২৩
গতবছর আম্ফান ঝড়ের ধাক্কা বহু জায়গায় সামলে ওঠা যায়নি, এর মধ্যে ঘনিয়ে এলো আবার একটি ঝড় - ২৬ শে মে, ২০২১ - ঘূর্ণিঝড় ইয়াস - আছড়ে পড়ল বাংলায়। ইয়াসের কয়েকদিন আগে আমরা ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মিলে একটা দল তৈরি করেছিলাম, ভূগোল বিভাগ তো, নাম দিলাম ভূপ্রহরী। পরিচিত ডাক্তার বাবু, সমাজসেবীরাও কয়েকজন সঙ্গী হলেন। সেই দলে বিভাগের প্রতিটা ক্লাস থেকে দশ বারোজন করে ছেলেমেয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিল। কথাবার্তা বলে বাকি ছাত্রছাত্রীদের তাদের নেতৃত্বে ভাগ করে দিলাম আমরা। স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রছাত্রীদের কাজ ছিল প্রতি বুধবার ভূপ্রহরীর ভার্চুয়াল গ্রুপে জানানো বন্ধুরা এবং তাদের বাড়ির লোকজনের স্বাস্থ্য কেমন আছে, বা অসুখ হলে পরিস্থিতি কী। দেখা গেল পারমিতা নামের এক ছাত্রী, আগে থেকেই ইটার্নাল ব্লিস নামের একটি সংগঠনের হয়ে কোভিড মোকাবিলার কাজ করে। চাঁদা তুলে ওরা অক্সিজেন সিলিন্ডারও কিনেছে। ফয়েজুর আর তার দাদারা মিলে কোভিড লিডস নামে কাজ করছে। ওদের দেখে সম্প্রতি ক্লাসের কিছু বন্ধুও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমরাও পুরোদমে কাজ শুরু করলাম। কোন ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকের কোভিড সংক্রান্ত যে কোনরকম সমস্যা হলেই, আমরা ভূপ্রহরীরা দিনে রাতে যখনই হোক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসে যেতাম। সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতাম। জীবনের একটা আলাদা মানে খুঁজে পেয়েছিলাম, মন খারাপ টারাপ সব ভুলে গিয়েছিলাম সকলে। আপৎকালীন মিটিং ছাড়াও রবিবার করে অনলাইন সভা হত। তাতে নানারকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। ডাক্তারবাবুরা আসতেন, বা তাঁদের কথার রেকর্ডিং শোনানো হত। ঠিক হয়েছিল, স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রছাত্রীরা এখান থেকে শিখে নিয়ে যে বন্ধুদের তারা খেয়াল রাখছে তাদের শেখাবে। কিন্তু বাস্তবে ওদের শেখাতে গিয়ে আমরা শিক্ষকেরাই অনেক কিছু শিখতে পারলাম।
আমাদের ধারণা ছিল কলেজের ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়েছে, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওদের সচেতনতার শিক্ষা খুব বেশি প্রয়োজন নেই, কারণ টেলিভিশন বা সমাজ মাধ্যমের কারণে এরা সব কিছুই দেখেছে, শুনেছে, জেনেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম একেবারেই ভুল ভেবেছি। যেহেতু প্রথম ঢেউয়ে গ্রাম তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি, তাই এই ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই অসুখটার ণত্ব ষত্ব কিছু জানেনা। টেলিমেডিসিন কি, অসুখের প্রোটোকল কি? কতদিনের মধ্যে কী ধরণের পরীক্ষা করাতে হবে, পরীক্ষা কোথায় হয়? অক্সিজেন কেন, কখন লাগতে পারে এগুলো তারা বিশেষ কিছুই জানেনা। তাছাড়া বেশিরভাগের বাড়িতে অক্সিমিটার তো দূর থার্মোমিটার পর্যন্ত নেই। কিছু ছেলেমেয়ের বাড়িতে এমন অবস্থা - বাবা বা মা