২
সেই যে হলুদ পাখি
জামরুল গাছের ডালে
মৈতনায় থাকলে আমার মেজ ননদ আর নন্দাই খুব ভোরবেলায় মর্নিং ওয়াক করতে যায়। শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে থাকতে ভোর রাত্রে বেরোতেন। লাঠি হাতে রোজ কয়েক মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। ছোট থেকে পিসির সঙ্গে যাবে বলে মেয়েরাও সঙ্গ ধরেছে। কর্ণা অনেকসময়ে সাইকেল নিয়ে যায়। প্র্যাকটিস হয়ে যায়। রঞ্জা সাইকেল চালাতে জানে না। আসলে কলকাতার রাস্তায় বাড়ি থেকে বেরোলেই বাস। আড়বেলেতে দাদাদের দেখে শখ হত খুব, কিন্তু সাইকেলটা আমারও শেখা হয়নি। একই কারণে রঞ্জারও হয়নি। সাইকেল কেনা হয়েছিল, হিরোর সানডান্সার। কিন্তু সাইকেল ধরে শেখানোর লোক ছিল না। প্রথমে মরচে পড়ল, তারপর দানে গেল।
আমি অত সকালে উঠতে পারি না। আসলে সারা বছর মেয়ের মর্নিং স্কুল। ওকে সাতটায় স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আমাকে আবার দশটার মধ্যে বেরোতে হয়। কোনোদিন দশটার ক্লাস থাকলে ন’টার মধ্যে, আর পরীক্ষা থাকলে তো কথাই নেই – সাড়ে আটটার আগেই বেরিয়ে পড়তে হয়। এখানে এলে তাই খুব সকালে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মুশকিল হল, এখানে বেলা করে শুয়ে থাকা যায় না। আলো ফুটতে না ফুটতে, কতরকম যে পাখি ডাকে, ঘুম ভেঙে যায়। শীতের শেষে, বসন্তের শুরুতে ভোরের দিকে কোকিল ডাকে খুব। বাদামি রঙের বড়সড় কোকিল অনেক ঘোরাঘুরি করে। আর যেদিন বড় বড় কাঠঠোকরার দল শুকনো গাছগুলোতে খটাংখট, ঠকাংঠক করে ফোকর বানাতে শুরু করে, সেদিন সকালে বিছানায় শুয়ে থাকে কার সাধ্যি। বিয়ের পরে প্রথমদিকে ভাবতাম বাড়িতে বুঝি মিস্ত্রি লেগেছে। আর সঙ্গে চড়াইয়ের কানফাটানো কিচিরমিচির ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ঘুঘুর ডাক বেশ একটানা। আর মাঝে মাঝে কুবো ডাকে কুব কুব আওয়াজ করে। বসন্তবৌরি দু’রঙের – একটা কলাপাতা সবুজ, অন্যটা ঘন হলুদ, কোনোটা বা বেনে বৌ। খুব ছোট্ট ছোট্ট একরকম সবুজ পাখি আসে, নাম মৌটুসি। আর একটা হালকা হলুদ মতন এইটুকুনি পাখি ইলেকট্রিকের তারে এসে বসে। কর্তা বলেন, ও হল তুলাফুটকি। খুব ছটফটে। এর সঙ্গে রোগা কালো লেজঝোলা ফিঙে, টুনটুনি, বুলবুলি আর দোয়েল-ও দেখি। সবার হাঁকাহাঁকি, বকাবকি মিলে একটা ঝালাপালা গান তৈরি হয়। উঠে পড়ি। হালকা একটা চাদর জড়িয়ে চটিটা পায়ে গলিয়ে এগিয়ে পড়ি। বক্সি বাড়ির গোয়াল পেরিয়ে, খিড়কি পুকুর। পুকুরের জলে সকালের প্রথম রোদ ঝিলমিল করে। পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা। আগে এখানে চটি খুলে বালি-কাদা-জলের মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটতে হত। এ’পথ দিয়েই জানকীর বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। বক্সিবাড়ির জমির আয়তন বড় বলে প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো বেশ দূরে। এখন অবশ্য জমির প্রান্তটা সরকারকে দান করা হয়েছে, তাই রাসমঞ্চটা ভাঙা পড়েছে। সেই শুঁড়ি পথ চওড়া হয়ে পাকা হল। এখন গাড়ি চলে। তবে মাটির সো়ঁদা গন্ধ, ঝোপঝাড়, ঘাসের সবুজের গন্ধ আর গোয়ালের গন্ধ সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত মিশেল হয়। তাতে নাক ডুবিয়ে পথ চলতে চলতে কেমন নেশা লাগে। মনটা একতারে বাঁধা থাকে, চিন্তাশূন্য থাকে। হঠাৎ বাইক বা মেশিন ভ্যানের তীব্র ভটভট আওয়াজ আর পোড়া তেলের ভয়ানক কটুগন্ধ সেই স্বপ্নমাখা হাঁটার আমেজকে এমনভাবে খুন করে দিয়ে চলে যায়, যে বিরক্ত হয়ে সত্যি সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করে। চিন্তা ফিরে আসে।
মেয়েগুলো কতদূরে গেল কে জানে। আমি অনেকটা চলে এসেছি। দু’পাশে এখন ধানক্ষেত। দূরে একটা বাঁশঝাড় ঝুঁকে আছে পথের ওপরে। বাঁশঝাড়ের তলায় দুটো ছোট বিন্দু নড়ছে যেন। আর একটু এগিয়ে দেখি। হুম, বাবা ঠিক ধরেছি। দুই শর্মা হি হি হা হা করতে করতে সাইকেল গড়িয়ে নিয়ে আসছে। আর আমাকে দেখেই চমকে গেছে।
- এই যে নন্টেকুমারী, ফন্টেকুমারী। এত দেরি কেন? পিসি কই?
- এ কী! সকালবেলাও শান্তি নেই। গোয়েন্দাগিরি করতে চলে এসেছ?
- হ্যাঁ, তোরা তো মেজপিসি, পিসেমশাইয়ের সঙ্গে এসেছিলি।
- ওরা শর্টকাটে ফিরে গেছে। আমরা একটু ঘুরেঘ্ঘারে ঘুরেঘ্ঘারে এলাম।
শুনে হেসে ফেলি। আমাদের একজন অল্পবয়সী ড্রাইভার ছিল গোপাল যাদব। বিহারী ছেলে। সে কলকাতার রাস্তায় মাঝেমধ্যেই পথ হারিয়ে ফেলত। এদিকে সাইনবোর্ড পড়তে পারত না। না পারে ইংরেজি, না পারে বাংলা পড়তে। তাই বলত, অনেক “ঘুরেঘ্ঘারে ঘুরেঘ্ঘারে” এলাম।
- কিন্তু মা, যখন তুমি এসে পড়েছ তখন...
- হ্যাঁ জেঠিমা, এসে পড়েছ যখন...
- কী?
- মা, তুমিও বোঝ, আমিও বুঝি
বুঝেও বু-ঝি-না-আ।
- জেঠিমা, তুমিও বল, আমিও বলি
তবে সো-ও-জা-সু-জি না।
- মানে?
- মানে সোজা বাড়ি ফি-র-বো-ও-না।
- ক্যাকটাস? আমায় ক্যাকটাসের গান দেখাচ্ছিস? ঐ দেখ ফণীমনসা, তুলে পিটবো এবার।
- শুধু শুধু মিষ্টি মিষ্টি ফুলু ফুলু হাতে কাঁটা বিঁধবে গো মা। তুলতে তুলতে আমরা সাইকেলে পগার পার হয়ে যাব। বাবার কত কষ্ট হবে তোমার হাত সারাতে। তুমি খাতা দেখতে পারবে না। কম্পিউটারে বসতে পারবে না। বড্ড দুঃখু পাবে গো মা। তার চেয়ে চল, বাজারে গিয়ে কিছু কিনে খাই।
- হ্যাঁ গো জেঠিমা, ঝাল ঝাল চটপটি যদি পাই।
- লোকের কাজ নেই তো। সাতসকালে তোদের জন্যে চটপটি বানিয়ে দোকান খুলে বসে আছে, খালি পেটে লঙ্কাগুঁড়োর চচ্চড়ি খাওয়াবে বলে।
- তাহলে একটু চিপস।
- চিপস? ঐ কিডনি পচানো নুনগুলো খালি পেটে গিলবি?
