গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে
বক্সি বাড়িতে আজ দুপুরে একেবারে এস্পেশাল আইটেম। মৌরলার পকোড়া আর মৌরলার তেল চচ্চড়ি। পাড়ায় একজনের পুকুরে অনেক মৌরলা ধরা হয়েছে, এ বাড়িতে দিয়ে গেছে বেশ খানিকটা, বড় বড় আঙুল সাইজের। বাচ্চা, বুড়ো সকলে খুব খুশি। আমাদের পুকুরেও মৌরলা ছিল, কিন্তু কর্তা কোন খেয়ালে পুকুরে ভেটকি মাছ ছেড়েছিলেন। আর যায় কোথা, রাক্ষুসে ভেটকি সব মৌরলা পেটে পুরেছে। আমাদের জন্যে একটাও রাখেনি। ভীষণ পেটুক মাছ। মৌরলা মাছটা খেতে আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু এ মাছ রান্না করা সহজ নয়। কাটার কায়দা জানতে হয়। পেটে যদি ডিম থাকে, বঁটিতে একটু খানি পেটটা কেটে নিয়ে এমন ভাবে টিপতে হবে – যাতে পিত্তি বেরিয়ে যায়, কিন্তু ডিম না বেরোয়। আর পেটে ডিম না থাকলে, মাছের তেল আর পিত্তি আলাদা বার করে, পিত্তি ফেলে দিয়ে তেলটা দিয়ে পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা কুচো দিয়ে ঝুরো করলে, খেতে খুব সোয়াদ লাগে। অত ছোট মাছ, একটা একটা করে পিত্তি বার করে সাদা করে ধোয়া কম কথা নয়। সবাই পারে না। আর পিত্তি থাকলেই মাছ তেতো হয়ে যাবে, তখন পুরোটাই মাটি। আমাদের রান্নাঘরের মতি বৌ মৌরলা মাছ রান্নায় খুব পটু। ও থাকলে চিন্তা নেই, তবুও কর্তা দাঁড়িয়ে থেকে মাছ কাটা, মাছ মাখা সব তদারক করছেন। মাছগুলো প্রথমে কানকোর তলায় একটু কেটে হালকা হাতে কিন্তু যন্ত্রের মতো টিপে টিপে পিত্তি বার করছে মতি বৌ। আর একটানে কানকো খুলে ফেলে দিচ্ছে। তারপর মাছগুলোকে এক পাশে সরিয়ে রাখছে। এদিকে কানকোকে বলে গালসে। প্রথম পর্বের পরে এবারে দ্বিতীয় পর্ব। পিত্তি বার করা মাছগুলোর পেট টিপে তেল বার করল মতি বৌ। তেলটাকে নুন হলুদ মাখিয়ে একটু আটা গুঁড়ো মিশিয়ে দিল। আমি দেখছি পরপর স্টেপগুলো। এদিকে মৌরলার তেলকে বলে আঁত। পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা কুচো দিয়ে বেশ মচমচে ঝুরোকে এখানে বলে আঁত চচ্চড়ি। তবে ঢিমে আঁচে খুব ধৈর্য ধরে সাবধানে ভাজতে হয়। আঁচ বেশি হয়ে তলা ধরে গেলে বিপদ। পুরোটাই সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারোর পাতে আর উঠবে না। আর ঠিকঠাক রেডি হলে খেয়ে আশ মেটে না। পরিমাণটা যে অল্প। মৌরলার সঙ্গে অন্য কিছু চুনো মাছ বা চিংড়ি অনেক সময়ে মিশে থাকে। লোক বেশি থাকলে এই আঁত চচ্চড়িতে ওগুলো মিশিয়ে একটু পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আমি ঠায় বসে পুরোটা দেখলাম। কারণ মতি বৌকে জিজ্ঞেস করলে ভাল ভাবে জানা যাবে না। ওরা হাতে কলমে কাজ জানে। কিন্তু কাজের পিছনে কার্যকারণ বুঝিয়ে বলতে পারে না।
