অনূঢ়া বিজয়া
বিজয়া দশমীতে আমরা খুব ভোর ভোর উঠে আর.জি. কর হসপিটালের উল্টোদিকে, খালপাড়ে, বাস টার্মিনাসে চলে যেতাম। তারপর ৭৯ নম্বর বাসে চেপে বসতাম। ৭৯ নম্বর বাস যশোর রোড ধরে নাগের বাজার, মধ্যমগ্রাম পেরিয়ে বারাসত চাঁপাডালির মোড়ে পৌঁছত। তারপর টাকি রোড ধরে বাসটা বেলিয়াঘাটা, দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা ছুঁয়ে এগিয়ে যেত নেহালপুরের দিকে। পুরো রাস্তার দু’পাশে মোটা মোটা গুঁড়ির গাছ। রাস্তাটা দু’পাশ থেকে গাছের পাতার ছায়ায় ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে ধান ক্ষেত, ছোট ছোট বাড়ি। তারপর গাইনবাড়ির প্রাসাদের গেট দেখা গেলেই বুঝে যেতাম ধান্যকুড়িয়া এসে গেছে। গাইনবাড়ি আমার একমাত্র পিসির শ্বশুরবাড়ি। পরের স্টপেজ মাটিয়া বাজার। ওখানে নেমে সাইকেল ভ্যানে সোজা আড়বালিয়ার বনিকপাড়া। তারপর তল্পিতল্পা ঘাড়ে করে, বটতলার পুকুরের পাশে আমাদের বাড়ি – জেঠতুতো, খুড়তুতো দশ ভাইবোন আবার একসাথে, হৈ চৈ, ঝগড়া, কানাকানি, গলাগলি – আরও কত কী!
বড়দিদি, মানে বড়জ্যাঠাইমার বড় মেয়ে, সবার বড়ো। আমার থেকে প্রায় পনেরো বছরের তফাৎ। আমরা যখন অনেক ছোট, তখনই বড়দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নাগচৌধুরী বাড়িতে। তাই আমাদের বাকি ভাইবোনেদের নানান কীর্তিকলাপে বড়দিদির ভূমিকা ছিল না। কিন্তু দুর্গাপুজোয় বড়দিদি ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি আসত। আর ওর শ্বশুরবাড়ি তো খুব দূরে নয়, গ্রামের ভেতরেই। বটতলার ঝুপসি শিকড় ছাড়িয়ে, সোজা দৌড়ে কলেজ স্ট্রিটের মডার্ন বুকের মালিকের দালান ডানদিকে। ওখানে কালিপুজো হত। তারপর বাঁদিকে দোতলা লালবাড়ি, ওরা হনুমানদের খেতে দেয়। তাই সবসময়ে জানালায়, কার্নিশে হনুমান ঝুলে থাকে। এবার ডানদিকে ঘুরে দৌড় দৌড়, এক্কেবারে নাগচৌধুরীদের সিংহওলা গেট পর্যন্ত। এবার বাঁদিকে তিন শিবের মন্দির আর এক রাত্তিরের বাড়ি। দুইয়ের মাঝখানে পায়ে চলা পথ। এগোলে ডানদিকে বড়দিদির বাড়ি। বড়জামাইবাবু ইস্কুল মাস্টার, নাগচৌধুরী বংশের এক শরিক। নাগচৌধুরীবাড়ির একতলার গেটের পাশে সারি সারি ঘর, থাকার কেউ নেই। তালাই থাকত। গেটের বাইরে লম্বা রক। সরু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় বড়দিদির ঘর। কড়িবর্গাওলা, অনেকগুলো জানলা, সব দরজার মত লম্বা। পুরোনো আমলের নকশা করা খাট, আলমারি আর পাঁচখানা আয়না লাগানো এক পেল্লায় ড্রেসিং টেবিল। দশমীতে সকালে বাড়ি পৌঁছেই, একবার একছুটে বড়দিদির বাড়ি গিয়ে দেখে আসতাম, দুপুরে ও কখন আসবে। বড়দিদির সঙ্গে দেখা করা ছাড়াও এই পিরিতির আরও দুটো কারণ ছিল।
