলটা কেউ বানিয়ে দিয়েছে? নাকি কেনা হয়েছিল?
- কেন?
- খুব ভাল্লাগে, অত বড় নয়, একটু ছোট সাইজের আমাদের বাড়ির জন্য যদি কেনা যেত, তাই জিজ্ঞেস করছি, অমন নকশা কাটা কাঠের ধার আর পায়া, অমন ধবধবে সাদা মোটা পাথর - দেখলেই মনটা কেমন হয়ে যায়।
- হুঁ হুঁ, দেখলেই তোর মনটা বেশ রানী রানী হয়ে যায়, তাই তো? বাড়িতে থাকলে মনে মনে রানী হয়ে শ্বেত পাথরের টেবিলে আনাজ কাটতিস।
- হুম, না মানে রানী নয়, হ্যাঁ মানে ঐরকম আর কি।
- হতেই হবে, টেবিলটা যে আন্দুল রাজবাড়ির, কলেজ তৈরির সময়ে দানে পাওয়া আসবাবের সঙ্গে এসেছিল, তা প্রায় বছর ষাটেক আগে।
- রাজবাড়ি থেকে দানে পাওয়া! এরকম আরও আছে?
- কেন গোল বিশাল কাঠের টেবিলটা, তারপর লাইব্রেরীর পিছনে দেওয়াল জোড়া আলমারিটা দেখিয়েছিলাম মনে নেই?
- কোনটা?
- সেই যে রে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ফুল ভলিউম আছে, সেই আলমারিটা।
- ওঃ সেটা তো সাঙ্ঘাতিক মানে দারুণ গর্জাস আর বিশাল। গায়ে কত কারুকার্য, কাঠের বিনুনি, কল্কা। আচ্ছা মা, আমি কী ভাবি জানো - এইসব পুরোনো আসবাব যদি কথা বলতে পারত, কত গল্প হত, ভাবো তো!
- হুঁ, সেতো বটেই।
- তুমি ভেবে ভেবে টেবিলের, আলমারির গল্প লিখতে পারোনা মা?
- না রে বাবু, বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখার সময় নেই।
- চেষ্টা করে দেখো না একবার। আমি তো বেশ কল্পনা করি, ওরা কী কী বলছে।
- বাঃ তবে তুইই লিখে ফেল। আমাকে এত বকাস না মানু, এখন মেলা কাজ, এত বকবক করার সময় নেই।
মেয়েকে পাশ কাটিয়ে ঘড়ি দেখি, আর তড়িঘড়ি হাতের কাজ সারি।
কোনক্রমে ভাতেভাত করে কম্পিউটারে খাতা দেখতে হবে। ভাগ্যিস খাতাগুলো ডাউনলোড করে রেখেছিলাম তাই রক্ষা, নইলে ইয়াস ঝড়ের জন্য আজ বেশ কয়েকদিন বাড়িতে ইন্টারনেট নেই। এর আগে আম্ফান ঝড়ে আমাদের সুন্দরবনের দিকের ছাত্ররা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঝড়ে চাল উড়ে জামাকাপড়, বই খাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই এবারে আমরা পই পই করে অনলাইন মিটিংয়ে ওদের বুঝিয়েছি যে, ঝড় শুরুর অনেক আগে থেকেই খাতা, বই, জামাকাপড়, ওষুধপত্র, যা কিছু অত্যাবশ্যক সব লাগেজ ব্যাগে প্যাক করে রাখতে, আর সিগনাল পেলেই রিলিফ সেন্টারে চলে যেতে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। এবার বিপদ এল অন্য সীমান্তে যা কারোর মাথাতেই আসেনি। এবারে সুন্দরবনের চেয়েও দীঘার দিকে বাড়ি যাদের, তাদের অবস্থা বেশি সঙ্গীন হয়ে গেছে। আমফান উড়িয়েছিল ওপর দিয়ে আর ইয়াস এসে ভাসিয়েছে নিচের থেকে। সুন্দরবনের ছেলেমেয়েরা জল জঙ্গলে থাকে, তাই জল বাড়লে ওরা সামলে নেয়। এই দীঘার দিকে আজকাল হোটেল আর মাছের ভেড়ির জন্য প্রাকৃতিক বালিয়াড়ি আর ঝাউবনের দফারফা হয়ে