৪
আজ সকাল থেকে বাড়িতে খুব হৈ চৈ। দু’-দু’জন নামীদামী অতিথির পদধূলি পড়েছে বাড়িতে। একজন হলেন বহুরুপী গিরগিটি, যাঁর পোশাকী নাম ইন্ডিয়ান ক্যামেলিওন, আর একজন হলেন ময়না পাখির ছানা, সবে চোখ ফুটেছে। আমার দেওর এলাকার নামকরা পশুপ্রেমী। সকাল সকাল বাইক নিয়ে বাজারে বেরিয়েছিল, হঠাৎ চোখে পড়ে গেল কয়েকটা দুষ্টু বাচ্চা ছেলে একটা গিরগিটি ধরে তার একপায়ে লাল সুতো বেঁধে পোষ মানানোর চেষ্টা করছে। কোনোমতে তাদের হাত থেকে গিরগিটি উদ্ধার করে ফিরছে, এমন সময়ে দেখে ঝুপসি গাছের বাসা থেকে ময়নার ছানা পড়ে গেছে। তার মা খুব ঝটাপটি করছে, কিন্তু ছানাকে বাসায় তুলতে পারছে না। সে ছানাকেও কোঁচড়ে করে তুলে এনেছে। সেই ইস্কুলে পড়ার দিন থেকেই সে পশুপাখি উদ্ধার করায় অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। আসলে এ বিষয়ে দেওর তার বাবার ধারা পেয়েছে। কর্তার কাছে গল্প শুনেছি, আমার শ্বশুর মশাই একবার এক বুনো ভামের ছানা পুষে বড় করেছিলেন। তার নাম ছিল বুচা। বুচার মা ছোট বেলায় কী এক কারণে বুচাকে রেখে সজ্ঞানে স্বর্গ লাভ করেছিল। সেই থেকে বুচা রয়ে গেল আমাদের বাড়িতে। কর্তা যখন হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরত, বাবার সঙ্গে গল্পগুজব করতে বসলেই বুচা দাঁত দেখিয়ে গরগর করত। বাবার সঙ্গে অন্য কারোর ভাব সে সহ্য করতে পারত না। ফলমূল খেত। কলা খেত। তবে খাবার সংগ্রহের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হত না তো, খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল। সেই বাড়তি ওজনই তার মৃত্যুর কারণ হল। আর একবার হল কী, কর্তা সায়েন্স কলেজের হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে, বাবা মায়ের শোওয়ার ঘরে লাল গা-ওলা একরত্তি এক বাছুর বাঁধা রয়েছে। আর সারা ঘর গরু গোবর মিশিয়ে সুন্দর গন্ধে ম ম করছে। ছেলে তো চেঁচামেচি করে সেই বাছুর গোয়ালে রেখে এল। তারপরে শুরু হল বাছুরের কেরামতি। বাড়ির মানুষ – ছেলের চার ডবল চেঁচিয়ে কেঁদে কেটে সে আবার শোবার ঘরে ফিরে এল। এ বাড়ির পশুপাখির গল্প বলতে গেলে এক মহাভারত হয়ে যাবে। এই তো কিছুদিন আগে, চোখ ফোটেনি-এমন তিনটে ভামের ছানা কী করে যেন দাওয়ায় উঠে এল। তার মা কোথায় কে জানে। এত টুকু টুকু বাচ্চা, মা ছাড়া কিছু খেতেও পারে না। তাদের ছেড়ে রাখলে কোন ফাঁকে শেয়াল এসে নিয়ে যাবে, বাজে, চিলে ছোঁ মারবে, তাই সাবধানে তাদের ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা হল। ভামের গায়ে একরকম বাসমতী চালের পায়েসের মত গন্ধ হয়। রাত্তিরে আড়াল থেকে সকলে লক্ষ্য রেখেছিলাম। দেখলাম মা ভাম এল, কিঁচকিঁচ করে কিছু কথা হল, তারপরে মাথা দিয়ে ঢুঁ মেরে ঝুড়ি উলটে একটা একটা করে ছানা মুখে করে নিয়ে গেল।
