৬
আজ নবমী। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুর্গা পুজোর দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা বসে আছি মনের আর ফোনের জানালা খুলে। লকডাউন না হলে আজ ননদ, নন্দাই, ভাগ্নেরা এসে যেত। ভাগ্নী নেই। রঞ্জা, কর্ণা ছাড়া বাড়িতে মেয়ে নেই। আমরা জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো চার বোন যখন পরিবার সমেত আড়বালিয়ায় যেতাম, গ্রামের বাড়িতে একটা হিল্লোল উঠতো। বড়দিদি তো আর নেই, এখন তিন বোন। আমার ননদেরাও তিন বোন। শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে থাকতে বাবা মাকে ঘিরেই আড্ডার আসর বসতো। এখন অন্নদা দিদিই মধ্যমণি থাকে। কত যে গল্প শুনেছি এ আসরে, তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকটা বলি।
আমার শাশুড়ি মা গোপীবল্লভপুরের পণ্ডিত বাড়ির মেয়ে। তাঁর বাবা রুদ্রনারায়ণ দাস ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ রাজ পরিবারের সন্তানদের গৃহ শিক্ষক ছিলেন। শাশুড়ি মায়ের বোনের বিবাহ হয়েছিল গোপীবল্লভপুরের গোস্বামী পরিবারে। মেসোমশাইয়ের নাম গোপাল গোবিন্দ নন্দদেব গোস্বামী। তিনি স্বনামধন্য বৈষ্ণব সাধক রসিকানন্দের উত্তরসূরী। এই গোস্বামী বংশ আদতে ঝাড়গ্রামের এক রাজ পরিবার। রাজধানী ছিল রোহিণী নগরে। অন্নদাদির মত এঁদেরও মূল পদবী পট্টনায়ক। আমাদের বাড়িতে যে গোপীনাথ অধিষ্ঠান করছেন, তিনিই ঐ বংশে আছেন ভিন্ন রূপে। যা হোক রসিকানন্দের গল্প বলি। তিনি তো রাজপুত্র—রোহিণী রাজ অচ্যুতানন্দ পট্টনায়কের ছেলে। মায়ের নাম রানী ভবানী। ছোট থেকে ছেলের দেব দ্বিজে পরম ভক্তি দেখে রসিকের বাবা মা তো প্রমাদ গুনলেন। পাইক, বরকন্দাজ বেরিয়ে পড়ল, ছিস্টি খুঁজে মিষ্টি মেয়ে খুঁজে আনার জন্য। শেষে হিজলি মণ্ডলের অধিকারী বলভদ্র দাসের মেয়ে ইচ্ছাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঠিক হল। কাড়া, নাকাড়া, সানাই, আরও কত কী বাদ্যি বাজিয়ে, বিশাল লোক সমাগম, আত্মীয় স্বজনের ভুরিভোজ সবকিছু নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে সম্পন্ন হল। ইচ্ছা দেবীর বাপের বাড়ি তো আর কম মান্যিগণ্যি পরিবার নয়। হিজলীর নবাব তাজ খাঁ মসনদীর দেওয়ান ছিলেন ভীমসেন মহাপাত্র। মহাপাত্র হল এঁদের উপাধি। এঁর খুড়তুতো ভাই বলভদ্রের মেয়ে হলেন ইচ্ছাদেবী। এই মহাপাত্রেরা ছিলেন বাহিরী এলাকার সামন্ত রাজা। কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে। এত করেও শেষ রক্ষা হলনা। বড় হয়ে রসিকানন্দ যখন রাজা হলেন, ভাগ্যের ফেরে ঘাটশিলাতে সাক্ষাৎ হল প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক শ্যামানন্দের সঙ্গে। আর যায় কোথা। সাধক শ্যামানন্দের শিষ্যত্ব নিয়ে সংসার ছেড়ে রসিক বেরিয়ে পড়লেন দেশে দেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করতে। পরে রসিকানন্দ কাশ জঙ্গলে ঢাকা এক নিরিবিলি স্থান কাশীপুরে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই গুরু শিষ্য মিলে গোপীনাথ জীউ ওরফে গোপীবল্লভ রায়ের এক মন্দির নির্মাণ করেন। সেই বিগ্রহের নামে স্থানটির নাম হয়ে যায় গোপীবল্লভপুর। এই স্থানটি রসিকানন্দের খ্যাতির প্রভাবে গুপ্ত বৃন্দাবন