আমার জন্ম কলকাতা মেডিকেল কলেজে। কর্ম, ধর্ম – এই শহরেই। তবে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছিল বসিরহাটের আড়বালিয়ায়। স্কুলের ছুটি পড়লেই চলে যেতাম দেশের বাড়ি। বড়জেঠু, মেজজেঠু, সেজজেঠু, তিন জ্যাঠাইমা, ভাইবোন মিলে পুরো দশ। আনন্দেই কেটে যেত দিনগুলো। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিসি ছিল। কেবল বাবা সবার ছোট বলে, নিজের কাকু ছিল না আমার। বাবাই ছিল সবার ছোটকা। তাই আমার বড় হওয়া গ্রাম শহর মিশিয়ে – এসব কাহন তো আগেই বলেছি, তবু শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে শিকড়টা ঝালিয়ে নিতে ক্ষতি কি?
বি.এ, এম.এ পাশ দেবার পর বাবা ভেবেছিলেন সম্বন্ধ খুঁজবেন আমার জন্য। লাল কলম হাতে পরীক্ষার খাতা থেকে মুখ তুলে মা বললেন, সাতজন্মের বেড়ি। যে হাঁড়িতে চাল দিয়েছে, সে বাড়ি ঠিক খুঁজে নেবে ওকে। মায়ের বিশ্বাসের ছিলায় বিধির বিধান – তীর ছুটল এঁটেল মাটির দেশ থেকে গঙ্গা পেরিয়ে আড়াআড়ি দক্ষিণ মুখে। গাঁথল গিয়ে বঙ্গোপসাগরের পারে বালিয়াড়ির দেশে। কোষ্ঠীবিচারের বালাই নেই, তবু অবাক হলাম। এপারে বাবা সমীর, আর ওপারে বাবা অমর। এপারে মা নদীর নামে কৃষ্ণা, তো ওপারে মা সাগরবেলায় বেলারানী। এপারে জেঠতুতো খুড়তুতো মিলিয়ে দশ, ওদিকে ওরা একবাড়িতে নিজেরাই ছয়। রাঙামাথায় চিরুনি দিয়ে, আর একরাশ কৌতূহল নিয়ে মৈথুনা গ্রামের বালিয়াড়িতে পা রাখলাম। রসুলপুর নদী থেকে সুবর্ণরেখার পাড় অবধি চলেছে বালিয়াড়ির সারি। চেনা বাংলার অচেনা সেই নোনা বালির দেশে ওড়না ফাঁক করে তাকালাম। প্রশস্ত উঠোনের এক পাশে খড়ের গাদা। অন্যধারে বেলনাকৃতি ধানের গোলা। মাথায় কুঁড়েঘরের মতো খড়ের চালা। বাঁ-পাশে গোয়ালঘর, তাতে দু’-তিনটি গরু-বাছুর রয়েছে। সামনে ডানদিকে দোতলা বাড়ি। ধানের গোলা আর গোয়াল ঘরের মাঝখানে গোপীনাথের মন্দির। তার উঁচু চুড়োয় গরুড়দেব বসে আছেন দু’টি ডানা মেলে। আর চারিপাশে অজস্র গাছগাছালি। মন্দিরের দাওয়ায় শাশুড়ি কোলে বসিয়ে মধু খাইয়ে দিলেন। কিন্তু বরণডালা, দুধে আলতায় পা – এসব কিছু হল না। জ্যান্ত মাছ ধরতে হবে না তো, মনে ভয় ছিল ভীষণ, সেসব-ও হল না; বেঁচে গেলাম। বাড়িতে ওঠার সময় দেখলাম চওড়া ঢালা কাঠের এক চেয়ার, দু’পাশে হাতল। তাতে বসে আছেন হাসিমুখে তিন বৃদ্ধ। মাঝের জনকে চিনি, আমার শ্বশুর-বাবা। কিন্তু পাশের দু’জন? পিঠোপিঠি এক ননদ আছে, পরিচয় করিয়ে দিল। আমার কাকুর জায়গা ফাঁকা ছিল। এবার আমার কাকু হল। অখিলকাকু, শচীনকাকু।
