মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে,
অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে,
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে
বকুল যূথি জাতি রে।
মেয়ের কথা হারিয়ে যায়। ‘আমি মাহীনগরে যাব’ বলে রঞ্জা নয়, শারদা এগিয়ে যায় এক সময় – সুড়ঙ্গের দিকে। শরীরটা খুব হাল্কা লাগে, নিজেকে দেখি বালিকা। দৌড়োতে থাকি। আমার ডেয়ার ডেভিল বড়মামার মুখ ভেসে আসে। বড়মামা কোলে তুলে নেয়।
- এই যে মাম, যাচ্ছ কোথায়?
- তোমার কাছে।
- ঐ লোকটা তোমায় বিমান বোস বলে ডাকল কেন? তোমার নাম তো বাপি।
- আমারই ভাল নাম বিমান। উড়োজাহাজ। কোথাও আগুন লাগলে আমি দমকলের গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে সেখানে যাই।
- লাল রঙের টং টং করে ঘণ্টা-বাজা গাড়ি? তুমি চালাও!
- রবিবার করে চলে এসো সুখচরে, তোমায় লাল গাড়ি চড়াব। জানো মাম, আমরা মাহীনগরের বোস।
- মাহীনগরের বোস কী গো বড়মামা?
- আমাদের বংশলতিকায় তেমন লেখা আছে।
- বংশলতিকা কী গো, কাল যেটা এনেছিলে? ওতে লেখা হয়?
- কাল এনেছিলাম? দূর পাগল, ওটা লবঙ্গলতিকা, মিষ্টি। বংশলতিকা একটা কাগজ। বাপ্তাকে বলবি, দেখিয়ে দেবে।
- ছোটোমামার নাম বাপ্তা কেন?
- ছোটবেলায় ও বাফ্তা সিল্কের মত সুন্দর ছিল। সেই থেকে অমন নাম।
- আমায় তোমার লাল গাড়ি করে মাহীনগর নিয়ে যাবে?
- এ্যাঁ, এই সেরেছে। ওরে খুকু, পাগলিকে বোঝা।
মায়ের গলা ভেসে আসে, “ওকে কোল থেকে নামাও বড়দা, প্রশ্ন করে করে মাথার ঝিঁকুড় নড়িয়ে দেবে। বেলা শেষ হয়ে যাবে, ওর প্রশ্ন শেষ হবে না।”
‘মা – আ – আ – আ’ – কে ডাকছে? আমি তো না। হঠাৎ সব তালগোল পাকিয়ে বড়মামা হারিয়ে যায়। এটা ১৯৭৫ নয়, ২০১৯। মেয়ে ডাকছে। মাহীনগরের বোস – কোন অতীত থেকে কথাটা ভেসে এল। অনেকদিন ভুলে ছিলাম।
- মা, কাল তো চুপ করে গেলে। আর কিছু বললে না। আজ কিছু বল। মাহীনগরে কীভাবে যায়?
- মাহীনগরের কাহিনী তো আমিও খুঁজছি রে বাবু। কিছুটা জানতে পেরেছি।
- বল শিগগির।
- আমি যখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দপ্তরে প্রোজেক্টে কাজ করছি, তখন সহকর্মী সুস্মিতাদি বলেছিল, ওরাও নাকি মাহীনগরের বোস। পরে মনে একটা অদ্ভুত কথা এল, গুগল দাদাকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয়। একথাটা আগে কেন মনে আসেনি কে জানে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, আন্তর্জালের গোলোকধাঁধায় ঘুরে মরি। এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটায় গুগল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের লেখায় খুঁজে পেয়ে যাই মাহীনগরকে।
- নেতাজী? উনিও মাহীনগরের বোস? কোথায় ওটা?