এ বাড়িতে পশু পাখিকে, গাছকে, ঘাসকে, পুকুরের মাছকে খেতে দেওয়ার, সম্মান করার এক প্রাচীন প্রথা আছে। আমার বাপের বাড়ির গ্রাম আড়বালিয়াতে এমন কখনও দেখিনি। সেই প্রথা হল গমা পূর্ণিমাতে প্রকৃতি পুজো। পুজোতে সকল পশুপাখির প্রতিনিধিত্ব করে গমা বুড়ি অর্থাৎ গোমাতা। এইদিন খুব সকালে গোয়ালের যত গরু আছে তাদের পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে দুই শিঙে রাখী বেঁধে দেওয়া হয়। সারাদিন ধরে পুজোর জন্য আস্কে পিঠে তৈরি করা হয়। সেদ্ধ চাল আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকাল সকাল বেটে নেওয়া হয়। এবার তাতে একটু নুন আর অল্প অল্প করে গরম জল মিশিয়ে খুব ভালো করে ফেটানো হয়। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখা হয়, যাতে মণ্ডটা একটু ফেঁপে যায়, তারপর মাটির সরায় পাতার জ্বালান দিয়ে একটা একটা করে আস্কে পিঠে তৈরি হয়। গোয়াল ঘর মাটি দিয়ে খুব ভালো করে নিকিয়ে, গোয়ালের কুলুঙ্গিতে ফুল বেল পাতা দিয়ে ঠাকুরমশাই পুজো করেন। এ পুজোতে লাগে এক বিশেষ ধরণের কলকে ফুল। এখানে এই ফুলকে বলে লাঙ্গলিয়া ফুল। বাড়িতে যে কোনো একটি ঘরের দেওয়ালে শাশুড়ি মা গমা বুড়ি আঁকতেন। একটা ছিপ নৌকোয় তিনজন গমা বুড়ি – বড়, মেজ, ছোট। অন্য তিন দেওয়ালে আঁকা হত ধানের ছড়া। কিন্তু লক্ষ্মী পুজোয় আমরা আড়বেলেতে যেমন মেঝেতে মা লক্ষীর পায়ের পাশে ধানের ছড়া আঁকতাম, এখানে রীতি তেমন নয়। আমরা আলপনা আঁকি শুধু তর্জনী দিয়ে। আর শাশুড়ি মা আঁকতেন হাতের সব আঙুলকে কাজে লাগিয়ে। তর্জনী দিয়ে শুধু শিরা এঁকে দু’হাতের দশ আঙুল দিয়ে ধান আঁকতেন অদ্ভুত পদ্ধতিতে। উল্লম্ব দেওয়ালে অঙ্কিত ধান থেকে চাল বাটার জল গড়িয়ে পড়ত। দূর থেকে আঁকাটা দেখলে মনে হত, মেঝেতে ধান ঝরে পড়ছে। পুজোর আগে বেশ কয়েকদিন ধরে ধানের মরাইতে বাঁশের চাঁচির গায়ে নতুন মাটির প্রলেপ দেওয়া হত। সেই মাটির দেওয়ালে কলা পাতার শিরা দিয়ে গমা বুড়ি আঁকতেন ঠাকুর মশাই। পুজো সমাপনের পরে গরুকে পিঠে খাওয়ানো হয়। তারপর পিঠে ভেঙে ভেঙে মাঠ ঘাট, ধান জমি, বন বাদাড়, পুকুর, খাল বিল সব জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করা হয়, আকাশ বাতাস গাছপালা, পশু, পাখি যেন সামনের ফসল ফলাবার সময়ে সহায়তা করে। গেঁড়ি-গুগলি, শামুক, ঝিনুককে প্রণাম করে বলা হয় মাঠে