ভোরবেলায় তো খুব কিছু খেয়ে বেরনো যেত না। আর তিন, সাড়ে তিন ঘন্টা বাসযাত্রার পর আড়বেলে পৌঁছে ভীষণ খিদে পেয়ে যেত। মায়ের তখনও গুছিয়ে বসতে দেরি, আর জ্যাঠাইমাদের রান্নাঘরে তখন মুড়ি, নাড়ু এসবই খেতে হবে। এদিকে বড়দিদির বাড়ির পাশেই বাজার। তার ওপর সামনে তিন শিবের মন্দিরের মাঠে বিজয়ার মেলা বসত। সেখানেও অনেক খাবারের দোকানদার আসত। আমরা যেই পাঁই পাঁই করে ছুটে গিয়ে বড়দিদিকে জড়িয়ে ধরতাম, বড়দিদিও আত্মহারা হয়ে যেত। কী খাবার যে আনাবে আর কী আনাবে না, ভাবার আগেই ছাদ দিয়ে ডেকে পাশের টুলুদের বাড়ির কাউকে বাজারে পাঠিয়ে দিত। একটু পরেই এসে যেত থরে থরে গরমাগরম সিঙাড়া, আলুর চপ, সন্দেশ, পান্তুয়া... আর কী? পেটপূর্তি, মনপূর্তি, মুড়ি চিবোনো থেকে বাঁচার স্বস্তি, সব কিছু একসঙ্গে হয়ে যেত। এরপর দুপুরে বাড়িতে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া হত – ভাত, মুসুর ডাল, পাকা পুঁই মিটুলির চচ্চড়ি, বা অন্য কোনো শাক-চচ্চড়ি, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি – এইরকম সব মেনু।
খাওয়ার পরে কিন্তু বিশ্রামের বালাই নেই। দাদারা লেগে পড়ত কচি বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম বানানোর কাজে। আর অনেক বেলপাতা পাড়ত, একটু বড় বড় দেখে, ছেঁড়া না হয়। তারপর দাওয়া মুছে নিয়ে, জলচৌকি পাতা হত, তার ওপর ঠাকুরের কাঁসার থালায় কলমগুলো রাখা থাকত। ঠাকুরের ছোট কাঁসার গেলাসে আলতা ঢেলে রাখা হত আর ঘটিতে গঙ্গাজল। সকলে দশমীর মেলায় যাবে। ফিরে এসে ঐ জলচৌকির কাজ। আর আমরা দু’বোন বড়দিদিকে নিয়ে, আবার ওর বাড়ি চলে যেতাম। সেখানে বড়দিদি নিজের শাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে বসত। ঝিলিমিলি জরিদার, বুটিদার, কল্কাদার সুতি, রেশম, রেয়ন, শিফন, জামদানি, বালুচরী, বেনারসী – কত কী! সব নেড়েচেড়ে শাড়ি পছন্দ করতাম। ম্যাচিং ফ্রক থাকলে তার ওপরেই কোল কুঁচিতে গিঁট মেরে শাড়ি পরা যেত। আর না থাকলে, বড়দিদি সূঁচ সুতো নিয়ে বসে যেত, আমাদের মাপে নিজের ব্লাউজ ছোট করার জন্য। বড়দিদি আমাদের শাড়ি পরিয়ে দিত। সাজিয়ে দিত আর আমরা ঐ পেল্লায় ড্রেসিং টেবিলটা ঘেঁটে ঘুঁটে ছারখার করতাম। বড়দিদি হাসত। সেজেগুজে মেলায় যেতাম। ফুচকা, আলুকাবলি এসব খাওয়া নিয়ে মায়ের ভয় ছিল। কিন্তু বড়দিদি কিনে দিলে মা তো কিচ্ছু বলতে পারবে না। এ হল একটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ।
