২
লকডাউন চলছে, কিন্তু আমাদের কাজ তো বন্ধ থাকতে পারে না। তাই পথ খুঁজছি যে যার মত। ফিজিক্সের এক অধ্যাপকের কাছে খবর পেয়ে ভর্তি হলাম দক্ষিণ ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্সে। হাফ মাসেতেই শিখে গেলাম, গুগলের অনেক খুঁটিনাটি। কী করে ঘরে বসে পরীক্ষা নেব, ভিডিও বানাব, অনলাইন ক্লাসে বসে বোর্ড ওয়ার্ক করব, ছেলেমেয়েদের খাতায় সই করব, আরও কত কিছু। একটা নেশা লেগে গেল। একের পর এক কোর্সে ভর্তি হতে শুরু করলাম। বন্ধু, সহকর্মীদের সঙ্গে বসে বসে প্র্যাকটিস করতে শুরু করে দিলাম সকলে। কিন্তু বাড়িতে আগে যে ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছিল, তাতে কাজ হচ্ছে না। কেবল অফিসে ফোন করে করে বহু চেষ্টা, ডিসইনফেকশন, স্যানিটাইজেশন, দু’তিন পরত মাস্ক – সব কিছু সামলে বাড়িতে লাগানো হল শক্তিশালী ওয়াইফাই রাউটার। এবারে দরকার একাধিক ডিভাইস। কারণ একই সময়ে মেয়ের আর আমার ক্লাস চলবে। পাশাপাশি বসা যাবে না। তাতে মনোযোগ নষ্ট হবে। কিন্তু টেবিল, প্লাগ পয়েন্ট – মানে দুটো ক্লাসরুম বানানোর মত জায়গা কোথায় ঘরে? তাছাড়া আরও একটা সমস্যা আছে। মেয়েকে তার ক্লাসে বেশি কথা তো বলতে হয় না, তার কাজ হল শোনা। সে ছোট ইয়ারফোনেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমার সেটায় চলবে না। স্পষ্ট পরিষ্কার কথা বলা যায় এমন যন্ত্র চাই। কোথায় যে পাই, বড় যন্ত্রণা। আলাপ আলোচনা শুরু করলাম। কলেজের যেসব অভিজ্ঞ ভেন্ডর আছেন তাঁদেরও পরামর্শ নিলাম। শেষে অনলাইনে কিনে নিলাম মাথায় পরা হেডফোন। আবার নতুন সমস্যা দেখা দিল। মোবাইলে ক্লাস করলে মেয়ের মাথাব্যথা করে। ওকে ল্যাপটপ দিলাম। সে ইচ্ছেমত খাটে বসে, বারান্দায় বসে কাজ করতে লাগল। আমি ডেস্কটপে – এটা আমার কমফর্ট জোন, না হলে স্ক্রিন শেয়ার, বোর্ড ওয়ার্ক, হাজার কারিকুরি করা মুশকিল। ল্যাপটপে ভীষণ ঘাড়ব্যথা করে। কিন্তু মুশকিল হল, যে, ডেস্কটপে বসানোর জন্য একটা ক্যামেরা কিনেছিলাম – তাতে মাইক্রোফোন ছিল, সেটা ক্লাস নেবার উপযুক্ত নয়। আবার যখন হেডফোন কিনলাম, তখন এটার আর ক্যামেরার দুটো অডিও ক্ল্যাশ করে ক্যামেরা হ্যাঙ হল – আর কাজ করে না। সফ্টস্কিল শেখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু হার্ডওয়্যার শেখা অসম্ভব। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছে সব খুলে বললাম, তারা হাসি চেপে শিখিয়ে দিল
- ম্যাডাম, এত কিছু চিন্তা না করে, আমাদের তো একবার বলবেন! আপনি ক্যামেরা কিনেছেন কেন? ওটা খুলে রেখে নিজের ফোনটা নিন। ডেস্কটপ দিয়ে যে ক্লাসে আপনি রয়েছেন, ফোন দিয়ে সেখানে ঢুকুন।
- একই ক্লাসে আমি একটা লোক, দু’রকম ভাবে ঢুকব?