কাজ করার সময়ে, পুকুরে মাছ ধরার সময়ে তারা যেন কারোর পা না কাটে। গমা পুজোর দিন বাড়ির মেয়ে জামাইদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়, নতুন পোশাক দেওয়া হয়। আশেপাশের আত্মীয় পরিজনও কিছু নিমন্ত্রিত থাকতেন। নিরামিষ খাওয়া দাওয়া হত। মুগের ডাল, আলু ভাজা, খামালু আর কুমড়োর ঘণ্ট, মটরের তরকারি আর চালতার টক। সঙ্গে থাকত নারকেল দেওয়া গুড়ের পায়েস আর গোপীনাথের ক্ষীরের ভোগ। শাশুড়ি চলে যাবার পরে এসব পর্ব এখন বাড়ি থেকে উঠে গেছে। যতদিন তিনি ছিলেন, ততদিন দুপুরে বা রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে কারোর পাতের এক দানা শাকান্ন ফেলে দেওয়ার জো ছিল না। সাত রাজ্যের কুকুর, বিড়াল, পাখি সবার জন্য পাতায় পাতায় খাবার ভাগ হয়ে যেত।
যাই হোক, আজ বহু চেষ্টায় বহুরূপীর নরম পা থেকে লাল সুতোর জট ছাড়ানো হল। এত সরু পা, সুতোর পাকগুলো কাঁচি দিয়ে কাটা যাচ্ছিল না। পা কেটে যাবার আশঙ্কা ছিল। প্রাণীটা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তার গোল গোল চোখ দুটো ঘুরছিল বটে, তবু সে চোখের অসহায় ভাষা খুব স্পষ্ট ভাবেই পড়া যাচ্ছিল। সুতো ছাড়িয়ে তাকে একটু জল খেতে দেওয়া হল। কী বুঝল কে জানে। একটু পরে দেওর তাকে কোলে করে একটা উঁচু গাছে চাপিয়ে দিল। ধীরে ধীরে তার সবুজ গা গাছের বাকলের মত হয়ে উঠল। তারপর কোথায় যে সে মিলিয়ে গেল, আর দেখা গেল না।
এবারে ময়না ছানার পর্ব শুরু হল। ময়নার মা ময়নামতী দেওরের বাইক অনুসরণ করে বাড়িতে এসে হাজির। এর ভার নিল আমার কর্তা – পক্ষীবিশারদ। দোকান থেকে সিরিঞ্জ কিনে, জল ছাতু মেখে ছানাকে হাঁ করিয়ে একটু একটু খাওয়ানো হল। প্রথমটা খেয়ে নিল। তারপর বোধহয় পেট ভরে গেল, তাই ফু করে সব ছিটিয়ে দিল, আর খেল না। বিকেল নাগাদ তার নানাবিধ পরিচর্যা সমাপ্ত হবার পর তাকেও গাছের কোটরে তোলা হল, যাতে তার মা দেখভাল করতে পারে।
শাশুড়ি মা আজ নেই বটে, তবু তাঁর চিহ্ন ছড়ানো এ বাড়ির সর্ব কাজে, সর্ব স্থানে। আজ দুপুরে রুণাদা যে দুটো স্পেশাল আইটেম বানিয়েছে – চিংড়ি মাছের মাথার বড়া আর পাকা শসার চাটনি, দুটোই শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকেই রুণাদা শিখেছে। এই সব রান্না আমার বাপের বাড়িতে থাওয়া দূরের কথা, কেউ মনে হয় নামও শোনেনি। মা বলত বটে, পাকা শশা দিয়ে তরকারি হয়, তবে চাটনির কথা কোনোদিন বলেনি।
– আজকে বড়াটা দারুণ হয়েছে গো রুণা জেঠু।
– তোমাদের ঠাকুমার থেকে শিখেছিলাম গো কন্যেরা।
– তুমি এমন বড়া করতে জানো মা? কেমন করে করে গো?
