৭
“তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে –
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।”
পরদিন একতিরিশে ডিসেম্বর। যা কিছু আগে থেকে ঠিক হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবেই দেবদারু বনে আমরা চড়ুইভাতি করি। ছুটকি হুজুগে পড়ে শিলনোড়ায় অনেক মশলা বাটল, কিন্তু বড়কি ফাঁকি দিয়েছে, কেবল খুন্তি ধরে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছে। যাই হোক হাসি মজা করে রাতে বনফায়ারও হয়। সবই হয়, তবু যেন ঠিক জমে না। শীতের ছুটি ফুরিয়ে আসে। কিঞ্চিত ভারি মন নিয়ে আবার আমরা শহরে ফিরি। কিন্তু এ জীবন ছন্দে ফিরতে গিয়েও হোঁচট খায়, কারণ মার্চ মাসে সব বন্ধ। কারখানা নয়, এই পৃথিবীটা লকডাউন হয়ে যায়। কী যেন এক বিচ্ছিরি অসুখ এসেছে চারপাশে। ঘর থেকে বেরোতে না, পাশাপাশি বসতে না, হাতে কিছু ধরতে না – সবেতে না। মাস্ক, গ্লাভস, সাবান, স্যানিটাইজার, কোয়ারেন্টাইন – এমন নানা শব্দ বুকের ওপর ভারি হয়ে চেপে বসে। এবাড়ি ওবাড়ি থেকে কিছু কিছু খারাপ খবর আসতে থাকে। দেশ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল, ছাঁটাই, বেতন বন্ধ আর মানুষের দীর্ঘশ্বাস ঘুরপাক খেতে থাকে। মতির ছেলেদের ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায়। কর্তার কাছে খবর পেলাম তারা তিনজন বহু কষ্টে কোনোক্রমে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু তিনজন কেন? একটা ছেলেই তো ক্যান্টিনে কাজ করত। বাকি দুটো তো ঘরেই থাকত। ইস্কুলে পড়ত। কর্তা বলেন,
– আর ইস্কুল, আমরা ফিরে আসার পরেই তাদেরকেও মতি পড়া ছাড়িয়ে কাজে ঢুকিয়েছিল।
– কিন্তু কেন?
– কেন আবার! ইস্কুলে তো যায় না। বাড়িতে কেউ দেখার নেই। ইস্কুলে হ্যাটা খায়, যেতে চায় না। এর ওর বাগানে উৎপাত করে, পাড়া প্রতিবেশীদের নিত্য অভিযোগ, ঝগড়াঝাঁটি – এইজন্যে।
– এখন কী হবে?
– এখন বাড়িতে এলে কী আর হবে, লবডঙ্কা। ইস্কুল তো বন্ধ।
মাসকয়েক পরে একদিন লকডাউনের মধ্যে উস্কোখুস্কো চুল, মলিন মুখ মতি আমাদের শহরের বাড়িতে এসে হাজির। দু’চোখে রাতজাগা কালি। আমরা তো দেখে অবাক। কোন নার্সিং হোমের গাড়ি করে, কাকে না কাকে ধরে হাজির হয়েছে। তাড়াতাড়ি তাকে স্যানিটাইজার স্প্রে করে স্নানে পাঠানো হল। কিন্তু ব্যাপারটা কী?