- হ্যাঁ ঢুকবেন, ঢুকে দেখুন কী হয়।
যা বলছে তেমন করে ফেললাম।
- এই তো ঢুকে পড়েছেন। এবারে ডেস্কটপের অডিও অফ করুন। ফোনের অডিও, ভিডিও দুটোই খুলে দিন। এই তো হয়ে গেছে।
আমার মুখে স্বর্গীয় হাসি, ফোনের ক্যামেরা দিয়ে কম্পিউটারে কথা বলছি। ডেস্কটপের ক্লাসে নিজেকে দেখছি অপলক। সবকটা ছেলেমেয়ের ভিডিও অফ, অডিও মিউট। আমি বললাম,
- ঠিক আছে এবার?
কয়েক সেকেন্ড সব নিশ্চুপ। অভিজিৎ নামের একটি ছেলের গলা শোনা গেল –
- সব ঠিক আছে ম্যাম। আপনি এবার ফোন দিয়ে লিভ করে যান। আর কম্পিউটারে যেমন পড়াচ্ছিলেন, শুরু করুন। ভিডিও অন থাকলে বেশি নেট খায়, এখন খুব চাহিদা বেড়ে গেছে তো, একটু স্লো হয়ে গেলে প্রোপাগেশন কোয়ালিটি লো হয়ে যায়, তখন আমরা আপনার কথা পরিষ্কার শুনতে পাব না। এবারে তো শিখে গেলেন, যখন যেমন দরকার ব্যবহার করবেন।
- ওহ, আচ্ছা আচ্ছা। শুধু আর একটা কথা আছে। সামনের সোমবার দিল্লি থেকে একজন প্রবীণ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক পিজির ক্লাস নেবেন। কিন্তু আমি চাই তোমরা, মানে সব ইউজি-র ছেলেমেয়েরা লেকচারটা শুনুক। কিন্তু এই ক্লাসে যতজন ধরবে, তার চেয়ে ডিপার্টমেন্টের ছাত্রসংখ্যা তো অনেক বেশি। কিছু কি করা যাবে না?
- সব করা যাবে ম্যাম। এ্যাই ইভান, পারমিতা বল না।
এবার পারমিতা সরব হয়।
- ম্যাডাম, ক্লাসটা ফেসবুক বা ইউ টিউব লাইভ করে দিলেই হবে।
- কিন্তু আমি যে ওগুলো জানি না।
- আমি, অভিজিৎ আর ইভান এগুলো শিখেছি ম্যাডাম। আপনাকে শিখিয়ে দেব।
- কিন্তু এই বয়সে এসব কি আমার পক্ষে শেখা সম্ভব? যদি কিছু ভুল হয়ে যায়।
ইভানের গলা শোনা যায়,
- শেখার কোনো বয়স আছে ম্যাম! আপনি পারবেন। আমরা সবাই আছি, আপনার ভয় কীসের? আপনি একটা টাইম দিন, আমরা আপনাকে এই গুগল মিটে বসে শিখিয়ে দেব।
- তোমাদের তিনজনের ফ্রি টাইমটা জানিয়ে দিয়ো। দিনে রাতে যেকোনো সময়, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
ক্লাস শেষ হবার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি, আমার নিজের হাতে এত শিক্ষক রয়েছে, আর আমি ছোট ছোট সমস্যা সমাধান করার জন্য দেশে-বিদেশে কতই না সন্ধান করছি। তবে বেশিক্ষণ ভাবুক হওয়া যায় না। এবারে খেতে হবে। সকলকে খেতে দিতে হবে, তারপর মাজা, ধোওয়া, গ্যাস মোছা, টেবিল পরিষ্কার, কিচেন গোছানো, বাজার তোলা, তরকারি ফ্রিজে তুলে রাখা – কাজ অনেক। এসব শেষ করতে করতে বিকেলের ক্লাসের সময় হয়ে যাবে। আমরা অনলাইন রুটিন করে নিয়েছি সুবিধেমত। তিনটে মানে তিনঘণ্টা অনলাইন ক্লাসে ছেলেমেয়েদের অনেকরই নেট ফুরিয়ে যায়। তাই সব শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা যাতে দিনে তিনটে করে ক্লাস পায়, তেমনভাবে সব সেট করা। আমি নিজের ক্লাসটা এমনভাবে সেট করেছি, যাতে মেয়ের ক্লাসের সময়টা ক্ল্যাশ না করে। তবে কিছু কিছু দিন এড়ানো যায় না। আমি বিকেলে বেশি ক্লাস করি, সকালে কম রাখি। মেয়ের ক্লাস আটটা থেকে শুরু। ঐ সময়ে রান্নাবান্না, ঘরকন্নাটা সেরে নিই। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ফোন বেজে উঠল, দেখি কর্ণা ফোন করছে।
- বল রে।
- জে—ঠি—মা, কেমন আছ?
