১
দিন চলে যায় নিজের মত। কন্যারা বড় হচ্ছে। দুই কন্যার আবদারে এক বিকেলে চিকেন আনা হল বাড়িতে। খাসির মাংস তাদের ফেভারিট তালিকায় পড়ে না। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও বক্সি বাড়ির রান্নাঘরে মাংস ছিল নিষিদ্ধ বস্তু। মাংস বলতে খাসি। মুরগি যে ঘরে খাওয়া যায়, সে ধারণা তখনও আসেনি। আমার শ্বশুরমশাই বাড়িতে মাংস রান্না শুরু করেন। বাড়িতে মন্দির আছে বলে যে সেকালে নিরামিষ খাওয়া হত, তা মোটেই নয়। আটখানা পুকুর ভর্তি নানারকম মাছ ছিল। ধানজমিতে মাছ ছিল। বাজারে সমুদ্রের মাছ ছিল। তাই মাছে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। খুব সম্ভবত মেদিনীপুরের নানা গুপ্ত সমিতি এবং বিপ্লবী সংসর্গের ফলে শ্বশুরমশাই মাংস খাওয়া রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু দাদাশ্বশুরমশাই তারিণীপ্রসাদের আচার বিচারের জন্য অন্দরমহলে মাংস ঢুকত না। তাঁর অজান্তে বাড়ির বাইরে রান্না করা হত। কর্তা গল্প করেন,
‘সেকালে আমিষ-নিরামিষ, এঁটো, সগড়ি, ছোঁয়াছুঁয়ি, মানামানির বড় বাড়াবাড়ি ছিল। উনুন, বাসন – এসব তো আমিষ নিরামিষের আলাদা ছিলই। মাকে যেহেতু দু’রকম রান্নাই করতে হত, দিনের মধ্যে – কি শীত, কি গ্রীষ্ম – একাধিকবার পুকুরে ডুবে চান করে শুদ্ধ হতে হত। গর্ভবতী অবস্থায়ও নিয়মের ছাড় ছিল না। আমরা ছোট ছিলাম, তখন অতশত খেয়াল করতাম না। এখন বুঝি, মা কী দিন কাটিয়েছে।
তবে পরিবারের চাপে নিয়ম মেনে নিলেও, বাবা-মা দু’জনেই ছিল মুক্তমনা। নিয়মের জালে নিজেদের মনটাকে বাঁধেনি। রবিবার বারোমাইলের হাট থেকে বাবা লুকিয়ে বিকেলে খাসির মাংস আনত, কিন্তু কলাপাতায় মুড়ে মাংসটা জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা হত। বিকেলে দুধ-খই খেয়ে নিলে, দাদামশাই আর হেঁশেলের দিকে আসতেন না। তখন রাতে ভিটের মধ্যেই গাছের আড়ালে বাবা-মা হারিকেন জ্বালিয়ে মাংস রান্না করত। আমি আর তপু দুপুর থেকে উত্তেজনায় ফুটতাম। কথাবার্তায় দাদামশাই যাতে কিছু বুঝতে না পারেন, তাই দু’ভাই মিলে মাংসের সাংকেতিক নাম দিয়েছিলাম মাং। কেবলই খোঁজ নিতাম, “মা, বাবা মাং আনল?” রাত্তিরবেলা গরম গরম মাংস আর আলুর ঝোল দিয়ে ভাত – মনে হত ওটাই স্বর্গ। কিন্তু তপুটা (আমার দেওর) ছোট তো, উত্তেজনায় ঘুমিয়ে পড়ত। মা ওর জন্য হাড়ওলা টুকরো বেছে বাটি করে রেখে দিত। রাত দেড়টা, দুটোয় যখন খিদের চোটে ওর ঘুম ভেঙে যেত, তখন একা একা উঠে কুড়ুর মুড়ুর করে হাড় চিবোত। খুব ছোট থেকেই ওর দুর্জয় সাহস। অন্ধকার বা কোনো কিছুতে ভয় পায় না। দাদামশাই মারা যাবার পর রান্নাঘরেই মাংস রান্না শুরু হল, বাধানিষেধ রইল না।’
যা হোক, এসব যেন গত জন্মের কাহিনী। বর্তমানে, সন্ধেবেলায় কন্যা এসে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে,
- আজ চিকেনের কী প্রিপারেশন হবে মা?
- চিকেন হরিয়ালি করব।
- সেটা কীভাবে হয়?
