৬
দেখো ঐ ওড়ে নিশান,
খেলার আকাশ ছোঁয়ার সোপান
আমরাই মোহনবাগান
- তুমুল আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয় ১৯১১ সালে। আর ঐ বছরেই অকালে জীবনদীপ নিভে যায় ভগিনী নিবেদিতার।
- ইশশ, একটা ভাল একটা খারাপ।
- এর ঠিক দশ বছরের মাথায় সতীশের মৃত্যু থেকে কুমুদিনীর পারিবারিক বিপর্যয় শুরু হয়।
- হুম। সালগুলো মাথায় রাখলে কোন ঘটনার চারপাশে কেমন কি হচ্ছে...
- পরিপ্রেক্ষিতটা
- হ্যাঁ, সেটা বোঝা যায়।
- এই প্রসঙ্গে একটা কথা বললে হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমরা তো মোহনবাগানের গল্প বলতে বসেছিলাম। এইসময়ে ১৯২০-তেই বাংলায় আর একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফুটবল দল ইস্টবেঙ্গলের জন্ম হয় – যার সঙ্গে মোহনবাগানের দ্বৈরথ একদিন অমরত্ব লাভ করবে।
- বাঃ। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল শুরু হয়ে গেল – তার মানে চিংড়ি আর ইলিশের লড়াইও চালু হল।
- হ্যাঁ-অ্যাঁ রে দিদি। আগে বেশ ছিল পাশাপাশি। এখন হয়ে গেল শত্রু।
- শত্রু কেন?
- আমাদের ক্লাসের মৈত্রেয়ীরা তো বাঙাল। ও বলে ওর ঠাকুরদা ইস্টবেঙ্গল জিতলে বড় সাইজের জোড়া ইলিশ কিনে ঘটি বাড়িদের পাশ দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে আসত। আর ওর ঠাকুমা বিরাট শিলপাটায় ঘটাং ঘটাং করে সর্ষে বাটত। আর বড় বঁটিতে রিং রিং পিস করে মাছ কাটা হত। অনেক কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঝাল করে দু’ তিন রকম রাঁধা হত – কাঁচা ঝাল, ভাপা এইসব। কচু শাক দিয়ে, কলমি শাক দিয়েও হত।
- বাপরে, ছুটকি অনেক কিছু জানে রে। মৈত্রেয়ী এত কথা কী করে জানল?
- সব ওর বাবা গল্প করেছে। ওর মা তো এসব পারে না, ঠাকুমার মত হয় না। তাই ওর বাবার খুব মন খারাপ। মেয়ের কাছে দুঃখ করে।
- সব্বোনাশ! আর মৈত্রেয়ী তোদের কাছে দুঃখ করে?
- না না, মৈত্রেয়ী দুঃখ করে না। ও তো হাসে। ওর মা তো টেলিফোনে চাকরি করে। বাবাকে বলে মাছ কাটতে পারব না। অত শখ থাকলে মাছ কাটিয়ে আনবে। আমি বলে দিয়েছি, আমার বাবা থার্মোকলের বাক্স করে দীঘা মোহনা থেকে ইলিশ আনে। আর মাছও কাটতে পারে।
- বাপরে, নিজের বাবাকে নিয়ে ওর কী গেরবানী দেখ একবার।
- তুমি মাছ কাটতে পার, জেঠিমা?
- না রে, কোনোদিন করিনি। কোনো ছোট মাছ হলে, কাঁচি দিয়ে কেটে পেট পরিষ্কার করে দিতে পারি। পাখনা কেটে দিতে পারি, আঁশ ছাড়াতে পারি। কিন্তু ঐ আঁশবঁটিতে বড় মাছ কাটতে পারি না। ইন ফ্যাক্ট, ছোট থেকেই মাটিতে বসে বঁটিতে কাটা জিনিসটা আমার একদম পছন্দ হত না। ছোরাটা ফিক্সড। হাতের কারুকাজ বেশি করতে হয়। আমাকে বড়মামা ছুরি ধরতে শিখিয়ে দিয়েছিল। আমি চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে ছুরিতে কাটতাম। এখনও ঐ অভ্যেস।
- বড়মামা মানে বিকাশ – ভারতীর ছেলে বিমানচন্দ্র বসু। তাই না জেঠিমা?