আশেপাশের সব দুর্গাঠাকুর এই মেলায় বরণ হয়। মেলায় মাটির হাঁড়িকুড়ি, রেশমী চুড়ি, খেলনাপাতি কিনতাম। পুকুরের জলে দুর্গাঠাকুর তিনপাক ঘুরে জলে পড়তেন। পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখে জল চলে আসত আমার। অন্ধকারে সেই চেনা পথ ধরে ফিরতাম সকলে। চুপচাপই থাকত সবাই। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। কী যে ফাঁকা, কীসে যে কষ্ট – সেটা ঠিক স্পষ্ট হত না। মাকে ফিসফিস করে বলতাম, ‘মা, দুই শরিক বসু বাড়ি, হাঁস ঠাকুরের বাড়ি ঠাকুর দালান আছে, দুর্গাপুজো হয়; ওদের কেমন মজা – উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে সবসময়ে দুর্গাঠাকুর দেখতে পায়। আমাদের অমন কেন হয় না। দুর্গাঠাকুর কি আমরা নিজের করতে পারিনা?’ মা ছোট করে উত্তর দিত, ‘ওরা জমিদার’। আমি বলতাম, ‘আমাদেরও তো বাড়িতে সুপুরি গাছ, নারকেল গাছ, আম গাছ আছে। আমরা জমিদার নই মা?’ মা হাসত। মায়ের হাসিমুখের আড়ালে মা দুর্গা হাসতেন। মানুষ তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, কেবল অতীত দেখতে পায়। আজ আমি এমন বাড়ির বৌ, যারা পূর্বতন জমিদার। মা দুর্গা নিজের হয়ে আসেন। দালান আলো করে বসেন। কিন্তু সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে কলকাতার পুজো আর আড়বালিয়ার পুজো আমায় ছাড়তে হয়েছে।
বাড়ি ফিরে এসে সেই জলচৌকিতে বসে শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় লিখত সবাই। সামনে পিলসুজে প্রদীপ জ্বলত। আসনে বসে, চারিদিকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে, কলম আলতায় ডুবিয়ে লেখা হত একে একে। প্রথমে বড়রা, তারপর ছোটরা। বেলপাতা ভরে উঠত আলতার লেখায়, আর ঝুড়ি ভরে উঠত আলতামাখা বেলপাতায়। লেখা হয়ে গেলে জলচৌকির সামনে গড় হয়ে প্রণাম করতে হত। প্রণাম হয়ে গেলে শুরু হত বিজয়া। প্রথমে ঠাকুমা, ঠাকুরদাদার ছবিতে প্রণাম করে একে একে প্রণাম করতাম বড়দের। বড়রা মাথা ছুঁয়ে, গাল ছুঁয়ে আদর করে হাতে গুঁজে দিতেন পার্বণী। এবারে বাড়ি বাড়ি মিষ্টিমুখের পালা। আড়বালিয়ায় যতরকম মিষ্টি পাওয়া যায়, সবরকমই কিছু না কিছু সব বাড়িতেই স্টক থাকত। সঙ্গে কুচো নিমকি। কিন্তু মেজজ্যাঠাইমার পাকশালায় কিছু বিশেষ থাকত। বিশেষ ব্যাপারটা হল পাঁঠার মাংসের কিমার ঘুগনি আর সিদ্ধির সরবত। প্রতি বছর ওটা ছিল কমন, কোনো নড়চড় হত না।
একটু বড় হলে, আমি নজর করতাম, কীভাবে কী হচ্ছে। গাঁজা গাছের ডগার কচি পাতাগুলোকেই সিদ্ধি পাতা বলে। সেই পাতা সরবত করার আগে বারবার খুব চটকে চটকে ধুয়ে নিতে হয়। সব কষ বেরিয়ে গেলে পাতা ধোয়া জল একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন সেই পাতা বেটে সরবত বানানো হয়। পাতা বাটার সঙ্গে আরও কয়েকটা জিনিস বাটতে হয়, যেমন – গোলমরিচ, চারমগজ আর মৌরি। এই বাটাটা একেবারে চন্দনের মত মিহি করে বাটতে হয়, তারপর ছেঁকে নিতে হয়, যাতে কোনো দানা না থাকে। এখন মিক্সার গ্রাইন্ডারের যুগে মিহি করে বাটা খুব সহজ, তবে যে যুগের কথা