- বিংশ শতকের প্রথমদিকে কায়স্থ পত্রিকায় নেতাজীর একটি আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাছাড়াও এই বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধও আন্তর্জালে আছে। সব মিলিয়ে জানি না কতটা গুছিয়ে বলতে পারব।
বাংলার অতীত ইতিহাসের এক রাজা আদিসুরের সময়কালে (এমনও হতে পারে যে তাঁর আমন্ত্রণে) উত্তর ভারতের কনৌজ থেকে পাঁচটি ব্রাহ্মণ পরিবার ও পাঁচটি ক্ষত্রিয় পরিবার বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। পাঁচটি ক্ষত্রিয় বংশ হল – গৌতম গোত্রের বসু, সৌকালিন গোত্রের ঘোষ, বিশ্বামিত্র গোত্রের মিত্র, কাশ্যপ গোত্রের গুহ, এবং ভরদ্বাজ গোত্রের দত্ত। কালক্রমে এই পরিযায়ী বংশগুলি সমাজের উচ্চবর্গ বা কুলীন বংশ হিসেবে মর্যাদা পায়। বাকি স্থানীয় কায়স্থদের গৌড়ীয় কায়স্থ বা মৌলিক কায়স্থ বলা হয়। একটি প্রবন্ধে এমনও পড়লাম, যে কুলীন বসুদের জিন বিশ্লেষণ করে উত্তর ভারতের শ্রীবাস্তবদের সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া গেছে এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বা অমিতাভ বচ্চন – এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শ্রীবাস্তবদের কুলতিলক। পুরো মিল তো হওয়া সম্ভব নয়, কারণ কালে কালে বহু জাতির সংমিশ্রণ হয়েছে বাঙালির রক্তে। আমরা প্রত্যেকেই বাবার দিকটা কয়েক পুরুষ খেয়াল রাখতে পারলেও মামার বাড়ির দিকগুলি খেয়াল রাখি না। অথচ তাঁরা প্রবলভাবে আমাদের মধ্যে বর্তমান।
যাই হোক, পড়লাম আদিসুরের হদিশ পাওয়া যায়, ষোড়শ শতকে লেখা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী তে। এই তত্ত্বগুলি সবই অনেকটা অনুমানভিত্তিক এবং বিতর্কিত। সেসবে ঢুকে আমার কোনো কাজ নেই। একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন রাজাদের দরবারে সামাজিক কাঠামো পুনর্নির্মাণ করার একটা চেষ্টা হয়েছিল। কুলীন কায়স্থদের তরফে সেই দরবারে উপস্থিত ছিলেন, মকরন্দ ঘোষ, কালিদাস মিত্র, পুরুষোত্তম দত্ত এবং দশরথ বসু। আজকের বাংলার বোসেরা সেই দশরথকেই পূর্বপুরুষ মানেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসও নিজের শিকড় হিসেবে তাঁকেই মেনেছেন।
দশরথের দুই পুত্র – কৃষ্ণ বাস করেন পশ্চিমবঙ্গে, পরম চলে যান পুব-বাংলায়। কৃষ্ণের প্রপৌত্র মুক্তি বোস। তিনি ডায়মন্ড হারবারের কাছে মাহীনগর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ হলেন মহীপতি বোস। বাংলায় তখন সুলতানি আমল চলছে। মহীপতি তাঁর মেধা ও বীরত্বের জন্য সুলতানের অর্থমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নির্বাচিত হন। সুলতান তাঁর কর্মকুশলতায় প্রীত হয়ে নতুন নামকরণ করেন ‘সুবুদ্ধি খান’ এবং মাহীনগরের কাছেই জায়গীর প্রদান করেন। সেই গ্রামটি