- ভাল, তোদের খবর কী?
- শোনো না, আজ কী হয়েছে। বাবা আজ পঞ্চায়েত থেকে বেরোচ্ছিল, এই অ্যাত্তোটুকুন বিড়ালছানা পা জড়িয়ে ধরল। কিছুতেই ছাড়ে না। খুব আস্তে মিউমিউ করছিল, গলায় জোর নেই, পেট খালি। বাবা তিনটে বিস্কুট জলে গুলে খাওয়াল। তারপর খবর নিল, দিনতিনেক আগে এর মা মরে গেছে।
- সে কী রে? তারপর?
- তারপর বাবা পকেটে করে তাকে বাড়ি নিয়ে এল এক্ষুনি। এখন একে পরিষ্কার করতে হবে। ডাক্তার দেখাতে হবে। অনেক কাজ।
- বা—বা—রে
- এখন রাখছি জেঠিমা, পরে আবার জানাচ্ছি কী হল। আর হ্যাঁ, এর নাম ঠিক হয়ে গেছে।
- উরেব্বাস, কী নাম?
- আপা।
- মানে?
- বাবা বলল, সেই যে স্বাধীন ভবপা, মানে ভব আপা ছিল, এই বিড়াল ছানাটাও তো তিনদিন না খেয়ে বুদ্ধি করে স্বাধীনভাবে ঘর খুঁজে নিল, তাই ভব আপার নামে এর নাম রাখা হল আপা। আর শোন স্মোকির সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে। ও বেশ দেখাশোনা করছে। বা—ই!
ফোনটা কেটে গেল। মনে পড়ে যায় ভবপা, মানে ভব আপার গল্প আমিও শুনেছি শাশুড়ি মায়ের কাছে, বড় ননদের কাছে। পতি আপা, ভব আপা – আমার দাদাশ্বশুরমশাই ঈশ্বর তারিণীপ্রসাদ দাস মহাপাত্রের এঁরা হলেন বোন – পতিতপাবনী আর ভগবতী – এর মধ্যে ভগবতী বালবিধবা, তাই বাপের বাড়িতেই থাকতেন। তাঁকে ঘিরে কত গল্প আজও ভিটেতে উড়ে বেড়ায়।
ভাবনাটা ভেঙে গেল, কারণ বাইরের ঘরে বাপে-মেয়েতে ঝগড়া লেগেছে।
- বাবা, আমি সেই সকাল আটটা থেকে ক্লাস করছি, আমার খিদে পেয়ে গেছে। এখন তুমি বলছ আমায় পাখির খাঁচা পরিষ্কার করতে হবে? ইটস নট ফেয়ার।
- বায়না করে করে একটা অবলা প্রাণী পুষলি, নিজে হাতে তার দেখাশোনা করবি না, এটা কেমন কথা হল মা?