মতি খেয়েদেয়ে একটু থিতু হবার পর বুঝলাম ব্যাপার বেশ ঘোরালো। অতিমারীতে সাধারণ মানুষের খাদ্যসুরক্ষার জন্য কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকার যে রেশন দিচ্ছে, তা মতির নাগালে নেই। তার বাড়িতে তিন ছেলে, শাশুড়ি, সে নিজে – এই পাঁচ পেট চালানোর মতো যথেষ্ট খাবার নেই। প্রায় একযুগ আগে মতির বর যে পাঁচজনকে তাড়িয়ে দিয়েছে, রেশন কার্ড দেয়নি। সেই সবার রেশন ভোগ করে। বছরের অনেকটা সময়েই ওদের খাওয়াদাওয়া বক্সি বাড়িতে চলে। যখন আমরা বা দেওর, ননদ গ্রামের বাড়ি যাই, ওরা এসে থাকে। বাকি সময়ে চাল গম কিনে খায়। এখন আমরা কেউ বাড়ি যাচ্ছি না। বাঁশের বেড়া দিয়ে গ্রামে ঢোকার রাস্তা বন্ধ। তাই ওদের গ্রাম থেকে এসে আমাদের কেয়ারটেকারের কাছেও যে চাল চাইবে সে উপায় নেই। ছেলেরা বাপের কাছে রেশন কার্ড উদ্ধার করতে গিয়েছিল। কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝগড়ির পরে বাপ ছেলেদের গায়ে হাত তুলেছে, মেরেধরে ভাগিয়ে দিয়েছে। তারপর বীরপুরুষটি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে, ছেলেরা ওকে মেরে ফেলতে চায়, মতি ছেলেদের পিছনে থেকে তাদের উস্কেছে। ছেলেদের হাতে মার খেয়ে ও নাকি ভয়ানক আহত। কী সব ভুয়ো ডাক্তারি কাগজ বের করেছে, মাথায় সাদা ফেট্টি বেঁধে ঘুরছে। আর এইসময়ে মতির মোবাইল ফোনে হোয়াটস অ্যাপে একটা কী সরকারি কাগজের ছবি পাঠিয়েছে। গাঁয়ের লোকে দেখে বলেছে এটা আদালতের কাগজ – তোকে আর তিন ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। একে ভাত জুটছে না, তার ওপরে এই ঝামেলা। তাই মরিয়া হয়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছে। মতির ফোনের অস্পষ্ট ছবিটা কম্পিউটারে নিয়ে বড় করে দেখা যায়, সত্যিই সেটা আদালতে দায়ের হওয়া অভিযোগের কাগজ। কাগজটার নম্বর নিয়ে কাঁথি কোর্টের চেনা মানুষকে দিয়ে খবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু একে লকডাউন। খবরাখবর নিতে সময় লাগবে। এর মধ্যে আবার শুনলাম মতির ছেলেরা ফের বাবার কাছে গিয়েছিল বলতে যে অভিযোগ যেন তুলে নেয়। বাপ বলে পাঠিয়েছে, তোদের মাকে বল আমাকে নিঃশর্ত আইনি বিচ্ছেদ দিয়ে দিতে, তবে মামলা তুলব। সপ্তাহ খানেক পর কোর্টের খবর আসে, জানা যায় কাগজটা ভুয়ো। এমন কোন কাগজ আদালতে জমাই পড়েনি। সবই মতির বরের চালাকি। মা আর তিন ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুলিশ আসবে শুনে সকলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওরাও তো আর সব সময়ে সোজা পথে চলে না। তবে ডামাডোলে রেশন কার্ড ফেরৎ পাবার কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। শহর থেকে বিস্তর ফোনাফুনি করে মতি যাতে চাল গম পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মতি অনেক জ্বালিয়েছে ঠিকই, ওর এই দুর্দশার দিনে মোটেই খুশি হতে পারি না। বরঞ্চ কপালে করাঘাত করে ভাবি, এই মতি এখনও স্বপ্ন দেখে যে তার যোগ্য বর ওকে আবার ঘরে নেবে, আবার ও তার সঙ্গে সংসার করবে।