- চিকেনটা কিউব করে কেটে নিতে হবে। বোনলেস বা উইথ বোন যে কোনোটাই চলবে। আমি এখন হাড়সমেত করছি।
- হরিয়ালি হবে কী করে?
- চিকেনে রসুনটা বেশি লাগে, আদা কম। খাসির মাংসে ঠিক উল্টো। এটা তিনকেজি চিকেন রান্না হচ্ছে। আমি দু’মুঠো রসুনের কোয়া, একমুঠোর একটু কম কাঁচা লঙ্কা, তুলনায় অল্প আদা, দু’আঁটি ধনে পাতা আর দু’আঁটি পুদিনা পাতা একসঙ্গে মিক্সিতে পিষে নিয়েছিলাম বিকেলে। এই মশলাটা চিকেনে খুব ভাল করে মাখিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। এর সঙ্গে পরিমাণ মত ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো আর টক দই মিশিয়ে মাংসে মেখে নিয়েছি। সেই বিকেল থেকে মশলামাখা মাংস ঢাকা দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম, এখন ঘণ্টাতিনেক হয়ে গেছে। তাই সাদা তেলে গরমমশলা, গোলমরিচ আর শা’জিরে ফোড়ন দিয়ে এখন পেঁয়াজকুচো ভাজছি। ভাজা হয়ে গেলে ওতে মশলামাখা মাংসটা ঢেলে দেব। নাড়তে নাড়তে তেল ছেড়ে যাবে। আঁচ কমিয়ে একটু ঢাকা দিয়ে দিলে, চিকেন, বাটা মশলা আর দই থেকে যে জল বেরোবে, তাতেই মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে।
- এই রান্নাটা কার কাছে শিখেছ?
-ইউটিউব। তবে ভেটকি মাছেও এই প্রিপারেশনটা ভাল লাগে। অবশ্য পেঁয়াজ, রসুন সব কম লাগবে মাছ দিয়ে করলে।
- আচ্ছা, কর দেখি।
বলেই সে দিদিকে হাঁক দেয়, “দিদি রে, আজ সবুজ রঙের তৃণমূল চিকেন রান্না করছে মা”।
- অ্যাই, বদমাইশ, কোনো কিছু সবুজ হলে তৃণমূল হয়ে যায়?
- এখন হচ্ছে তো মা। দেখছ না, সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ার হল। লাল কার্পেট উঠে চারদিকে সবুজ কার্পেট হচ্ছে ফাংশনে।
- শোন রক্ত সবুজ হয় না, গাছের পাতা লাল হয় না।
এবারে কন্যার বিজ্ঞ দিদির হাসিমুখে আবির্ভাব হয়।
- লাল সবুজ তো ঠিক আছে জেঠিমা। রং দে তু মোহে গেরুয়ার কী হবে?
- কেন, গেরুয়া রং খুব ভাল। ত্যাগের রং, জাতীয় পতাকার প্রথম রং। বিবেকানন্দের জোব্বার রং।
- বিবেকানন্দ? খুব ভাল মানুষ। আমার মতই খেতে ভালবাসতেন। আজও বেলুড় মঠে ওঁর রেসিপিতে খিচুড়ি হয়, চাটনি হয়। কিন্তু বিবেকানন্দের সব কথা তুমি মানো জেঠিমা?
- মোটামুটি মানি। উনি আমার শক্তি। আমার ইনস্ট্যান্ট এনার্জি ট্যাবলেট।
- কিন্তু সীতা সাবিত্রীর কথাটা। মেয়েরা এখনও সীতা হবে? পিতৃতন্ত্রের তলায় পিষ্ট হয়ে থাকবে? আমাদের ইস্কুলের একজন স্যার খুব সমালোচনা করেন।
- দেখ বাবু। প্রত্যেকটা মানুষ, সে তিনি মনীষী হোন আর যেই হোন, তিনি সেই যুগের হাতে বন্দি। হয়তো উনি আজকের যুগে থাকলে, সেযুগে নিজের বলা অনেক কথাই ফেলে দিতেন। আমি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম – রমাতোষ সরকারের লেখা। সেখানে উনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন, কেন দেড় হাজার বছর আগেকার গণনার সূর্যসিদ্ধান্ত না মেনে আধুনিক সরকারি বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মানতে হবে। ঐ বইতে একটা জায়গায় উনি লিখেছেন, যে সূর্য সিদ্ধান্ত রচয়িতা সে যুগের মানুষের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কারণ পূর্বপ্রচলিত বেদাঙ্গ জ্যোতিষ না মেনে, ঐ বইতে তৎকালীন আরব এবং রোমান গণিত ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই তিনি আজকে কোনোভাবে এসে পৌঁছলে নিজের আগের গণনা বর্জন করে, আধুনিক বিজ্ঞানটাই নিতেন। আজকে যে ঐ পঞ্জিকার গণনায় ভুল থাকছে, সেটা ঐ গ্রন্থকারের পক্ষে অগৌরবের নয়। সে যুগে যা অসম্ভব ছিল, তা না পারার দায় তাঁর নয়। এই কথাটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে।
- হুঁ, কথাটা তো সত্যি মা, তার মানে হচ্ছে, প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সম্মান করতে হলে, প্রাচীন গণনা নয়, তাঁদের যুক্তিবাদী মনটাকে নিতে হবে এবং নতুন পরীক্ষিত বিজ্ঞানকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে – তাই তো?