- হ্যাঁ।
- আমাদের কাঁথিতে বাবা যখন ইলিশ আনে, রান্নার পিসি ঐ একটাই জানে, সেটাই হয়।
- কোনটা?
- ইলিশ মাছের টক। এখানে এসে ঝালটা যা একটু খেয়েছি। এ দুটো ছাড়া রঞ্জা ইলিশের কী কী বলল, আমি কক্খনো খাইনি। খালি তেলে পাঁচ ফোড়ন দেবে, শুকনো লঙ্কা দিয়ে ছ্যাঁক ছোঁক করবে, নুন চিনি দেবে আর তেঁতুল জল ঢালবে। খালি তেঁতুল। মাছ ভেজে দিয়ে দেবে, ব্যস্ হয়ে গেল। কোনো একটা তরিবতের রান্না নেই। মাছগুলো কাটবে এইটুকু এইটুকু। খেতে শুরু করলেই ফুরিয়ে যাবে। আবার বাবাকে বলবে, বেশি আনতে হবে না দাদা। এই মাছ দিয়েই তিনবার রান্না হয়ে যাবে।
- হা হা হা। টকে তরিবত বলতে শেষে একটু ভাজা মশলার গুঁড়ো দেওয়া যায়। আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো হয়। আসলে মাছ কাটার সময়ে বলে দিতে হয়, ক’পিস হবে। তোর বাবা বাজার এনেই খালাস। কিছু দেখে না। তুই শিখে নে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে দেখবি হেঁশেলের কন্ট্রোল হাতে চলে এসেছে। আর এখানেও অনেক লোক তো। বড় পিস করে ভাপা করা মুশকিল। তাই এখানেও ছোট পিস কাটা হয়। তবে আমি তোর সঙ্গে একমত। ইলিশ না খেলে না খাব। একদিন খাব তো বড় টুকরো খাব।
- তোর কপাল পোড়া রে দিদি। তুই ইলিশের ভাপা, দই ইলিশ কিছু খাসনি এখনও। স্বর্গের সোয়াদ পাসনি। এবারে তুই একটু বর্ষার দিকে আমাদের বাড়ি আসবি। বাবাকে বলে দেব, ইলিশ আনবে। মা ভাপা করে দেবে।
- ঠিক আছে। জেঠিমা এবার ইলিশ সরাও, বাকিটা বল।
- আমি ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস নিয়ে একটি প্রবন্ধ খুঁজে পেলাম। লিখেছেন এন. কল্যাণী। সেখানে যা লেখা আছে, সংক্ষেপে তার উপজীব্য হল – ১৯০৪ থেকে সিস্টার নিবেদিতা অনুভব করেন ভারতবাসীর একটি নিজস্ব জাতীয় পতাকা প্রয়োজন। নিবেদিতার মননে অনুপ্রাণিত বজ্র চিহ্নের জাতীয় পতাকাটি চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯০৬ সালে। প্রথমে বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির গোপন সভায়, মাঝে বজ্র দু’পাশে বন্দে মাতরম লেখা পতাকাটি উত্তোলন করেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৯০৬ সালের ৭ই আগস্ট। ঐ প্রথম পতাকাটি আমাদের ইস্কুলে ছিল। এখন আছে বাগবাজারের নিবেদিতা মিউজিয়ামে।
- এখন গেলে দেখা যাবে জেঠিমা?