সুবুদ্ধিপুর নামে খ্যাত হয়। এই সুবুদ্ধি খানের দশটি ছেলে। তাদের মধ্যে চতুর্থ শ্রীমন্ত বোস বাবার মতই মেধাবী এবং কর্মকুশল। তিনিও সুলতানের প্রিয়পাত্র হয়ে ঈশান খান উপাধি লাভ করেন। ঈশান খানের তিন ছেলে, তার মধ্যে মেজ ছেলে গোপীনাথ বোস প্রতিভায় বাবা ও ঠাকুর্দা দু’জনকেই ছাপিয়ে যান এবং তৎকালীন সুলতান হুসেন শাহের অর্থমন্ত্রী ও নৌবাহিনীর প্রধান হয়ে ওঠেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি পুরন্দর খান হিসেবে অধিক পরিচিত। সেনরাজাদের দ্বারা পুনর্নির্মিত জাতি প্রথার জন্য কুলীন ও মৌলিক কায়স্থরা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত না। করলে আইনের চোখে তা অবৈধ হয়ে যেত। বারবার একই বংশে ঘুরেফিরে বিবাহ করার জন্য শারীরিক, সামাজিক – নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। পুরন্দর স্বীয় ক্ষমতাবলে মাহীনগরে বাংলার সকল শ্রেণীর কায়স্থদের নিয়ে এক বিরাট সভা বসান এবং বিবাহরীতি পরিমার্জন করেন। নতুন নিয়মে ঠিক হয়, কুলীন ঘরের কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্র অন্য কুলীন বংশে বিবাহ করবে, কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতি বিবাহের পথ খুলে যায়। ইনব্রিডিং থেকে অবলুপ্তির আশঙ্কা মুছে যায়। এইখান থেকে আবার অকুলীনদের মধ্যে কুলীন বংশে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে জাতে ওঠার প্রবণতা শুরু হয়। তবে তা অন্য প্রসঙ্গ, এখানে আলোচনা করে লাভ নেই।
- হ্যাঁ, মা।
- আমি যখন এসব পড়াশোনা করছিলাম, তোর বাবা কী একটা কারণে বারবার বিরক্ত করছিল। আমি বললাম, ”মেলা বিরক্ত কোরো না, আমার শরীরে কিন্তু আফগান রক্ত থাকতে পারে, খুব সাবধান।”
- আফগান? কিন্তু কী করে?
- কী করে আবার, বোসেরা সুলতানী আমলে মন্ত্রী-সান্ত্রী ছিল। এখন কারোর না কারোর আফগান, পাঠান বৌ ছিল হয়তো। এটা আমার কল্পনা।
- হা হা হা, তা তো হতেই পারে। তারপর?
- তোর বাবা দেখি ভাল মানুষ হয়ে চলে গেল। আমি একটু অবাক হলাম। তারপরেই দেখি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে উচ্চগ্রামে ভাইকে ফোন করছে।
- কাকামণিকে? খিঁ খিঁ খিঁ। তা কী বলছে?
- ফোনটা স্পিকারে রেখে বলছে, “ওরে তপু, বাড়িতে চার ফুটিয়া আফগান জুটেছে।”
- হা হা হা, আর ওপাশ থেকে কী বলছে?
- বলছে, “ভাল করে জেনে নে ছোড়দা, আফগান, পাঠান না উজবেক!”
তোর বাবা বলছে "উজবেক, উজবেক।"
- উ হু হু হু মা, দুই ভাই মিলে তোমায় আসলে অন্য কথা বলল, আ হা হা হা।
- হাসছিস! হাস, তা বলে আমি গবেষণা থামাইনি।
- না না, গো-এষণা থামালে আমরা গল্প শুনব কী করে। চরৈবেতি। কন্টিনিউ।