- তাহলে কটা লজেন্স, একটা করে ললিপপ।
লজেন্স আর ললিপপের নাম শুনে মনটা বড্ড তরল হয়ে যায় আমার। ঐ লোভটা ছাড়তে পারি না।
- প্রবলেম আছে। আমি তো পয়সা নিয়ে বেরোইনি।
- আমাদের কাছে আছে।
- চল তাহলে।
বাজারের নাম বক্সিবাজার, আমার দাদাশ্বশুর স্বর্গীয় তারিণীপ্রসাদ দাসমহাপাত্রের বসানো। একঠোঙা লজেন্স হাতে তিনজনে তিনটে কোলা ললিপপ চুষতে চুষতে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু যত আনন্দ নিয়ে ফিরলাম, তত আনন্দ মনে রইল না। কারণ রান্নাঘরে দেখি আবার সেই মটরের তরকারি উনুনে চাপাবার তোড়জোড় চলছে। দু’দিন একই তরকারি কেন? কারণটা হল পরশু রাতে অনেক বেশি মটর ভেজানো হয়ে গিয়েছিল। তা সাড়ে আট পেরিয়ে নয় সকাল হতে চলল, এখনো কড়া চাপেনি কেন? উনুনে দেখি সাত আটটা টমেটো পোড়ানো চলছে। কী ব্যাপার? পান্তা-পার্টি টমেটো-পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল দিয়ে মেখে পান্তা খাবে। গতকালও ওরা নিজেদের জন্য বেগুনের গায়ে ছোট ছোট গর্ত করে তাতে আস্ত রসুন ঢুকিয়ে পুড়িয়েছিল, তারপর সর্ষের তেল, ধনেপাতা, ছোট ধানি লঙ্কা দিয়ে মাখছিল, স্বচক্ষে দেখেছি। ভারি মজা! নিজেদের রোজ আলাদা আলাদা আইটেম। আর আমরা যেহেতু রুটি খাই, আমাদের জন্যে রোজ বেগার ঠেলা, ছোবড়া ছোবড়া কাঁচা পেঁয়াজ ভাসা মটরের তরকারি। দেখাচ্ছি মজা। গম্ভীর মুখে বললাম, গতকাল তোমরা মটরের তরকারি খাওনি। তাই আজ তোমরা ওটা দিয়ে পান্তা খাও। আমাকে টমেটো পোড়াগুলো দাও।
- কেন বৌদি, তোমাদের টমেটো পোড়া দিয়ে রুটি খেতে ইচ্ছে করছে?
- হ্যাঁ, আর শোনো, কুচোনো পেঁয়াজগুলো দাও, ধনে পাতা দাও। আর ওপাশে ঝুড়িতে দেখো পেঁয়াজকলি আর ক্যাপসিকাম শুকোচ্ছে, ওগুলো ঝিরিঝিরি কেটে দাও।
এবারে রুনাদার কাছে ভিড়লাম।
- রুনাদা ও রুনাদা, তোমার মশলার সিক্রেট ভাণ্ডারটা বার কর তো দেখি।
- সিক্রেট তো ‘খুলে আম’ বার করা যায় না।
- হ্যাঁ যায়, সিক্রেট যদি ওপেন সিক্রেট হয়, তবে অবশ্যই যায়।
- বাপু দেখে যা, শারদা সিক্রেট চাইছে। আমার সব গেল।
ওপর থেকে বাপুর মানে আমার কর্তার স্বর ভেসে আসে,
- ওসব তোদের ব্যাপার, আমাকে জড়াবি না।
রুনাদা আসলে খিচুড়ি হোক, কি মাংস – রান্নার স্বাদটা দারুণ করে। তার কারণ আমিষ নিরামিষ কী সব সিক্রেট মশলা বানিয়ে রাখে। কাঁচা এবং ভাজা দু’রকম। কাঁচা মশলা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে, ওটা দিয়ে রান্না হয়। আর ভাজা মশলা উনুনের আঁচে চাটুতে শুকনো ভেজে গুঁড়ো করে বানায়। ওটা রান্না হয়ে গেলে ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হয়। ধীরে ধীরে মিশে যায়। মশলাগুলো বানিয়ে যত্ন করে আলাদা আলাদা কাগজে মুড়ে কৌটোয় তুলে রাখে, যাতে গন্ধ না উড়ে যায়। এই রান্নাঘরের মাইনে করা মেয়ে বৌদের ঐ মশলা ছোঁয়ার জো নেই। রুনাদার ধারণা, এই মশলা ওদের হাতে পড়লে নষ্ট হবে। যেখানে সেখানে খোলা রেখে দেবে, হয়তো বেশি ঢেলে দেবে বা কম। সবচেয়ে বড় কারণটা অবশ্য মুখে বলে না। যদি আঁচলে ঢেলে নিয়ে পালায়, এত কষ্টের জিনিস।