দু'জনেই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি নাবালক বা সদ্য সাবালক সদস্যরা কেউ হালকা অসুস্থ। কিন্তু তাদের করোনা পরীক্ষা করা যাচ্ছেনা, কারণ পরীক্ষা করাতে গেলে রাত থাকতে উঠে ভোর থেকে হাসপাতালে লাইন দিতে হবে। সেটা ওরা যেতে পারছেনা। আর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট না থাকলে আশা কর্মীরাও এসে অক্সিজেন লেভেল মাপবেননা - এটাই নাকি সরকারী নিয়ম। ঐ ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে শুধু কান্নাকাটি করছে।
আর একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের আত্মীয় স্বজন পাশাপাশি থাকেন। অসুস্থ হলে বড়মা, ছোটোমা রান্না করে তাদের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আধা শহর বা মফস্বলের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রান্না করে পাঠানোর মতো তেমন কেউ নেই। আবার কাছাকাছি সেরকম কোন হোম ডেলিভারিও গড়ে ওঠেনি। রান্না কেউ কেউ জানে, তবে অসুস্থ ক্লান্ত শরীরে রান্না করে খাওয়া একটা বিষম বিড়ম্বনা। বাইরে থেকে এসে যে কেউ রেঁধে দিয়ে যাবে, বা মুখে খাবার ধরবে, করোনা আক্রান্ত বাড়ি বলে সেটাও সম্ভব হচ্ছেনা। মুখে স্বাদ নেই। এদের যা যা দরকার, তেমন কিছুই খাওয়া হচ্ছে না। এও শুনলাম যে টিউটর বা পাড়ার লোক, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ছেলেমেয়েকে ভিটামিন সি ট্যাবলেট আর ইলেকট্রাল পাউডার কিনে দিয়েছেন। কিন্তু সকলের বাড়িতেই বেশ ফাঁকা জায়গা, চারপাশে গাছ গাছালি - লেবু গাছ, তেঁতুল গাছ, পেয়ারা গাছ। বদ্ধ ফ্ল্যাটবাড়িতে বসে মোবাইল দিয়ে এদের বাড়িগুলো দেখে নিজের জন্য বেশ দুঃখ হত আমার, অস্বীকার করবনা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ভিটামিনের ওষুধ না খেয়ে বাড়ির গাছের লেবুর সরবত, তেঁতুলের সরবত, পেয়ারা খেলে যে অনেক ভালো থাকবে, সেটা এদের বলে কে? এ যেন একটা চক্রব্যূহ, যার থেকে এই মুহূর্তে বেরন ভীষণ কঠিন। এই প্রথম আমাদের শিক্ষাজগতের লড়াইটা শিক্ষা প্রাঙ্গণ ছেড়ে ছাত্রছাত্রীদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ল। এমনভাবে তো আমরাও ওদের দিকে তাকাইনি আর ওরাও আমাদের দেখেনি কখনও। যখন রোজ রোজ দেখা হত, তখন ওদের পারিবারিক বিষয়ে এত গভীরে কিছু জানতামনা। এখন সমস্যাগুলো বোঝার পর ভেবে ভেবে কূল পাইনা এসবের সমাধান কী। এর মধ্যেই একদিন দুপুরে একটা উদ্বিগ্ন ফোন আসে,
- ম্যাডাম আমি নৌরিন বলছি, ভলান্টিয়ার। আমাদের ক্লাসের কবিতার বাবার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, ওর ভাই বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে, সেখানে গিয়ে দেখে অক্সিজেন লেভেল ছাপ্পান্ন। বাড়িতে ওর মায়েরও জ্বর এসেছে। কবিতার কী হবে ম্যাডাম? ও ফোন করেছিল, খুব কান্নাকাটি করছে।
- আমি গ্রুপে লিংক দিচ্ছি, পনের মিনিটের মধ্যে সবাই জয়েন কর।
মিটিংয়ে কবিতার ক্লাসের বন্ধুরা বলে,
- ম্যাডাম, আমরা ঠিক বিশদে বলতে পারবোনা। আজ তিন চার দিন ওদের পরিবারকে দেখাশোনা করছে পাড়ার রেড ভলান্টিয়ার আজাদদা।
- আজাদ কে?
- সে আমাদের নয়, অন্য কলেজের ছাত্র। তাকে কি মিটিংয়ে নিতে পারি ম্যাডাম?