- আমি দেখেছি। গায়ে কাঁটা দেয় রে দিদি। তারপর বল।
- আমার মায়ের কাছে ছোটবেলায় গল্প শুনেছি, আমার দাদু কুমুদিনীর ছোট ছেলে নয়। আর একজন ছিল। সে মায়ের কাছে থাকবে বলে সবসময় বায়না করত। মা সময় দিতে পারতেন না, বিরক্ত হতেন। সে বলত, মা আমি বিরক্ত করব না, তোমার গায়ে একটা কড়ে আঙ্গুল ছুঁইয়ে শোবো মা? পরে শিশুপুত্রটি মারা যায়।
- এ মা!
- আমার মা কুমুদিনীকে দেখেননি। কারণ মায়ের জন্ম তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরে। এসব কথা শুনেছেন আমার দিদা, মানে কুমুদিনীর পঞ্চম পুত্রবধূ লাবণ্যপ্রভার কাছে। আমার মা আমাকে দেখিয়েছিলেন, শিশুপুত্রের শোকে পূজার ফুল বইয়ের কোন কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু তখন তো আর বেশি কান করে শুনতাম না। তাই স্মৃতি থেকে চলে গিয়েছিল। আজ পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে মর্মে মর্মে বুঝি কর্মরতা মায়েদের বেদনা। একশ’ বছর আগে মায়ের ঠাকুমার নিয়তি তাড়িত মুখটি হৃদয়ে ভাসে। পূজার ফুলের প্রতিটা কবিতা পড়ে পড়ে সেই কবিতাটা খুঁজে পেয়েছি।
- একশ’ কেন? তার বেশি হবে।
- দেখ, ১৮৮৬ বা ৮৭ সালে চোদ্দ বছরে যদি বিয়ে হয়, জন্ম ১৮৭২ বা ৭৩ হবে। আমার জন্মের প্রায় একশ’ বছর আগেই হল।
- মা! একটা অদ্ভুত চিন্তা মনে আসছে। তুমি নিয়তির কথা বলছ বটে, কুমুদিনীকে যা বুঝছি, তিনি কি নিয়তি মানতেন?
- কী জানি? স্বামী বিয়োগ, একের পর এক পুত্র বিয়োগে বিধ্বস্ত হলেও, দত্ত বাড়িতে ছেলের ভাগ দাবি করেননি কুমুদিনী। তাদের আশ্রিতও হতে চাননি। দেববাড়িতেও ফিরে যেতে রাজি ছিলেননা। হয়তো বিধবা হিসেবে সমাজের নানা বেড়ি পড়বে পায়ে – সেই ভয় পেয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনভাবে ফড়িয়া পুকুরে একটি বাড়ি কিনে পরিবার নিয়ে সেখানে উঠে আসেন এবং শোভাবাজার রাজবাড়িতে স্বামীর অংশের দখলীসত্ত্ব ত্যাগ করেন। তখন গ্রাসাচ্ছাদন চলছিল রাজবাড়িরই ভাতায় এবং সম্ভবত জমিজমা থেকে আয়ও ছিল। শোভাবাজার রাজবাড়িতে একটি প্রথা আছে, বিধবা কন্যা বা পুত্রবধূ মাসিক ভাতা পেতে পারে। স্বামী ও দুইপুত্র চলে যাওয়ার পরে কুমুদিনী সেই ভাতা পেতেন। কিন্তু সেই ভাতা তিনি যে নিরুপায় হয়ে গ্রহণ করেছিলেন, তার প্রমাণ পাই, যখন বাকি দুই পুত্র রোজগার শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই রাজবাড়ির বিধবা ভাতা তিনি ত্যাগ করেন। এত শোকের সাগর, অভাব