বুলবুলিতে ‘ভাত’ খেয়েছে –
খাজনা দেব কিসে?
আসলে বেশিজনের রাঁধাবাড়া এইরকম পরিকাঠামোয় করতে গেলে খেই হারিয়ে যেত আমার। রাঁধুনি দিদিদের যদি জিজ্ঞেস করতাম, কোনো জিনিস কতটা নেব, তারা মিষ্টি করে বলত, জানি না তো। আমি শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করতাম, এরকম কেন করে আমার সঙ্গে? উনি বলতেন, ওসব কথা ধরতে নেই। এই রান্নাঘরে ওরা পুরোনো এবং দক্ষ। তুমি নতুন আর আনাড়ি। অথচ তোমার আদর, মর্যাদা বেশি। ওদের ঐ রান্নাঘরটাই অস্তিত্ব। তাই দখল ছাড়তে চায় না। ধীরে ধীরে অবশ্য রান্নাঘরের মেয়ে-বৌদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে শুরু হল।
মাকে দেখে শিখেছিলাম। মা নিবেদিতা ইস্কুলের শিক্ষিকা, মেধাবী ছাত্রী। কিন্তু আড়বেলেতে মা কখনও খাপ খুলত না। জ্যাঠাইমাদের আড়ালে থাকত। আমিও নিজেকে মায়ের ছাঁচে ঢেলে নিলাম। কিন্তু মাঝেমধ্যে দেখতাম, ঐ মেয়ে-বৌরা মশলাপাতি, আটা-ময়দা, চিনি কিছু কিছু নিয়ে যাচ্ছে আড়াল করে। শাশুড়ি মায়ের কানে তুললাম কথাটা। তিনি হাসলেন। বললেন কিছু বাসনও গেছে এভাবে। পুকুরে মাজা হয় তো। মাজার সময়ে ভাসিয়ে বা ডুবিয়ে দেয়। অন্ধকারে তুলে নিয়ে যায়। বললাম, সে কী, তুমি কিছু বল না? তিনি বললেন, সে অনেক কথা। বড় কিছু না হলে সব জিনিস দেখতে নেই। কথাটা শুনলাম, কিন্তু মানতে পারলাম না। কর্তার কানে তুললাম। কর্তা বললেন, খবরদার এসব ব্যাপারে নাক গলিও না। মা যেমন বলছে, তেমনিভাবে চল। আমরা এখানে থাকি না। দু’দিনের অতিথি। আমরা ওদের রাগিয়ে দিয়ে ঝামেলা করে চলে যাব, তারপর সারাবছর কী হবে? যার হাতে রান্নাঘর, তার হাতে জীবন। ওসব মায়ের হাতে ছেড়ে দাও। পরে অবশ্য অনেক দাম দিয়ে বুঝেছি, কেন শাশুড়ি মা বলেছিলেন, সব জিনিস দেখতে নেই।
শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরের রাঁধুনি দিদিদের সঙ্গে আমার প্রথম মতান্তর হল ভাত নিয়ে। আমাদের বাড়িতে ভাতের ফ্যান গালার আগে মা ঠান্ডা জল ঢেলে দিত। এর দুটো কারণ ছিল। নামানোর আগে মাড় খুব ঘন হয়ে যায়। জল দিয়ে পাতলা করে দিলে সেটা ভাতের গায়ে আঠালো হয়ে বসে থাকে না, ভাতটা ঝরঝরে হয়। দ্বিতীয় কারণটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যান গালার সময়ে অনেক সময়েই হাত পিছলে যায়। ভাতের মাড় পিচ্ছিল কিন্তু আঠালো পদার্থ। পিছলে মাড় গায়ে পড়লে গড়িয়ে পড়ে যায় না, বরং চামড়ায় আটকে বসে। ফোসকা পড়ে যায়। আবার ভাতের ভাপেও অনেক সময়ে মুখ বা হাত ঝলসে যায়। নামানোর আগে ঠাণ্ডা জল দিয়ে দিলে মাড় আর ভাপ দুটোরই উত্তাপ কমে যায়। দুর্ঘটনা কিছু ঘটলেও উত্তাপ কমিয়ে দেবার ফলে সেটা তীব্র হয় না। কিন্তু এই রাঁধুনি দিদিদের বদ্ধমূল ধারণা, যে ভাত একবার যে জল দিয়ে বসানো হবে সেটাই থাকবে। দ্বিতীয়বার আর জল দেওয়া যাবে না। পরে জল দিলে ভাত নাকি পানসে হয়ে যাবে, সে যদি মাড় শুকিয়েও যায়, তাই সই।