- হ্যাঁ, নিয়ে নাও।
মিটিংয়ে আসে জনৈক আজহারুদ্দিন। তার কাছ থেকে শুনে সমস্যার পয়েন্টগুলো গুছিয়ে নেওয়া হয়। কবিতার বাবাই পরিবারে রোজগেরে। অসুখের কোন লক্ষণ ছিলনা, জ্বরও হয়নি, হঠাৎ দিন তিনেক আগে ভয়ানক শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। জেলা হাসপাতালে বাবার চিকিৎসার খরচ লাগছেনা বটে, কিন্তু ঐ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর নেই। হাসপাতাল থেকেই অন্য হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত হবে, কিন্তু সেটা কোনভাবে দেরি হচ্ছে, হয়তো রোগীর চাপের জন্য। পাড়ার সকলের মত একবার সুপারের সঙ্গে কথা বলতে হবে ভাইকে। কিন্তু হাইস্কুলে পড়া ছেলেটা খুব লাজুক, সবার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে, সুপারের সঙ্গে কিছুতেই তার দেখা হচ্ছেনা। কবিতাদের বাড়িতে এই মুহূর্তে টাকা পয়সা বিশেষ নেই, আর বাজার বলতে এক প্রতিবেশী কিছু ডিম আর আলু কিনে দিয়েছেন। কবিতার মা একটা আলাদা ঘরে আছেন, তবে বাড়িতে অক্সিমিটার নেই, তাই নিয়মিত অক্সিজেন লেভেল দেখার সুযোগ নেই। তার মানে হল, ওদের সমস্যা এখন দুটো ফ্রন্টে। প্রথমেই পারমিতার অ্যাকাউন্টে যে যা পারি, টাকা ট্রান্সফার করলাম আমরা। কথা হয়ে গেল, পারমিতার থেকে টাকা নিয়ে আজাদ পৌঁছে দেবে কবিতার বাড়িতে, আর ওর থেকে কিছু নিয়ে, বাজার হোক বা ওষুধ যা দরকার কিনে দেবে, আপাতত সপ্তাখানেক তো চলুক। হাসপাতালের ব্যাপারটা কিছু করা যায় কিনা, দেখার জন্য আমরা প্রজ্ঞাদির শরণাপন্ন হই। প্রজ্ঞাদি আমাদের কলেজে বটানি পড়াতেন, এখন অবসর নিয়েছেন। ওঁর স্বামী ছিলেন এস এস কে এমের প্রাক্তন সার্জন সুপার দেবদ্বৈপায়ণ চট্টোপাধ্যায়, আমাদের দেবদা। সেই সূত্রে অনেক ডাক্তারবাবুকে প্রজ্ঞাদি চেনেন। ভূপ্রহরীর মিটিংয়ে বসেই প্রজ্ঞাদি একের পর এক ফোন করতে করতে ঈশ্বরের কৃপায় সুপারের নম্বর পেয়ে যান - তারপর যা হোক কয়েকদিনের মধ্যেই কবিতার বাবাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, আর সকলের প্রার্থনার জোরে একদিন সুস্থ হয়ে তিনি বাড়িও ফিরে আসেন। প্রজ্ঞাদি কবিতাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন অক্সিমিটার না থাকলে কীভাবে বুঝতে হবে, মা বাবার শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক ছন্দে চলছে কিনা। রোগীকে কিছুক্ষণের জন্য চিৎ করে রেখে তার পেটের ওপরে একটা বই রেখে তীক্ষ্ণ ভাবে নজর করতে হবে এবং মনে মনে সংখ্যা গুণে দেখতে হবে, বইটা একরকম ছন্দে ওঠানামা করছে নাকি কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত - এমন হচ্ছে। মানে যদি একটানা শ্বাস এক ছন্দে চলে, তবে এক..দুই - বইটা উঠল, তিন..চার বইটা নামল - কোন সমস্যা নেই। আবার যদি এমন হয়, এক-দুই-তিন-চার চলতে চলতে এক..দুই - বইটা উঠল, তিন..চার..পাঁচ..ছয়..সাত বইটা নামল - কিছুটা সময় অন্তর সমস্যা হচ্ছে - সঙ্গে সঙ্গে টেলিমেডিসিনে ফোন করে জানতে হবে, কী করণীয়।