- যাই হোক, মাহীনগরের সেই বিশাল সভা ইতিহাসে স্থান পায়। সভার প্রায় লাখ লোকের জলের ব্যবস্থা করার জন্য সেখানে এক বিশাল পুষ্করিণী খনন করা হয়েছিল, লোকমুখে যার নাম হয়ে যায় বোসের গঙ্গা। যদিও কলকাতার ভৌগোলিক ইতিহাস কিছুটা অন্য কথা বলে। খুব সম্ভব আদি গঙ্গার মজে যাওয়া কোনো খাত সংস্কার করে পুরন্দর জলের ব্যবস্থা করেছিলেন, ঠিক যেমন মুর্শিদাবাদের মতিঝিল আসলে নদীর ছেড়ে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। সেটা সংস্কার করে মুক্তোর চাষ করা হত, এও তেমন। পশ্চিম বঙ্গের বোসেরা মাহীনগরের বোস হিসেবে খ্যাত হন। মনে রাখতে হবে, সুলতান হুসেন শাহের সময়ে যদি এইসব ঘটনা ঘটে থাকে, তবে সেকাল শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনেরও কাল। মনে ভাবলাম, পুরন্দর ও শ্রীচৈতন্যের নাম একসঙ্গে দিয়ে একবার খুঁজে দেখব? পেটের মধ্যে থাকা কথা গুগল কখনো লুকোয় না।
পড়লাম যে পুরন্দরের পুত্র কেশব খান বসু, ভাই, পুত্র ও পরিবারকে নিয়ে চৈতন্য ভক্তি আন্দোলনে যোগ দেন। কী জানি? হয়তো সেই থেকে মাহীনগরের বোসেদের গৃহদেবতা কৃষ্ণ।
- দেখ মা, আমাদের বাড়িতেও গোপীনাথ কৃষ্ণ। আবার তোমার আড়বালিয়ার বাড়িতেও যে সতীমা, আউলচাঁদ – সেখানেও কৃষ্ণের প্রভাব তুমি বলেছিলে। সারা বাংলা জুড়ে এত কৃষ্ণ কী করে এল মা? কৃষ্ণ তো মথুরা, বৃন্দাবনের লোক – মানে উত্তর প্রদেশের। মৃত্যু গুজরাটে। পশ্চিম থেকে এভাবে পূর্বে চলে এল?
- সে তো আসবেই। এক দেশ, এক সংস্কৃতি। কিন্তু তুই যেটা ভাবছিস কৃষ্ণের প্রভাব – পুরোটা তা নয়। বহিরঙ্গে আমরা অনেক বেশি দুর্গাপুজো আর কালীপুজো করছি। মাছ, মাংস খাওয়ারও কমতি নেই। কিন্তু গৃহদেবতা হিসেবে যে কৃষ্ণ থেকে গেছেন, সেটা হল চৈতন্যের প্রভাব।
- শ্রীচৈতন্যদেব? কিন্তু তাঁর কথা তো খুব একটা ভাবি না। মানে আলাদা করে তাঁর পুজো বা স্মরণ – এসব তো হয় না।
- হয়, তুই বুঝতে পারিস না।
- কেন বুঝতে পারব না? তুমি বোঝাও।
- গাঁ গঞ্জে অষ্টম প্রহর, চব্বিশ প্রহর – এই ব নামসংকীর্তন হতে দেখেছিস? ফণীজেঠুদের বাড়ির কাছে বালিসাইতে হয় চোদ্দ মাদল। আমাদের আড়বালিয়ার পাশে ধান্যকুড়িয়ায় গাইন বাড়িতে কালীপুজোর পরের দিন, মানে প্রতিপদে, শ্যামসুন্দরের মন্দিরে অন্নকূট হয় – আমার পিসির বাড়ি। কয়েক বছর আগেও একশ’র ওপরে নানা পদ ভোগ দেওয়া হত। তরকারি থেকে মিষ্টি – সব আজও বাড়িতেই বানানো হয়।
- অন্নকূট কী জিনিস?
- এখানে তোদের বাড়ির দিকে, কথায় কথায় বাড়িতে মন্দিরে লোকে মহোৎসব করে। সব জাতির একসঙ্গে বসে পংক্তিভোজনকে আমাদের চব্বিশ পরগণার ওদিকে বলা হয় অন্নকূট।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকবার খেয়েছি।
- এগুলোই চৈতন্য প্রভাব। তিনি আমাদের বাঙালি জাতির চেতন থেকে গভীরে অবচেতনে বসে আছেন। তাই ওঁর কথা সরাসরি না ভেবেও, আমরা ওঁর দেখানো পথে চলেছি।
- অদ্ভুত তো। কিন্তু চৈতন্যদেবের আগে সকলে মিলে মহোৎসব, খাওয়াদাওয়া এসব ছিল না বলছ?
