“কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি
শ্যামচন্দ্র নাহিরে
.....
অলস যমুনা বহয়ি যায়
ললিত গীত গাহিরে।”
- আমাকে বাদ দিয়ে তোমাদের কী গল্প হয়ে যাচ্ছে জেঠিমা?
- এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে তোমার জন্যে কে বসে থাকবে মহারানী?
- হে হে, তা কী কথা হচ্ছিল?
- এই চৈতন্যদেবকে নিয়ে কথা হচ্ছিল।
- চৈতন্যদেব? বিষয়টা কী?
- বিষয়টা হল আমার মনে হচ্ছে, উনি আমার লাইফটা অনেকটা কন্ট্রোল করছেন।
- সে আবার কী? ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। নতুন কোনো খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার?
- দিদি, খাওয়াদাওয়া ছাড়া তোর মাথাতে আর কিছুই আসেনা না।
- খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারও আছে। বিবেকানন্দের যেমন খিচুড়ি, চৈতন্যদেবের তেমন দইচিঁড়ে – দুটোই আমরা মহানন্দে খেয়ে যাচ্ছি। দুশ’-পাঁচশ’ বছর কোনো ব্যাপার নয়, আরও কয়েকশ’ বছর ধরে খাব।
- এটা দিয়েই তোমার লাইফ কন্ট্রোল করা হচ্ছে?
- না, পুরোটা ঠিক তা নয়।
- আসলে মায়ের মামার বাড়ির গৃহদেবতা কৃষ্ণ, বাপের বাড়ির সংস্কৃতিতেও সেই একই ধারা। মা বলছে এসব চৈতন্যদেবের প্রভাব।
- শুধু মামার বাড়ি, বাপের বাড়ি কেন বলছিস, কাজের বাড়ি মানে আন্দুল, আর শ্বশুরবাড়িও তো তাই।
- আন্দুল কলেজের সঙ্গে, আমাদের বাড়ির সঙ্গে চৈতন্যদেবের কী সম্পর্ক, জেঠিমা?
- এগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু লতায়-পাতায় অনেক কিছু আছে।
- ওকে, তাহলে প্রাতরাশ করতে করতে লতাপাতার জঙ্গল কিছু সরাও, যাতে আলো ঢুকতে পারে।
- চল সবাই নিচে রান্নাঘরে যাই।
মুড়ি আর গরম গরম ঘুগনি মেখে চলল আমাদের প্রাতরাশ। যদিও এখানে রাঁধুনি দিদিরা ঘুগনিতে প্রচুর আলু আর কাঁচা পেঁয়াজবাটা দেয়। হেড কুক যে বৌটি, তিনি কুচো পেঁয়াজ খান না। তাই তাঁর করা রান্নাতেও ও জিনিসটি ব্রাত্য। তরকারিটা ঠিক আমাদের চেনা ঘুগনি হয় না। তবে এখানে একে ঘুগনি বলাও হয় না। সবাই বলে মটরের তরকারি। প্রথম প্রথম জিভে অচেনা লাগলেও, এত বছরে মানিয়ে নিয়েছি। এখন আর অসুবিধে হয় না। তবে কর্তাদের খাবার আলাদা। তাঁরা খাবেন পান্তা, বেগুন পোড়া, কাঁচা লঙ্কা আর কাঁচা পেঁয়াজ। খেতে খেতে ইতিউতি গল্পগাছা চলে। কিন্তু মেয়েরা ভবি ভোলার নয়।
- আন্দুলের গল্পটা বল জেঠিমা।
- আনুমানিক সাতশ’ বছর আগে নানাবিধ বিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চার পীঠস্থান হিসেবে আন্দুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তখন এই এলাকার নাম আন্দুল ছিল না। লোকমুখে সরস্বতী নদীর পাশে এই এলাকাকে বলা হত দক্ষিণের নবদ্বীপ। নামকরণের কারণ জানতে হলে আবার আমাদের চলতে হবে শ্রীচৈতন্যের যাত্রাপথে।
- একসঙ্গে পা বাড়িয়েছি জেঠিমা।
- আন্দুল কলেজে যোগ দেবার পর নেশা চাপল স্থানীয় ভৌগোলিক হব। এলাকাটাকে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে হয়েছিল।