- হ্যাঁ রে মা, বিবেকানন্দের ক্ষেত্রেও আমি সেই পথ নিয়েছি। উনি কোথায় কী স্ববিরোধী কথা বলেছেন, তা ঊনকোটি চৌষট্টি বিচার না করে, তাঁর হৃদয়, দেশপ্রেম, শক্তি, আহ্বানকেই আমি বড় করে দেখি। আর তাছাড়া সীতাকে কি তোরা খুব দুর্বল চরিত্র মনে করিস? আমি মনে করি না। আমি একজনের কথা জানি, যিনি সীতার মত হয়েছিলেন।
- কে বল তো?
- আমার দিদা, লাবণ্যপ্রভা।
- আবার গল্প রে বোনু। মাঝপথে জেঠিমা যেন না পালায় দেখ।
- আরে না না। রান্নাটা হয়ে গেলেই মাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেব।
- দেখবি? বড্ড জ্বালাচ্ছিস তোরা।
রান্না হয়ে গেলে দুই মেয়েকে নিয়ে দাওয়ায় বসি।
- লাবণ্য দিদার সংসারের গল্প বল মা।
- শুনবি? সে অনেক কথা। তোদের ধৈর্য্য থাকবে না।
- থাকবে থাকবে, বল। বলবে কি না?
- গল্পটা পুরোটা লাবণ্যপ্রভার নয় রে, বলতে পারিস মায়ের ঠাকুমা, মায়ের মা, আমার মা আর আমার গল্প; মানে কুমুদিনী, লাবণ্য, কৃষ্ণা আর শারদার গল্প।
- আচ্ছা বল।
কবে সেই চাঁদ উঠেছিল যেন,
কবে জ্বলেছিল রবি।
আঁকতে পারি না, শুধু লিখে যাই,
স্মৃতিপটে দেখা ছবি।
ইস্কুলে ছুটি হত বিকেল সাড়ে চারটে। মায়ের সঙ্গে নিবেদিতা লেন থেকে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় অবধি হেঁটে যেতাম। সেখান থেকে বাস। গিরিশ এভিনিউ আড়াআড়ি পেরিয়ে শ্যামপার্কের গলি, একটু এগিয়ে নববৃন্দাবন। তার পর ডানদিকে শ্যামপার্ক, বাঁদিকে সেনবাড়ি ছাড়িয়ে মণীন্দ্র কলেজের পাশ দিয়ে ভূপেন বোস এভিনিউ। তারপর সোজা মোড় অবধি হাঁটা লাগাতাম। নববৃন্দাবনের পথে ঝুলনের আগে মাটির পুতুলের পশরা বসত। আর দেখলেই আমি খুব বায়না করতাম। আইসক্রিমওলা, নাড়ুগোপাল, পুলিশ, ঘড়া-কাঁখে, ঘোমটা-মাথায় মেয়ে, গোরু, হাতি, বর-বৌ। এক একদিন বায়নায় পাগল হয়ে মা পুতুল কিনে দিত। দু’হাতে দুটো পুতুল নিয়ে রানীর মত বাড়ির পথ ধরতাম। কিন্তু যেদিনই শিকে ছিঁড়ত, সেদিনই কেমন করে জানি বৃষ্টি এসে যেত। প্রাণপণ নিজে ভিজে পুতুল বাঁচাতাম। কোনোদিন হয়তো শ্যামবাজারের কোনো সহৃদয় দোকানি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট দিয়ে পুতুল মুড়ে দিতেন। যখন সেগুলো বাড়ি আসত, কোনোটার অভ্র ঝরে গেছে, অথবা কাঁচা মাটির ওপর রঙ চটে গেছে। তবু আনন্দের ঘাটতি ছিল না। হোক না ছাল ওঠা, নাক ভাঙা, আমার ভাণ্ডার কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। সেগুলো সাজিয়ে ঝুলন করতাম।