চিংড়ি মাছের মাথাগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে শিলে বেটে নিতে হয়। তারপর বাড়তি খোসাগুলো বেছে ফেলে দিয়ে, বাকিটার সঙ্গে কাঁচালঙ্কা কুচো, পেঁয়াজ কুচো, একটু লঙ্কাগুঁড়ো, শুকনো বেসন মিশিয়ে ছাঁকা তেলে ফেলে ভাজতে হয়।
– ঠাকুমা খুব ইউনিক ছিল, না জেঠিমা? মনে আছে নার্সারি ইস্কুল থেকে ফেরার পথে আমি একটা অসুস্থ বেড়াল ছানা তুলে এনেছিলাম, তার মা মরে গিয়েছিল।
– হুঁ খুব মনে আছে।
– ঠাকুমা তাকে কীভাবে বাঁচিয়েছিল?
– হুম, আসলে কী জানিস, পৃথিবীর সব মায়েরাই নিজের মত ইউনিক।
– জেঠিমা কাল তুমি এমন জায়গায় তোমার কাহিনী থামিয়ে দিলে, আমার তো ঘুমই আসতে চাইছিল না।
– সারারাত কি তোদের সঙ্গে বকবক করব নাকি? সকালে কাজ নেই? সেইজন্য থেমে গেছি।
– ঠিক আছে, কোই বাত নেহি। আজকে ঐ উত্তরটা দাও, তুমি কী করে নিশ্চিত হলে, কেন বলছ যে লীলাবতীর মেয়ে কুমুদিনী আমাদের নন।
– বলছি, তার কারণ আছে। আন্তর্জালে পড়লাম যে ঐ কুমুদিনীর ছোটবোন বাসন্তী চক্রবর্তী (মিত্র) তাঁর মৃত্যুর পরে কুমুদিনী চরিত লিখেছেন। বাসন্তী চক্রবর্তীর ঐ বইটা পাগলের মত খুঁজেছি, কিন্তু পেলাম না, শেষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শরণ নিলাম, আর একই সঙ্গে বাবা কৃষ্ণ কুমারের আত্মচরিত বইটাও পড়ে ফেললাম। সেখানে দেখলাম, ওঁর স্বামীর নাম সত্যিই শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু। আর দুটো বইতেই ঐ কুমুদিনীর অজস্র সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ক কাজের বর্ণনা আছে, তবু দুটো বইয়ের কোথাও সিস্টার নিবেদিতার উল্লেখ নেই। আরও একটা কথা হল, ঐ কুমুদিনী মোটেই বাড়িতে বসে মেম টিচারের কাছে পড়াশোনা করেননি। তিনি বেথুন কলেজে পড়েছেন এবং সেখান থেকে পাশ করেছেন। আর ঐ কুমুদিনীর বিয়ের তারিখ যা দেওয়া আছে, তাতে বুঝলাম ওঁর বিয়ে হয়েছে বত্রিশ বছর বয়সে। আমাদের কুমুদিনীর বিয়ে হয়েছিল চোদ্দ বছর বয়সে। আর বাসন্তীর বইতে খুব আবছা হলেও ঐ কুমুদিনীর একটা ছবি আছে। বয়সকালের ছবি, তবুও তার সঙ্গে আমাদের কুমুদিনীর সঙ্গে মিল পাইনি। আরও একটা কথা আছে জানিস? এই কুমুদিনীর এক ভাই ছিলেন সুকুমার মিত্র এবং এই কুমুদিনীরও দুটো সন্তান। বাসন্তী চক্রবর্তীর এই বইটা তো আসলে স্মৃতিকথা বা স্মরণিকা যাই বলিস – এখানে নানা মানুষ কুমুদিনীর স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখানে ওঁর মেয়ের একটা লেখা আছে – মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, শেষে লেখা আছে – ইতি তোমার খুকু। কিন্তু এই খুকুর ভালো নাম লেখা নেই। তাই জানারও উপায় নেই। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, ঐ বইতে এই কুমুদিনীর একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনী যিনি লিখেছেন, তিনি নাম লিখেছেন – বিশ্বস্ত সঙ্গী। এখন নাও ঠ্যালা। কে বিশ্বস্ত সঙ্গী বুঝব কী করে?