প্রবীণ অধ্যাপকদের থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম: ধর্ম-বিপ্লবী, সমাজ-সংস্কারক এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই যুগপুরুষ উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়ার পথে আন্দুলে এসেছিলেন। কিন্তু ১৫১০ খৃষ্টাব্দে প্রথমবার যাত্রায় নয়। বঙ্গ থেকে পুরীযাত্রার পথগুলির মধ্যে নাকি সহজ পথ ছিল পানিহাটি-আন্দুল-শাঁখরাইল-নিমকির খাল-বাগনান-কোলাঘাট-পাঁশকুড়া-রঘুনাথবাড়ি-পিছলদা-নারায়ণগড়-বেলদা-দাঁতন-জলেশ্বর-রেমুনা-কটক হয়ে পুরী – এই পথটি। কিন্তু এই পথটা মূলত জলপথ। একে জলদস্যুর ভয়, তায় এপথে তখন উড়িষ্যার রাজা প্রতাপ রুদ্র ও বাংলার সুলতান হুসেন শাহের অধিকারের লড়াই চলছে। তাই তিনি নাকি সপার্ষদ দ্বারির জাঙ্গাল নামক পথ, অর্থাৎ লিলুয়া থেকে গঙ্গার পাড় ধরে কালীক্ষেত্র-আটিসারা-ছত্রভোগ-তমলুক-নরঘাট-নারায়ণগড়-দাঁতন-জলেশ্বরের রাস্তা ধরেন। বাকি অংশ আগের পথের মত – মানে জলেশ্বর থেকে আবার রেমুনা হয়ে পুরী। এ পথ জঙ্গলাকীর্ণ। লোকের খুব একটা নজর থাকে না। এরপর কালক্রমে উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র এবং হুসেন শাহের দুই পরাক্রমী মন্ত্রী সাকর মল্লিক (কোষাধ্যক্ষ) ও দবীর খাস (ব্যক্তিগত সচিব) চৈতন্যের বশীভূত হন, পরবর্তীতে যাঁরা পরিচিত হলেন পরম ভক্ত সনাতন ও রূপ গোস্বামী নামে। এইবারে চৈতন্য ব্যবহার করলেন অপেক্ষাকৃত সুগম আন্দুল-সাঁকরাইল ছোঁয়া পথটি।
- তুমি ওসব জায়গায় গেছ জেঠিমা?
- হ্যাঁ, সাঁকরাইলে মাঝেমধ্যেই যেতে হয়। মানিকপুর থানার পাশে সরস্বতী নদী পড়ছে ভাগীরথী-হুগলীতে। ঐ জায়গায় গঙ্গার বাঁকে ভয়াবহ ভাঙন আছে। আমরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ওখানে ব্যাঙ্ক ইরোশন ম্যাপিং করতে যেতাম। প্রথমবার গিয়ে দেখি, সব দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা আছে। শাঁখরাইল – সাঁকরাইল নামটা আসল নয়, ওটা ইংরেজি বানান করতে গিয়ে হয়ে গেছে। চৈতন্যদেবকে শঙ্খরোল করে ওখানে নৌকায় চাপিয়ে বাংলা থেকে বিদায় জানানো হয়েছিল।
- আচ্ছা! কিন্তু আন্দুল নামের সঙ্গে চৈতন্যের কী সম্পর্ক?
- বলছি, ধৈর্য ধরে শোন। আন্দুলের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি বড় জমিদার পরিবারের কথা আছে। বসু মল্লিক, দত্ত চৌধুরী, কুন্ডু চৌধুরী এবং কর-রায়-মিত্র (রাজ বংশ)। চৌধুরী অর্থাৎ খাজনা সত্ত্ব যার, মানে জমিদার। দত্ত চৌধুরী বাড়ির কৃষ্ণানন্দ দত্ত শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক। তিনি নিমাইয়ের পার্শ্বচর নিতাই বা নিত্যানন্দ প্রভুর শিষ্য এবং পরম বৈষ্ণব। পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নিয়ে মহাপ্রভুর মতই পুরী চলে যান। নিত্যানন্দ নাকি ওঁর বাড়িতে এসেওছিলেন। তখন পথে পথে প্রবল নামসংকীর্তন আর ভক্তদের ধূলিতে গড়াগড়ির জন্য, এই এলাকাকে আনন্দধূল বলে ডাকা হতে থাকে। লোকমুখে ঐ আনন্দ ধূল হয়ে যায় আন্দুল।
- বুঝলাম। আবার নিতাই! নিতাই সম্পর্কে আগে কিছুই জানতাম না মা। ঐ পুরো এলাকাটাই কী বৈষ্ণব ধর্মে প্লাবিত হয়?