মেয়েটা আসলে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে কিছু খেতে চায় না। ওর অসুবিধে হয়। সেই সাত সকালে দু’পিস পাঁউরুটি খেয়ে বসে আছে। খিদে তো পাবেই। আমি ঝটাপট হাত লাগাই। লকডাউনে বাড়ি বসে বসে সবার খ্যাঁটনের বহর বেড়ে গেছে। গ্যাস-ওভেন, মাইক্রোওভেন, ইনডাকশন ওভেন একসঙ্গে সব চলতে থাকে। ভাত, ডাল, চচ্চড়ি, মাছ, চাটনি—ঝপাঝপ গরম হতে থাকে। থালা, জল, বাটি রেডি হচ্ছে। ওদিকে খাঁচা পরিষ্কার চলছে। বাপে-মেয়েতে কচরমচর, কিচিরমিচিরও চলছে। আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাই।
- আরে শোন, তোর দিদি যে বেড়াল পুষেছে, খবরটা জানিস?
- সে কী, কুকুর, বিড়াল একসঙ্গে? ঝগড়া হবে না?
- ছোট্ট বিড়ালছানা, আজ এসেছে। তোর কাকামণির কারবার। স্মোকি মেনে নিয়েছে, দেখাশোনা করছে। আর ভব আপার নামে নতুন সদস্যের নাম হয়েছে আপা।
- ও মা ফোনটা দাও না, দিদিকে একবার ফোন করি।
- ও এখন ব্যস্ত আছে। আগে খেয়ে নে। পরে করবি। তোরা তাড়াতাড়ি না করলে আমার বিপদ, আমার আবার সেকেন্ড হাফে দুটো ক্লাস আছে।
খাবার টেবিলে বসে মেয়ে আর বাপের মধ্যে স্বাধীন ভব আপার গল্প চলে। খাবার বাড়তে বাড়তে, খেতে খেতে শোনা গল্পগুলো আবার শুনি।
- ভব আপা আমার কে হয় গো বাবা?
- ভব আপা সম্পর্কে তোর ঠাকুরদার পিসি।
- উনি এখন কোথায়?
- স্বর্গে গেছেন মা, সেই পঞ্চাশের দশকে। আমাদের জন্মের দু’দশক আগেই তিনি গত হয়েছেন। আমরা শুধু গল্প শুনেছি। আমার মা বাবার বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে। মায়ের তখন চোদ্দ বছর বয়েস। ভব আপা মায়ের পিসশাশুড়ি। বারো বছরে বিধবা। মায়ের কাছেই শুনেছি – তাঁর লম্বা চওড়া চেহারা, ফর্সা রং, টিকোল নাক, ধবধবে থান পরা, সবাই ডাকত ভবপা – ভব আপাকে দেখে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। কিন্তু কেউ কাছে ভিড়তে পারত না, এমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব। কারোর তোয়াক্কা রাখতেন না। তাঁর দাপটে বাড়ি থেকে পাড়া কাঁপত। সেই যুগের গ্রামে এমনধারা মহিলা একেবারেই ব্যতিক্রমী। নিজের আলাদা ঘর, স্বপাক আহার। সঙ্গে থাকত পনেরো-ষোলোটা বিড়াল।
- অ্যাঁ, কী বলছ গো বাবা? পনেরোটা না ষোলোটা?
- কী জানি মা ক’টা? কেই বা গুণে রেখেছে। কমা বাড়া হত নিশ্চয়ই। তবে শুনেছি তারা আপার খাটে আপার সঙ্গেই ঘুমোত।
- ঐ অতগুলো?
- আপা যখন যেখানে যেতেন, তাঁর চারপাশে বিড়াল বাহিনী যেত। আপাকে মা খুব ভয় পেত।
- সব জায়গায় বিড়াল নিয়ে যেতে অসুবিধে হত না?