নামে পরিচিত হয়। রসিকানন্দ হন ঐ মন্দিরের গোস্বামী। সেই থেকে রোহিণীর রাজ পরিবার হয়ে যায় গোস্বামী বংশ। ১৬৫২ সালে রসিকানন্দের মৃত্যু হয় রেমুনাতে — যেখানে ক্ষীর চোরা গোপীনাথের মন্দির আছে। এই গল্প এলাকার পুরোনো মানুষদের মুখে মুখে ঘোরে। পরে আন্তর্জালেও দেখলাম রসিকানন্দের জীবনীতে এসব কাহিনী রয়েছে। রসিকানন্দের পর থেকে প্রতি প্রজন্মে ঐ বংশের বড় ছেলে মন্দিরের গোস্বামী হন। সেই রীতি ধরে আমার মেসো শ্বশুরমশাই ছিলেন গোস্বামী। রাজনৈতিক ভাবে ঐসব অঞ্চল তখন ময়ূরভঞ্জের রাজার অধীন ছিল। রসিকানন্দ তাঁর সময়ের রাজাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই থেকে রাজপরিবারের সঙ্গে গোস্বামীদের বংশ পরম্পরায় গুরুশিষ্য সম্বন্ধ।
এই ক্ষীরচোরা গোপীনাথের গল্পটাও দারুণ। যে রাজা কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরি করেছিলেন, সেই রাজাই রেমুনার এই গোপীনাথের মন্দির তৈরি করেন। এখন ঘটনা হল, শ্রীচৈতন্যের গুরু যে ঈশ্বর পুরী, তাঁর গুরু হলেন মাধবেন্দ্র পুরী। তিনি একবার এই মন্দিরে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। মন্দিরে থাকার সময়ে তিনি জানতে পারেন এই মন্দিরে গোপীনাথকে ক্ষীর নিবেদন করা হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির স্থানীয় ভাষায় পায়েস, ক্ষীর এইসব ভোগকে বলা হয় ক্ষীরিভোগ। একদিন পুজোর আগে ঠাকুরের সামনে পরপর ক্ষীরের পাত্রগুলি এনে রাখা হচ্ছিল। মাধব ঠাকুরের মনে হল, ইশশ্, যদি একবার চেখে দেখতে পারতাম কেমন স্বাদ, তবে আমার আশ্রমেও আমি ঠিক এমনই ভোগের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু এই ভাবনা আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চমকে উঠলেন, এ কী সর্বনাশ করে ফেললেন। তিনি যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁর কি সাজে দেবতার ভোগ দেবতাকে নিবেদন করার আগে নিজে সেবন করার ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেওয়া? মনে মনে ঠাকুর তো মরমে মরে যান। তখনই মন্দির ত্যাগ করে অন্যস্থানে গিয়ে তিনি ধ্যানস্থ হন। এদিকে ভক্তের ইচ্ছে কী ভগবান কোনদিন ফেলতে পারেন! সেদিন বিকেলে ভোগ প্রসাদ বিতরণের পরে পূজারী চলে গেছেন বাড়ি। রাতে গোপীনাথ তাঁর স্বপ্নে আসেন। বলেন "ওরে ওঠ, আমার পরম ভক্ত উপবাসে পড়ে আছে। এখুনি যা, তাকে ক্ষীর দিয়ে আয়।" পূজারী কাঁপতে কাঁপতে বলেন, "প্রভু ক্ষীর তো আর নেই, সব বিতরণ করা হয়ে গেছে।" গোপীনাথ তখন আশ্বাস দিয়ে বলেন, "চিন্তা নেই। সিংহাসনে আমার পায়ের পিছনে এক বাটি ক্ষীর আমি নিজেই সরিয়ে রেখেছি।" ঘুম ভেঙে উঠে পূজারী ছুটতে ছুটতে গিয়ে মন্দিরের তালা খোলেন। দেখেন সত্যি সত্যিই স্বপ্ন নির্দেশিত জায়গায় এক বাটি ক্ষীর রাখা আছে। এই আশ্চর্য ঘটনা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। ভগবান নিজেই নিজের ভোগ চুরি করে লুকিয়ে রেখেছেন, তাই বিগ্রহের নাম হয়ে যায়, ক্ষীর চোরা গোপীনাথ। তবে এই মাধব ঠাকুরের কাহিনীটি আমি অনেক পরে জেনেছি একজন মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে। উইকিপিডিয়াতেও দেখলাম মাধব পুরীর নামই আছে। কিন্তু আমাদের গ্রামে এই কাহিনীর একটি অন্যরূপ প্রচলিত আছে। আর সেই গল্পের নায়ক মাধব পুরী নন, তাঁর শিষ্যের শিষ্য শ্রীচৈতন্যদেব। আসলে বাংলায় আচার্য মাধব পুরী তো তেমন জনপ্রিয় নন। তাই মনে হয়, কয়েকশো বছর ধরে লোকের মুখে মুখে চলে আসা কাহিনীর মধ্যে শ্রীচৈতন্য জায়গা করে নিয়েছেন। গল্পটি হল, একদিন সন্ধ্যেয় পুজো শেষ করে ক্ষীরিভোগ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করে, পূজারী চলে গেছেন নিজের বাড়ি। এদিকে গ্রামের লোক বা মন্দিরের পূজারী কেউই জানেননা, ঐ পথ ধরে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে ভাবে বিভোর শ্রীচৈতন্য আসছেন ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে। জানেন শুধু ভক্তের ভগবান। গভীর রাতে সত্যি সত্যিই যখন চৈতন্যদেব গোপীনাথের মন্দিরে পৌঁছলেন, তখন চারিদিক শুনশান। ক্লান্ত, অবসন্ন, চৈতন্য অভুক্ত অবস্থায় মন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু ভক্তের ভগবান কি সইতে পারেন তাঁর পরম ভক্তের না খেয়ে থাকার কষ্ট! এবারে উপায়? মন্দিরের পূজারীর স্বপ্নে দেখা দিলেন গোপীনাথ। মোহন মুরলীধারীর মুখে হাসি উধাও। রুষ্ট, চিন্তিত মুখ দেখে পূজারী চোখের জলে ভাসেন। গোপীনাথ বলেন, আমার পরম ভক্ত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে চাতালে। এখনই তার প্রসাদ ভোজনের ব্যবস্থা কর। আতঙ্কে অস্থির পূজারী জানান, প্রসাদ তো সব বিতরণ করা হয়ে গেছে প্রভু। পাত্র ধোওয়া হয়ে গেছে। আজ তো আর প্রসাদ নেই। আবার কাল হবে। গোপীনাথ তখন জানান যে তিনি নিজেই কিছুটা প্রসাদ সরিয়ে রেখেছেন। মন্দিরে গিয়ে গর্ভগৃহের
সিংহাসনের তলায় খুঁজলেই পাওয়া যাবে। পূজারী যেন ভোজনের ব্যবস্থা করে। ঘুম ভেঙে যায় পূজারীর। কোন এক ঘোরের মধ্যে তিনি ছুটে যান মন্দিরে এবং আবিষ্কার করেন, স্বপ্নাদেশে নির্দেশিত জায়গায় এক হাঁড়ি ক্ষীরিভোগ রাখা আছে। নয়নজলে ভেসে তিনি চৈতন্য ও তাঁর সহযাত্রীদের যথাসম্ভব আপ্যায়ন করেন।
এইসব গল্প আমার কন্যেরা জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনছে। আর ছোটবেলাতেই অন্নদাদি ওদের মাথায় ঢুকিয়ে ছিলেন যে, ওদের মাসিঠাকুমার বাড়িতে ময়ূরভঞ্জ থেকে হাতি আসত। আসলে গুরুবংশ তো। জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পথ। তাই হাতির পিঠে বাৎসরিক গুরুদক্ষিণা আসত। বড়রা যেমন একটা কথা একবার শুনলে আর শুনতে চায়না, বাচ্ছারা তো তেমন নয়, তারা একই গল্প বারবার শুনতে চাইত। আর ছোটবেলায় দামু সিনেমার দামুর মত সব গল্পেই ওদের আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল ময়ূরভঞ্জের হাতি। কন্যেদের ছোটবেলার এইসব গল্প মনে করতে খুব ভালো লাগে আমার। ঐ হাতিরা ছিল দুই কন্যের হিরো। গল্প যেই বলুক, তাকে ওরা প্রশ্ন করে করে জেরবার করত। পুজোর সময়ে কন্যেদের স্নায়ু এমনিতেই উত্তেজিত, মুশকিল হত দুপুরবেলা ওদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে। যেই গল্প শুনিয়ে, পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়াতে যেত, তাকে অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। বেশিরভাগ সময়ে অন্নদাদি এই ফাঁদে পড়ে যেতেন। আমি শ্রোতা,
— হাতিরা কি ইচ্ছা দেবীর বিয়েতে গিয়েছিল?
— হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই গিয়ে থাকবে। ওরা নইলে রাজবাড়ির গিফ্টগুলো কে নিয়ে যাবে!
— কটা হাতি গিয়েছিল?
— উঁ, মনে হয় একশোটা।
— ওরা কি পিছন পিছন লাইন করে একজনের ল্যাজ আর একজনের শুঁড়ে জড়িয়ে গিয়েছিল? নাকি পাশাপাশি মার্চ করে যাচ্ছিল।
— অনেক পুরোনো দিনের কথা তো, মনে হচ্ছে, যা শুনেছিলাম পাঁচটা করে হাতি পাশাপাশি যাচ্ছিল।
— বুঝেছি, প্রথমে পাঁচটা হাতি সর্দার, পিছনে তাদের পাঁচটা বৌ, তারপর তাদের পাঁচটা ছেলে, হাতিরা মেয়েদের নিয়ে গিয়েছিল তো?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিয়েবাড়িতে মেয়েরা যাবেনা, তাকি হয়? পাঁচটা মেয়ে ছিল।
— তারপর কারা?
— তারপর পাঁচটা পাহারাদার।
— এতো মাত্র ফাইভ ফাইভস আর টোয়েন্টি ফাইভটা হাতি হল। বাকিরা?
— একই রকম। মোট চারটে গ্রামের পঁচিশটা করে হাতি।
— এই দিদি, চারটে গ্রামের পঁচিশটা করে হাতি কটা হয় রে?
— (দিদি কাগজ পেন্সিল বাগিয়ে) হান্ড্রেড রে হান্ড্রেড। মিলে গেছে।
— অন্নদাপিসি, হাতিদের বিয়েবাড়িতে খেতে দিয়েছিল তো?
— নিশ্চয়ই। ওদের বড় পেট, কত পরিশ্রম, বেশি খিদে।
— ওদের কী খেতে দিল?
(অন্নদাদির মঙ্গল কাব্য মুখস্থ। বেশ জায়গা বুঝে ছড়া কাটেন। কিন্তু এখন ঢুলুনি এসে গেছে। বয়সটা দেখতে হবে তো!)
— ও অন্নদাপিসি হাতিদের কী খাওয়ানো হল?
— “চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে
মিঠা আমের বৌল।
কলার মূল দিয়া রান্ধে
পিপলিয়া শৌল।।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে
মরিচের ঝোল।
জিরামরিচে রান্ধে
চিতলের কোল।।
উপল মৎস্য আনিয়া তার
কাঁটা করে দূর।
গোলমরিচ রান্ধে
উপলের পুর।।
আনিয়া ইলিশ মৎস্য
করিল ফালাফালা।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন
দক্ষিণসাগর কলা।।”
— এ্যাঁ, হাতি মাছ খায়?
— না না
“বেগুন কুমড়া কড়া,
কাঁচকলা দিয়া শাড়া,
বেশন পিটালী ঘন কাঠি।
ঘৃতে সন্তলিল তথি,
হিঙ্গু জীরা দিয়া মেথী,
শুক্তা রন্ধন পরিপাটী।।”
— বাবা, একটা বিয়েবাড়িতে হাতি শুধু তেতো খেল!
— হাতিরা খুব ভালো, তেতো খায়। তোমরাও খাবে।
উচ্ছা দিয়া লা-উ
পাতের তলায় থা-উ।
চপ কাটলেট দা-উ
গাউল গাউল খাউ।
অমনি করলে হবে—নি?
(বাব্বা এটা একটা অন্য ছড়া — ছেলেরা বিয়ের পরে বৌয়ের দিকে ঝোল টানে সেটাকে বিদ্রুপ করে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে তৈরি, আমার শাশুড়ি মায়ের মুখে শুনেছি। বিয়ের পরে যখন এখানকার রান্নাঘরে এত বড় উনুন, পিঁড়েয় বসে রান্না, ষাঁড়াশি নেই, বিশাল কড়ার আংটায় লম্বা লোহার খুন্তি গলিয়ে কড়া নামাতে হয়, এসব নিয়ে কাজ করতে নাজেহাল হতাম, রান্নাবান্না পুড়েঝুড়ে যেত, তখন শাশুড়ি মুখ টিপে হেসে বলতেন ও কিছু হবেনা — বাপু খেয়ে নেবে।
“মা রানছি লা-উ
পাতের তলায় থা-উ।
বৌ রানছি লা-উ
গাউল গাউল খা-উ।”
অন্নদাদি বেশ তাতে নিজের কথা বসিয়ে বাজারে ছাড়লেন। কেয়া বাৎ। বুড়ির এলেম আছে। আর এখানে ‘কি’ অব্যয়কে সবাই ‘নি’ বলে।)
— হ্যাঁ রে দিদি বিয়েবাড়িতে হাতিদের শুধু তেতো খাইয়ে ওখানকার রাঁধুনি বেঁচে ছিল তো?