- না, না – সেটা মনে হয় না।
- কেন?
- আমাদের কলেজ বেড় দিয়ে গেছে সরস্বতী নদী। নদীর ওপারে কিছু দূর গেলে ক্ষেত্রপালতলা নামে একটি সুন্দর জায়গা আছে।
- আমি দেখেছি রে দিদি। মা স্টুডেন্টদের নিয়ে বায়োডাইভার্সিটি রেজিস্টার করতে গিয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম।
- ওখানে কি অনেক বায়োডাইভার্সিটি আছে?
- বিরাট একটা জলাজমির ধারে একটা ফাঁকা জায়গা। জলার ওধার দিয়ে কুয়াশার মধ্যে ট্রেন যায় – দূর থেকে দেখা যায়। জলার ঘাসে অসংখ্য পাখি আসে। এপারে বট, অশ্বথ্থ মিলে এক বিশাল প্রাচীন ঝুরি-নামা ছায়ায় বাঘ, সাপ এবং ক্ষেত্রপাল শিবের পুজো হয়, কাছে মনসা মন্দির, পীরের থান এবং ওলাবিবি তলাও আছে। এ থেকে আমার মনে হয় চৈতন্যের পদধূলি পড়ার আগে জলাজঙ্গলে পূর্ণ এই অঞ্চলে সুন্দর বনের মত লৌকিক ধর্ম বিরাজ করত। বসন্তকালে বটফল পাকলে, হাজারে হাজারে হরিয়াল ঘুঘু, টিয়াপাখি, বুলবুলি – আরো কত পাখি যে আসে, ঠিকানা নেই। প্রাচীন ঝুপসি গাছের পাতা ঢেকে যায় পাখিতে।
- তাই নাকি?
- আমি দেখেছি রে দিদি।
- তুই দেখেছিস? হরিয়াল ঘুঘু কী পাখি রে, কেমন দেখতে?
- গ্রীন পিজিয়ন দিয়ে গুগলে সার্চ দে, ছবি পেয়ে যাবি। পায়রার মত নাদুসনুদুস চেহারা, টিয়াপাখির মত সবুজ।
- এখানে তো কত গাছ, এখানে কেন আসে না রে রঞ্জা, আমি দেখতাম।
- দেখবি কী করে, আমার ছাত্ররা বলছিল ওদের বাড়ির কাছে এই পাখি এলেই গ্রামের লোক ধরে রান্না করে খেয়ে নেয়। এইভাবে মানুষ এদের বংশকে প্রায় লোপাট করে এনেছে। কিন্তু ক্ষেত্রপালতলা ধর্মীয় জায়গা তো, তাই লোকে ধরে না।
- খুব বাজে জেঠিমা, খাবার জিনিসের কি কিছু কম পড়েছে? সুন্দর পাখি ধরে খেয়ে নিতে হবে?
- মানুষ সর্বভুক। আর ভীষণ লোভী। কী করবি বল। সেদিন একটা কথা শুনলাম।
- কী?
- উড়িষ্যার ভিতরকণিকায় অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে হাজার হাজার অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে – সেটা জানিস তো?
- হ্যাঁ।
- কিছু কচ্ছপ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যায়। আর চোরাশিকারিরা তো আছেই। তারা ঐ কচ্ছপ ধরে। এই এলাকার লোক কচ্ছপ খায়, মানে এমনি তো পায় না। কচ্ছপ ধরা, বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু পেলে ছাড়ে না। আর বড় অলিভ রিডলেকে বলে বালিগড়। একটা বালিগড় চোরাগোপ্তা পেয়ে গেলে এদিকের মানুষের ঘরে উৎসব লেগে যায়। গতকাল আমাদের যে দুর্গাবৌদি রান্না করে, সে খুব হেসে হেসে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিল, “তুমি কী খেয়েছ?” বাচ্ছাটা আধো আধো করে বলছে – বালিগল।
- অ্যাঁ! যাদের বাঁচাতে সারা পৃথিবী চেষ্টা করছে, তাদের খেয়ে উৎসব? আমাদের বাড়িতেই সর্বভুক খুনি?