যা হোক, ওদের খাওয়াদাওয়ার তো হিল্লে একটা হল, তবে মতি তো আর বাংলায় একা নয়, ওর মতো আছে আরও কত, রেশনের বিনি পয়সার চাল গম যাদের নাগালের বাইরে, এই লকডাউনে যারা ঘরে ঘরে চাল চেয়ে ফেরে। চাল হয়তো সকলেই দেয়, কেউ করুণা করে, কোথাও চালের বিনিময়ে শ্রম লাগে, কোথাও অন্য কিছু।
অতিদীর্ঘ ভয়াতুর সেই অনবসরে পল পল যেন কাটতেই চায়,না। প্রতিবেশীমণ্ডলে একটি একটি তারা খসে, কালো আকাশ আঁধার আরও আঁধার হয়। পাশে থাকা ভাইকে করোনাসুর আক্রমণ করে বসে। ভাই হাসপাতালে থাকে। বাড়িতে আমরা দীঘল রাত জাগি। ভাইয়ের অল্পবয়সী শ্যালক ছোটাছুটি করে যোগাযোগ রাখছিল। তাকেও কি ঐ অসুর রেহাই দেয়? সময়ের চাকা খুব ধীরে ধীরে ঘোরে। ভাই বাড়ি ফেরে, তার শ্যালক ফেরেনা। শেষ দেখা হয়না। বাড়িতে তার বুড়ো বাপ মা, স্ত্রী, শিশু পুত্র কন্যা নির্বাক হয়ে থাকে। সে আছে, এই সেদিনও ছিল। হঠাৎ নেই। একথা কি সত্যি? এমনি করে কাটে মাস। প্রথম ঢেউ থিতিয়ে আসে। শহর জুড়ে শুরু হয়ে যায় ভোটের কনসার্ট। সুখ দুঃখের হারমোনিয়ামকে শব্দে হারিয়ে দেয়, ধর্ম ভেদ, জাতি ভেদ, বর্ণ ভেদ, অর্থ ভেদের বিউগল। করোনাসুর দ্বিতীয় বারের জন্য ঘন হয়ে আসে। আমার ছোট্ট সংসারে সে এবার তীব্র আঘাত হানে। একটা সূচোলো হুল ফুটিয়ে আমার কর্তার রক্তের অক্সিজেন চোঁ চোঁ করে টেনে নিতে থাকে। আমার নিয়ন্ত্রণে কিছু থাকে না। পাড়া জুড়ে সকলে আঁতিপাঁতি খুঁজে বেড়ায় – এ শহরের কোন কোণে আছে একটি নিরাপদ বিছানা। অবশেষে ঈশ্বর সদয় হন। পার্ক স্ট্রিটের মিশন অব মার্সি হাসপাতালে ডাক্তার আসিফ ইকবালের তত্ত্বাবধানে কর্তা ভর্তি থাকেন। পরীক্ষায় জানা যায়, তাঁর শরীরে কোভিড উনিশ আর ডেঙ্গু যুগল জ্বর বাসা বেঁধেছে। কর্তাকে ভর্তি করে ফিরতি পথে খবর আসে কন্যাও পজিটিভ। থৈ পাইনা। আমার নিয়তিতে কী লিখেছেন জগদীশ্বর। সেই একাকী নির্জনতায় হঠাৎ কলিং বেল বাজে। দেখি সামাজিক দূরত্ব উনুনে ফেলে আমার শহরের হেঁশেলে ঢুকেছে মতি বৌ। সে কোথা থেকে খবর পেয়ে আবার কাকে না কাকে ধরে এসে হাজির হয়েছে। ওকে দেখে শূন্য বাসায় আবার খড়কুটো খুঁজে পাই। মতির হাতে মেয়ে সমেত সর্বস্ব ফেলে আমি হাসপাতালে পড়ে থাকি। গ্রামের বাড়িতে গোপীনাথের কাছে তুলসী পড়ে, ডেমুরিয়ার জগন্নাথের কাছে জমা হয় গাঁয়ের পড়শির কত মানত, শহরে এক খৃষ্ট হাসপাতালের দেওয়ালে মাথা কুটে ইষ্ট নাম জপ করি আর দেওয়ালের ওপাশে সংগ্রাম করেন এক মুসলমান ডাক্তার। মতি আমার সংসার সামলায়, ভারত মায়ের নয়নবারিতে শুদ্ধ হয় আমার এই মিথোজীবী যাপন। অবশেষে ইষ্টদেবতা কৃপা করেন। দক্ষিণের সমুদ্রে নিম্নচাপ কেটে সূর্যোদয়ের রক্তিমাভা লাগে। দীর্ঘ লড়াই শেষে কর্তা বাড়ি ফেরেন, কন্যাও সুস্থ হয়ে ওঠে। জানি না ঝড়ের এ বিরতি কি সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী।
এ জগতে নিজের নিয়মে
মেঘ আসে, মেঘ যায়,
রোদ ওঠে, ছায়া হয়,
যেন এক স্বপন চলন।
আমার জীবনে এত
ছায়া কাঁপে, আলো আসে,
চোখ জুড়ে ঘুম বসে,
এ কাহিনী নয় শুধু অতীত কথন।