গেছে। ফলে যেসব গ্রামে কোনদিন সমুদ্রের জল ঢোকেনি, কোন প্রস্তুতিও ছিলনা জলের সঙ্গে লড়াই করার, সেগুলোও ভেসে গেছে। খবর পেলাম, ভেড়ি ভেসে যাওয়ার কথা জানতে পেরেই বেশ কিছু অমানুষের দল মহানগর থেকে ট্রাকে করে এসে জাল ফেলে টন টন মাছ ধরে নিয়ে চলে গেছে। মাছচাষীদের এমনিতেই ঘরবাড়ি গেছে, এখন ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তাও বন্ধ, সবদিক দিয়ে সর্বস্বান্ত। এখন সরকারি, বেসরকারি সবরকম ভাবে ত্রাণের কাজ চলছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, বেসরকারি ভাবে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা তো উপকূলরেখা বরাবর ভিতরে ভিতরে কোন কোন গ্রাম সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত, অতশত জানেননা। তাছাড়া তাঁদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। অনেকেই নিজেদের ছোট গাড়ি নিয়েই যাচ্ছেন। তাই চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলা, শুকনো খাবার যাই তাঁরা নিয়ে যান না কেন, তাঁদের ত্রাণ সামগ্রীগুলি রাস্তার পাশেই প্রায় লুঠ হয়ে যাচ্ছে বলা যায়। অথচ সেসব জায়গায় বিশেষ কোনো ক্ষতিই হয়নি। খুব কম লোকই ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে, স্থানীয় পঞ্চায়েতের সঙ্গে যোগাযোগ করে হোম ওয়ার্ক করেন এবং স্কর্পিও জাতীয় ভারী গাড়ি নিয়ে ত্রাণ দিতে যান। সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তো জল পেরিয়ে ভারি গাড়ি ছাড়া ঢোকা সম্ভব নয়। খুব অস্বস্তিকর হলেও একথা সত্যি, যে বেসরকারি ত্রাণের বেশিরভাগই যেখানে দরকার সেখানে পৌঁছচ্ছেনা।
দেওরের কাছ থেকে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে আমার কর্তা মন দিলেন ত্রাণের কাজে। আমাদের শহরের পাড়া থেকে দুহাত ভরে নানাভাবে দান আসতে লাগল। সব মানুষের ভেতরেই ভালো আত্মা থাকে, কিন্তু জীবনে নানান ঘা খেয়ে চাপা পড়ে যায়, তবে প্রয়োজনের সময়ে ঠিকই বেরিয়ে আসে। প্রথম পর্বের কাজের পর কর্তা এসে যা বললেন, শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল আমার। শুনলাম কর্তা দেখেছেন, ত্রাণ নেওয়ার লাইন থেকে কিছুটা দূরে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জড়োসড়ো গৃহস্থ বধূরা, শরীরে শুধু শাড়ি জড়ানো, শাড়ির আনুষঙ্গিক পোষাকগুলি পরণে নেই। এতদিন হাত পেতে কিছু নেওয়ার অভ্যাস তো ছিলনা, ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে তাই অনেকেই লজ্জা পাচ্ছেন। নিজে মেয়ে হয়ে এসব শুনে স্থির থাকা যায়না। সমস্যাটা খুবই বাস্তব। দানে শাড়ি জমছে অনেক, কিন্তু সেই পরিমাণ ব্লাউজ, সায়া নিয়ে তো কেউ যাচ্ছে না। দ্বিতীয় পর্বে তাই হাওড়া হাটে একটি ছেলেকে পাঠানো হল, এক পেটি করে সায়া, ব্লাউজ কিনে