ঐ শ্যামপার্কের পাশে সেনবাড়ি হল আমার একরকম মামার বাড়ি। মামারা ছিলেন বয়স্ক। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসতাম। আর নারান মামা প্রায়ই সেনবাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আসতেন। নারান মামা বাসে উঠতে পছন্দ করতেন না। বাগবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে পাতিপুকুরে আমাদের বাড়ি যেতেন। মাকে ডেকে বলতেন, “রাজকুমারী, একটু ভাল করে ডাল কর তো। ও বাড়িতে কত লোক। চৌবাচ্চায় ডাল ঢালা হয়। ফোড়নের গন্ধ পাই না।” সেনবাড়ির যৌথ পরিবারের সদস্য অনেক। তাছাড়াও অতিথি অভ্যাগতের ঢল লেগে থাকত। রান্নার ঠাকুরেরা শেষের দিকে উপায়ান্তর না দেখে ডালে ভাতের ফ্যান মেশাত। আর সেটাই নারান মামার রাগ। নারান মামা সেনবাড়ির হেঁশেলের গল্প করতেন। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম।
সেনবাড়িতে সকালে বিকেলে দু’শ’ আড়াইশ’ করে লোকের পাত পড়ত। একে একান্নবর্তী পরিবার, তায় তার আশ্রিত, আত্মীয়, অনাহুত, রবাহূত কেউই অভুক্ত থাকত না। সব গিন্নিরা সকাল হলেই কাজে লেগে পড়তেন, আর তাঁদের সাহায্য করার জন্য ছিল বিহারী ঠাকুরের দল। তারা বংশ পরম্পরায় ও বাড়িতে থাকত। সেনবাড়ির কিছু ভূসম্পত্তি আছে শিমূলতলায়। সেখান থেকেই এককালে তারা এসেছিল।
- এখনও আছে মা?
- হ্যাঁ, এখনও আছে। মায়ের কাছে শুনেছি, আমার দাদুরও শিমূলতলায় জমি বাড়ি ছিল।
- আমরা যাব জেঠিমা। শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা।
- কী করে যাবি? মায়ের ভাগের সেসব সম্পত্তি এখন কিছুই নেই। দাদু সব উড়িয়ে দিয়েছে। গেলে টুরিস্ট হয়ে যেতে হবে।
- আচ্ছা, তারপর বল।
- সেনবাড়িতে দুটো খুব বড় বড় ঘর ছিল। একটা ভাঁড়ার ঘর, আর একটা কুটনো কোটার ঘর। আর রান্নাঘর ও দুটো ছিল, একটা নিরামিষের আর একটা আমিষের জন্য।
- ভাঁড়ার কী গো মা?
- ভাঁড়ার মানে ভাণ্ডার। সেখানে চাল, ডাল, তেল, মশলা, চিঁড়ে, মুড়ি – যা যা খ্যাঁটনে লাগে সব থাকত। সেকালে সব বাড়িতেই আলাদা ভাঁড়ার ঘর থাকত। গিন্নিরা সকালে বাসি কাপড় ছেড়ে, কাচা কাপড় পরে, তবেই রান্নাঘরের জিনিসে হাত দিতে পারত। চুল টান করে বেঁধে রাখতে হত, যাতে রান্নার উপকরণে চুল না পড়ে যায়। অনেক বড় বড় পরিবারে মুখে কাপড় বেঁধে রান্না করতে হত, বাটনা বাটতে হত, যাতে কথা বলতে গিয়ে থুতু না ছেটায়। আবার মার কাছে শুনেছি আমার দিদা ভাঁড়ার ঘরে বসে লুকিয়ে পড়াশোনা করত।
- অত সম্পর্ক বলতে হবে না জেঠিমা। কুমুদিনী, লাবণ্য, কৃষ্ণা সব নাম ধরে বল। আমরা বুঝে নেব। লাবণ্যকে লুকিয়ে পড়াশোনা করতে হত কেন? তাছাড়া ভাঁড়ার ঘরে তো দাসদাসী সকলেই ঢুকবে, লুকোবে কী করে?