আর একটা ব্যাপার হল, মা বলে দিয়েছিল, চাল যদি মোটা হয় আর বেশিক্ষণ সময় লাগে ফোটাতে, তবে সবার আগে ভাত বসাবি। ফুট এসে গেলে গ্যাস নিভিয়ে, ঐ অবস্থায় হাঁড়ি নামিয়ে রেখে অন্য রান্না সেরে নিবি চটপট। ফুটন্ত জলে চাল কিছুক্ষণ থাকলে নরম হয়ে যাবে। রান্না শেষ হয়ে এলে বা কারোর বেরোনোর সময় হয়ে এলে, ঐ হাঁড়ি আবার গ্যাসে বসিয়ে দিবি। এবার খুব চটপট ভাত হয়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে ভাতটাও শেষে গরম পাওয়া যায়, কিন্তু জ্বালানিটা খুব কম পোড়ে। রাঁধুনি দিদিদের এসব কিছু শেখানো গেল না। কেউ যদি বলে আমায় তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, যা হয়েছে তাই দিয়ে ভাত দিয়ে দাও, তারা দিতে পারত না। হয়তো তখন ভাত বসানোই হয়নি। দিদিদের ধারণা, সব রান্না হবে। শেষে ভাত বসবে। তবে ননদেরা আমার পদ্ধতিটা জেনে বাহবা দিল।
আবার শহরে একার সংসারে এসে আমার ভাত নিয়ে অন্য একটা বিপদ হল। চাল যা নিই, ভাতের মাপ ঠিক হয় না। আসলে শহরে আমাদের আপনি-কোপনির সংসার। আর একটি মেয়ে থাকত। তাকে আমার শাশুড়ি পাঠিয়েছিলেন। গাঁ-গঞ্জের অনেক অসহায় মেয়েকেই শাশুড়ি আশ্রয় দিতেন। তিনি সমাজের তোয়াক্কা করতেন না, কাউকে ভয়ও পেতেন না। উল্টে ওনাকে গ্রামের লোক সমীহ করত। এক-একটি মেয়ের এক-একরকম গল্প। রান্নাঘরে বসে বসে টুকিটাকি কাজের ফাঁকে তাদের কথা শুনতাম। একটি মেয়ের স্বামী সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডস নিয়ে ফেরে। গ্রামে এসে মারা যায়। তিন ছেলেমেয়ে সমেত পরিবারের লোক অল্পবয়সী বিধবা মেয়েটিকে বাড়িছাড়া করে। সে আমার শাশুড়ি মায়ের আঁচলের তলায় ঠাঁই পায়। যে মেয়েটি আমার কাছে থাকত, তার মা মুড়ি ভেজে দিন গুজরান করতেন। রাজরোগে মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়। বাপে আবার বিয়ে করলে। নতুন মায়ের একটি মেয়ে হবার পরে বাপ-মায়ে শলা করে আগের পক্ষের মেয়েদু’টিকে বিদায়ের ব্যবস্থা করলে, মানে শহরে চাকরির নাম করে দূর দেশে কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা হল। খোঁজ পেয়ে বড়টিকে শাশুড়ি নিজের কাছে রাখলেন। দেখেশুনে বিয়ে দেবেন। কালোকোলো ছোটোখাটো, হাসিখুশি মিষ্টি মেয়েটিকে নাক বোঁচা বলে শ্বশুরমশাই জাপানি বলে ডাকতেন। দেওরের কালো রঙের লাসা আপসো কুকুর ছিল – নাম লাড্ডু। লাড্ডুকে কোলে বসিয়ে গরস গরস করে ভাত মেখে জাপানি খাইয়ে দিত। ছোটোটিকে আমার সঙ্গে পাঠালেন। জাপানির সঙ্গে মিলিয়ে তার নতুন নাম দিলাম মিনি। শাশুড়ি মা বলে দিলেন দু’জনেই বেরিয়ে যাবে, চাকরিতে। একজন ঘরে থাকুক। লেখাপড়া তেমন জানে না। ছোটোবেলায় যা শিখেছিল ভুলে গেছে। আমাকে পইপই