আনার জন্য। ছেলেটি ফিরল বিশাল বিশাল নীল প্লাস্টিকে মোড়া সাত পেটি জিনিস নিয়ে। আমরা তো অবাক। এত টাকা তো ঐ ছেলেটার কাছে ছিলইনা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ছেলেটি যখন জিনিস কিনছিল, তখন তার কেনার ধরণ দেখে হাটের ওস্তাগরেরা জানতে চেয়েছিলেন, জিনিসগুলো লাগবে কোথায়? ইয়াস ঝড়ের ত্রাণের জন্য কেনাকাটা হচ্ছে শুনে, ছ পেটি মেয়েদের নতুন পোষাক তাঁরা বিনামূল্যে দিয়েছেন। সত্যি, বারবার এভাবেই ঈশ্বর প্রমাণ করেন, যে তিনি মানুষের মাঝেই থাকেন। মেয়েদের পোষাক ছাড়াও শিশুদের পোষাক, শিশুদের খাবার গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট আর, স্যানিটারি ন্যাপকিন - এই জিনিসগুলো আমি আর মেয়ে মিলে প্যাকেট করতে লাগলাম, যাতে চটপট দিতে সুবিধে হয়।
আমাদের ওদিককার ছেলেমেয়েদের খবর পাচ্ছিলাম না, কারণ বিদ্যুৎ সংযোগ ঝড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আর ওরা ফোনে চার্জ দিতে পারছে না। আমি ফোন করে দেখছি মাঝে মাঝে, অন্য টীচার আর ক্লাসের বন্ধুরাও পালা করে চেষ্টা করছে, যদি ধরে ফোনটা, কোথায় কীভাবে আছে ওরা জানাটা দরকার। একদিন সন্ধেবেলায় খবর পেলাম আনন্দী ফোন ধরেছে। ওদের গ্রামের একজন জেনারেটর বসিয়েছে। সেখানে কিছু টাকা দিয়ে আধঘন্টা করে ফোনে চার্জ দিয়ে নিচ্ছে আশেপাশের লোক। ও ভালোই আছে। ঘরদোর মোটামুটি ঠিক, গোয়ালটা একপাশে ভেঙেছে। কিন্তু বোন জ্বরে পড়ে আছে। বাবা মা দুজনেই ঝড়ের আগে কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন, কিন্তু এখনও খুব দুর্বল। আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলাম।
- হ্যাঁ ম্যাম বলুন।
- তোমাদের খবর শুনলাম।
- হ্যাঁ, একটু আগে অর্ধেন্দু ফোন করেছিল, আগে তো চার্জ ছিলনা। কারেন্টের কাজ চলছে। তিন চারদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে বলছে।
- আচ্ছা, তাহলে তো ভালোই। এখন বাজার টাজার খুলেছে? খাবার দাবার, ওষুধ পত্র পাওয়া যাচ্ছে তো?
- ঝড়ের দুদিন পঞ্চায়েত থেকে খিচুড়ি দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাড়িতেও চাল, ডাল, তেল মশলা আর পেঁয়াজ স্টকে আছে। কিন্তু শাক সব্জি, মাছ, ডিম অল্প অল্প করে উঠছে বাজারে। ঐগুলোর ক্রাইসিস।
- বাজার কি কাছেই?
- না ম্যাম, বাজার এখান থেকে বেশ দূর। সাইকেলে যেতে হয় চল্লিশ মিনিট।
- তোমার বাড়িতে সব রুগী, রান্নাবান্না কি তুমিই করছ সব?
- হ্যাঁ ম্যাম আমিই।
- আজ রাতে কী যোগাড় করেছ?
- ঐ তো ম্যাম, চারটে ডিম আছে, তিনটে আলু আর তিনটে টমেটো। ঐ দিয়ে ডাল আর ডিমের ডালনা করব ঝাল ঝাল করে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে - কিন্তু দেখুননা ম্যাম, বোনটা রাজি নয়, নানা বায়না করছে।
- ওহ বাবা, তোমরা বুঝি খুব ঝাল খাও?
