১১
— ও মা! এগুলো কী কাটছ?
— ভেটকি মাছের ফিলে।
— আরে! কোত্থেকে পেলে? আজ ফিশফ্রাই হবে।
— অত নাচানাচি করিস না। ফিশফ্রাই হবে না।
— কেন?
— একটা ভালো ফিশফ্রাই করতে গেলে যা যা উপকরণ লাগে তা এই লকডাউনের বাজারে যোগাড় করা সম্ভব নয়।
— কেন এমন কী লাগবে?
— সে অনেক কিছু।
— তাহলে এগুলো কেটে কী করবে?
— সর্ষে আছে, লাউ পাতা আছে রাতে পাতুরি হবে।
— ওহ, ঠিক আছে, তবে।
— আচ্ছা মা, চপ, কাটলেট, ফিশফ্রাই এগুলো কি ইংরেজরা এদেশে এনেছিল?
— তোর মুন্ডু। ইংরেজরা এখানে এসে খেতে শিখেছিল। ওরা সেদ্ধ সাদ্ধা খাওয়া পার্টি।
— ও - ও, তাহলে এসব কে আবিষ্কার করেছে?
— কে আবিষ্কার করেছে? অত কিছু জানিনা বাবা। প্রাচীন ভারত, গ্রীক, রোমান, আধুনিক ভারত, শক, হুন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগিজ আরও কত জাতির রান্না একসঙ্গে মিশেছে। তার মধ্যে কে কোনটা আবিষ্কার করেছে, কে জানে? আর শোন, ফিশফ্রাই যেমন তেমন করে হয়না। আমাদের বাড়িতে যেদিন ফিশফ্রাই হবে ঠিক হত, তার আগে অনেক প্রস্তুতি চলত।
— তোমাদের বাড়ি মানে, পাতিপুকুরে? ছোটবেলায়?
— হ্যাঁ, পাতিপুকুরে। কিন্তু খুব ছোটবেলায় নয়। তখন বাড়িতে ফিশফ্রাই করার মত বাবার অবস্থা ছিলনা। বাড়িতে ফিশফ্রাই হত, যখন আমি একটু বড় হয়েছি, গ্র্যাজুয়েট হবার পর টিউশন পড়াচ্ছি, তখন। ছোটবেলায় মামার বাড়িতে কেবল নানারকম কাটলেট আর ফ্রাই বানানোর গল্প শুনতাম। আর হাতিবাগানে উত্তম কুমারের সিনেমা এলে, সিনেমা দেখার পর কখনও ক্বচিৎ রেস্তোরাঁয় ফিশফ্রাই খাওয়া হত।
— মামার বাড়িতে গল্প? মানে শোভাবাজারে?
— একদম। শুনেছিলাম রাজবাড়িতে চট্টগ্রাম থেকে মগ রাঁধুনি নিয়োগ করা হত, যারা চপ, কাটলেট বানাতে বিশেষজ্ঞ। তারাই নিশ্চয়ই ফিশফ্রাইও বানাত।
— চট্টগ্রামে মগ জলদস্যু থাকে? তারা রান্না করে?
— দুর পাগল! মগ মানেই কি জলদস্যু? মগ হল আরাকানের লোক, মানে কীকরে বোঝাই, মায়ানমারের একটা অংশের বাসিন্দা।
— চট্টগ্রাম বাংলাদেশে না? ওখান থেকে মায়ানমারের লোক আসছে কীকরে?
— আরে শোন, বাংলাদেশ তখন তো আমাদের থেকে আলাদা ছিলনা। এক দেশ। আর আরাকান তো পাশেই। অনেক দিন আগে আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম দখল করেছিলেন। সেই থেকে ওখানকার কিছু লোক চট্টগ্রামের বাসিন্দা হয়ে যায়।
— কিন্তু ওরা কাটলেট, ফ্রাই কোথায় শিখল?