করে বলে দিলেন। আমি যেন তার পড়া ঝালিয়ে চিঠি পড়া এবং চিঠি লেখার উপযুক্ত করে দিই। এইটুকু না জানার ফলে অনেক মেয়ে আসল শ্বশুরবাড়িতে বা পাচার হওয়া নকল শ্বশুরবাড়িতে মরে। তখন তো মোবাইলের যুগ আসেনি। চিঠিই একমাত্র ভরসা। অবাক হয়ে দেখতাম, এই গ্রাম আমাদের আড়বালিয়ার থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষিত মানুষ আছে অনেক। কিন্তু গরীব মানুষের সঙ্গে তাদের দিনযাপনের ফারাকটা বেশ চওড়া। যাক, এসব কাহন পরে হবে। এখন ভাতের কথাটা বলে নিই।
শহরে ভাড়া বাড়িতে দুটো ঘরে আমরা তিনজন থাকতাম। কিন্তু প্রায়শই বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে ভরে থাকত। কারণ কেউ আসত ডাক্তার দেখাতে। কেউ আসত দূরপাল্লার ট্রেন ধরতে। এমন নানা কাজে গ্রামের মানুষের বিরতি যাপনের জায়গা ছিল ঐ এক চিলতে ভাড়ার ঘর। তখন সম্বৎসরের চালটা দীঘার বাড়ি থেকেই আসত। চাল কিনতে হত না। কিন্তু সে চাল ছিল মোটা দানা আর লাল। আর কয়েকমাস অন্তর খেপে খেপে কোনো লোক এসে দিয়ে যেত। একে তো ওরকম মোটা ভাত খাওয়া অভ্যেস ছিল না আমার। আবার কখনও এক কাপ চালে তিনজনের হয়ে যায়, তো কখনও দু’জনের কম পড়ে যায়। ভাত কোনোসময়ে অনেক বেশি হয়ে যেত, আবার কখনও কম পড়ে যেত। মাপ করতে পারতাম না। সে ভারি মুশকিল। আতান্তরে পড়ে যেতাম। কিন্তু কারণটা উদ্ধার করতে পারতাম না। এই নিয়ে অনুযোগও করতাম। একদিন কর্তা বললেন, তুমি যে বল তুমি নাকি বাংলায় ভাল। তোমার মা বাংলার টিচার, পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে কথাটা শোনোনি কখনও? সেদিন প্রথম ঐ কথাটার আসল অর্থ আমি জানতে পারলাম। যখন পুরোনো চালের বস্তা আসে, তখন দানাগুলো হয় শুকনো আর হাল্কা। এক কাপে বেশি দানা ধরে। তাই ভাতও বেশি হয়। আর যখন নতুন চালের বস্তা আসে, তখন দানাগুলো রসস্থ থাকে। তাই ওগুলো ফোলা আর ভারি থাকে, এক কাপে কম দানা ধরে, ভাতও কম হয়। কর্তা আরও বললেন,
- শহরের সরু সাদা চাল খেয়ে অভ্যেস। আমার বাড়ির মোটা লাল ভাত মুখে রোচে না তোমার। কিন্তু জানো কি, এই ধরণের মোটা চাল থেকে এই আসল লাল জিনিসটাকে বাদ দিয়ে মেশিনে সরু সাদা চাল বানিয়ে তোমার মত বেকুবদের কাছে বিক্রি করা হয়।
- আমি বেকুব?
- বেকুব নও? চিকন চালের দামে মোটা চালের বর্জ্য কিনছ। কেজি প্রতি প্রায় দশ-কুড়ি টাকা ঠকছ, তাও ঠকাটাই তোমার ভাল মনে হচ্ছে। বোকা না হলে এমন কেউ করে? শহরে বসে বাড়ির চাল পাচ্ছ, লোকে চেয়েও পায় না। তাও তার দাম দিতে পার না। এও জান না যে ঐ লাল অংশটাই চালের পুষ্টি।
- কিন্তু এমন করা হয় কেন?
- কারণ লোকে চিকন চাল খেতে ভালোবাসে। আর ঐ লাল ব্র্যান অংশটা দিয়ে তেল তৈরি হয়, তাই।
চালের এই অষ্টোত্তর শত কাহিনী শুনে আমি তো থ’, সত্যি সত্যিই বেকুব বনলাম।
তেজপাতে তেজ কেন,
ঝাল কেন লঙ্কা?