বাড়িতে বাবা মা পড়ে গেলে ছেলেমেয়েগুলোর যে কী অবস্থা হয়, সে তো নিজের বাড়ি দিয়েই বুঝতে পারি। বেশিরভাগকেই অসুস্থ শরীরে রান্না করে খেতে হয়েছে। সরকারী আনন্দধারা প্রকল্পের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা বহু জায়গায় রান্না করা খাবার পাঠিয়েছে। আমাদের কিছু ছাত্রছাত্রীর পরিবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের এলাকার অসুস্থ মানুষের জন্য রান্না করেছে। তবু এসব কিছু দিয়ে জুড়েও আমাদের কলেজের হিন্টারল্যান্ডের পুরো এলাকা কভার করা যাচ্ছিলনা। শিক্ষকদের বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। কারোর বাড়িতে মৃত্যু, তো কারোর বাড়ির লোক হাসপাতালে। দিশাহারা অবস্থা - হঠাৎ মনে হল, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মায়েরা তো আছেন। ভলান্টিয়ার ছেলেমেয়েরা যেমন কয়েকজন বন্ধুর দেখাশোনা করছে, তেমন সুস্থ মায়েরাও তো রান্না খাওয়ার ব্যাপারটা কয়েকজনকে গাইড করতে পারেন। আসলে এই মুহূর্তে পাঁচ পদ রান্না করা তো সম্ভব নয়, ফুল পট রেসিপি লাগবে, যাতে একবারেই যা রান্না হবে, তাই হবে স্বাদু, সুষম আর পেট ভরা।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ - মায়েদের কাছে দুরকম অনুরোধ পাঠালাম আমরা। প্রথমটা হল - আপনার সন্তানের অন্তত দু তিনজন বন্ধু যাদের অসুস্থ আত্মীয়কে রান্না করে খাওয়াতে হচ্ছে, বা নিজে অসুস্থ শরীরে রান্না করতে হচ্ছে, তাদেরকে অনলাইনে দেখাশোনা করুন। আর দ্বিতীয়টা হল, এই সময়ের উপযোগী ফুল পট রেসিপি যদি জানা থাকে, সবাইকে জানান। অভাবনীয় সাড়া পেলাম। আমরা ভূপ্রহরীর জন্যেও একটা ফেসবুক পেজ করেছিলাম - তাতে প্রোনিংয়ের ভিডিও, শ্বাসের ব্যায়াম, তারপরে ওষুধ - অক্সিজেন কোথায় পাওয়া যাবে, মাস্ক কীভাবে পরতে হবে, হাত ধোওয়া, পরিচ্ছন্নতা - এইসব নানা তথ্য আপলোড করতাম। আসলে দুষ্টু লোকেরা এত ভুলভাল ফোন নম্বর, অন্যান্য তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়েছিল, তার থেকে ঠিক বের করা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার সমান। আমাদের কিছু ছাত্রছাত্রী সারাদিন ফোন করে করে, কোনটা ঠিক ফোন নম্বর, আর কোন গুলো মেকী সেগুলো খুঁজে বার করত। সেই পেজেই মায়েদের দেওয়া রেসিপিগুলোও তুলে দিলাম - সবারই তো দরকার।
ফুল পট রেসিপি বলতে খিচুড়িটা সকলেই জানে। আর আছে সেদ্ধ ভাত। করোনায় মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় তো, তখন রোগ থেকে উঠে সেদ্ধ ভাত মুখে রোচেনা। একজন মা চমৎকার চিকেন রাইসের রেসিপি দিলেন। আর একজন জানালেন চটজলদি এগ রাইস বানানোর কৌশল। ডিম আর চিকেন দুটোই আজকালকার ছেলেমেয়েরা খেতে ভালোবাসে। এগ রাইস দুভাবে করা যায় - প্রথম পদ্ধতি হল - যতজন খাবে, ততগুলো ডিম সেদ্ধ করে রাখতে হবে আর ডুমো ডুমো করে আলু কেটে ভেজে নিতে হবে। এবারে হালকা করে পেঁয়াজ ভেজে তাতে হলুদ, নুন, জিরে, ধনে দিয়ে কষে, তার মধ্যেই