যাই হোক, রুনাদার কাছ থেকে দু’চামচ রোদে রাঙা কাঁচা মশলা আর দু’চামচ ভাজা মশলা নিয়ে বীরের মত রান্নাঘরে ফিরলাম।
এবারে কড়ায় সর্ষের তেলে চটপট জিরে, তেজপাতা, লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচো ভেজে নিলাম। তারপর ঐ তেলে পেঁয়াজ কলি আর ক্যাপসিকামের টুকরো দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজলাম। এবারে পোড়া টমেটোগুলো দিয়ে, হলুদ, নুন, মিষ্টি দিয়ে রুনাদার এস্পেশাল মশলা চার্জ করে ফেললাম। সব একসঙ্গে কষে অল্প জলে ভাপিয়ে, শেষে ধনেপাতা, ভাজা মশলা ছড়িয়ে দিলাম। নিজের মুখে বলাটা বা ঠিক নয়; মেয়েরা সোনামুখ করে খেয়ে নিল যখন, তখন বলা যায়, এই টমেটো-সবজি ভর্তার স্বাদটা বেশ ভালই হয়েছিল।
- মা, রুনাজেঠুর সিক্রেট মশলায় কী কী ছিল জেনেছ? তোমায় বলেছে?
- হুঁ, জিরে, ধনে, মৌরি, মেথি, কালো জিরে আর হিং।
- আর ভাজা মশলায় কী ছিল?
- দারচিনি, এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গ।
- বাবা তোমায় বলে দিল যে বড়, কাউকে তো বলে না।
- তা ধর, বিয়ের পর আমার সঙ্গে কুড়ি বছরের দোস্তি তো হল। তাছাড়া, বলে দিলেও আমি তো আর অমন বানাতে পারব না।
- কেন?
- কোনটা কী অনুপাতে মেশাতে হবে, সেটা বোঝা বহুবছরের অভ্যেস আর অভিজ্ঞতা ছাড়া হয় না। আমার সেটা নেই।
- বিয়েবাড়ির ঠাকুরদের রুনাজেঠু হারিয়ে দেবে।
- রুনাদার মেয়ের বিয়েতে রুনাদা তো নিজেই রান্না করেছিল। কারোর হাতে ছাড়েনি।
- জেঠিমা তোমার ঐ আন্দুল রাজবাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি – ঐরকম জায়গায় সে যুগে যদি রুনাজেঠুকে পাঠানো যেত, বিরাট নামডাক হয়ে যেত।
- তা আর বলতে?
- কিন্তু রুনাজেঠু ভুল যুগে জন্মে গেল।
- হুম, তা কথাটা ঠিকই বলেছিস। এই বক্সি বাড়িতেও যখন সাতশ’ একরের জমিদারী ছিল, তখন জন্মালেও কথা ছিল।
- আন্দুল রাজবাড়ির চ্যাপ্টারটা আজ শেষ কর জেঠিমা। শুনব। বৃদ্ধ ক্ষেত্রমোহন রাজা হয়ে আরও সাতাশ বছর রাজত্ব করলেন। আর ইংরেজদের ফুটুর ডুম হয়ে গেল। এই অবধি কাল হয়েছিল।
- এই ক্ষেত্রমোহনের কোনো একজন আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের কুমুদিনীর ননদের বিয়ে হয়েছিল।
- এ্যাঁঃ, তাই নাকি! কুমুদিনীর ননদ মানে শরতের বোন?