— সেটা তো আমারও প্রশ্ন। কিন্তু ছোটবেলায় উত্তর পাইনি। মা বা মামারা উত্তর জানতো না। বড় হয়ে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করে একটা চলনসই উত্তর বানিয়ে নিয়েছি।
— বল শুনি।
— চট্টগ্রাম একটা বড় বন্দর। অন্তর্জলে পড়লাম যে এই মগ রাঁধুনিরা আরবি জাহাজের হেঁশেলে কাজ করত। আবার পরবর্তী কালে যখন পর্তুগিজরা এল তাদের সঙ্গেও এই রাঁধুনিদের ঘনিষ্ঠতা হল। সব মিলেমিশেই মনে হয় ওরা এসব বানাতে শিখেছিল। যা পড়েছি, তার সঙ্গে দুইয়ে দুইয়ে চার করে আমি নিজের মত একটা উত্তর করে নিয়েছি। এখন এতে কিছু ভুল থাকলে থাকতে পারে।
— তুমি কতরকম অদ্ভুত বিষয় পড় বলতো মা। পড়তে পড়তে বিরক্ত লাগেনা?
— আমি কি তুই? বই দেখলেই পালাব? কিছু পড়তে পারলে আমার মনের ভার হালকা হয়।
— হয়েছে। এবারে কী প্রস্তুতি বলছিলে, ওগুলো বল।
— বাড়িতে যেদিন ফিশফ্রাই হবে বলে ঠিক হত, তার আগে হত নিউমার্কেট অভিযান।
— কেন?
— ওখান থেকেই সব আনা হত। ভেটকির ফিলে, পুদিনা পাতা, পার্সলে পাতা, কাসুন্দি। তারপর বড়বাজার থেকে ভালো মানের গরম মশলা। বাবার সব চেনা দোকান ছিল।
— এগুলো পাতিপুকুরে পাওয়া যেত না?
— পুদিনা, পার্সলে এসব তো তখন সাধারণতঃ রান্নায় ব্যবহার হত না, তাই পাড়ায় পাওয়া যেত না। ভেটকি পাতিপুকুরের মাছের বাজারে পাওয়া যেত, কিন্তু ফিলে কেটে দেবে কে? তাছাড়া মাছের কোয়ালিটির ব্যাপার আছে।
— কিন্তু এখানে যে বাজার থেকে ফিলে দিয়ে গেল!
— তিন দশক আগে যুগটা আজকের মত ছিল না বাবু। সাধারণ ঘরে ফিলের চাহিদা ছিল না, তাই পাড়ার মাছের দোকানদারেরা ওভাবে কাটতে জানতো না। এখন চাহিদা হয়েছে, তাই ওরাও শিখে নিয়েছে।
— হুম বুঝলাম। সব কিনে আনার পরে বল।
— কেজিতে আমাদের চোদ্দ পিস ফিলে কাটানো হত। এখন কেটারিং কোম্পানিগুলো খেয়াল করলে দেখবি কেউ কেজিতে পঁচিশ পিসও কাটিয়ে নেয়।
— চোদ্দ পিস কাটানো হত কেন?
— যাতে একটা ফ্রাইয়ে কামড় দিলে ভিতরের পাতলা ছালের মধ্যে ঠাসা মাছ মুখে পড়ে।
— উমমম। তারপর?