চাল আর জল দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। জল মেপে দিতে হবে - ফ্যান গালা চলবেনা। ভাত ফুটে ঝরঝরে হয়ে গেলে তাতে ডিমসেদ্ধ আর আলু ভাজা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এবারে দ্বিতীয় পদ্ধতি হল, আগের দিনের ভাত যদি বেঁচে যায়, তবে ঐ ভাতে দুটো কাঁচা ডিম ভেঙে খুব ভাল ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এবারে বাড়িতে যা সবজি থাকবে - বীন, বরবটি, গাজর, আলু, কপি, টমেটো - যা হোক টুকরো করে ভেজে তার সঙ্গে ডিম মাখা ভাত নেড়ে নিতে হবে। যদি বাড়িতে সয়া সস থাকে একটু মিশিয়ে নেওয়া যায়, না থাকলেও অসুবিধে নেই, শুধু কাঁচালংকা, হলুদ নুনেই বেশ চলে যাবে। চিকেন রাইসের পদ্ধতি আলাদা কিছু নয়, কেবল চিকেন আর একটু রসুন যোগ করতে হবে। এগ রাইসের মধ্যেও চিকেন দিলে চলবে।
একদিকে রেসিপি নিয়ে গবেষণা চলছে, ওদিকে কবিতার বাড়িতে অন্য বিপদ। ভাইটাকেও রোগে ধরেছে, যদিও তীব্রতা বেশি নয়। কবিতার বাবা খুবই দুর্বল কিন্তু কোভিড থেকে সেরে ওঠা ইস্তক মাছ মাংস পেঁয়াজ রসুন - কোন কিছুর দর্শন সহ্য করতে পারছেন না, খাওয়া তো দূর অস্ত। ভাইটা রোজ রোজ শুয়ে শুয়ে মুখরোচক কিছু খাবার বায়না করছে। মায়ের খাবার ঝামেলা নেই, কিন্তু তিনি এখনও শোয়া। এইরকম ছাত্রছাত্রী বা তাদের পরিবারের জন্য একজন পরিচিত পুষ্টিবিদ সঞ্চিতাদির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ঐ সময়ে তিনি অকাতরে লাগাতার ডায়েট বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, আর আমি ফেসবুক পেজে সেগুলো দিয়ে গেছি, যাতে ছেলেমেয়েরা সকলে জানতে পারে। যাই হোক, এদিকে একা সামলাতে গিয়ে কবিতার পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। মনে ভাবি, আজ যদি মা থাকত, কত রকম পথ্য তৈরির কৌশল বলে দিত আমাকে। আমরা বাড়িতে কেউ যখন অসুস্থ হতাম, মা সুস্বাদু সব পথ্য বানাত, আর বার বার বলত শিখে নে, শিখে নে। তখন এসবের মর্ম বুঝিনি, পাত্তা দিতামনা। আজ চক্রব্যূহে পড়ে মাথা খুঁড়ছি, অভিমন্যুর মত লড়াই করতে পারছি কৈ? ছোটবেলায় নতুন ক্লাসে উঠলে কখনও সখনও বাবার বই কিনে দিতে দেরী হত, আমি তখন দিদিমণিদের ক্লাসে পড়ানো সব কথা পাই টু পাই মনে রেখে দিতাম, পরদিন পড়া ধরলে বলেও দিতাম। কেউ বুঝতোই না যে আমার বই নেই। আজ সেই স্মৃতির ধারে সময়ের পলি পড়ে ভোঁতা হয়ে গেছে, কিছুই মনে পড়েনা আর। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় আমার। দুপুরে একটু তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল, অনেক দিন পরে মাকে দেখলাম - মা বলছে,
- বাঙালি রান্নার আসল কৌশল এখন আমরা যেভাবে প্রথমেই ফোড়ন দিয়ে সবজি মশলা সব কষে জল দিয়ে দিই, মোটেই তা নয়। আমার মা শিখিয়ে গেছে দুবার সাঁতলাতে হয়।
- লাবণ্যর হাতে অনেক সময় ছিল মা, তাই ওসব করত, এখন ওসব সম্ভব নয়।
- সব সম্ভব, অসুখ বিসুখ হলে তখন তো মায়ের রাস্তায় তোকে যেতেই হবে।
- কী রাস্তা?