শ্বশুরবাড়ি ঢুকে তো রৈরৈ, সকলে অনেক কিছু জানতে চায়। গাছে উঠতে পারি কি না। পুকুরে সাঁতার দিতে পারি কি না, ছিপে মাছ ধরতে পারি কি না। মাছ কুটতে পারি কি না। গ্রামে থাকতে পারব কি না। আমি শুধু হাসি, আসলে কাজ কর্ম কিছুই পারি না। দোষ দিতেও পারি না। মহানগরিনী নায়িকা আর অজ-গ্রামের নায়ক নিয়ে নাটকটা ফ্লপ হবে কি না, এ নিয়ে অতিথি কেউ চিন্তিত হতেই পারেন। আমারও যে গ্রাম-যোগাযোগ আছে, সেটা তাঁদের অজানা। তবে দশকথার আটকথাই মাছ নিয়ে হচ্ছে। মাছ আমার প্রিয় নয়। ছোটবেলায় সেজ-জ্যাঠামশাই অট্টহাসি হেসে বলতেন, এ মেয়ের মেছোর ঘরে বিয়ে হবে। তা কি এমনভাবেই সত্যি হল! ভারি বিপন্ন হই। শুধু দশজোড়া চোখের বৃত্তের বাইরে সেই ঢালা চেয়ারে তিনজোড়া দৃষ্টি প্রসন্ন প্রশ্রয় দেন। ইশারায় কিছু কাজ হল কি না – বুঝিনি, শাশুড়ি একটানে উদ্ধার করে দোতলায় নিয়ে চলে গেলেন। সে যাত্রা স্বস্তি পেলাম।
ছিলাম সুন্দরবনের উত্তর দিশায়, ইছামতীর পাড়ে, বাংলাদেশের সাতক্ষীরার ধারে। এসে পড়লাম কর্ণ-বরাবর উল্টো মুখে উড়িষ্যার পারে। রন্ধন আর ভাব প্রকাশের ভাষা, দু’টি ব্যাকরণই অচেনা।
“হেথা গড়িয়ায় চান হয়, মাড়ায় মশারি,
দুর্গাপূজা ঘরে হয়, রথ বারোয়ারি।
কত রঙ্গ বঙ্গদেশে আহা বলিহারি।
প্যাকেট(র) মিষ্টি নিয়ে যাউচে ফটক
ট্যাংরায় কালিয়া হয়, রুই মাছে টক
জেনে নব বৌ-এর চক্ষু চড়ক।”
(গড়িয়া মানে পুকুর, মশারি মাড়ানো মানে মশারি তোষকের চারপাশে গুঁজে দেওয়া, ‘র’ হল অব্যয় - যার অর্থ থেকে)
বিয়ের চারদিনের দিন এক ঘটনা ঘটল। এখানে বাসি বিয়ে হয় না। চৌথী হয়। মানে চারদিনের দিন মন্দিরে আবার বিয়ে হয়। কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। ঐদিন রাতে শাড়ির আঁচলে পাঁচটা ফল বেঁধে ঘুমোতে হয়। ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভোররাতে বর ঘুম থেকে ডেকে বলে, নিচে কলটানার আওয়াজ। মা উঠে পড়েছে। তুমি উঠে পড়। আমার আর হুঁশ নেই। চিরকাল রাতে পড়াশোনা করি, আমি লেট রাইজার। শেষে দরজায় ঠকঠক। নভেম্বরে বালির ঠান্ডা, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে খিল খুললাম। দেখি বাইরে মোটা শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি মা। পুকুরে নামা অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডায় শাল জড়িয়ে... বলির পাঁঠা হয়ে চললাম। সূর্য উঠতে এখনো দেরি। পুকুরের সামনে শাশুড়ি বললেন, গাছের আড়ালে জামা বদলে নাও। বলে আমার পরনের শাড়িটা পুকুরে কেচে মেলে দিলেন। আর বললেন, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমার ওপরে যা চলেছে তা বৌয়ের ওপর হতে দেব না। মনে ভাবি, আড়বালিয়ায় যদি এমন হত, জ্যাঠাইমারা বলতেন – একটা দিন মানতে হয়। ওষুধ খেয়ে নেবে। মায়ের বুক ফাটলেও জ্যাঠাইমাদের ওপরে কথা বলতেন না। ছোটবেলায় হাঁপের