- হ্যাঁ ম্যাম, তা একটু খাই, আর আমার বোনটা ঝাল খাওয়ার মাস্টার। ঝোল খাবেনা, সব শুকনো শুকনো গরগরে খেতে চায়।
- তাই নাকি, তা ও বায়না করছে কেন?
- জ্বরটা আজ সকাল থেকে নেই। মুখে তো স্বাদ ফাদ কিছু নেই, বায়না হচ্ছে অনেক রকম পদ ভাতের চারদিকে সাজিয়ে দিতে হবে, নইলে খাবেনা। কী মুশকিল বলুন তো ম্যাম, এখন কি সাত পদ রান্নার যোগাড় আছে? বোঝেনা, করোনায় মাথাটাও বিগড়ে গেছে মনে হচ্ছে। ওকে বোঝাতে হবে ভালো করে, এখন বাড়িতে খুব বেশি কিছু নেই।
- শোন শোন, অসুস্থ মানুষকে ওভাবে নেই নেই বলতে নেই, ওতে উদ্বেগ বাড়ে। বায়নাটা ও অসুখের ঘোরে করছে। সুস্থ থাকলে নিজেই বুঝতো।
- তাহলে?
- আমি একটু ভাবি দাঁড়াও। ও যখন শুকনো ভালোবাসে, তখন মুসুর ডাল সেদ্ধ কর। পেঁয়াজ ভেজে বেরেস্তা করে, ওপরে ছড়িয়ে দেবে। আর বোনের জন্য একটা ডিম সেদ্ধ করে অল্প চিরে নাও। শুকনো লংকা পুড়িয়ে হাতে কচলে ভেঙে ফ্যালো। চিলি ফ্লেক্স হয়ে যাবে। একটু পেঁয়াজ বেরেস্তা আর চিলি ফ্লেক্স নুন দিয়ে ডলে ডিমের চেরার মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে। একটা আলু ছোট ছোট ডুমো করে কেটে ভেজে নেবে। ডালের সঙ্গে একটু একটু আলু ভাজা, আর লঙ্কা পোড়া টাকনা দিয়ে তোমরা বড়রা খেয়ে নেবে। আর ওই আলুর খোসাটা ফেলবেনা। চাইনিজ খাবারে কেমন তেরচা করে বরবটি কাটে দেখেছ?
- হ্যাঁ ম্যাম।
- কাঁচা লংকা বেশ কয়েকটা ওভাবে কেটে নাও। আলুর খোসা আর কাঁচা লংকা একসঙ্গে ভেজে দেখবে বেশ একটা সুগন্ধ উঠছে। ওটাতে নুন, লেবুর রস দেবে। তাহলে বোনের পাতে কতরকম হল?
- হি হি, ভাতের সঙ্গে চাররকম ম্যাম। ডাল সেদ্ধ, ডিম, ডুমো আলু ভাজা, খোসা আর কাঁচা লংকা।
- ওতেই হবে। একটু একটু দেবে। ও আইঙ্কে করে নানারকম খাবে বলছে। পাতে বসে খুব একটা খেতে পারবে বলে তো মনে হয়না। অল্প করে দিয়ে যদি পুরোটা শেষ করতে পারে, ওর মনে একটা আত্মবিশ্বাস আসবে, যে আমি সেরে ঊঠছি।
- হ্যাঁ ম্যাম, একদম ঠিক।
- আর শোন, সকালে ঐ তিনটে টমেটো আর একটা আলু পোড়া, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে মেখে মুড়ি খেয়ে নেবে সকলে। আর সকালেই পাতলা করে ডাল করবে। তিনটে ডিম যে বেঁচে রইলো, আর শেষ আলুটা - তাই দিয়ে অমলেটের তরকারি করে নেবে। তোমরা মেদিনীপুরের লোক, বাড়িতে গয়না বড়ি টড়ি কিছু নেই?