রান্না কেমন হল
রাঁধুনির শঙ্কা।
সুকুমারের রায়ের প্রশ্ন একটু বদলে দিলেও, এমন কূটতর্ক তো সংসার করতে গেলে উঠে পড়বেই। প্রথমেই আবিষ্কার করলাম, কর্তামশাই সজনে ফুল, কাঁচা টমেটো – এগুলো খেতে জানেন না। সজনে ফুলের চচ্চড়ি, মৌরলা মাছ আর কাঁচা টমেটোর বাটি চচ্চড়িতে তাঁর হাতেখড়ি হল। আমিও কি ছাই জানতাম, যে তেঁতুল দিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়ার টক এত ভাল খেতে? এটাও জানতাম না, গঙ্গার পাড়ে লঞ্চঘাটে সরু সরু চুনো মাছ পাওয়া যায়। ওটাকে বলে গঙ্গার কাঁচকি মাছ। ঐ চুনো মাছের আমসি টকও মুখে লেগে থাকে। আমি যেমন টকের স্বাদে মজলাম, কর্তার আবার নিরামিষ পটলের ঝাল খুব ভাল লেগে গেল।
একটু বড় আকৃতির, কিন্তু কচি পটল হলে ভাল হয়। পটলগুলো খোসা ছাড়ানো হবে না। বঁটি বা ছুরির উল্টো ধার দিয়ে একটু আঁশ ছাড়িয়ে নিতে হবে। তারপর লম্বালম্বি দু’ফালা করে নিতে হবে। তেলে পাঁচফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পটলগুলো হাল্কা ভেজে নিতে হবে। তারপর নুন, মিষ্টি, হলুদ আর সর্ষে বাটা ভেজানো জল দিয়ে ফোটাতে হবে। একটু মিষ্টি স্বাদের ঘন ঝোল রেখে নামিয়ে নিতে হবে। নামানোর আগে কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে নিলে ঐ ঝাঁঝটা খাওয়ার সময়ে ভাল লাগে। কিন্তু এখানে একটা কথা আছে। এই কাঁচা তেল দিয়ে রান্না নামানোর কৌশলটা মিনিকে শেখাতে গিয়ে একটা মুশকিল হয়েছিল, মানে বোঝার ভুল হয়েছিল। কাঁচা তেল দেওয়ার পর ঝোলটা বেশ কয়েক মিনিট টগবগিয়ে ফোটাতে হবে। তারপর রান্না নামাতে হবে, তেলটা দিয়েই নামিয়ে নিলে হবে না, তেলচিটে গন্ধ বেরোবে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম।
কর্তামশাই বাজারে পেঁয়াজকলি কিনে রোজ ভাজা করতে বলত। আমি তো জানি না যে ও ভাজা ছাড়া আর কীভাবে খেতে হয়, সেটাই জানে না। আমি একদিন ফালি ফালি পাতলা আলু কেটে পেঁয়াজকলির চচ্চড়ি করলাম। একদিন ভাজা পেঁয়াজকলি দিয়ে মাছের ঝাল করলাম। এই রান্নাগুলো করে কর্তা আর মিনি দু’জনেরই প্রশংসা পেলাম। পেঁয়াজকলি ভাজা দিয়ে ভাত খাওয়া বন্ধ হল।
এখন আমাদের বাড়িতে কাঁকড়ার শাঁসালো শরীরটা ঝাল, কালিয়া বা মালাইকারি হয় আর দাঁড়াগুলো দিয়ে টক বানানো হয়। পাকা তেঁতুল জলের মধ্যে চটকে গুলে রাখতে হবে। এবারে সর্ষের তেলে পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা দিয়ে তারপর দাঁড়াগুলো দিয়ে ভালো করে গনগনে আঁচে ভাজতে হবে। ভাজার সময়ে নুন, হলুদ, চাইলে একটু লঙ্কাগুঁড়ো দেওয়া যেতে পারে। ভালো করে ভাজা হয়ে গেলে তেঁতুল জল দিয়ে ফোটাতে হবে। ফোটানোর সময়ে চিনি দিয়ে দিতে হবে। শ্বশুর শাশুড়ি ডাক্তার দেখাতে আমাদের শহরের বাড়িতে আসতেন। তখন এইসব রেসিপি জেনে নিতাম। শাশুড়ি শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমসি বা তার বদলে পাতি লেবুর রস দিয়েও টক হয়। কিন্তু সেটা করতে গেলে পাতিলেবুর রসটা রান্নার শেষের দিকে মেশাতে হয় – না হলে তিতকুটে ভাব চলে আসবে আর রান্নায় জল দেবার সময়ে তাতে আমসিটা চটকে দিতে হবে। তেঁতুলের টক করতে গেলে তেঁতুলের জলটা রান্নার প্রথমদিকেই মেশাতে হবে। তেঁতুল যত জাল খাবে, তত তার স্বাদ খুলবে। মোটা শক্ত দাঁড়াগুলো সাঁড়াশি বা নোড়া দিয়ে ফাটিয়ে দিলে তাতে নুন মিষ্টি ভালভাবে ঢুকবে আর ভাতের পাতে খেতেও সুবিধে হবে।