- ঐ যে, সাধারণ রান্নায় “আগা-মুড়ো সাঁতলা, মাঝপথে ছাঁচনা”। আর “পথ্যি হলে, রবে আরম্ভে ছাঁচনার জোরা, পরে হাতা পোড়া দিবে সম্বরা।”
তন্দ্রাটা ভেঙে যায়। এ কী দেখলাম! কথাটা মা বলত বটে, ভুলে গিয়েছিলাম একদম, আজ এতদিন পরে আবার শুনলাম। বাক্যটা আওড়ানোর চেষ্টা করি। এটা কী কোন বাগধারা? মায়ের ব্যাপার তো, হয়তো নিজেই বানিয়েছে মনে রাখার জন্য, অথবা লাবণ্য বলেছিল মাকে। যাই হয়ে যাক, ছাঁচনা - ছাঁচনাটা কী জিনিস? হাতে হাতে কাজ করি, খালি ভাবি ছাঁচনা নিয়ে কী বলেছিল মা! মানেটা কে বলে দেবে! মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে মনে হল, সত্যিই কি সব ভুলেছি? তাই যদি হবে মাগুর মাছের সুপটা সেদিন বললাম কী করে? সেই কবে পঁচানব্বই সালে জন্ডিস হয়েছিল আমার, তখন মা এই সুপ বানাত। মাথা ঠান্ডা করে মন দিয়ে আরও ভাবতে হবে। দু একদিন পরে জানলায় বসে স্মৃতির কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে ছেঁড়া ছেঁড়া মনে পড়তে থাকে -
- মা এতরকম যে বলে যাচ্ছ, সব তো মনেও রাখতে পারছিনা আর পরে তো আরও ভুলে যাব।
- আমার মা বলেছিল, মায়ের মা, মানে আমার দিদা বলেছেন আমরা যেভাবে রান্না করি, সেই সব কথা সুন্দরীদি লিখে রেখেছেন বইয়ে।
- সুন্দরীদি? তিনি আবার কে গো? তোমার মায়ের মা - মানে লাবণ্যর মা যূথিকার দিদি?
- মাও তো সুন্দরীদিই বলত। নিজের দিদি তবে নয়, এ মনে হয় আমাদের যেমন বেলাদি - মহিলামহলের - হয়ত সেইরকম।
- (সোৎসাহে বলি) আচ্ছা, আমাদের যেমন শিশুমহলের ইন্দিরাদি? ‘ছোট্টসোনা বন্ধুরা ভাল আছ তো সবাই?’
মা ভেসে যায় অনন্তে। ভাবনার সুতো কেটে যায়, লাফিয়ে উঠি। সুন্দরীদির ব-ই! ব্যক্তিগত স্মৃতি যেখানে ছিঁড়ে যায়, সেখানে সামাজিক স্মৃতির কাছে হাত পেতে দেখতে হবে। আন্তর্জালে দেখব একবার? কিন্তু খুঁজব কী শব্দ দিয়ে? সুন্দরীর বই? না না সুন্দরীর রান্নার বই? শেষ পর্যন্ত একটা সুরাহা হয়। গুগলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার যন্ত্রগণকের পর্দায় ভেসে ওঠেন প্রজ্ঞা সুন্দরী তাঁর তিন খণ্ড “আমিষ ও নিরামিষ আহার” নিয়ে। বইগুলো ডাউনলোড করে গোগ্রাসে পড়তে থাকি, এই মুহূর্তে যেমনটি দরকার, সেই তথ্যগুলি নোট করে রাখি একটা খাতায়। এখন আমি অনেকটাই চাপমুক্ত আর পথ্য রান্নার কৌশলও করায়ত্ত। সেই সঙ্গে আরও একবার ঝালিয়ে নিই সুপ, কারী, মালাইকারী, দোলমাকারী, কোপ্তাকারী, ডালনা, কালিয়ার ব্যাকরণ। আর হ্যাঁ, ছাঁচনা জিনিসটাও খুব ভালো করে শিখে নিয়েছি।
বাটা আর গুঁড়ো মশলা দিয়ে ঘন থকথকে কাইয়ের রান্না হল কারী। কারীতে নারকেলের দুধ পড়লে হয় মালাইকারী। পুর ভরা সবজি ভাজা পড়লে এই কারীই হবে দোলমাকারী। আর বড়া ভাজা দিয়ে কারী হল কোপ্তাকারী। সবজি ভেজে নিয়ে আদা, পেঁয়াজ রসুন, জিরে, ধনে হলুদ ইত্যাদি মশলা লাল করে কষে জল দিয়ে ফোটালে হল কালিয়া। যেকথাটা জানতাম না, সেটা হল, পেঁয়াজ ছাড়া নিরামিষ কালিয়া করতে গেলে তরকারিতে খোয়া ক্ষীর কষে মেশাতে হয়।