- ছোটবেলায় আমিও গল্প শুনে তোর মত ভাবতাম রে। কিন্তু এখন বুঝি। তুইও তো বড় হচ্ছিস, বুঝতে পারবি মা, বালবিধবা, অপরূপা সুন্দরী। অজ পাড়া গাঁ। আড়ে ঝাড়ে দুষ্টু লোকের তো অভাব নেই। নিজেকে বাঁচাতেই মনে হয়, বিড়ালের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন চারপাশে। আর জানিস মা, ভব আপা ছিলেন মাছ ধরায় এক্সপার্ট। উনি নিজে বাড়ির পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতেন, সেই মাছ সেদ্ধ করে বা রান্না করে ভাতের সঙ্গে মেখে দু’বেলা তাঁর বিড়ালদের যত্ন আত্তি করতেন।
- কিন্তু দুর্গাপুজোর সময়ে কী হত বাবা? মনে আছে দিদির যখন পিঙ্কু বিড়ালটা ছিল, তখন পুজোর সময়ে তাকে দইভাত খাওয়ানো হত!
- হ্যাঁ, সে কথাটা তুই খুব ঠিক কথাই বলেছিস। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে আমাদের দুর্গা পুজো নিরামিষ। কিন্তু সেখানেও আপার একটা দারুণ গল্প আছে।
- কী বল না।
- পুজো এলে ভব আপা ঘর থেকে একটু দূরে জমির মধ্যেই উনুন বানিয়ে খড়ের আঁটির জালান দিয়ে আগুন করতেন। তারপর এক ফাঁকে মাছ ধরে এনে, ঝপাঝপ জ্যান্ত মাছ ঐ খড়ের আগুনে ফেলে দিতেন।
- তারপর?
- ঠান্ডা জলে সারারাত পান্তা ভেজানো থাকত। আপার ঘরের পাশে নিকোনো উঠোনে সারি সারি কলাপাতায় পাত পড়ত। প্রতি পাতে একতাল করে পান্তা আর একদলা করে মাছ পোড়া মাখানো – সারি বেঁধে তাঁর বিড়ালেরা ভোজে বসত। সে নাকি এক দেখার মত ব্যাপার।
- ভব আপা নিজে মাছ খেত বাবা?
- খেতেন। পুজোর দিনে হয়তো খেতেন না। নিজে তো সংসার সন্তান কিছু পাননি। বিড়ালেরাই তাঁর সন্তান। বিড়ালদের ভালবেসে বিধবাদের মাছ না খাওয়ার সংস্কার তিনি ভাঙতে পেরেছিলেন।
- তারিণীপ্রসাদ বারণ করেননি?
- না রে মা। তারিণীপ্রসাদকে বুঝতে হলে, তোকে যে আর একটু বড় হতে হবে। আমাদের গ্রামে, চারপাশের আরও দশটা গ্রামে আজও তাঁর নামে লোকে কপালে হাত ঠেকায়।
- বাবা, ভব আপা, তারিণীপ্রসাদ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
- হয়েছে, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। মায়ের তাড়া আছে।
- বাবা বাবা, ও বাবা!
- কী?
- বাবা, তুমি বেশ ভব আপা, আর আমি তোমার বিড়াল। আমায় পান্তাভাত আর মাছপোড়া করে দেবে? আমি খাব।
মেয়ের কথা শুনে আমি আর ওর বাবা দু’জনেই হাসি। মেয়ে বলে চলে,
- বাবা, একটা কথা – ভব আপা ওয়াজ অ্যান ইন্টেলিজেন্ট ওম্যান।
- কীরকম?
- দেখ, পুজোর সময়ে পুরোনো আমলের লোক কেউ মাছভাতের ব্যাপারে বাড়িতে আপত্তি তুলতে পারে। তাই খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। উনুনে পোড়া গরম মাছ বিড়াল খেতে পারে না। জাংগল বুক সিনেমাটায় দেখলে না, জীবজন্তু গরম খায় না–সবাই রক্তফুলকে ভয় করে। তাই সাধারণ ভাতের বদলে ঠান্ডা পান্তার ব্যবস্থা করে রাখত। তাই না! ঠিক বলেছি না বাবা!