মৌরলার পকোড়াও একটা সুস্বাদু পদ; কর্তা জেদ ধরেছেন, এত টাটকা আর রয়্যাল মৌরলায় পকোড়া খাবেন। পিত্তি যেহেতু খুব ভাল করে বার করে নেওয়া হয়ে গেছে, তাই তেতো হবার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। পেঁয়াজ কুচো, রসুন থেঁতো, কাঁচা লঙ্কা, কালো জিরে, ধনে পাতা, নুন আর হলুদ একসঙ্গে একটা পাত্রে মিশিয়ে হাত দিয়ে চটকে মাখতে হবে। পেঁয়াজ কুচোটা এভাবে চটকে মিইয়ে দিলে পকোড়া ভাল লাগে। পেঁয়াজগুলো খাড়া খাড়া খোঁচা হয়ে থাকে না। একটু রঙ চাইলে কাশ্মিরী লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া যায়, তবে ওটা বাহুল্য। না হলেও দিব্যি চলে যায়। এবারে বেসন আর চালের গুঁড়ো মেশাতে হবে, তারপর কাঁচা মৌরলা মাছ দিয়ে মাখতে হবে। জল দেবার প্রয়োজন নেই। পেঁয়াজের জল, মাছের জলেই বেশ মাখা হয়ে যাবে। এবারে ফ্রাই প্যানে সাদা তেল দিয়ে, বেশ কষকষে গরম করতে হবে। তারপর মিশ্রণটা গোলা গোলা করে লাল করে ভাজতে হবে।
খাবার টেবিলে আবার সেই গল্প জমে ওঠে।
- যাই বল জেঠিমা, মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ হওয়াটা কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। মেয়েদের কী দোষ?
- দোষ গুণের কথা নয়, এ হল এক একটা পরিবারের রীতি।
- তাই বলে, মেয়ের বিয়েতে কোফতা কাটলেট, ফ্রাই, কালিয়া, পাতুরি কিচ্ছু হবে না? সব ছেলেদের হবে?
- কেন হবে না? সব হবে।
- কী করে হবে? বলছ তো নিরামিষ।
- নিরামিষে তুই যা যা বললি – সব হয়।
- অসম্ভব।
- হয় রে হয়। এঁচোড়ের, মানে গাছ পাঁঠার কালিয়া হয়, ছানার পাতুরি হয়, লাউ পাতায় মশলা পোরা পাতুরি হয়, মুড়িঘণ্টের বদলে মোচার চণকান্ন, চালপটল হয়, কাঁচকলার কোফতা, থোড়ের কোফতা হয়, আর কাটলেট কত নিবি? বিটের কাটলেট, সয়াবিনের কাটলেট, পনির কাটলেট, বাঁধাকপির কাটলেট – সব হয়। মাশরুমের ফ্রাই দারুণ খেতে হয়। তাছাড়া পটলের দোরমা, ওলের ভর্তা – এসবও হয়। আমাদের দেশে নিরামিষ রেসিপি আমিষের থেকে কম কিছু নেই।
- কিন্তু এসব তো বাড়িতে হয় না। মোচার চণকান্ন? সেটা আবার কী?
- বাড়িতে আমিষ বিকল্প থাকে বলে এসব রান্না হয় না। কিন্তু করলেই করা যায়। ইন্টারনেটে কত পুরোনো আমলের রান্নার বই আছে। ইউটিউব আছে। বয়স্ক মানুষেরা আছেন। মোচার চণকান্ন একটা পুরোনো আমলের বাংলা রান্না। গবেষক শুভজিৎ ভট্টাচার্যের লেখায় পেলাম। আমার বন্ধু, তোদের মিতা মাসি ওটা রান্না করেছিল। ঝিরি ঝিরি করে কাটা মোচা সেদ্ধ করে তাতে আদা, জিরে, লংকা বাটা, হলুদ, নুন চিনি মেখে চটকে রাখতে হয়। এবারে সর্ষের তেলে জিরে ফোড়ন দিয়ে গোবিন্দ ভোগ চাল ভেজে নিতে হয়। চাল ভাজা হয়ে গেলে একপাশে নামিয়ে রেখে মশলা কষতে হবে। তেলে জিরে, শুকনো লংকা, তেজ পাতা, আদা কুচি আর চিনি দিয়ে লাল করে ভেজে নিতে হবে। তারপর আবার জিরে, লংকা বাটা, হলুদ দিয়ে কষে কিসমিস দিতে হবে। মশলা থেকে তেল ছেড়ে সুগন্ধ উঠলে মোচা মাখা দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিতে হবে। মোচা হয়ে গেলে ভাজা চাল দিয়ে নেড়ে চালের পরিমাণে জল দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। নিজে করে খেয়ে দেখবি একদিন, লাজবাব।
- বুঝলাম। কোফতা কাটলেট, ফ্রাই, কালিয়া, পাতুরির বিকল্প আছে মানলাম। কিন্তু মা, বিরিয়ানির কোনো বিকল্প হয়? এ পৃথিবীতে সম্ভব?