- ওভাবে বলিস না। এরা তো পরিবেশ, ইকোলজি কিছুই জানে না। তাছাড়া, সারা পৃথিবীর সবাই চেষ্টা করছে নাকি। কয়েকজন চেঁচাচ্ছে। তাদের কথা কেউ শোনে না। আর উপকূলের গরিবগুর্বো মানুষ হয়তো কয়েক হাজার বছর ধরে কচ্ছপ খাচ্ছে। এখন বারণ করলে তারা অভ্যেস বদলাবে কেন? বললেই বা শুনবে কেন? যাই হোক, তোরা কিন্তু আন্দুল থেকে একলাফে সমুদ্রের ধারে চলে এসেছিস। এখন ফিরবি কিনা বল। নইলে আমি উঠলাম। মেলা কাজ পড়ে আছে।
- না না না। এই তো আবার আন্দুলে ফিরে এসেছি। ক্ষেত্রপালতলার লোক সাপকে ভয়ে পুজো করতে পারে, জলা জায়গা বলছ যখন। কিন্তু হাওড়ায় বাঘ ছিল জেঠিমা?
- না থাকার কিছু নেই। গঙ্গার ওপারে কলকাতা পেরিয়ে তো সুন্দরবন বিস্তৃত ছিল। এপাশেও স্বাভাবিক উদ্ভিদ একরকম হবে। এও শুনেছি, বাকসাড়া বলে হাওড়ার একটা জায়গা আছে, সে নামটা নাকি এসেছে বাঘের সাড়া থেকে।
- অ্যাঁ! তারপর বল।
- এখন কিন্তু ক্ষেত্রপালতলায় মেলার আয়োজন করে হরিসভা। সেটা বৈষ্ণব প্রভাব। বৈষ্ণব উৎসব হিসেবে রাসপূর্ণিমায় বিশাল মেলা বসে। শ্রীকৃষ্ণ এবং চৈতন্যের নানা জীবনকাহিনী দেখিয়ে মূর্তি আর পুতুলের প্রদর্শনী হয়।
- ইন্টারেস্টিং।
- ধর্মীয় অভ্যাসের এই প্যারাডাইম শিফ্ট বা আমূল পরিবর্তন তো চৈতন্য প্রভাবেই হয়েছে।
- তা তো বটেই।
- উল্টোদিকে, আবার আন্দুল রাজবাড়িতে মা অন্নপূর্ণার দেখার মত বিশাল মন্দির আছে। নিত্যপুজো হয়। সেখানে কামান আছে, আগে তোপধ্বনি হত। আর রাজবাড়িকে নিয়ে প্রায় সব জমিদার বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয়।
- যেমন আমাদের হয়, বাড়িতে গোপীনাথের মন্দির, এদিকে দুর্গাপুজো হয়। তাই না মা?
- হ্যাঁ, আসলে দুর্গাপুজো তো শুধু পুজো নয়, আসলে সামাজিক অনুষ্ঠান, জনসংযোগের উপায়। তারপর আরও কিছু আছে, যাতে বুঝলাম আন্দুলে শুধু বৈষ্ণব ধারা নেই।
- আচ্ছা, আরও আছে?
- আনন্দ বাজারে একবার আন্দুল রায়পাড়ার দুর্গাপুজোর কথা বেরিয়েছিল। ঐ রায়বাড়িতে দশমীতে বিসর্জনের পরে পূজিত হন দক্ষিণরায়। এই বংশ রবীন্দ্রনাথের মত পিরালি ব্রাহ্মণদের একটি শাখা। পূর্ববঙ্গের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন বিভিন্ন কারণে। কোথায় যাবেন, ঠিক নেই। নতুন জায়গায় পা রাখার আগেই বজরায় প্রসব বেদনা উঠল পরিবারের ভাইদের এক জন, বাবুরাম কুশারীর স্ত্রীর। মাঝপথেই থামল বজরা। সপরিবার নেমে গেলেন বাবুরাম। যেখানে নামলেন, সে জায়গার নাম আন্দুল। কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন বাবুরামের স্ত্রী। হুগলির হরিপাল থেকে বাবুরামের পরিবারে শঙ্খ ও শাঁখা বিক্রি করতে আসতেন মহেশ্বর বটব্যাল। সৎ ও পরিশ্রমী মহেশ্বরকেই ঘরজামাই হিসেবে বেছে নেন দূরদর্শী বাবুরাম। ধীরে ধীরে সেই মহেশ্বরই পত্তন করলেন বিশাল জমিদারির। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে মিলল ‘রায়’ উপাধি।