— সেই তো, মাঠ জঙ্গল ভেঙে, মোট বয়ে শুধু শুক্তা পরিপাটি। শুঁড়ে জড়িয়ে আছাড় দেবে। এই বোনু পিসিকে চেপে ধর। কী কী খাইয়েছিল বলতে বল শিগগির।
(আমি দেখলাম, অন্নদাদির এলেম থাকলেও এখন দম ফুরিয়েছে। কাৎ হয়ে গেছেন, নাক ফুরুৎফুর করছে। মেয়েরা ঘুমোবে কি, ময়ূরভঞ্জের হাতিদের সম্ভাব্য অবমাননা, আপ্যায়নের অভাব বুঝে টগবগিয়ে উঠেছে। বুড়ো মানুষটাকে বাঁচাতে এবারে আমি নিজে মাঠে নামলাম। ছোটবেলা থেকে শোভাবাজার রাজবাড়ির খাওয়া দাওয়ার লিস্টি গুলো থেকে কয়েকটা ইচ্ছা দেবীর বিয়েতে যুক্ত করে দিলাম।)
— আরে শোন শোন, চটছিস কেন? হাতিরা তো অত মাছ মাংস তেল মশলা খায়না। তাই ওদের জন্যে মিষ্টি ছিল।
— অ, তাই বল। কী কী মিষ্টি খেল ওরা? এখন সেসব পাওয়া যায়?
— হ্যাঁ, কিছু পাওয়া যায়, কিছু আবার যায়ও না। একটা বিশাল বড় মাঠের ওপরে সাদা কাপড় পাতা। তার ওপরে চুড়ো করে রাখা ছিল পাহাড় প্রমাণ মিষ্টি। হাতিরা সেই মাঠের ধারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে টপাটপ, গবাগব মিষ্টি খেয়ে নিল — যে যত পারে।
— সন্দেশ, রসগোল্লা?
— না না, নানারকম নাড়ু, লাড্ডু, জিলিপি, খাজা, মোয়া। এই বড় বড়, ফুটবলের মত আকার। তাছাড়া আরও ছিল কটকটি, পেরাকী, পক্কান।
— নানারকম নাড়ু মানে?
— এই ধর নারকেল নাড়ু — চিনির, গুড়ের দুরকম। তারপর তিলের নাড়ু, মুগের নাড়ু কতরকম হয়।
— দাঁড়া দাঁড়া বোনু, নাড়ু ছাড়। কটকটি, পেরাকী, পক্কান — কীসব বলছে। ওগুলো কী?
— এগুলো সব পুরোনো দিনের খাবার রে মা। পক্কানকে একধরণের মোয়া বলতে পারিস — বেসনে সাদা তেল ময়ান দিয়ে মেখে জল দিয়ে ফেটিয়ে নিতে হয়। খুব বেশি ফেটানোর দরকার নেই। পরিষ্কার কাপড়ে বেসনের মণ্ড রেখে, হাত দিয়ে চেপে ছাঁকা তেলে বেসনের ঝুরি ভেজে, টুকরো টুকরো করে নিতে হবে। তারপরে জাল দেওয়া আখের গুড়ে ফেলে, শুকিয়ে, হাতে পাকিয়ে মোয়া বানিয়ে নেওয়া হয়। আর পেরাকী হল একধরণের পুর ভরা ভাজা পিঠে।
— আর কটকটিটা কী?
— কটকটিও নাড়ু। বেসনের লম্বা ঝুরি মুচমুচে করে ভেজে নিয়ে, সেটা দিয়ে নাড়ু বানানো হয়।
— বাবা, এসব তো খাইনি কখনও।
— এখন অনেক নতুন ধরণের মিষ্টি পাওয়া যায়, তাই ওগুলো বানানোর চল কমে গেছে। অনেক বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিন পক্কান আর পেরাকী তৈরি করা হয়। আর তোদের বাড়িতে বেসন দিয়ে কটকটি না হলেও ঐ ধরণের অন্য একটা খাবার তো হয়।
— কোনটা?