টান উঠত আমার। এখনও পান থেকে চুন খসলে সর্দি-কাশি। এসব না জেনেও, রীতি-রেওয়াজ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে আমার প্রাণরক্ষা করলেন ইনি। না হলে হাসপাতালের শয্যা অপেক্ষায় ছিল। চিরঋণী হয়ে গেলাম। দিন গেলে বুঝলাম, গ্রাম্যতার মাঝে তিনি মূর্তিমতী বিদ্রোহিনী। একশ’ বছর আগে সেই যিনি আয়ার্ল্যান্ড থেকে এসে গুরু বিবেকানন্দের কথায় মেয়েদের ইস্কুল করেছিলেন, আমি সেই স্কুলের ছাত্রী। ফেমিনিস্ট চিনতে ভুল আমার হয়নি। ক্রমে এই গাঁয়ে মেয়েদের ইস্কুল খোলা, আরও নানা সমাজ সংস্কারে শাশুড়ি মায়ের অবদান জানলাম। যত চিনলাম, মনের দিক থেকে ততই তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। এও বুঝলাম, তাঁর মনের জোরের নৌকোর হাল বাঁধা আছে তিন খুঁটিতে। বাবা আর দুই কাকা। শহরে আমরা রোদ বেরোলেই ছাতা, সানগ্লাস, এয়ার কন্ডিশনার – কত আড়াল খুঁজি। আর এখানে গায়ে রোদ লাগানোর রীতি। ঢালা চেয়ারটা লোক দিয়ে উঠোনে বার করে, তিন বৃদ্ধ বসে থাকতেন আয়েশে। কাজ সেরে মা এসে বসতেন মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে। কখনো বা মাদুরে। গল্পগাছা কতকিছু হত। দোতলা থেকে দেখি আর হাসি। মনে মনে নাম দিয়েছি “চার ইয়ার”। কাকারা যে রক্তের সম্পর্কের নন, তা আমি বহুদিন জানতাম না। ভাবতাম অন্য বাড়িতে থাকেন শুধু। জানার পর মনে ভাবি, সত্যিই তো।
“রক্তের মিল আর স্বার্থের অমিল।
চুম্বকের দুই মেরু, বড় গরমিল।।
পরস্পরকে টানে, তবু দ্বন্দ্ব-বর্গীয়।
সখ্যতা অমৃত বটে, তাই স্বর্গীয়।।”
সিঁড়ির যেমন ধাপ আছে, বন্ধুতারও ক্রম আছে। সবচেয়ে ওপরে, এ-বাড়িতে অমর-বেলা, তো ও-বাড়িতে শচীন-অখিল। পরের ধাপে, এ-বাড়িতে বাপু-তপু, তো ও-বাড়িতে তুলু-পিপলু। দিন যায়। এ-বাড়িতে রঞ্জা-কর্ণা, তো ও-বাড়িতে সোহম, মাম্পি, ভোম্বল।
এ-বাড়িতে বাবা সবচাইতে মজার মানুষ। অষ্টপ্রহর তাঁর হা হা হাসিতে ঘর ভরে থাকে। অখিল কাকু খুব চুপচাপ, তিনি আমাদের লেভেলে তেমন মেশামেশি করেন না। শচীন কাকু তেমন না। প্রণাম করলে লাজুক হাসেন। আবার গল্পও করেন। শুনতে পাই তিনি পণ্ডিত মানুষ। অনেক বই লেখেন। অনেক ইস্কুলে তাঁর লেখা বই পড়ানো হয়। তবে আমার চোখে তিনি লাজুক কিন্তু মিশুক, ভারি মিষ্টি একজন মানুষ।
বিয়ের পর প্রথম দুর্গাপুজোয় এক গোল বাধল। যবে থেকে হাঁটতে শিখেছি, তবে থেকে বিয়ের বছর পর্যন্ত দুর্গাপুজোয় আমাদের বাঁধা রুটিন ছিল। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী – তিন দিন আলোয় আর পুজোর গানে ভাসা কলকাতায় বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঠাকুর দেখা, চপ, কাটলেট, ফুচকা – যা পাওয়া যায় খাওয়া। নবমীতে সোজা সোদপুর – বড়মামার বাড়ি। ফিরে হাতিবাগানে নতুন কোনো থিয়েটার দেখা। আর দশমীতে ভোরে উঠে আড়বালিয়ায়। সেখানে ছিল বিরাট আকর্ষণ। তিন মন্দিরের মাঠে মেলা; এলাকার যত দুর্গাঠাকুর, সব আসত, বরণ হওয়ার জন্য। সব গ্রামের বৌরা আসত বরণডালা নিয়ে। সিঁদুর খেলা হত। এতকাল শুধু দেখেছি। এবারই প্রথম আমার এন্ট্রি পাবার কথা। বাড়ি ফিরে বেলপাতায় শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় লেখা। সেই লেখার জন্য দুপুর থেকে প্রস্তুতি। কঞ্চির কলম কাটা, আলতা গুছিয়ে রাখা, লক্ষ্মীপুজোর জলচৌকি নামিয়ে সাজানো। অনেক কাজ। লেখা হয়ে গেলে, মূল আকর্ষণ ছিল বড়দের প্রণাম করে পার্বণী পাওয়া। শেষে ভাইবোনেরা বসে কার কত আয় হল, তার হিসেব কষা। অলিখিত নিয়ম ছিল, বিয়ে হয়ে গেলে সে আর পার্বণী পাবে না। তাকে দিতে হবে। আমার বাবা সবার ছোট। তাই আমিও দশজনের মধ্যে ছোটোর দিকে। আমার ওপরে সাতজন। গত বছর আমি হায়েস্ট পেয়েছিলাম। আমার নিচে, দু’জন দুধেভাতে। তারা একটু কম পেয়েছিল। আসলে যখন যে হায়েস্টে ওঠে, তারপরে তার বিয়ে হয়ে যায়। ছোটদের আর একটু লাভ বাড়ে। এবার আমি ডোনার হব। মনে মনে অনেক জাল বুনে রেখেছিলাম। বিজয়া পালন হত ঘটা করে। স্পেশাল আইটেম ছিল মেজজ্যাঠাইমার মাংসের ঘুগনি। আমাদের এক এক বাড়িতে এক এক রকম মিষ্টির রকমারি বাহার থাকত। বিজয়ার পরে কয়েকদিন সব বাড়িতে খেতে খেতে রাতে আর খেতে হত না। আর অষ্টমী বাদে অন্তত দু’দিন পাঁঠার মাংস হবেই। বাকি দিন চিকেন বা রুই-কাতলা হত।
এ বছর শুনলাম, পঞ্চমীতেই চলে যাব শ্বশুরবাড়ি। ফিরব লক্ষ্মীপুজোর পর। সেখানে বাড়িতে পুজো। আড়বেলে যাবার কোনো গল্প নেই। যত জাল বুনেছিলাম, এক কোপে ফালাফালা। কলেজের এক রসিক প্রবীণ সহকর্মী বলেন, দুর্গাপুজো তো মেয়েদের বাপের বাড়ি যাবার উৎসব। তুমি উল্টোদিকে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছ, কলকাতা ছেড়ে পুজোয় প্রথমবার। পারবে তো? তাঁকে বলি, বাড়িতে তো পুজো হয়। আসলে বাড়ির পুজো সম্পর্কে আমার একটা ধারণা ছিল – সিনেমা আর উপন্যাসে যেমন হয়, অথবা অন্তত খবরের কাগজে যেমন পড়া যায়।
প্রত্যাশা পূর্ণ হল না। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দেখলাম, মন্দিরে নিত্যপূজার সাথে, একপাশে ঘট পেতে, পিছনে একটা পট রেখে দুর্গাপুজো হচ্ছে। তিন দিন হবে। বৈষ্ণবমতে পুজো, তাই পুরোটাই নিরামিষ। ষষ্ঠীর বোধন আর দশমীতে বিসর্জন নেই, তাই বিজয়া পালন, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখের পর্বও নেই। মৃন্ময়ী মা নেই। কোনোদিনই ছিলেন না। আমাদের বিয়ের এক বছর আগে, কষ্টি পাথরের গোপীনাথ, কয়েকশ’ বছরের পুরোনো রাধা, অষ্টধাতুর