- হ্যাঁ, ম্যাম, আছে তো।
- ব্যাস ব্যাস, পাতলা ডালের সঙ্গে গয়না বড়ি সেঁকে নেবে খাবার আগে।
রান্না সেরে তুমি এবার ঝাড়া হাত পা হয়ে সাইকেল ভ্রমণে বেরিয়ে পড়, বাজার দোকান কর, যা খুশি কর। ক্রাইসিসের বাজারে ভিড় হবে, লাইন পড়বে, ফিরে এসে আর তুমি রান্না করে তিন তিনজন রুগী সামলাতে পারবেনা। আবার রাতে বুদ্ধি করে চলতে হবে।
- হ্যাঁ ম্যাম, আপনি ঠিকই বলেছেন, এতটা আমার মাথায় আসেনি।
আমি ফোনটা স্পীকারে দিয়ে হাতের কাজ সারতে সারতে কথা বলছিলাম, দেখিনি মেয়ে এসে চুপটি করে সব শুনছে। ফোন রাখার পর, মেয়ে এসে জমিয়ে বসল।
- মা এত অল্প জিনিসে তিন বেলার খাবার করা যায়?
- হুঁ। এর কাছে অনেক কিছুই আছে। কষ্টের সময়ে আরও অল্প উপকরণে পেট ভরাতে হয়।
- তুমি নিজে কখনও এমন করে খেয়েছ?
- হ্যাঁ, ছোটবেলায় মাকে দেখেছি কষ্ট করে সংসার চালিয়েও হাসিমুখে সকলকে খেতে বেড়ে দিতে।
- দিদা কীকরে শিখল?
- আমার দিদা মানে লাবণ্যর কাছে শিখেছে।
- তা কীকরে হয়, লাবণ্য তো বড়লোক ছিল।
- প্রথমে ছিল, তারপরে গরীব হয়ে গেল।
- ওহ, কুমুদিনী যখন শোভাবাজার রাজবাড়ি ত্যাগ করলেন, তখন সবাই গরীব হয়ে গেল?
- না, না, কুমুদিনীর ছেলে, মানে আমার দাদুভাই তো বিলিতি কোম্পানিতে চাকরি করত, সে যুগের নিরিখে অনেক টাকাই রোজগার করত। বড়লোকীও ছিল দেদার।
- যেমন?
- এবেলার লুচি ওবেলায় কেউ খাবেনা, তাই বারান্দা থেকে ঝুরঝুরিয়ে ফেলে দেওয়া হত।
- বাবাগো, এইভাবে খাবার নষ্ট?
- ঠাকুর চাকর নিয়ে এলাহী সংসার।
- আর কী ছিল?
- পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে ইংরেজ ফটোগ্রাফারের তোলা এক বিশাল বাঁধানো ছবি ছিল।
- তারপর?
- মেহগনি কাঠের কারুকার্য খচিত আসবাব ছিল। একটা দুটো চোখে দেখেছি আমি। আর…
- আর?
- লাবণ্যর একটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল, যেমন তুই স্বপ্ন দেখিস, তার চেয়েও সুন্দর আর বড়। - মানে? সে টেবিল এখন কোথায়? … বল না মা, আমি একবারটি চোখের দেখা দেখব।
- আমি নিজেই দেখিনি, তোকে কীভাবে দেখাবো? কেবল শুনেছি যে সে ছিল। এখন কিচ্ছু নেই, কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
- কালের গর্ভ কী?
- মানে নীলামে সব বিক্রি হয়ে গেছে।
- ইশশ। ঠিক আছে, টেবিল নেই মানলাম। তার গল্পও কিছু নেই?
- হুঁ, তা তো আছে।
- তবেই সেটাই বল, লাবণ্যর টেবিলের গল্পটাই আমি ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখব। তোমার কলেজেরটার আর দরকার নেই।
রাজবাড়িতে বিয়ের জমক
উড়ল কত সুখ।
ঝকমকে এক টেবিল এল
বিবাহ যৌতুক।
বধূর কপাল বিধির ফাঁদে
দুঃখে পুড়ে খাক।
বোবা টেবিল একলা কাঁদে
কেউ শোনেনি ডাক।