কিন্তু এখন এসব গুরুপাক ভোজন তো অসুস্থ রুগীদের চলবেনা। ভাতে ভাত খেতে গেলে সুন্দরীদি বলছেন, ভাতের মধ্যে সবজি ফেলে সেদ্ধ করলে খেতে ভালো লাগে, কিন্তু ভাত অপরিষ্কার হয়ে যায়। তাই আলাদা জলে সবজি সেদ্ধ করব, আর ওই জলে অল্প করে আতপ চাল ফেলে ফেলে দেব। তাতেও সোয়াদ খুলবে। কথাটা লিখে রেখে দিলাম, সময় মত কাজে দেবে। উনি আরও বলছেন, গরম ভাতে পটল, বেগুন, পাকা উচ্ছে আর কাঁচকলা পোড়া খেতে। বেগুন পোড়া সব সময়েই খাই, কিন্তু পটল, পাকা উচ্ছে বা কাঁচকলা পোড়া তো খাইনি, ওটাও লিখে রাখলাম। চটজলদি নয়, সময় নিয়ে যত্ন করে নরম আঁচে ধিকি ধিকি পোড়াতে হবে। ভাত গলা দিয়ে না নামলে ডালের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাল সেদ্ধর সঙ্গে সবজি পোড়া বা সেদ্ধ মেখে খাওয়ার পরামর্শটাও বেশ মনে ধরল আমার। দুর্বল মানুষ যার চিবিয়ে খাওয়ার শক্তি নেই, অসম্ভব ক্লান্তি, তাকে এমন নরম অর্ধ তরল খাবার খাওয়ালে ভাল হবে। এখন মুশকিল হয়েছে, ফোনে ফোনে অজস্র মশলা ফুটিয়ে কাড়া তৈরি আর রোজ রোজ সেটা খাওয়ার পরামর্শ মানে মেসেজ, ভিডিও দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সঙ্গে অদ্ভুত সব শক্ত নামের ওষুধের অনুষঙ্গ। আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে অতিরিক্ত ঐসব খেয়ে পেটগরম করে ফেলেছে। যাদের পয়সা আছে তারা দামী দামী বিদেশি ফল আর মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট খাচ্ছে। কিন্তু আমি যা পড়াশোনা করছি, তাতে করে মনে হচ্ছে এই সময়ে স্থানীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। এখন করোনার সঙ্গে দোসর রয়েছে নিউমোনিয়া। দুটোতেই ভিটামিন সি দরকার, কিন্তু যারা অসুস্থ নয়, তার কী ট্যাবলেট খাওয়া উচিৎ? পয়সাও তো লাগে। এই তো সুন্দরীদি কাঁচা আম পোড়া, পাকা আম পোড়া, আমড়া ভাতে, আমলকী ভাতে, চালতা ভাতে কত কী লিখছেন। এখন আমার ছেলেমেয়েগুলোর এগুলোই খাওয়া দরকার।
এবারে আসি ছাঁচনার প্রসঙ্গে। বইয়ে দেখলাম, সুন্দরীদি ঝাল, ঝোল সব কিছুই ডালনা নাম দিয়েছেন। উনি লিখছেন, প্রথমে সবজিগুলো ভেজে তারপরে ছাঁচনায় ফোটাতে হবে। সেদ্ধ হয়ে গেলে কড়ায় আবার ফোড়ন দিয়ে পুরো ঝোল ঢেলে টগবগ করে ফোটাতে হবে - ঠিক মা যেমনটা বলেছিল, রান্না দুবার সাঁতলাতে হয়। আর ছাঁচনা জিনিসটা হল প্রয়োজন মত গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, হলুদ, আদা, জিরে, ধনে, লঙ্কা বাটা বা গোটা দিয়ে ফোটানো গরম জল। মশলা ফুটতে ফুটতে বুড়বুড়ি কেটে ফেনা ওথলাবে, তখন ভাজা সবজি ঢেলে দিয়ে ফোটাতে হবে। ডালনার প্রকার ভেদ অনুযায়ী মশলাও আলাদা হবে। আলু পটলের সাদা ডালনায় উনি জিরে মরিচ বাটা দুধে গুলে দিতে বলেছেন, তো মাংসের এমন ঝোলে কখনও ছাতু গুলে দিতে বলেছেন। সে যাই হোক পথ্য বিষয়ে লাবণ্যর উপদেশ এবারে আমি জলের মত পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। লাবণ্য বলেছিল, “পথ্যি হলে, রবে আরম্ভে ছাঁচনার জোরা, পরে হাতা পোড়া দিবে সম্বরা।” মানে হচ্ছে মানুষ যখন অসুস্থ তখন সবজি প্রথমে ভাজা চলবেনা। কাঁচা সবজি ছাঁচনায় ফুটবে। সবজি সেদ্ধ হয়ে গেলে যখন ফোড়ন দিয়ে সুগন্ধ করার পালা আসবে, তখন কড়ায় তেল না দিয়ে, লোহার গোল হাতায় ছ্যাঁকপোড়া তেল দিয়ে ফোড়ন ভেজে হাতা সমেত সেদ্ধ জলে ডুবিয়ে দিতে হবে। ওটাই হল হাতাপোড়া সম্বরা। মনে মনে লাবণ্যর তারিফ করি আমি। ছবির সামনে গিয়ে চুপিচুপি বলি, “খুব পাকা গিন্নি ছিলে তুমি দিদা, তোমার পদ্ধতিতে ঝোল সুস্বাদু আর সুগন্ধ দুটোই হবে, কিন্তু রোগীকে বেশি তেল খেতে হবেনা।” আর এই যে ভয়ের চোটে কাড়া খেয়ে খেয়ে সবাই পেটে চড়া পড়াচ্ছে, আর জিভের বারোটা বাজাচ্ছে, সেটাও করতে হবেনা, যদি এমন মশলা ফোটানো জলে রান্না হয়। সঙ্কেতের পাঠোদ্ধার করতে পেরে মনটা খুব খুশি হয়ে যায় আমার, সুন্দরীদির বইটা যেন এক গুপ্তধনের সিন্দুকের চাবি। আমি যে বই ডাউনলোড করেছি তার প্রথম খণ্ডের প্রকাশ কাল ১৩০৭ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯০০ সাল। মানে কলকাতা তখন সবে প্লেগের ঝড় সামলে উঠেছে। আর সোয়াশো বছর পরে করোনা অতিমারীতে সেই বই নিয়ে চর্চা করছি আমি। রবিঠাকুরের সেজদাদার মেজমেয়ে প্রজ্ঞা সুন্দরী - আমার প্রমাতামহীর সুন্দরীদি - পাঁচ পুরুষ পরেও তুমি আমাদের দিদির মতোই কাছের, বড় আপন। তোমার লেখাগুলি এত আন্তরিক, এত বাস্তবসম্মত, ঠিক যেন বড় কেউ হাতে ধরে শিখিয়ে দিচ্ছেন। আর লাবণ্যকেও সাধুবাদ দিতে হয়। ধনীর দুলালী, রাজপরিবারের বৌ, কিন্তু বিয়ের পরে যাতনাই যাতনা। এগারোটি গর্ভ, চোখের সামনে সাতটি সন্তানের অকালমৃত্যু, অযত্ন, রোগভোগ, দারিদ্র্য কমকিছু তো একজীবনে সহ্য করেনি, সে পথ্য পটিয়সী হবে নাতো আর কে হবে?
- ও মা! (হঠাৎ চমক ভাঙে) এই ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ? খেতে দেবেনা?
- ওহ হ্যাঁ, এই যাই বাবু। বেলা হয়ে গেছে খেয়াল ছিলনা।
- কেন খেয়াল ছিলনা? আজ কি লাবণ্যর জন্মদিন?
- লাবণ্যর জন্মদিন কবে জানিনা রে বাবু।
- কেন?
- সেকালে মেয়েদের জন্মদিন পালন, ছোট ছোট খুশি এগুলোকে কেউ পাত্তা দিতনা। জন্মসাল সম্ভবত ১৯০৮ বা ০৯।
- লাবণ্য কী দুঃখী ছিল? তুমি একবার বলেছিলে সীতার মতোন।
- আঘাত এসেছিল, তবে লাবণ্য ছিল ফাইটার। এক হার না মানা জীবন যোদ্ধা।
- সত্যি! আমাকে বলবে কী হয়েছিল?
মনে মনে ভাবি বলতে তো হবে, সবকিছু গুছিয়ে বলে যেতে হবে তোকে। নইলে কীকরে জানবি নিজের উত্তরাধিকার।
এক যে ছিলেন সুন্দরীদি
সুন্দর তাঁর বই।
নানান দেশের পাকের রসে
পুরো টম্বুর টই।
কিন্তু যদি পথ্যি রাঁধি,
রূপরেখাটা কই?
লাবণ্যকেই মানছি গুরু
গড় করি লো সই।
কাল-নদীতে বান ডেকেছে
খড়কুটোটাই ছই।
মনের পথে জোনাক জ্বলে,
পথটা তো খুঁজবোই।
পথের পাশে মা’ রা তরু,
তরুর ছায়ায় রই।
চিত-সায়রে উতল জোয়ার
অমা-রাত পেরোবই।