— মাছের ফিলেটা প্রথমে খুব ভালো ভাবে ধুতে হবে। এবারে তৈরি করতে হবে ম্যারিনেশনের মশলা। কতটা কী মেশাতে হবে, তার একটা অনুপাত আছে। ধর তিন, সাড়ে তিন কেজি মাছ যদি হয়, তার সঙ্গে আড়াই শো গ্রাম ধনেপাতা, তার চেয়ে একটু কম, এই ধর দুশো গ্রাম পুদিনা পাতা, পার্সলে পাতা, আদা, রসুন সব একশো গ্রাম করে লাগবে। বাজার থেকে মাছ বাড়িতে আনার পর অন্তত আধঘণ্টা মাছটা পাতিলেবুর রস মেশানো জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
— আচ্ছা।
— সব উপকরণের পরিমাণটা ঠিক হয়ে গেলে পার্সলে পাতা, ধনেপাতা, কাঁচা লংকা, পুদিনা পাতা, আস্ত রসুন, আদার টুকরো, পেঁয়াজের টুকরো বাটতে হবে। বাটাতে মিশবে পাতিলেবুর রস, নুন, চিনি, একটু গরম মশলা বাটা, একটু সরষের তেল আর কাসুন্দি। এবারে ডিম ফেটিয়ে ঐ মিশ্রণে মেশাতে হবে।
— বাবা, কতরকম কাণ্ড! তারপর?
— এবারে ভালো হয়, যদি বরফ গুঁড়ো করে মেশানো যায়। তাহলে মশলার রংটা বেশ ঘন সবুজ থাকে। কিন্তু আমাদের তো ফ্রিজ ছিল না। তাই ওটা দেওয়া যেত না। যা হোক, এবার ওই মশলায় খানিকটা ময়দা মিশিয়ে খুব ভালো করে পুরো জিনিসটা ফেটাতে হবে।
— আরও আছে?
— না, এই মশলায় মাছের ফিলেগুলো ম্যারিনেট করে ঘণ্টা চারেকের জন্য ঢাকা দিয়ে রেখে দিতে হবে।
— তারপর ভাজা, চাকুম চুকুম।
— না বাবা, ভাজারও নিয়ম আছে। এমনি এমনি চাকুম চুকুম হবেনা। আগে থেকে লেড়ো বিস্কুট কিনে শিলে গুঁড়িয়ে রাখতে হত। মা বলত যে বাজারের রেডিমেড যে গুঁড়ো পাওয়া যায়, তাতে ভালো মচমচে হয়না।
— ওরে বাবা!
— এবারে খবরের কাগজ মাটিতে বিছিয়ে তার ওপরে মোম কাগজ পাতা হত। তারপর দুটো থালায় বিস্কুটের গুঁড়ো রাখা হত। পাশে একটা বড় বাটিতে নুন আর কর্ন ফ্লাওয়ার মিশিয়ে ডিমের গোলা রাখা থাকবে।
— এত ধৈর্য থাকে?
— পুরোটা শোন। এক একটা মশলা মাখা ফিলে বিস্কুটের গুঁড়োতে এপিঠ ওপিঠ রাখতে হবে। গুঁড়ো মাখানো হয়ে গেলে ওটা ডিমের গোলায় ডুবিয়ে, আবার ঐ বিস্কুটের থালায় এপিঠ ওপিঠ করে গুঁড়ো মাখাতে হবে। এতে ঐ থালার গুঁড়ো একটু ভিজে আঠা আঠা হবে। ফলে দেখা যাবে সব দিক হয়তো সমানভাবে গুঁড়োর পরত হল না, কম বেশি হল। তখন অন্য থালা থেকে শুকনো গুঁড়ো নিয়ে ওর ওপরে অল্প অল্প ছড়িয়ে পরতটা সব দিকে সমান করতে হবে। এইভাবে সুন্দর করে এক একটা কাঁচা ফিশ ফ্রাই গড়ে পরপর মোম কাগজে রাখা হত।
— তারপর?
— তারপর ডুবো তেলে ভাজা। গড়া হবে, ভাজা হবে। খাওয়া হবে। তেলে পোড়া বিস্কুটের গুঁড়ো বেশি জমে গেলে মাঝে মাঝে তেলটা ছেঁকে নিতে হবে। এবার তুই বল, একি একজনের কাজ?
— নাঃ।
— এই লকডাউনে করা সম্ভব?
— অসম্ভব।
— কিন্তু মেঝেতে কাগজ বিছিয়ে এত ফিশ ফ্রাই করার দরকার কী?