বলছি, তখন তো যন্ত্রের ব্যাপার ছিল না। শিলনোড়ায় মেয়েদের হাতের জোরেই এসব কিছু করতে হত। এর সঙ্গে পরিমাণমত দুধ, চিনি আর জল মিশিয়ে পাতলা সরবত বানানো হত। এতে ওষধি গুণ আছে, ঘুম এসে যায়। দশমীতে এই সিদ্ধির সরবত বানানো খুব প্রাচীন প্রথা। কি জানি, আমার মনে হয়, দুর্গাপুজোয় তো খুব খাটাখাটনি হয়, তাই বেশ কয়েকঘন্টা পূর্ণ বিশ্রামের জন্য হয়তো এমন একটা প্রথা চালু করা হয়েছিল। পরে লোকে কার্যকারণ ভুলে গেছে। একটা রীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। তবে আজকাল দোলের দিন ঠান্ডাইয়ের হুজুগ ওঠায় দশমীর এই অনাড়ম্বর প্রথার কথা অনেকেই জানে না। আজকাল কোনো বাড়িতেই আর এইসব তেমন শুনি না। এই সরবত আড়ম্বরপূর্ণ করতে হলে এর মধ্যে গোলাপ ফুলের পাপড়ি, কেশর বা জাফরান, কাজুবাটা, আমন্ড বাদাম বাটা, পেস্তা বাদামবাটা গুঁড়ো বরফ এসব অনেক কিছু মেশানো যায়। গ্লাসে পরিবেশনের সময় সরবতের ওপরে জাফরান, পেস্তা কুচি, গোলাপ পাপড়িকুচি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বাদাম বাটা আর জাফরান মেশালে সরবতের রঙটাও সুন্দর হয়, সুবাস আসে। স্বাদও খোলে। আবার ষোলোকলা পূর্ণ করতে, এতে সাধারণ জলের বদলে গোলাপ জল আর ক্যাওড়ার জলও মেশানো যেতে পারে। তবে আমাদের বাড়িতে এত ছিরকিটি কিছু হত না। আর তখন ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরে এত লোকের জন্য শুধু একটা সরবত বানাতে এতরকম দামি দামি উপকরণ যোগাড় করাও সুসাধ্য ছিল না। আমার ব্যক্তিগতভাবে বাড়ির সিদ্ধির সরবত ভালো লাগত না। আর দাদারা বলেছিল, বেশি খেয়ে ফেললে নেশা হয়ে যাবে আর ইস্কুলে ক’বার কান ধরেছিস, ক্লাসের বাইরে এক পা তুলে দাঁড়িয়েছিস – মানে যেসব কথা বাড়িতে লুকিয়েছিস, তারপর কার ওপর রাগ আছে, সামনে হেঁ হেঁ করছিস – সব বলে ফেলবি। নেশা হয়ে গেলে মানুষের কার্যকারণ, বিবেক বিবেচনা লোপ পায়। দুর্গাঠাকুর নিজে চলে গিয়ে সব পাপ ধরার জন্য এই সরবতটা রেখে যান। এইজন্যেও এই সরবতের প্রতি একটা খুব ভয় ধরে গিয়েছিল, এড়িয়ে চলতাম, বলে দিতাম খাব না। তাই নিয়মরক্ষার জন্য ছোড়দিদি একটা কাপে একটুসখানি তলানি সরবত নিয়ে আসত। আমি আর বোন দু’জন জিভ বার করে দাঁড়াতাম। আর ছোড়দিদি সরবতে কড়ে আঙ্গুল ডুবিয়ে আমাদের জিভের ওপর ফোঁটা কেটে দিত।
পাঁঠার মাংসের কিমার ঘুগনির জন্য একটু তরিবত লাগত। মেজজ্যাঠাইমা নবমী রাতে বড় গামলা করে মটর ভিজিয়ে দিত। আর মেজজেঠু চেনা মাংসের দোকানে অর্ডার দিয়ে রাখত, কাকভোরে বেরিয়ে মাংস দেখেশুনে কিনে থুরিয়ে কিমা করে আনত। ঐ সকালেই মেজজ্যাঠাইমা কিমাতে সর্ষের তেল, পেঁয়াজ বাটা, আদা রসুনবাটা, কাঁচা লঙ্কাবাটা, পাতিলেবুর রস আর অল্প নুন মেখে, কিমাটা বেশ করে