- ঠিকই বলেছিস। তাছাড়া পুজোর সময়ে বাড়িতে তো ভাত হয় না। দুর্গাঠাকুর ভাত খান না। গোপীনাথের ভোগের অন্ন কখন রেডি হবে, প্রচুর অতিথি, বিড়ালের ভাগ্যে জুটবে কিনা, জুটলেও সেটা অতিথিরা কী চোখে দেখবেন, অন্নভোগের সঙ্গে মাছের মিশেলটা সবাই মেনে নেবে কিনা – সে প্রশ্নগুলোও তো আছে। তাই রাতে চোখের আড়ালে ভাত করে, পান্তা করে রাখাই ভাল।
- ওমা, ফ্রিজে আর মাছ আছে? কিনতে পেরেছ? থাকলে আমায় মাছপোড়া করে দেবে কাল?
- কালেভদ্রে করেছি তো এবাড়িতে। খেতে চাস না তো।
- আরে তখন বুঝিনি, এবার করে দাও, ঠিক খাব।
- চালানি পোনা মাছ শুধু আছে রে বাবু। বেশি কিছু তো পাওয়া যাচ্ছে না। টাটকা মাছে না হলে ভাল লাগবে না।
- একবার দেখোই না করে।
- আচ্ছা সে দেখা যাবে।
হাতের কাজ সারতে সারতে নিজে নিজেই মনের ভিতরে কথা সাজাই। উপায় ভাবি। মেয়ে মাছ পোড়ার স্বাদ ঠিকমত জানে না। ওকে একটা কিছু করে মন বুঝিয়ে দিতে হবে, নইলে আবার খুব বায়না করবে। সে এক ঝামেলা। ইস্কুল যেতে পারছে না তো, আজকাল খুব খিটখিট করে। যদি সত্যিকারের টাটকা মাছ থাকত, তবে শুধু নুন হলুদ, সর্ষের তেল মেখে ফ্রাইপ্যানে লাউ পাতায় মাছটা পোড়াতাম। পোড়ানো হয়ে গেলে মাছ থেঁতো করে কাঁটা বার করে দিতাম। আগে থেকে কুচোনো পেঁয়াজ তেল নুনে চটকে জরিয়ে রেখে দিতাম, তারপরে মাছ থেঁতোতে জরানো পেঁয়াজ মেখে দিতাম। কিন্তু লকডাউনে টাটকা মাছ পাওয়া দায়। যা আছে তাই দিয়েই উনিশ বিশ কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। ঐ চালানি পোনা মাছের টুকরোগুলো প্রথমে নুন লেবু মেখে রেখে দেব মিনিট দশেক। তারপর আদা রসুন বাটা, টমেটো কুচি, ধনেপাতা, হলুদ, কাশ্মিরী লঙ্কাগুঁড়ো আর সর্ষের তেল মেখে আধঘণ্টা রেখে দেব। বাটনা করে সব ফ্রিজে রাখা আছে। অসুবিধে নেই। মশলা না দিলে স্বাদ আনা যাবে না—টাটকা মাছ তো নয়। বারান্দায় লাউ শাক হয়েছে। ফ্রাই প্যানে অল্প সর্ষের তেল গরম করে তার ওপরে ঐ লাউ পাতা পেতে মাছগুলো রেখে আবার লাউপাতা দিয়ে ঢেকে পোড়া-পোড়া করব। হয়ে গেলে মাছগুলো তুলে হামানদিস্তেয় থেঁতো করে কাঁটাগুলো বার করে দেব। আবার মশলায় থেঁতো মাছটা মিশিয়ে দিলেই হল। কেল্লা ফতে। ওর মাছপোড়া হয়ে যাবে। ভব আপার বিড়াল হয়ে ভাতে মেখে খেয়ে নেবে।
“কেমন আছ কেয়া কদম, শিমুল পলাশ ফুল,
প্রথম পড়ার পাঠশালাটি, বেঞ্চি, টেবিল টুল।
কেমন আছ ষড়ঋতু ছয় রকমের রূপ,
দিনের সকল কোলাহল আর রাতের যত চুপ।
কেমন আছিস মামণি তুই—আগের মতই নাকি?
সবাই তোরা ভাল থাকিস, আজকে চিঠি রাখি।”