- ছিল তো। সেই কবে আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেব চেষ্টা করেছেন সঙ্ঘ তৈরি করে। সুফী সাধকেরাও বিভিন্ন যুগে জাতপাতের বেড়া ভাঙতে চেয়েছিলেন। মাত্র পাঁচশ’ বছর আগে নিত্যানন্দ যে মহোৎসব শুরু করলেন, এখনও সেই কালচার প্রবলভাবে চলছে।
- নিমাই নয়, নিতাই করেছে?
- হ্যাঁ নিতাই। এই বাড়িতে বিয়ের পরে ডেমুরিয়া জগন্নাথ মন্দিরে খেতে গিয়ে আমি প্রথম মহোৎসব শুরুর গল্প শুনেছিলাম।
- তাই নাকি? ব্যাপারটা কী?
- প্রামাণ্য কিনা বলতে পারব না। গল্পটা যেরকম শুনেছিলাম, সেরকম বলছি।
নিত্যানন্দ বাংলায় হরিনাম প্রচারের জন্য একবার খড়দহে এসেছিলেন।
- খড়দহটা কোথায়?
- শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে বি টি রোড ধরে বাসে করে যাওয়া যায়। শিয়ালদহ লাইনে ট্রেনে করে যাওয়া যায়। তোকে বলেছিলাম না, আমার বড়মামার বাড়ি ছিল সোদপুর – পানিহাটি। ঐ এলাকা।
- আচ্ছা, তারপর বল। খড়দহে কোথায় থাকছিলেন?
- খুব সম্ভবত পানিহাটিতে রাঘব পণ্ডিত নামে একজন বিদ্বান মানুষের বাড়িতে থাকছিলেন। ঐ এলাকার এক জমিদার গোবর্ধন দাসের ছেলে রঘুনাথ দাস নিত্যানন্দের ভক্ত হয়ে ওঠে। তার পয়সাকড়ি ছিল। নিত্যানন্দ রঘুনাথকে বললেন – উপস্থিত সব বৈষ্ণব ভক্তদের দই-চিঁড়ে খাওয়াতে। বড় বড় মাটির হাঁড়িতে চিঁড়ে ভিজিয়ে তাতে দুধ, দই কলা আর চিনি দিয়ে ফলার মাখা হল। সব জাতি নির্বিশেষে একসঙ্গে বসে সেই ফলার খেল।
সেই থেকে পানিহাটিতে শুরু হয় দই-চিঁড়ের মহোৎসব। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা-ত্রয়োদশী তিথিতে বটগাছের নীচে এই উৎসব হয়। হাজার হাজার বৈষ্ণব ভক্ত আসে। ধীরে ধীরে সারা বাংলায় এই ধরনের উৎসব ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখানকার ভাষা তো ওড়িয়া মেশা। এখানে বলে চুড়া মহোৎসব। বিয়ের পরে আমি ভেবেছিলাম কোনো মন্দিরের চূড়া। তারপর জানলাম, ও হরি, এখানে চিঁড়েকে চুড়া বলে।
- তখনকার লোক খুব চিঁড়ে খেত, না মা?
- এখনকার লোক খায় না নাকি?
- কোথায় খায়?
- তুই কেবল ম্যাগি আর ইপ্পি খাস বলে, চারপাশের লোকে কী খাচ্ছে দেখতে পাস না। ছোটবেলায় চিঁড়েটা ছিল আমাদের অন্যতম প্রধান খাবার। এখন বেশি খাই না, মিষ্টি দই দিয়ে মাখা হয়, চিনি বা সন্দেশ মেশানো হয়। চাঁপা কলা দেওয়া হয়। গরমকালে পাকা আম মাখা হয়। সব হাই ক্যালোরি, ডায়াবেটিসে চলে না। তাই খাওয়া হয় না।
- বাড়িতে না করলে আমরা কী করে খাব?
- সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজোয় বিসর্জনে দধিকর্মা খাসনি কোনোদিন মনে হচ্ছে। এখন দইচিঁড়ের ফলার শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছিস?