- হ্যাঁ, মানে সহোদরা বোন নয়, তুতো বোন।
- কী রকম?
- রাধাকান্ত দেবের সেজ মেয়ের ছেলে শরৎ, কুমুদিনী ছেলের বৌ।
- হ্যাঁ।
- রাধাকান্তের তিন ছেলে – মহেন্দ্রনারায়ণ, রাজেন্দ্রনারায়ণ আর দেবেন্দ্রনারায়ণ। তার মধ্যে মহেন্দ্র অল্পবয়সে মারা যান। যাই হোক, এই তিন ছেলের মধ্যে কোনো একজনের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল আন্দুল রাজবাড়িতে। শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোটতরফের বংশধর সুশান্তকৃষ্ণ দেব একটা বই লিখেছেন, তাতে মহেন্দ্রনারায়ণের মেয়ের নাম লেখা আছে ব্রজকুমারী মিত্র। হতে পারে তিনিই আন্দুল রাজবাড়ির সেই বৌ। নামটার বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তাহলে এই মেয়েটি কুমুদিনীর মামাতো ননদ হল। এই ননদের মেয়ে সরোজিনী, মানে সম্পর্কে কুমুদিনীর ভাগ্নী ছিলেন ওঁর সই। অভিন্নহৃদয় বান্ধবী। ননদের মেয়ে সরোজিনী মিত্রের বিয়ে হয় খানাকুলের ঘোষ বংশে। বরের নাম ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষ। সরোজিনী ব্রজেন্দ্রনাথের মেয়ের নাম প্রতিমা। এই প্রতিমার সঙ্গে কুমুদিনী তাঁর বড় ছেলে সতীশচন্দ্রের বিয়ে দেন।
- ও - ও - ও! এই সেই প্রতিমা, যে যক্ষ্মা হওয়ার পরে কাশী চলে গিয়েছিল। ননদের নাতনির সঙ্গে ছেলের বিয়ে।
- হুম। কুমুদিনী একবার ননদ, ভাগ্নী সরোজিনী সকলের সঙ্গে নৌকো করে কাশী গিয়েছিলেন। ছোট্ট প্রতিমাও সঙ্গে ছিল। সেই নৌকোবিহারেই বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে যায়।
- বাবা রে, তুমি এ সব কথা জানলে কী করে?
- বাবলিদি বলেছে।
- বাবলি মাসি জানল কী করে?
- বাবলি মাসিই তো জানবে। প্রতিমা আর সতীশ তো বাবলিদির ঠাকুমা আর ঠাকুরদা। তাছাড়া প্রতিমার দু’জন ভাইপো মানে বাবলিদির বাবার মামাতো ভাই এখনো বেঁচে আছেন। স্টিল ব্যাটিং অন নাইনটি প্লাস। তাঁদের থেকে ভেরিফাই করে নিয়েছে।
- বল কী? আচ্ছা মা, সতীশ তোমার বড়দাদু। সুরেন সেজদাদু, যাঁকে হাটখোলার দত্তবাড়িতে দত্তক নেওয়া হয়েছিল এবং যিনি আন্দুল রাজবাড়িতে মারা গেলেন। তাঁর বিয়ের গল্পটা কী? হাটখোলার দত্তবাড়ির সঙ্গে রাজবাড়ির সম্পর্কটাই বা কী?
- সম্পর্ক বলতে গেলে অনেক শতাব্দীর পুরোনো কাসুন্দি চাখতে হবে, ধৈর্য আছে?