- এই কথাটা ছোটবেলায় আমিও কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে গল্প অন্য রামায়ণ। এখন মহাভারত শোন। মোহনবাগানের মহাভারত।
- বুঝলাম না, মোহনবাগানের মহাভারত মানে?
- মানে হল, সেনবাড়ির সঙ্গেই জুড়ে আছে মোহনবাগান।
- কী বলছো মা! ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের মোহনবাগান? তাড়াতাড়ি বল, ফাস্ট।
- বলছি তো রে বাবা। তোরাই তো ট্র্যাক চেঞ্জ করে গুলিয়ে দিচ্ছিস। সেনবাড়ির বিশাল ভাঁড়ার ঘরে থাকত এক পেল্লায় দাঁড়িপাল্লা। একজন হেড গিন্নি থাকতেন। তিনি কখন কার কী দরকার বুঝে রোজকার চাল-ডাল-মশলাপাতি বার করে দিতেন। আর কুটনো কোটার ঘরে সব বৌদের আলাদা আসন পিঁড়ি আর নাম লেখা বঁটি থাকত।
- নাম লেখা বঁটি?
- সে যুগে বাসন কোসনেও নাম লেখানোর খুব চল ছিল। আমার ছোটবেলায় মায়ের নাম লেখা গেলাস, আমার নাম লেখা থালা বাটি ছিল।
- কীভাবে লিখতে মা? মার্কার পেন দিয়ে?
- আরে না রে পাগল, লোক আসত বাড়িতে, যারা বাসনের গায়ে ঠুকে ঠুকে ফুট ফুট করে নাম ফুটিয়ে তুলত।
- আচ্ছা।
- তোদের এই মৈতনার রান্নাঘরে যেমন সকাল থেকে উনুন জ্বলছে, লোক আসছে, অনেকটা এরকমই। কিন্তু এখানে যেমন রোজ পঁচিশ-তিরিশ জনের ব্যাপার, সেনবাড়িতে ওটা দু’শ’, আড়াইশ’। মানে আমাদের এখানকার সিস্টেমটাকে আটগুণ বড় করে কল্পনা কর।
সকালে জলখাবারে কোনোদিন ডালপুরি, কখনও লুচি, রুটি এইসব হত। সঙ্গে মিলিয়ে আলু ছেঁচকি, চাকা চাকা করে আলু ভাজা, আলু মরিচ, সাদা আলুর তরকারি এইসব হত এক একদিন।
- সব আলু?
- হ্যাঁ, আমাদের ছোটবেলায় বা তার আগের যুগে লোকে খেয়ে বাঁচত। অত হার্টের রোগ, পেটের রোগ, ডায়াবেটিসের ভয় ছিল না।
- আলু ছেঁচকি কী করে করে গো মা?
ছেঁচকি আর তরকারির মধ্যে তফাৎ কী?
- ছেঁচকিতে আলু হোক, পেঁপে হোক, অন্য সবজি হোক – একটু ছোট করে কেটে জলে ভাপিয়ে নেওয়া হয়। তারপর অল্প তেলে হয় গোটা সর্ষে, নতুবা কালো জিরে, তার সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ঐ তেলে ভাপানো সবজি দিয়ে নেড়ে নিতে হবে। নুন মিষ্টি দেখে নামিয়ে নিতে হবে। সবজি ভাপানো থাকে বলে, এতে কম তেল লাগে। অনেক সময়ে বাজারে আনা সবজি পুরোনো হয়ে বুড়িয়ে গেলে তাই দিয়ে ছেঁচকি করা হয়। কিন্তু তরকারিতে আগে কাঁচা সবজি ভেজে, মশলা দিয়ে কষে তারপর জল দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। এটাই তফাৎ।
- বুঝলাম, তারপর বল।
- দুপুরে ডাল, চচ্চড়ি, চাটনি – যাই হোক, পোনা মাছের পাতলা ঝোলটা হত। ওবাড়ির লোকের এমন অভ্যেস ছিল, যে অনেকে ঐ জিরে ধনের ঝোল ছাড়া ভাত খেতে পারত না। আমার মা, মানে কৃষ্ণাও অমন ঝোল রাঁধতে জানত। মা সবসময়ে জিরেও দিত না। বেশিরভাগ সময়ে শুধু ধনেগুঁড়ো দিয়ে ঝোল করত। অমৃত লাগত।