- ও! দধিকর্মাটাই দইচিঁড়ের ফলার!
- একটু আলাদা। ঘি-ভাতের উচ্চ পর্যায় যেমন পোলাও। রোজকার দই-চিঁড়ে আপগ্রেড করলে দধিকর্মা হয়।
- ঘি ভাত আর পোলাওয়ের তফাৎটা কী?
- বাড়িতে ঘি ভাত করতে গেলে, চাল পরিষ্কার করে ধুয়ে ঘণ্টাখানেক জলে ভিজিয়ে রাখবি। যদি লম্বা সরু কাঁটার মত চাল ভাললাগে, তবে বাসমতী, আর ছোটদানা চাল পছন্দ হলে গোবিন্দভোগ নিতে পারিস। তবে বিরিয়ানি বা ফ্রায়েড রাইসে লম্বা চাল, আর পোলাওয়ে ছোট দানা চাল দিয়ে রান্না করাটা কমন প্র্যাকটিস। এবার ঘি-ভাতে দুটোর যেকোনোটাই নিতে পারিস।
- আচ্ছা।
- মনে রাখবি, এসব রান্না আতপ চালে হয়, সেদ্ধ চালে নয়।
- কেন?
- আতপ চাল কম সময়ে রান্না হয়। সুস্বাদু। আর সেদ্ধ চাল আমরা রোজকার খাবারের যোগান দেয়। ছোটবেলায় মা বলত আলো চাল। আতপ শব্দটা খুব একটা ব্যবহার হত না।
- ও.কে., তারপর বল।
- তারপর বড় ছাঁকনিতে চালের জল ঝরিয়ে নিবি। এবার কড়ায় তেজপাতা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ফোড়ন দিয়ে তাতে জলঝরানো চাল ঢেলে হালকা হাতে একটু ভেজে নিতে হবে। তারপর পরিমাণমত জল দিয়ে ফোটাতে হবে। চাল ফুটে উঠে ভাতের মত হয়ে এলে স্বাদমত নুন আর ভাজা কাজু কিসমিস দিয়ে ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে।
তফাৎ যদি বলিস, ঘি ভাত হল নিরামিষ। তার সঙ্গে সাত্ত্বিক ঠাকুর পুজোর অনুষঙ্গ আছে, আর পোলাও হল রাজসিক মেজাজের – এর সঙ্গে বাদশাহী মৌতাত আছে। তাই পোলাওয়ের বৈচিত্র্য অনেক বেশি। নিরামিষ, আমিষ – দু’রকমই হবে। নিরামিষের মধ্যে বাসন্তী পোলাও আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমিষের মধ্যে গন্ধরাজ চিংড়ি পোলাও বা চিকেন কিমার বল দিয়ে মোতি পোলাও – এগুলো দারুণ খেতে হয়।
- তেল-ঘির পরিমাণের দিক দিয়ে কোনটা বেশি রিচ?
- সেটা যে যেমন করবে, তার ওপরে। আইনমত পোলাওয়েরই বেশি রিচ হওয়া উচিত। কিন্তু তোর বাবা যেমন গল্প করে, যে তোদের পিসিদের বিয়েতে এমন ঘি-ভাত হয়েছিল, যে ঘি থেকে ভাত ছেঁকে তোলা হয়েছিল। এরকম রান্না হলে ঘি-ভাতও খুব রিচ হবে।
- ও মা! এখন পোলাও, ঘি-ভাত ছাড়ো। আই লাভ দধিকর্মা। ওটা কীভাবে হয়?
- দধিকর্মায় দইচিঁড়ের সঙ্গে বাতাসা, মুড়কি, লাড্ডু, রাবড়ি, কাজু, কিশমিশ, আঙুর মেশানো হয়। তরিবত হয়। এটাই তফাৎ।
- বিসর্জন ছাড়া বাড়িতে ওটা করা যায় না মা?
- না করব না। তুই চিঁড়ে ভাজা খেগে যা।
- রাইট। আজ বিকেলে চিঁড়ের চানাচুর করবে।