- দেখ, ফেসবুকে আমি এক রাজার বিয়ের আশীর্বাদের মেনু দেখেছিলাম। সেখানে রুই মাছের টিকলি পোলাও, চিংড়ি মাছের কাশ্মিরী পোলাও, মটন ক্রুকেট পোলাও, ডিমের টিকলি পোলাও – এই চার রকম আমিষ পোলাওয়ের সঙ্গে নিরামিষ পদ ছিল ছানার পোলাও এবং বিষ্ণু ভোগ।
- বা বা! বিষ্ণু ভোগ কেমন হয়?
- ও হল খোদ জগন্নাথ দেবের ছাপ্পান্ন ভোগের এক ভোগ। ঘি, ছোলার ডাল আর বাসমতী চাল দিয়ে হয়। সঙ্গে অনেক রকম ড্রাই ফ্রুট। ডাল শুনে আবার খিচুড়ি ভেবে ফেলিস না যেন। ও জিনিসটা কিন্তু পাক্কা ভেজ ফ্রায়েড রাইস। তাছাড়া দমে রেখে বিরিয়ানি, সে এঁচোড় দিয়েও হয়, সয়াবিন দিয়েও হয়। আখনির জলে ঠিক মতো চাল ফোটাতে পারলে, কোথায় লাগে আমিষ?
- কোন রাজার বিয়ে গো জেঠিমা?
- সে আছে একজন। সেই বিয়ের সঙ্গে তোদের বক্সিবাড়ির একটা যোগাযোগ আছে।
- কে রাজা? কী ব্যাপার? বল না!
- নামটা বলছি। কিন্তু ঘটনাটা এখন নয়, পরে বলব। সব একসঙ্গে বললে খেই রাখতে পারবি না। সেই রাজা হলেন কৃষ্ণনগরের রাজা সৌরীশ চন্দ্র রায়।
- আচ্ছা জেঠিমা, মেয়ের বিয়েতে নিরামিষের এই রীতি – এটা কি শুধু পরিবারের লোকেদের জন্যে, নাকি অতিথি-অভ্যাগত সবার জন্যে?
- সবার জন্যে, বরযাত্রীদেরও নিরামিষ দেওয়া হয়। আমার মামার বাড়ি বোস, দেব তো নয়, কিন্তু পূর্ব পুরুষেরা দৌহিত্র বংশে রাজবাড়িতেই থাকত, তাই আমার মামার বাড়িতেও একই রীতি। আমার মায়ের বিয়েতে, মাসিদের বিয়েতে নিরামিষ হয়েছিল। বাবলিদির বিয়েতেও নিরামিষ হয়েছিল।
- তোমার বিয়েতে?
- ধ্যাত, আমি কি বোস বাড়ির মেয়ে নাকি?
- ও, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তো আড়বালিয়ার মেয়ে। না মানে বাবা আড়বালিয়া আর মা কলকাতা। তুমি কলবালিয়া।
- দেখবি? আমি কলবালিয়া?
- হ্যাঁ, আর তোমার মামার বাড়ি শোভাবাজারের বোস।
- আমার মামার বাড়ি হল মাহীনগরের বোস। মামারা বলত মাইনগর।
- মাহীনগরের বোস মানে? মাহীনগর কোথায়? সেখানে কেউ থাকে? ওখানে গেলেই সব জানা যাবে? আমি যাব। হাসছো কেন মা? বল।