- অবশ্যই আছে জেঠিমা। তুমি বল।
- তবে শোন, মোগল আমলে তেকড়ি দত্ত ছিলেন সেকালের মুজঃফরপুর পরগণার খাজনা আদায়কারী জমিদার। হাওড়ার বেশ কিছুটা অংশ ঐ পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। চৌধুরী হল জমিদারী উপাধি। তেকড়ি দত্ত থেকে পরপর অধস্তন পুরুষে জমিদারদের নাম শুনে নে। তেকড়ির পুত্র রত্নাকর। রত্নাকরের ছেলে কামদেব, তাঁর ছেলে কৃষ্ণানন্দ দত্তচৌধুরী। এঁর নাম শুনেছিস আগে।
- হুম, যাঁর বাড়িতে নিত্যানন্দ এসেছিলেন। যিনি পরে সন্ন্যাসী হয়ে পুরী চলে যান।
- একদম ঠিক। আন্দুলের লোকেরা বলে কৃষ্ণানন্দই ঐ জায়গার নামকরণ করেছিলেন আনন্দ ধূলি, যা আজ আন্দুল হয়েছে।
- আগের নামটা কী?
- আন্দুলের আগের নাম খুব সম্ভবত পারিন্দ্র অথবা চান্দোল – দু’রকম নাম পাওয়া গেছে। এবারে শোন, কৃষ্ণানন্দ তো তাঁর ছেলে কন্দর্প নারায়ণের হাতে সব ভার তুলে দিয়ে সন্ন্যাসী হলেন। কিন্তু কন্দর্পের পরের পুরুষে গোলমাল বাধল।
- কী গোলমাল?
- কন্দর্পের বড়ছেলে রামশরণ। তাঁর হাতেই এস্টেটের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে মন কষাকষি হতে মেজভাই গোবিন্দশরণ ষোড়শ শতকে আন্দুল থেকে টোডরমলের মানে মুঘল সম্রাট আকবরের যিনি অর্থসচিব, তাঁর একজন রাজস্ব আধিকারিক হিসেবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এঁরই উত্তর পুরুষেরা হাটখোলায় জমিজমা কেনেন এবং অট্টালিকা তৈরি করেন। এঁরা ব্যবসায়ী এবং পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করতেন।
- বাপরে এত পুরোনো কথা জানা গেল কী করে?
- দত্তচৌধুরীদের বংশপরিচয় নিয়ে বহু প্রাচীন একটা বই আছে – দত্ত বংশমালা। ঐ বংশের একজন আছেন ধ্রুব দত্তচৌধুরী। তিনিও এই বিষয়ে বই লিখেছেন। তাছাড়া জেনি ডট কমে আমি নিজের বংশলতিকা আপলোড করেছিলাম। তাতে মাহীনগরের বোস বংশ সূত্রে আমাদের অন্যতম আদি পুরুষ শ্রীমান বসু। তাঁর তুতো ভাই পুরন্দর খান। সেই সূত্রে অন্য আর একটি বংশ লতিকা জেনি মিলিয়ে দিয়েছে। ওদিকের যিনি কোলাবরেটর অভিজিৎ দত্ত, তিনি আবার হাটখোলা দত্ত বাড়ির বংশধর। উনি আর আমি কথা বলে দুটো ফ্যামিলি ট্রি মিশিয়ে দিয়েছি। উনি আর আমি সম্পর্কে হয়তো আত্মীয়, কিন্তু সঠিক সূত্রটা জানি না। আরও একটা মজার কথা হল, আমাদের কুমুদিনী আর লীলাবতী কৃষ্ণকুমারের মেয়ে কুমুদিনী দু’জনেই হাটখোলা দত্ত বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত।
- কী রকম?
- কৃষ্ণকুমারের মেয়ে কুমুদিনীর দিদা মানে লীলাবতীর মা নিস্তারিনী ঐ দত্তবাড়ির মেয়ে। আবার আমাদের কুমুদিনী ঐ দত্তবাড়িতে ছেলেকে দত্তক দিচ্ছেন, নিজে থাকছেন।
- কিন্তু মা সম্পর্কটা কী?
- সেটাই তো প্রশ্ন। পুরোনো লোক বলতে এখন বেশি লোক তো বেঁচে নেই। তাও যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আমার আর বাবলিদির মনে হয়েছে, হাটখোলার দত্তবাড়ি কুমুদিনীর মামার বাড়ি। খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকলে কি সেজ ছেলেকে দত্তক দিতেন? সেকালে এসব চেনাশোনা আত্মীয়তার মধ্যেই হত। দয়াল দত্ত মানে আমার সেজদাদুর পালক পিতা খুব সম্ভবত কুমুদিনীর মামাতো ভাই।
- হুম। তোমার যুক্তিতে পয়েন্ট আছে মা। কিন্তু এই যে বলছ জেনিতে বংশলতিকা মেলানো - এমনও হয়?