– স্বামী হতে পারে, সঙ্গী বলছে যখন।
- উঁ হু, এই কুমুদিনী মারা যাওয়ার দু’বছর আগেই ওঁর স্বামী মারা গেছেন। এখন ভাই হতে পারেন। কিন্তু এই সঙ্গী আদৌ পুরুষ না কি মহিলা সেটাও যে বোঝার কোনো উপায় নেই। কে লুকিয়ে রইলেন আড়ালে? আসলে মানুষ কেবল সমকালটাকে দেখে। একশ’ বছর পরের মানুষও যে এসব পড়বে, খুঁজবে সেটা ভাবতে পারে না।
– তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল এবার?
– বুঝতে পারছিস না? বাড়িতে থেকে যিনি পড়েছেন আর নিবেদিতার সঙ্গে যিনি কাজ করেছেন, তিনি আমাদের কুমুদিনী। তার মানে হল সমকালে তিন নয়, চারজন কুমুদিনী বসু ছিলেন, এবং চারজনেই বিয়ের আগে মিত্র। এঁদের মধ্যে তিনজন বই লিখেছেন। আর দু’জন সমাজ সেবা ও দেশ সেবার সঙ্গে যুক্ত।
– এ তো ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার দেখছি।
– হ্যাঁ, সেকাল বা একাল সকলেই সমকালে তিনজন লেখিকা, সমাজসেবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কুমুদিনীকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি নিজে যখন এসব খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি, তখন বাবলিদি একদিন ফোন করে বলল, নিজের বাড়িতে ‘পূজার ফুল’ বইটা খুলে দেখ, কুমুদিনী নিজেই তাঁর বাবা মায়ের নাম বলে গেছেন। সেদিন সাহিত্য পরিষদ থেকে ফিরে বইটা খুলে দেখি, ওঁর বাবার নাম বিশ্বম্ভর মিত্র আর মায়ের নাম প্রভাবতী মিত্র।
– মানে একসঙ্গে চার কুমুদিনী, তিনজন লেখিকা, আগে মিত্র, পরে বসু? লেখিকাদের পরপর বলছি মা। এক নম্বর - ১৮৭১ - ১৯২৫ - লিখেছেন লহরী, ‘অমরেন্দ্র’, ‘পঞ্চপুষ্প’, ‘আভা’ ও ‘সাহিত্য – চিন্তা’, বাবা মদনমোহন মিত্র, স্বামী অতুল চন্দ্র বসু
– একটু ভুল হচ্ছে, ভারত মহিলা পত্রিকা সন ১৩২০, মানে ইংরেজি ১৯১৩ সালের নবম সংখ্যায় দেখলাম, এই প্রথম কুমুদিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন তাঁর স্বামী। সেই লেখা অনুযায়ী এই কুমুদিনীর জীবনকাল হল ১৮৬৭ থেকে ১৯১৩। ঐ বইতেই দেখলাম গল্প প্রবন্ধ মিলে এঁর আরও চারখানা লেখা ছাপা হয়েছে। সূচীপত্রে লেখা স্বর্গীয়া কুমুদিনী বসু। এই স্বর্গীয়া শব্দটা ধন্দ কাটিয়ে দিচ্ছে। কারণ বাকি দু’জন তখন বেঁচে আছেন। আর এই কুমুদিনীর কোনো সন্তান নেই।
– আ - চ্ছা! এবার দু’নম্বর কুমুদিনী - ১৮৮২ - ১৯৪৩ - লিখেছেন শিখের বলিদান এবং মেরী কারপেণ্টার। বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্র, স্বামী শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু।