ঠেসে ঢাকা দিয়ে রেখে দিত। আর ভেজানো মটরটা আলাদা উনুনে, মানে রান্না ঘরের বাইরে যে উনুনটায় ধান সেদ্ধ হত, তাতে সেদ্ধ করতে বসিয়ে দিত। এবার সারাদিন ধরে সে সেদ্ধ হবার সময় পেত। নলকূপের লোহাভরা কড়া জল তো, মটর সেদ্ধ হতে সময় লাগে, তাই এই ব্যবস্থা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মেলায় বেরোনোর আগে কিমা ঘুগনি আর সিদ্ধির সরবত দুটোই রেডি করা হত। কিমাটা ছ’-সাত ঘন্টা মশলায় থেকে তখন জরে গেছে। এবারে সর্ষের তেলে তেজপাতা, এলাচ, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে কিমাটা মশলা সমেত ঢেলে দেওয়া হত। এবারে অল্প কষে কিমাতে গরমজল দিয়ে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করা হত। সময় বুঝে সেদ্ধ মটরটা ঢেলে দেওয়া হত। একসঙ্গে ফুটিয়ে স্বাদ বুঝে নামানো হত।
বিজয়া উপলক্ষে বাবা-মায়ের মাঝে মাঝে জিবেগজা বানানোর শখ হত। কিন্তু সেটা বানাতে গেলেই প্রতিবার দু’জনের ঝগড়া লেগে যেত। আর বাকিরা মুখ টিপে লুকিয়ে হাসত। সামনে অবশ্য নির্বিকার থাকত সবাই। ঝগড়ার কারণ হল, বাবা ময়দা মেখে জিবেগজা বেলে খুন্তি দিয়ে কেটে বরফির মত করত। আর সেটাই মায়ের রাগের কারণ। মা বলত, জিবেগজা হবে জিভের মত, এই বলে খুব রেগে রেগে লম্বাটে ডিম্বাকৃতি জিবেগজা বেলত। মা যতই চেঁচাক, বাবা নিশ্চুপ, কিন্তু হাতে সেই বরফি কাটছে। তারপর দু’রকম আকৃতির জিবেগজা তেলে ভেজে, রসে ফেলে দুটো আলাদা বয়ামে ভরে রাখা হত। আমাদের তো আপত্তি কিছু নেই, দু’জনের জেদে দু’রকম জিবেগজা সংখ্যায় কিছু বেশিই হত। কাজেই যত ঝগড়া, আমাদের তত লাভ।
দশমীর পালা সাঙ্গ হলেও কোনোবার যদি সেটা শুক্রবার পড়ত, তবে বাবার অফিস খোলার আগে আরও দুটো দিন ফাউ পাওয়া যেত। বড়দিদি এলে অন্য জ্যাঠাইমারা বড়জ্যাঠাইমাকে বলত, বড় খুকিকে একটু যত্নআত্যি করো বড়দি, ও একা সংসারে নাজেহাল হয়, ঠিকমত রাঁধাবাড়া পারে না। বড়জ্যাঠাইমা হাসত। আমি কিন্তু বড়দিদির বাড়ি গিয়ে দেখতাম, যে বড়দিদি পিঁড়িতে বসে উনুনে বড় বড় পোনামাছ ভাজছে, একেবারে চচ্চড়ি নাড়বার মত ঘটাং ঘটাং খুন্তি নাড়িয়ে। আর মাছের টুকরোগুলো শক্ত লালচে বাদামি হয়ে টকাস টকাস করে খুন্তির তালেতালে নাচছে। মা আমাকে বলে দিয়েছিল, যে মাছ ভাজার সময়ে বেশি নাড়াবে না। একপিঠে রং ধরলে টুকরোগুলো বুঝে বুঝে উল্টে উল্টে এ’পাশ ও’পাশ শুধু ঘুরিয়ে দিতে হবে, যাতে কোনো পাশ বাদ না যায়। আর ভালো করে ভাজতে হবে, কিন্তু কাঠের মত না হয়ে যায়, তাহলে সোয়াদ হবে না। মায়ের পরামর্শের সঙ্গে বড়দিদির ঐ মাছভাজা মিলত না বটে, কিন্তু আমার মনে হত, বড়দিদি যা করে তাই শ্রেষ্ঠ। কেন যে অন্যরা বলে, যে বড়খুকি রাঁধাবাড়া তেমন পারে না।