- হ্যাঁ, এই পৃথিবীতেই এমন হয়। আমি ওঁর বংশলতিকা দেখলাম। উনি সম্পর্কে নেতাজীর এক মামার নাতি।
- নেতাজী! আমাদের নেতাজী – সুভাষ বোস? মা আমি কিন্তু এবারে কেঁদে ফেলব।
- শান্ত হ। হাটখোলা দত্তবাড়ি তো নেতাজীরও মামার বাড়ি। আগে তো বলেছি তোদের।
- ওহ, ওই ব্যাপারটা একটু বল তো, ভাল করে শুনি।
- শোন তবে। বলছি বটে, মনে রাখবি তো? গোবিন্দশরণ দত্তের বড় ছেলে বাণেশ্বর দত্ত, তাঁর ছেলে রামচন্দ্র দত্ত। এই রামচন্দ্রই হাটখোলায় বসবাস শুরু করেন। রামচন্দ্রের ছোট ছেলে গোরাচাঁদ দত্ত হাটখোলা ছেড়ে চলে যান বরানগরে। গোরাচাঁদের নাতি দেবীপ্রসাদ। আবার দেবীপ্রসাদের নাতি গঙ্গানারায়ণ। এই গঙ্গানারায়ণের মেয়ে জামাই হলেন প্রভাবতী আর জানকীনাথ বসু – নেতাজীর মা বাবা।
- ওরেব্বাবা! এত মনে রাখতে হবে? তুমি এসব জেনি আর ধ্রুব দত্তচৌধুরীর লেখা থেকে জেনেছ?
- মূলত তাই। আমার আরও একটা সোর্স আছে। আমার এক ছোটবেলার মানে নিবেদিতা ইস্কুলের বন্ধু আছে সোমা বসু। ওরা কাশীনাথ দত্ত রোডে থাকে। কাশীনাথ হলেন দেবীপ্রসাদের ছেলে আর গঙ্গানারায়ণের বাবা।
- বুঝেছি নেতাজীর দাদুর বাবা।
- হ্যাঁ, সোমারা নেতাজীর দাদুর পাড়ায় থাকে। দত্ত বাড়ি হল ওর বাবার মামার বাড়ি। সোমার ঠাকুমার বাবার নাম ছিল জিতেন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরী।
- বাড়িটা একদিন দেখতে গেলে তো হয় মা।
- দেখতে যাবি? তোর ডোরেমনকে বল একদিনের জন্য টাইম মেশিনটা দিতে। আমরা একদিন ঘুরে আসব।
- কেন?
- ও’বাড়ি ভেঙে বহুকাল আগে ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
- সে কী? এইভাবে তো একদিন সব শেষ হয়ে যাবে মা। (মেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে)
- দাঁড়া বোনু, ঐ শ্রীমান বসুর ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝলাম না।
- ব্যাপার কিছুই না। কুমুদিনীর স্বামী শরতের বাবার নাম তোদের কী বলেছিলাম?
- মহেশ চন্দ্র।
- ঠিক। মহেশের বাবা বৈকুণ্ঠ, তস্য পিতা রামরাম বসু।
- দাঁড়াও দাঁড়াও জেঠিমা, রামরাম বসু নামটা খুব চেনা লাগছে। একটু মনে করি। ইনি কি সেই কেরি সাহেবের মুন্সী?
- না, তিনি নন।
- কী করে নিশ্চিত হচ্ছ?
- বয়েসের হিসেবে হয় না তাই। শরতের জন্ম ১৮৫০ এর আশেপাশে। ২৫ বছর করে গড়ে এক পুরুষ ধরলে আমাদের রামরামের জন্ম ১৮০০ সালের এপাশ ওপাশ হওয়া উচিত। কিন্তু কেরি সাহেবের মুন্সী যিনি, তাঁর জন্ম ধরা হয় ১৭৫৭ সালে। আরে বাবা, আমি কি খুঁজে দেখিনি ভেবেছিস! বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস বইয়ে বোসেদের বংশ লতিকায় অনেকজন রামরাম আছেন। তার মধ্যে উত্তর পুরুষ মহেশ – এমন আছেন দু’জন। একজন রাজা সুবোধ মল্লিকের পূর্বপুরুষ, আর একজন আমার মামার বাড়ির দিকে।
- ওরে বাবা, তাহলে শ্রীমান বসু কে?