– আর একটা বই আছে, জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী। এঁর জীবনের প্রামাণ্য নথি আছে বাবা কৃষ্ণকুমার আর বোন বাসন্তীর লেখায়। আর একটা মজার কথা কি জানিস? – ঐ যে ভারত মহিলা পত্রিকার কথা বললাম, ওখানেই এই দ্বিতীয় কুমুদিনীর লেখাও একটা গল্প আছে - নাম সমাধি। সূচীপত্রে লেখা শ্রী কুমুদিনী মিত্র বি এ। কাজেই পরিচয়ের কোনো সমস্যা নেই।
– হুম, তিন নম্বর কুমুদিনী - ১৮৭২ - ১৯৪২ - লিখেছেন পূজার ফুল - কবিতার বই এবং বোঝবার ভুল উপন্যাস। বাবা বিশ্বম্ভর মিত্র, স্বামী শরৎ চন্দ্র বসু।
– একদম ঠিক। কিন্তু পারিবারিক অ্যালবাম আর শ্রুতি ছাড়া এঁর কোন প্রামাণ্য জীবনী নেই। আমরা এঁকে এখন যে খুঁজে বেড়াচ্ছি, অলরেডি একশো বছর গন। তাই খোঁজাটা ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আরও মুশকিল হল, এই ১৯১৩ এর পরে দ্বিতীয় কুমুদিনী বিয়ে হয়ে বসু হলেন। আমাদের কুমুদিনীর বই দুটো ছাপা হয়েছে, ১৯২৫ আর ১৯২৭ এ। যদি ধরে নিই, যে ওঁর লেখাগুলো এই ১৯০৫/১৫ এর পর থেকে ১৯৩০ বা ৪০ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে, তখন সেই লেখাগুলো কোন কুমুদিনীর তা বোঝার উপায় কী?
– এ তো দেখছি মহা মুশকিল। বোঝার কি কোনো উপায়ই নেই?
– একটাই হতে পারে কৃষ্ণকুমারের মেয়ে নামের আগে লেখেন শ্রী, আর আমাদের কুমুদিনীর বইয়ে আছে শ্রীমতী কুমুদিনী বসু।
– তাহলে তো বোঝা সহজ।
– না রে বাবু, সহজ নয়। মদনমোহন মিত্রের মেয়ে ত্রিপুরার কুমুদিনীর লহরী নামের বইটাতেও শ্রীমতী কুমুদিনী বসু লেখা আছে। মৃত্যুর পরে ওঁর স্বামী যখন ওঁর লেখা ছাপিয়েছেন, তখন কোথাও পণ্ডিতা কুমুদিনী বসু, আবার কোথাও স্বর্গীয়া কুমুদিনী বসু লেখা। কিন্তু জীবিতাবস্থায় তিনিও শ্রীমতী।
– বাপরে বাপ। কিন্তু, মা আমাদের কুমুদিনীর চার পাশেও তো, লেখাপড়া জানা লোকেরা ছিল। তারা কেন কেউ ওঁর জীবনী লিখলে না?
– কে লিখবে বল? স্বামী চলে গেলেন, বড় ছেলে, সেজ ছেলে জোয়ান বয়সে মারা গেল। মেজ ছেলে দেশান্তরী হল। মেয়েদের বিয়ে হয়ে সব সংসারে ব্যাস্ত। যে ছেলেরা চলে গেল, তারা ছিল জ্ঞানী-গুণী-বিদ্বান। কারোর জীবনী লিখতে গেলে একটু পরিণত হতে হয়, নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। সে বয়স আসার আগেই তারা চলে গেছে। বাকি দুটো ছেলে মনোমত মানুষ হল না। লেখাপড়ার ধার দিয়ে গেল না।
– সেকি? কারা লেখাপড়ার ধার দিয়ে গেল না? ক্ষিতীশচন্দ্র আর বিকাশচন্দ্র?