আশির দশকের শেষের দিকে সেজদা আর নদা মিলে বাড়িতে মুরগির পোল্ট্রি করেছিল। আর বড়দিদির বাড়িতে রান্না হয়েছিল। সেই আমার জীবনে প্রথম মুরগি চেখে দেখা। খাসির মাংসের মতই পেঁয়াজ, রসুন, আদা, লঙ্কা দিয়ে কষে পাতলা ঝোল করা হয়েছিল। তবে মুরগি খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অবশ্য তার কারণও ছিল। এখন যেমন সরকার থেকে বাড়িতে কোয়েল, টার্কি – এগুলো খাওয়া শুরু করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তখন মুরগি নিয়েও তাই করা হয়েছিল। আর ঐ সময় থেকে সরকারি স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রচার শুরু হয়েছিল। ছোটবেলায় তো আমরা রাস্তার কলে জল খেতাম। রাস্তার ট্রলি থেকে আখের সরবত খেতাম, লেবুর সরবত খেতাম। কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু পরে ওগুলি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় – আন্ত্রিক রোগ, হেপাটাইটিস ইত্যাদি কমানোর জন্য। খাসির মাংসকে বলে রেড মিট, বেশি খেলে হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ে, মুরগির মাংস সেই তুলনায় নিরাপদ – এসব কথাও ঐসময়ে প্রথম শুনি। ধীরে ধীরে বাংলার ঘরে ঘরে মুরগি বিপ্লব শুরু হয়। আর এখন তো বাচ্ছারা মুরগি ছাড়া খেতে চায় না। খাসির মাংস দেখলেই তাদের কপাল কুঁচকে যায়।
বিজয়া আর তারপরের দিনক’টায় সন্ধে থেকে রাত বিরাট আড্ডার মজলিস বসত, অবশ্যই বড়দের আর ছোটদের আলাদা। কান পাতলেই শোনা যেত,
- আরে গেলবারে কি কাণ্ড, ... বাড়ির বড়বৌদি সিদ্ধি খেয়ে সারারাত বারান্দার এ’পাশ ও’পাশ দৌড়োদৌড়ি করেছে। সে আর থামতে পারে না।
- সব্বোনাশ! বলিস কি রে?
.......
- আরে তোমাদের মেজদা, বিছানা করে, মশারি গুঁজে, তারপর একগ্লাস সিদ্ধি খেয়েই শুয়ে পড়বে। আর কোনো কথা নয়।
- মেজঠাকুরপোর সবসময়ে মাপা চলন, নিক্তি মাপা।
- (সমবেত) হোঃ হোঃ, হেঃ হেঃ, হাঃ হাঃ।
আবার ছোটদের মজলিস –
- আড়ৎদার পাড়ার অমুকদা ভীষণ পেটুক।
- আরে রাখ! এবারের পুজোর ক’দিন সমানে ঝাল মটর, চটপটি, চপ এসব খেয়ে এমন পেট ছেড়েছে, দশমীর আসল মেলায় যেতে পারেনি।
- সে কিরে! এ – বাবা!
- (সমবেত) হিহি, হাহা, হোহো।
এইসব আড্ডায় আমাদের মধ্যমণি হয়ে বসত বড়দিদি। আবার মাঝে মাঝে ভারিক্কি চালে আমাদের সাংসারিক জ্ঞান দিত।
করোনা অনবসরের দিনগুলিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকি। আর অতীত রোদেলা দিনের স্মৃতিগুলি আমায় ঘিরে ঘিরে নাচে। আমার গৃহবন্দী দিনগুলি কোনোক্রমে কাটে, তবু স্মৃতিগুলি পিছু হাঁটে না।
গাছে ছয়খানা মোট চম্পা আছে,
পারুল ছিল চার,
বড় পারুলটা নিয়ে গেছে
দুরন্ত ক্যানসার।
চিতায় নিলি কায়া –
নিতে পারবি মনের মিল ও?
শুধু শরৎবাবু নয় গো
আমারও বড়দিদি ছিল।