অ্যান্টিক বৈষ্ণবী স্টাইলের দুর্গামূর্তি, মায় ঘণ্টা-কাঁসর, বাসনকোসন সব চুরি হয়ে গেছে। এখন নিমকাঠের মূর্তিতে গোপীনাথ, রাধারানী পূজিত হচ্ছেন। দোষ লাগার নিদান হয়েছে, তাই ঘটে পুজো। শাক্ত দেবীর যে বৈষ্ণবমতে পুজো হতে পারে, এ বিষয়ে কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না আমার। বিয়ের সময় ডায়নামো আলো ছিল, ভিড় ছিল, কিছু বুঝিনি। অন্য সময় হলে হয়তো ভালো লাগত। দুর্গাষষ্ঠী, সপ্তমীতে মন্দিরের প্রদীপ, হারিকেনের টিমটিমে আলো, আর দেবদারু জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র আঁধার আমাকে যেন গিলে খেতে এল। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার জন্য সব ছোট থেকে হোস্টেলে। পুজো হল ছুটিতে বাড়ি ফিরে আড্ডা দেওয়া, আরাম করা। আমার আঠাশ বছরের ঝোড়ো দুর্গাপুজো নিম্নচাপের স্থিরকেন্দ্রে এসে পড়ল। তার চেয়ে বেশি ভয়, বাকি পুজোগুলোও এমন কাটবে। বাড়ির লোকে ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই বাড়ি আসাতে এতই মশগুল, মেজোবৌয়ের মনখারাপের খবর কারো কাছে পৌঁছল না। রুমমেট, যাঁর কাছে খবর পৌঁছতে পারত, তাঁর টিকি পাওয়া গেল না। তিনি বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত রইলেন।
পঞ্চমীতে আসার পর আজ তিনদিন। খাঁচায় বন্দী পাখি হয়ে আনমনে বসেছিলাম। বিকেলে শচীন কাকু এলেন।
- কি বৌমা, কলকাতায় তো খুব ঘুরুথায়। এঠি কিছি নাই।
- ঠাকুরের মুখ দেখা হয়নি কাকু।
- এখানে দুটো পুজো তো হয়। মাইতি হাট আর রথতলা।
- তাই নাকি?
- তুমি বাপুকে (আমার বরকে) ধরো বৌমা। নতুন সংসার তো। এখনো ব্যাচেলরের মতো টো টো কোম্পানি করছে। একান্ত যদি না নেয়, আমাকে বোলো। আমি রথতলার প্রেসিডেন্ট। হাঁটতে পারো তো?
- আচ্ছা। হ্যাঁ তা পারি... আজ আসুক, মজা দেখাচ্ছি।
পরের সন্ধ্যেয় বাপু বন্ধুর বাইক ধার নিয়ে, আমাকে ঠাকুর দেখাতে বেরোল। মাইতি হাট, রথতলা পেরিয়ে হিরাকনিয়া। পুজোর মেলা। বক্সিগঞ্জের হাটের মত বেতের বোনা ধামা-কুলো থেকে শীতের র্যাপার নক্সা-কাটা; পিতলের বাসন থেকে লোহার ছুরি কাঁচি – খুব মজা হচ্ছিল। খুব ঝালঝাল মশলাদার ঘুগনি খেলাম, শালপাতায়; বলে দিলাম, পেঁয়াজ কুচি দেবেন না। এখানে এমন ঘুগনিকে বলে চটপটি। এগরোলের দোকান, মাংসের চপ, সবের দোকান বসেছে। ম্যারাপ বেঁধে, প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পেতে অস্থায়ী রেস্তোরাঁ বসেছে কয়েকটা। সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই হাসিমুখ বেরিয়ে আসছে,
- কিরে, বাপু নাকি, বৌদি এস এস।
কর্তামশাই বললেন,
- আমার বন্ধুরা দোকান দিয়েছে। তোমাকে দেখে ডাকছে। যাবে নাকি?
- এখানে নিরামিষ আছে?