– হ্যাঁ, আমার গোঁফদাদু আর দাদুভাই। দাদুভাই নিজে ইস্কুল ফাইনাল পাশ করেনি। মা দিনরাত লেখার কাজে ব্যাস্ত থাকে বলে নাকি ছোট থেকে লেখাপড়ার ওপরে রাগ। নিজের মেয়ে মানে আমার মাকেও তো ইস্কুলে ভর্তি করতে চায়নি। শেষে দাঁতি মামার বৌ মানে ফুল মাইমা দাদুভাইকে খুব ধমকে মাকে নিবেদিতা ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কুমুদিনী যে ছেলেদের মুখ দেখতেন না, তারা লিখবে, মায়ের জীবনী? শোন, যা হয়ে গেছে, তা গেছে। মহাকালের চাকা তো ফেরানো যায় না। তাই যেটুকু আছে, সেটুকু বাঁচাই। নইলে আরও একশ’ বছর চলে গেলে তো এটুকুও থাকবে না।
– সে তো ঠিক কথা গো মা। যা গেছে তা যাক যাক – যা গেছে তা যাক। এবারে যা বলছিলে আগে, সেইটা বল।
– কুমুদিনীর সমসাময়িক হয়েও অনুরূপা দেবী কী করে ভুল করলেন, সেটাও মনে হয় ধরতে পেরেছি।
– তাই? বল তবে।
– যে বছর ‘পূজার ফুল’ প্রকাশিত হয়, সেই বছরেই ‘শিখের বলিদান’-এর ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইয়ের আকার, প্রচ্ছদ বিন্যাস, নকশা, লিপি সব একরকম। আলাদা করার উপায় নেই। ভুল না হওয়াটাই অসম্ভব।
– যাই হোক মা, আর কোনো সন্দেহ তো নেই।
- না, পরিচয় নিয়ে সন্দেহ তো আজ আমার আর নেই। আন্তর্জালের ভুল তথ্যগুলো যে কাঁটা ফোটাচ্ছিল, সেগুলো সব উপড়ে ফেলা গেছে। কী করে নিঃসন্দেহ হলাম, সেই গল্পটাই তো বলছি। যোগ্য উত্তরসূরী না থাকার জন্য, এত কিছু করেও কুমুদিনী হারিয়ে গেছেন। অন্তর্জালে একটা ছবি পর্যন্ত ছিলনা। যার জন্য এত ভুলভ্রান্তি উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে খবর ঘুরছে। এখন আমি জেনি ডট কমে একটা ছবি দিয়েছি।
দিনমানে শত কাজের ফাঁকেও পুরনো কথাগুলি বয়ে চলে এক নদীর মত। নিজে নিজে ভাবি আর উদ্ভ্রান্ত হই। শুধু তো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নয়, এশিয়াটিক সোসাইটির দরজাতেও কড়া নেড়েছি আমি। ওখানকার সেক্রেটারি সত্যব্রত চক্রবর্তী মশাই বিদ্বান মানুষ। আমাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রহালয় সমিতির প্রেসিডেন্ট শচীন্দ্রনাথ বাবুও বলেছেন, এই কলকাতা শহরের কোনো আরকাইভে যদি রেকর্ড থেকে থাকে, তবে তা বেরিয়ে যাবেই। স্বাধীনতার ইতিহাসে অনেকে লুকিয়ে আছেন, তাঁদের খুঁজে বের করাই আমাদের কর্তব্য। আশ্বাস দিয়ে তিনি হাসেন, প্রত্যুত্তরে আমিও হাসি, কিন্তু মনে মনে খুশি হতে পারি না। এক না পাওয়ার জ্বালা তাড়িয়ে বেড়ায়।
ওলো সই কুমুদ রানী, অ্যাপো একখানা চাই।
কার হাতে রয় কতটা সময়, কেই বা জানে তা ভাই।
কত কী লিখিলে, কী কী করিলে, পুরোটা যে জানা নাই,
আমি বাহিরে হেসেছি, হৃদয়ে কেঁদেছি, তব দেখা যেন পাই।