— কী বলছিস? এত খরচ করে, পরিশ্রম করে, তরিবৎ করে ফিশফ্রাই হবে আর প্রতিবেশী, বন্ধু বা আত্মীয় - যারা কাছে আছে তারা খাবে না?
— ওহ। হ্যাঁ, সবাইকে দিয়ে খেতে হবে। বাবা জানে ফিশফ্রাই করতে?
— হ্যাঁ, তোর বাবা বেশ ভালো ফিশফ্রাই গড়তে পারে। ভাজাটা অত পারেনা।
— দাদুর মত, আমার বাবার নিউ মার্কেটে চেনা দোকান আছে?
— আছে তো!
— চেনা না থাকলে কী অসুবিধে?
— শোন বলি, নিউ মার্কেট থেকে ভেটকি তো কেনা হয়, কিন্তু আসল ভেটকি নিজে চিনে কেনার ক্ষমতা তোর বাবা, আমার বাবা, শিবের বাবা, কারোরই সাধ্য নেই।
— মানে?
— মানে হল, ওখানে বম্বে ভেটকি, শেলে ভেটকি, ভোলা ভেটকি, ঢাইন, বাসা, প্যাঙাশ হাজার মাছ আছে। কেটে ফেললে কারোর বোঝার সাধ্য নেই যে কী মাছ দিচ্ছে। ওখানে বাজারুর অভিজ্ঞতায় ভরসা আর দোকানিকে বিশ্বাস - এই দুটোর ওপর ভর করে কাজ চলে। তাই চেনা দোকান থাকলে একটু সুবিধে - এই আর কি।
— ওরে বাবা! এইরকম ব্যাপার? আচ্ছা মা, বাবারা ছোটবেলায় ফিশফ্রাই খেত?
— না।
— কেন?
— বাবার ছোটবেলায় - তখন গ্রামে এইসব খাবারের প্রচলন হয়নি।
— হুম, তখন গ্রাম থেকে শহরে এসে লেখাপড়া, চাকরি অত শুরু হয়নি, তাই না মা? সেইজন্য কেউ খেতে জানতো না।
— চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে খুব একটা ঢোকেনি। টিভিও খুব কম ঘরে ছিল। তাই ব্যাপারটা লেখাপড়ার জন্য নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওসব জায়গায় খুব ভালো ভাবেই ছিল। তারিণীপ্রসাদ আর তাঁর বয়স্যরা মিলে স্বাধীনতার পরে তৈরি করেছিলেন ঐ এলাকার ছেলেদের জন্য প্রথম হাইস্কুল। আর মেয়েদের ইস্কুল শুরু হয়েছিল তোর ঠাকুমা বেলারানীর তত্ত্বাবধানে, তোদেরই বাড়ির দাওয়াতে।
— এই তো, এবার ইস্কুলের গল্প চলে এসেছে। বল, বল পুরোটা। কিন্তু আমি তো জানতাম ইস্কুল, হাসপাতাল সব কিছু বুড়ো ঠাকুরদা তারিণী করেছেন। এর মধ্যে ঠাকুমাও ছিল! ঠাকুমা লেখাপড়া জানতো? একটু খুলে বল দেখি।
তোদের কী বলি বল - আমি মনে হাসি - জানতেও পারিসনি, তোরা কত ভাগ্যবতী, কত অসাধারণ সব মানুষের ছায়া পেয়েছিলি, আর তোরা কত ভাগ্যহীনা, ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের হারালি। সেই কবে নজরুল লিখেছিলেন,
"কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
ঠাকুমাকে চিনতে তোদের সময় লাগবে। সব স্মৃতি হারানোর আগে লিখে রাখি কিছু কিছু, যতটুকু পারি। বড় হয়ে যদি পড়িস এ লেখা হয়তো নিজেকে চিনবি নতুন করে।