মহাষষ্ঠীর বোধন থেকে বিজয়া দশমীর বিসর্জন – দুর্গোৎসবের প্রতিদিন এ বাড়িতে নিরামিষ ভোগ উৎসর্গ করা হয়। বাড়ির হেঁশেলেও এ ক’দিন আমিষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। দশমীর ঘট বিসর্জনের পরে সকলে মাংস খান।
- এ কী গো, ঠিক আমাদের মত রীতি মা।
- বিজয়াদশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের পরে এখানে পুজো করা হয় দক্ষিণরায়কে। ঠিক বাড়ির ঠাকুরদালানে নয়। ব্যাঘ্রদেবতা পূজিত হন বাড়ির বাইরে মাঠে। সারা বছরই দক্ষিণরায়ের মূর্তি রাখা থাকে বাড়ির সামনে। তাঁকে ঢেকে রাখা হয় ঝুড়ি দিয়ে। দশমীতে ঝুড়িচাপা মূর্তিকে বাইরে বার করে এনে পুজো করা হয়। পুজোর পরে আবার তিনি চলে যান ঝুড়ির আড়ালে।
আরও এক দিন পুজো করা হয় দক্ষিণরায়কে। সেটা নীলষষ্ঠী তিথি। বছরে শুধুমাত্র এই দুই তিথিতে এ পরিবারে আরাধনা করা হয় তাঁকে। বাকি দিনগুলিতে তাঁকে দেখা যায় না।
- কিন্তু মা, সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা কী করে অংশ হয়ে উঠলেন হাওড়ার এক জমিদারবাড়ির শারদোৎসবে?
- সে ইতিহাস ঐ বাড়ির লোক ও এখন জানেন না। হয়তো বাঘের উপদ্রবটাই কারণ।
- ক্ষেত্রপালতলায় তো বাঘের মূর্তি সবার সামনে থাকে। এখানে ঝুড়িচাপা কেন?
- রায় পরিবারে প্রচলিত গল্প বলে যে – কোনও কালে দক্ষিণরায়ের মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন এ বাড়ির কোনও কর্তা। কিন্তু যতবারই মন্দির তৈরি করা হচ্ছিল, ততবারই রহস্যজনক ভাবে ভেঙে পড়ছিল অর্ধসমাপ্ত মন্দির। শেষ অবধি পরিবারের ধারণা হয়, নিজের জন্য মন্দির চাইছেন না স্বয়ং দক্ষিণরায় দেবতাই। তাই মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত খারিজ হয়। দক্ষিণরায় রয়ে যান পরিবারের সঙ্গেই। অন্তরাল থেকেই রায় পরিবার এবং তাদের জমিদারির সব বাসিন্দাকে রক্ষা করেন।
- দারুণ ব্যাপার না, গাটা বেশ শিরশির করছে।
- এখানে সংক্রান্তিতে বড় করে চড়কের মেলা হয়। আবার নীলষষ্ঠীতে আন্দুলে শিবের বিয়ে হয়।
- শিবের বিয়ে? সত্যি?
- দুইল্যা ক্লাবের পাশে সাঁতরা পাড়ায় একটা শিবমন্দির আছে। কষ্টিপাথরের শিবঠাকুরের নাম নীলাপতি। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় আন্দুল স্টেশনের কাছে বিশালাক্ষীতলার পার্বতীর।
- তুমি দেখেছ জেঠিমা?
- বিয়ে সন্ধেয় শুরু হয়ে শেষ হতে রাত এগারোটা বারোটা হয়ে যায়। অত রাত অবধি আন্দুলে থাকা যায় নাকি! আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যারা কাছে থাকে, তারা ছবি তুলে আমাদের পাঠায়, তখন দেখেছি।
- এতক্ষণ ধরে, মানে সত্যিকারের মন্ত্র পড়ে পুরো বিয়ে হয়?
- খাওয়াদাওয়া? মা?
- বরযাত্রী, কনেযাত্রী খাওয়াদাওয়া সবই হয়।
- জেঠিমা, ও জেঠিমা নেমন্তন্ন পাওয়া যাবে?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, আরে মায়ের স্টুডেন্টরা আছে না। কী গো মা, ওদের বলে দিলে হবে না? বড় বড় ছেলেমেয়ে তো সব। আমাদের জন্যে একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না? আমরা বিয়েতে না বৌভাতে, কোনটায় যাব?