— কেন? গুড় দিয়ে পাক করা বড় বড় মুচমুচে মুড়ির মোয়া? সেটা তো খেয়েছিস।
— হুম।
হঠাৎ অন্নদাদি নড়েচড়ে উঠে বলে ফেললেন, হাতিরা ক্ষীরিভোগ খেল। আমি হাসি গোপন করি। উনিও কি হাতিরই স্বপ্ন দেখছেন? এই ক্ষীরিভোগ শব্দটাই কাল হল। আলোচনা অন্যদিকে বাঁক নিল।
— ক্ষীরিভোগ তো সাদা কাপড়ে রাখা যাবে না। বাটিতে রাখতে হবে। হাতিদের কত বড় বাটি লাগে গো মা?
— বড় গামলার মত বাটি লাগবে।
— জেঠিমা, গোপীনাথ কত বড় বাটি লুকিয়ে রেখেছিলেন?
— জামবাটি হতে পারে, আবার হাঁড়িও হতে পারে।
— শুধু তো চৈতন্যদেব একা নন, তাঁর সঙ্গীসাথীরাও খাবে।
— তা বটে, তাহলে ভোগের একটা গামলাই মনে হয় সরিয়ে রেখেছিলেন।
— আচ্ছা মা, ময়ূরভঞ্জের হাতিরাই তো পিঠে করে চৈতন্যদেব কে নিয়ে যেতে পারত। তাহলে ওঁর আর হাঁটার কষ্ট হতনা।
— হ্যাঁ, তা পারতো। তবে কিনা চৈতন্যদেব নিজেই বললেন যে উনি হেঁটে যাবেন। নইলে হাতিরা ওঁকে অফার দিয়েছিল।
— তাহলে কেন গেলেন না?
— শ্রীচৈতন্য কত অনাথ, আতুর, দরিদ্রের কুঁড়ের পাশ দিয়ে চলেছেন বাবু। অত হাতি সঙ্গে গেলে কার বেড়ার ঘর পড়ে যাবে, কার কলাগাছ ভাঙবে..
— না না না না ওটা ঠিক নয়, তাহলে উনি ঠিকই করেছেন।
— আচ্ছা জেঠিমা, আমরা যদি এখন ডাকি ময়ূরভঞ্জের হাতিরা আসবে?
— তাহলে তো খুব ভালো হয় রে দিদি। আমরা হাতির পিঠে চড়ে বেড়াব।
— বলনা জেঠিমা আসবে?
— হ্যাঁ, তা ডাকলে অবশ্যই … না মানে বাচ্ছারা দুষ্টুমি করে যদি দুপুরবেলা না ঘুমোয়, তখন তো ওরা আসবেনা। ওরা খুবই নিয়মানুবর্তী।
— এ্যাই বোনু চোখ বোজ, ঘুমো ঘুমো। আচ্ছা জেঠিমা আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি, আর তখন হাতিরা আসে, আমরা বুঝবো কী করে?
— ঠিক বুঝতে পারবি। চোখ বুজলেও ওদের দেখা যায়। চোখটা বোজ। দেখবি ওরা এসেছে।
দুপুরের রোদে ধীরে ধীরে কমলা রং ধরে। কলাগাছের পাতা বেয়ে একটা কাঠবিড়ালি আমার জানলায় নেমে খুটুর খাটুর করে। কালোর ওপরে সাদা ছিটছিট প্রজাপতি ওড়ে। আরও ছোট বয়সে মেয়েদের বুঝিয়েছিলাম ঐ প্রজাপতিরা আসলে কলাপাতার পরী। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন কলাগাছের কান্ডের মধ্যে একটা দরজা খুলে গিয়ে পরীরা নিজের রূপ ধরে বেরিয়ে আসে। ফিনফিনে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। সকাল বেলা কালো প্রজাপতি সেজে থাকে। যা বলি সরলভাবে বিশ্বাস করে। এখন যেমন মনে প্রাণে ময়ূরভঞ্জের সুপার ডুপার হাতিদের কল্পনায় মশগুল। ঘুমন্ত বিচ্চুদুটোর সরল মুখে জানলা দিয়ে বিকেলের রোদ পড়েছে। জানলার পর্দাটা টেনে দিতে গিয়ে দেখি বোজা চোখের পাতার নিচে মণি এপাশ ওপাশ করছে। কী জানি হয়তো, হাতির পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন দেশে বিদেশে।