- পিছন দিকে এগিয়ে পরপর বাবাদের নাম বলে যাচ্ছি, পরে পড়া ধরব। রামরাম-নিধিরাম-রামদেব-নন্দরাম-শ্রীমুখ-ভবানী-চাঁদ-হৃদয়ানন্দ-শ্রীকর-গৌরীবর-শ্রীমান। মানে শরতের ঊর্ধ্বতন চোদ্দতম পুরুষ হলেন শ্রীমান।
- বাপরে বাপ, এত নাম মনে রাখা সম্ভব নয় মা। বরানগরে নেতাজীর মামার বাড়িটা আর দেখতে পাব না ভেবেই তো খুব দুঃখ হচ্ছে।
- দুখ্খু টুখ্খু ছাড় বোনু। পয়েন্টে আয়। হিসেব মত নেতাজীর মামার বাড়ির শিকড় আন্দুলে। কুলগুরুও ওখানে। জেঠিমা তুমি কি সব জেনে শুনে আন্দুলে চাকরি নিয়েছ?
- না রে বাবু। আমাদের সময়ে কলেজ সার্ভিস কমিশনে কাউন্সেলিং বা কলেজ বেছে নেবার সুযোগ ছিল না। চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম, কোন কলেজে যোগ দিতে হবে। আমি চাকরি পাওয়ার আগে এই কলেজের নাম কোনোদিন শুনিনি। আর সে ত কোয়ার্টার সেঞ্চুরি আগের কথা। এসব কিছু যে আমি কোনোদিন জানতে পারব, সেটাই তখন জানতাম না।
- তাহলে এমন কী করে হল, জেঠিমা? একেই কি বলে বিধির বিধান?
- এটা আমারও মনে হয়, জানিস দিদি। মায়ের জীবনটা একটা অদ্ভুত অদৃশ্য জাল দিয়ে জোড়া।
- ডেসটিনি জেঠিমা ডেসটিনি। তোমার লাইফে কোনো ডেসটিনি আছে, যা তুমি জান না।
- বলছিস?
- আচ্ছা মা, এমনও তো হতে পারে, কৃষ্ণা, লাবণ্য, ভারতী, কুমুদিনী, সরোজিনী, প্রতিমা, হেমনলিনী, আদুরী, বুড়োদি, সেই সতীমা, আগের শারদা, মোক্ষদা, বেলারানী – এমন আরো যত মা আছেন সবাই চান তাঁদের কথা তুমি বল, তাঁদের না বলা কথা।
- আমাদের যা বলছ, তা তুমি লেখার চেষ্টা কর জেঠিমা।
- কিন্তু যাঁদের দেখিনি, চিনি না – তাঁদের কথা কীভাবে লিখব?
- তুমি পারবে মা, চেষ্টা কর। এই আমাদের যেমন বলছ, তেমন করেই লিখতে শুরু কর। দেখবে সহজ হয়ে আসবে। জড়তা কেটে যাবে।
- বোনু ঠিকই বলেছে জেঠিমা। আমরা তো সবকিছু মনে রাখতে পারব না। তোমার কথাগুলো হারিয়ে যাবে। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে সব মায়েদের কথা। এটা হওয়াটা কিন্তু একেবারেই ঠিক হবে না। তুমি ভেবে দেখো।
মেয়েদের কথাগুলো ভুল নয়, তবে ওরা যা বলছে, তা কি সত্যিই সম্ভব?
মায়ের কথা বলব ভাবি
সাড় না পাই জিভের ডগায় -
জোর করে মন লিখব সবই
কালি শুকোয় নিবের আগায়।
সেকাল একাল কইব কত?
আলোর নিচে গোপন ক্ষত।
গহীন রাতের শপথ ব্রত,
বুঝবে কি কেউ মায়ের মত?