- নিরামিষ? নিরামিষ খাবে কেন?
- পুজো চলছে, তোমাদের পুজো তো নিরামিষ।
- সে তো বাড়িতে, বাইরে কিসের? অ, ঐজন্যে চটপটিতে পেঁয়াজ দিতে বারণ করলে?
- অ্যাঁ! বাইরে নিয়ম মানো না?
- না।
- সে কী?
- একটা কথা বলে দিচ্ছি, শোনো। ঐতিহ্য মেনে চলতে চাইলে চলবে। কিন্তু নিজেকে সবসময়ে নিয়মের বেড়ি পরাবে না। খুব বাজে জিনিস।
- কিন্তু এখানে আমিষ খেলে তো সবাই দেখবে। বাড়িতে বলে দেবে তো।
- সে তো বলবেই। আমি নতুন বৌ নিয়ে খেতে এসেছি, এটাই তো ওদের আনন্দ।
- কিন্তু মা যদি রাগ করে।
- মা! রাগ করবে? হাসালে দেখছি। তোমার এখানে প্রথম পুজো। পুজোর মেলা। তায় মোগলাই পরোটা আয় আয় করে ডাকছে। এখন মা যদি শোনে, আলুর চপ খাইয়েছি, তাহলে আমায় আস্ত রাখবে? কথার ছুরি দিয়ে কাটবে।
- কাকে? তোমায় না আমায়।
- তোমায়? আমায় কাটবে। মায়ের কাছে মেয়েরা হচ্ছে সব। ছেলেরা ফ্যালনা।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ, বড়দি, মেজদি অনেক বড়। আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছোড়দি আর আমি পিঠোপিঠি। অন্যবাড়িতে দধির অগ্র, ঘোলের শেষ – সব ছেলেরা পায়। আমাদের বাড়িতে উল্টো। মানে মা উল্টে দিয়েছে। আগে এমন ছিল না। মার তত্ত্বাবধানে সব ভালো অংশ ছোড়দি পেত। তারপর আমি, তপু।
মনে ভাবি, ভারি আশ্চর্য মানুষ এই বেলারানী। যাই হোক। সেই মেলা – হোটেলে পেটপুরে মোগলাই পরোটা দিয়ে পেটপুজো হল। পুজোয় নিরামিষ খেয়ে প্রাণপাখিটা কষ্টে ছিল, কিছুটা তো উপশম হল। টেবিলে পরোটা দেবার সময়ে বন্ধুটি বলল,
- খেয়ে দেখ বৌদি, একেবারে স্পেশাল বানিয়েছি। কলকাতার থেকে আলাদা পাবে না।
খেয়েও দেখলাম বেশ ভালো। কর্তা বললেন,
- এরা সব কলকাতার হোটেলে কাজ করে। বলেছিলাম না – সেই অনাদি কেবিন, চৌরঙ্গী কেবিনের কথা। এমন হাজারো আছে। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে দোকান দেয়।
কথাটা ঠিকই। ছেলেটি আমার সঙ্গে কলকাত্তাই বাংলাভাষায় কথা বলল। এখানকার ওড়িয়া-মেশানো বাংলা নয়। খাওয়া শেষ হলে ছেলেটি বলল,
- একটা পান দেব বৌদি?
শুনেই কর্তা বলে উঠলেন,
- অ্যাই ভ্যাট! এ এসব পান-ফান খায় না।
আমি চুপিচুপি বললাম, পুজোয় বেরিয়ে আমি তো পান খাই। কিন্তু কর্তা ইশারায় চুপ করতে বললেন। ওখান থেকে বেরিয়ে বললাম,
- এটা কী হল?
- কী - কী হল?
- পান খেতে দিলে না কেন?