- হা হা হা, পুরো কথাটা শোন। নীলাপতি শিবলিঙ্গকে ধুতি, মালা, মুকুট, চন্দন পরিয়ে বর সাজানো হয়। তারপর ফুলে ঢাকা পালকি চড়ে নীলাপতি বিয়ে করতে বেরোন। সঙ্গে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে যায় বরযাত্রী। এলাকার মানুষ, বাচ্চাকাচ্চা, আলোর গাড়ি সব মিলিয়ে একটা ভালই মিছিল চলে।
- আমরা যাব নাচতে নাচতে জেঠিমা।
- অ্যাই দিদি, ওখানে নাচা যাবে না, সবাই দেখবে ম্যাডামের মেয়ে রাস্তায় নাচছে, মায়ের একটা প্রেস্টিজ আছে না।
- উঁঃ চিনবে কী করে?
- আমি তো ছোট থেকে মার সঙ্গে কলেজে যাই, আমাকে সবাই চেনে।
- ধুর বাবা! তারপর বল।
- বিয়ের আসরে পার্বতীর মূর্তি থাকে না। একটা সরার ওপরে আর একটা সরা চাপা দিয়ে, লাল সুতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধা হয়। ঐ সরাকে লাল চেলি, মালা, মুকুট, চন্দন পরিয়ে পার্বতী সাজানো হয়।
- আশ্চর্য, তারপর?
- বিধিমত বিয়ে সমাধা হবার পরে, বরের পালকিতে পার্বতীকে তুলে নেওয়া হয়। বরযাত্রীর সঙ্গে কনেযাত্রীরাও এবারে যোগ দেয়। মিছিল আরো বড় হয়। সকলে মিলে এলাকার কারোর দালান বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ সব ঠিক করে। সেখানে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া হয়।
- বিয়ে, বৌভাত একসঙ্গে?
- হ্যাঁ
- আর মেনুটা?
- লুচি, আলুর দম, বোঁদে।
- অ্যাঁ-অ্যাঁ, অ্যাতো কষ্ট করে শুধু লুচি-বোঁদে।
- তাতে কী? উপলক্ষটা দেখ।
- হ্যাঁ খুব সুইট, বাংলার মিষ্টি লৌকিক উৎসব।
- আচ্ছা মা, তোমার কথা শুনে যা মনে হচ্ছে, আন্দুলে বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব সব ধারাই রয়েছে একসাথে।
- ঠিক বলেছিস, বলা হয় দক্ষিণে মা গঙ্গা, উত্তরে পঞ্চানন শিব, পুবে অন্নপূর্ণা আর পশ্চিমে ক্ষেত্রপাল এঁরাই আন্দুলকে রক্ষা করেন। আর অন্তরে থাকেন চৈতন্য।
- হুম। আবার এখানেই রাজবাড়ি, এতগুলো জমিদার বাড়ি।
- রাজবাড়িতে ঢুকতে গেলে আপাতত চৈতন্যকে ছেড়ে নবাব, বাদশাহ আর ইংরেজের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হবে।
- করব করব, অসুবিধে নেই।
- কিন্তু চৈতন্যদেবের সঙ্গে একাসনে এঁদের আনলে তো হবে না। টাইম গ্যাপ চাই। তোদের এখন একটা কাজ আছে, ভুলে যাচ্ছিস।
- না না ভুলিনি। করব তো।
- তাহলে যা শিগগির।
হুড়কো দিতেই মেয়েরা ছুটে যায় ঠাকুরদালানের দিকে, গৌর-নিতাই হয়ে, নাকি কল্পিত নীলাপতির বরযাত্রী হয়ে উদ্বাহু নৃত্য করতে করতে। বক্সিবাড়ির চাতালে এলে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিরাও অভুক্ত থাকে না। ছাতারে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে, এখানে ডাকে সাতভায়া। তারা খায় চালের খুদ। শালিক আসে একটু বেলায়। তারা খায় পাকা কলা। ধান কিছু ছড়ানো থাকে চাটাইয়ে। চড়ুই, বসন্তবৌরি, বা ময়না, যে যার সময় মত আসে। মাটির সরায় থাকে জল। সকালে পাখিদের পর্ব চলে। আর দুপুরে মানুষের খাওয়াদাওয়ার পর ভাত-ডাল-মাছ কাঁটা মেখে কুকুর বিড়ালের ভোজন চলে। শ্বশুরমশায় সব ঠিক করে গেছেন। মেয়েরা বাড়িতে থাকলে তারাই এসব তদারক করে।