অনটন পেরিয়েও দেশসেবা করে গেছেন অবিচল ভাবে। নিবেদিতা বিদ্যালয়ে পড়েছিলাম আদর্শ জ্ঞানী ব্যক্তি হন – ‘সুখেষু বিগতস্পৃহ, দুঃখেষু নিরুদ্বিগ্নমনা’। কুমুদিনী এর বাস্তব প্রতিমূর্তি। একবার বাবলিদিতে আমাতে গল্প হচ্ছিল, এত বড় বড় লোকের বংশধর, আত্মীয় যদি হই, তবে আমরা গরীব হলাম কেন? কি কষ্ট করে বড় হয়েছি আমরা। বাবলিদি বলে, “সোজা উত্তর, আমাদের গরীব হওয়ার পিছনে একমাত্র দায়ী ঐ কুমুদিনী। কী দরকার ছিল সর্বস্ব ত্যাগ করার? সংসার দেখেননি। সাহিত্যসেবা, দেশসেবা, সমাজসেবা করে গেছেন শুধু।” বাবলিদির কথায় পয়েন্ট আছে। স্বীকার না করে উপায় নেই। তবু আজ বেশ লাগে এক ঋজু, বিদূষী, দেশ হিতৈষিণী, নির্লোভ নারীর বংশধর আমি। না-ই বা রইল টাকা। এই বংশগৌরব যে কতটা তৃপ্তির, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
- ভালই হয়েছে জেঠিমা। ঐ টাকার উৎস মানেই তো সিরাজদৌল্লার হত্যা, বিশ্বাসঘাতকতা, দেশের পরাধীনতা – কত কী। তার চেয়ে গরীব হয়ে নিজে খেটে খাওয়া অনেক ভাল।
- ঠিক বলেছিস।
- জেঠিমা! কুমুদিনীকে আমরা ধরে নিচ্ছি অল্পবয়সে হয়তো ব্রাহ্ম আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ি গোঁড়া হিন্দু, ওঁদের ঠাকুর কী ছিল?
- শোভাবাজার রাজবাড়ির গৃহদেবতা কৃষ্ণ, আমরা যে ধারার উত্তরপুরুষ, মানে বড় তরফ, তাঁদের দেবতা রাধা গোবিন্দ জীউ। আর ছোট তরফের ঠাকুর গোপীনাথ জীউ। আমাদের মহেশ বোস - শরৎ বোসের বংশের ঠাকুর রাধারমণ কৃষ্ণ।
- আচ্ছা মা, কুমুদিনীর চোদ্দ বছরে বিয়ে হয়েছিল। লেখাপড়া শিখেছিলেন, হয়তো লেখালিখিও করতেন অল্প বয়স থেকে। এটাও তো হতে পারে, শরৎ কুমুদিনীর লাভ ম্যারেজ। হয়তো কোনো সাহিত্য সভা টভায় চোখে চোখে কথা...
- হা, হা, হা, হা, তুই তো দেখছি কল্পনায় বহুদূর চলে গেছিস। তবে ছবি দেখে মনে হয়, শরৎ কুমুদিনীর বয়সের তফাৎ পনেরো বছর তো হবেই। শাড়ি গয়না পরে ছোট মেয়েকেও বড় দেখায়, ঠিক বোঝা যায়না। অত দিন আগের কথা জানা যখন সম্ভব নয়, আমাদের কল্পনার পাখা মেলে দিতে বাধা নেই। কুমুদিনীর মত লেখার হাত থাকলে এই প্লট নিয়েই জম্পেশ উপন্যাস লেখা যেত।
- কুমুদিনীর ছবি কেমন?
- খুব সুন্দরী, ডিগনিফায়েড।
- দেখাবে আমাদের। আচ্ছা, বিকাশ-লাবণ্যর সম্বন্ধ করে বিয়ে। তাই তো? আর সমীর-কৃষ্ণার?
- লাভ
- তুমি আর জেঠু, তুলসী-শারদা – লাভ। হুম, তিন পুরুষে দুটো লাভ ম্যারেজ তো কনফার্মড। বোনু শুনে রাখ। আমাদের যেন আবার পরে সম্বন্ধ না করে।