- আরে, তুমি কলকাতার রাস্তায় বেনারসী পান খাও। এসব এখানে পাওয়া যায় না। এখানে বরোজে বরোজে পান চাষ হয়। অভ্যেস না থাকলে, ঐ পান খেলে মুখ জিভ পুড়ে যাবে।
- ওঃ
- বেশি শখ হলে, দেব একটা জর্দা পান মুখে ঠুসে। এখুনি আঁ আঁ করে মাথা ঘুরে পড়বে।
মাথায় একটা চিন্তা আসে। আমার কলেজের এক সহকর্মিনী মেদিনীপুরে শ্বশুরবাড়ি শুনে বলেছিলেন,
“ঐ এক বিদ্যাসাগর।
বাকি সব মেসের চাকর।”
এ জেলার অনেক মানুষই দেখছি রন্ধনশিল্পী। কিন্তু বাকি জেলায় মেদিনীপুরকে নিয়ে দেখছি ভারি মাথাব্যথা। বললাম,
- তোমাদের বাড়ির তো কেউ পান খায় না। কিন্তু আশপাশের যাকেই দেখি, বেশিরভাগই পচর পচর করে পান খেতে খেতে কথা বলে। হাসলেই ক্ষয়াটে লাল দাঁত দেখা যায়।
- মায়ের রুলের গুঁতোয় আমাদের বাড়ির কেউ পানদোষ করতে পারেনি।
হেসে উঠি। পানদোষ? তা অষ্টপ্রহর পান মুখে নিয়ে ক্যানসারের দিকে এগিয়ে যাওয়া দোষ বইকি।
বাইক এগিয়ে চলে। একটা মেলা থেকে আর একটা মেলা পর্যন্ত ছমছমে অন্ধকার পথ। না, পুরো অন্ধকার নয়। আকাশে ফালি চাঁদ ছিল, পথের পাশে জোনাকি ছিল, ঝোপেঝাড়ে জ্বলজ্বলে চোখ ছিল। কী জানি, হয়তো শেয়ালের। কিছুটা পাকা, বেশিটাই কাঁচা রাস্তা। রথতলায় ম্যারাপ বেঁধে পুতুলনাচ হচ্ছে। হিরাকনিয়ায় বিরাট বটগাছ। মাইতিহাটের মেলা সবচেয়ে বড়। শহরে ফিরে বলার মত কিছু তো হল। আর কী? শচীন কাকু আমারও বন্ধু হয়ে গেলেন।
জীবন চলে গেল কুড়ি কুড়ি বছরের পার। চার ইয়ারের তিন ইয়ার – অমর, বেলা, অখিল – তিনজনই ছুটি নিয়েছেন। মেয়েরা বড় হয়ে মায়ের জায়গা নিয়েছে। সুবর্ণলতার দক্ষিণের বারান্দা হয়েছিল। আমারও দুর্গাদালান হয়েছে। মৃন্ময়ী মা আসেন। বাড়িতে কারেন্টের ভোল্টেজ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও পুরো সময় জেনারেটর ভাড়া করা থাকে। সেই ঢালা চেয়ারটায় শচীন কাকু একাই বসে থাকেন। পুজোর আগে আমাদের গাড়িটা জিনিসপত্র নিয়ে যখন গ্রামের পথে ঢোকে, রথতলার মাঠ পেরোয়, খেয়াল করি, কাকু বসে আছেন কি না। বসে থাকলে নিশ্চিন্ত।
হঠাৎ চেনা দাঁড়িপাল্লাগুলো গোলমাল করে এল ভয়ানক উম্পুন ঝড়। আড়বেলে আর মৈথুনা – দুটোই তছনছ। হিরাকনিয়ার বিরাট গাছটাও উপড়ে গেল। ঐ ঝড় কাকুর কাছে চিঠি দিয়েছিল। আমরা টের পাইনি। দিন পনেরোর মধ্যেই খবর পেলাম, কাকু তাঁর কলমটি রেখে, বাকি তল্পিতল্পা নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন আকাশের ওপারে। আচ্ছা, চেয়ারটা পাঠানো যাবে? বা মাদুরটা? চার ইয়ারের দল পূর্ণ হল। আচ্ছা থাক। যেখানে ওঁরা গেছেন, সেখানে আসন আছে। ঝড়বৃষ্টি কেটে গেলে, আকাশভরা তারা উঠবে। ভালো করে খুঁজলে চার ইয়ারের আড্ডা ঠিকই দেখতে পাব।
পুনশ্চ: দুই বাড়ির ইয়ারানা আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে একটু একটু। যাক, আবার ফিরে যাই সেই সংসার শুরুর দিনগুলোতে।