৫
বেপরোয়া খেলার সাহস।
খেলার বিবেক, খেলার নবাব।
আমরাই ভিনদেশিদের,
বিরুদ্ধে এই দেশের জবাব।
– গল্প শুনেছি, মিত্র পরিবারে ঠাটবাট ছিল একেবারে পাক্কা সাহেবী। সে যুগেও খাওয়াদাওয়া হত টেবিলচেয়ারে, একেবারে টেবিল ম্যানারস, এটিকেট সব মেনে। সাহেবী প্রথা মেনে সে বাড়িতে উইকএন্ড আউটিং, হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাওয়ার চল ছিল। বিলাসিতা ছিল। এর উল্টোদিকে সেন পরিবার ছিল সংযমী। তাদেরও তো ধাপার জমিদারী ছিল। মা গল্প করত, ধাপা থেকে গাড়ি করে প্রচুর সবজি, বিশেষ করে ভুট্টা, ফুলকপি আর মূলো আসত। আত্মীয় স্বজনদের বিলোনো হত। মায়েদের বাড়িতেও আসত। কিন্তু ব্রহ্মনাথ, ভবনাথ এই সম্পদকে মাথায় চড়তে দেননি। এই সংস্কারে, ও বাড়িতে পাঁচদিনের দুর্গাপুজো না হয়ে একদিনের অন্নপূর্ণা পুজো হয়। সেই পুজো আজও চলছে। ১৯০০ সালের ৮ই এপ্রিল এই অন্নপূর্ণা পুজো শুরু করেছিলেন ভবনাথ সেনের স্ত্রী জয়কালী সেন। এই যাদুবলে আজও ঐ পরিবার তাদের যৌথ বাড়িতে বাস করছে এবং মণিলাল সেনের পৌত্র, দাঁতি সেনের পুত্র প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও রাজ্যপাল শ্যামল সেনের মত বংশের কৃতি সন্তানেরা বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এখন শ্যামল মামাই ও বাড়ির কর্তা। আসলে সেন বাড়ির সূত্রে শ্যামল সেনের বাবা দাঁতি সেন আমার মামা। কিন্তু আর জি করের বাড়ির সূত্রে শ্যামল সেন আমার মামা। তিনি যখন রাজ্যপাল হলেন, আমরা সংবর্ধনা দিতে রাজভবনে গিয়েছিলাম।
– রাজভবনে কী আছে?
– অনেক সাজানো ঘর, মিউজিয়াম এইসব। অতিথিদের চা-চক্রে চায়ে চিনি মেশানো আর নোনতায় সস মাখানোর কিংবা জামবাটি থেকে নিজের প্লেটে একটি মিষ্টি তুলে নেওয়ার চামচের মাপ যে আলাদা, অথবা কোনটার পরে কোন কাজ – এসব আদবকায়দা তো আমরা জানতুম না। ভুলভাল হয়ে যাচ্ছিল। রাজভবনের রাজকীয় পোশাক আর পাগড়ি-পরা বয়স্ক কর্মীরা মুখে কথা বলেন না। কেবল চোখের ইশারায় ঠিকটা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। রাজভবনের অসংখ্য ঘর, কোনটায় কোন রাষ্ট্রনেতা থাকা পছন্দ করতেন, ইন্দিরা গান্ধী এসে কোন ঘরে থাকতেন, নুরুল হাসানের জন্য শয়নঘর লাগোয়া স্নানাগারের নকশা কেমন পরিবর্তন করতে হয়েছিল – সেসব মৃদুকণ্ঠে কিন্তু অনর্গল বলে চলেছিলেন গাইড। এখানে উচ্চগ্রামে কথা বলা মানা। উচ্চশব্দে কয়েকশ’ বছরের প্রাচীন দেওয়াল, ছাদ, আসবাব, তৈলচিত্র, প্রত্নসামগ্রীর আঘাত লাগে। ইংরেজ আমলের স্মৃতিচিহ্নের বিশাল অংশটির তালা খুলে দেখিয়েছিলেন গাইড। আবছা আলোয় চোখ সয়ে এলে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। চোখ আটকে গেল, দেওয়ালে ঝোলানো একটি ছবিতে। দেড়শ’ বছর আগেকার এক তারিখে সস্ত্রীক বড়লাট রাজভবনের ফটকে নেমে আসছেন ফিটন গাড়ি থেকে। ছবিতে মানব চরিত্রগুলির তুলনায় ফিটন গাড়িটি বড় বাঙ্ময়। পিছু ফিরতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম, ঘরের মাঝসারিতে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং কালো রঙের ফিটন গাড়িটি। এও শুনলাম, কর্মীরা অনেক সময়েই অতীত চরিত্রদের পদচারণা অনুভব করেন। অনেকদিন পর্যন্ত মরা আলোয় দেখা রাজভবনের জমকালো অলিগলির ঘোর কাটতেই চাইছিল না।
– মা, তোমার কপালটা না বেশ চওড়া। অনেক কিছু দেখেছ জীবনে।
– তোরাও দেখবি, কতটুকু আর জীবন দেখেছিস।
পারিবারিক শ্রুতিতে জেনেছি যে আমার মায়ের ঠাকুরদা শরৎচন্দ্র বোসও মোহনবাগানের জন্মে যুক্ত ছিলেন এবং অর্থসাহায্য করেছিলেন। হয়তো এমন আরো মানুষ আছেন। মোহনবাগানের প্রথম কমিটিতে তাঁদের নাম নথিভুক্ত নয় বলে মোহনবাগানের ইতিহাস থেকে তাঁরা আজ হারিয়ে গেছেন।
– হুম। বোরিয়া মজুমদারের বইটা পড়ব আমি জেঠিমা, অনেক দিন থেকে টার্গেট করেছি।
– পড়িস, উনি ভাল কাজ করেছেন।
আমার কী মনে হয় জানিস, তখনকার প্রধান পরিবারগুলো তাঁদের জীবিকার জন্য ইংরেজ সরকারের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না।
– ঠিক।
– যদিও এর ব্যতিক্রম ভূপেন বোস। তিনি সরাসরি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের পারিবারিক শ্রুতি বলে মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনীও বঙ্গভঙ্গ আর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দেড়শ’ বছর পরে ইতিহাস পুনর্গঠন খুবই কঠিন। অনেক সময়েই অনুমানের ভিত্তিতে তথ্য হাতড়াতে হয়। ১৮৮৯ সালে মোহনবাগানের জন্মের সময়ে আমাদের কুমুদিনী মানে শরতের স্ত্রী নববধূ, কোলে সদ্যজাত জ্যেষ্ঠপুত্র সতীশচন্দ্র। তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে – মোহনবাগানের জন্মকালে জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। এরপরেও সেকালে লেখাপড়া জানা কলেজের গণ্ডিতে পৌঁছোনো মানুষজনের ওপরে ছিল ডিরোজিওর প্রভাব। এইসব কারণে আমার মনে হয় লেখাপড়া, ডিরোজিও এবং ব্রাহ্ম ও অন্যান্য সমাজ সংস্কারের সান্নিধ্যে এসে এই পরিবারগুলির মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়। সেই আবেগ ফুটবল দলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে, যা পূর্ণতা পায় ১৯১১ সালে, খেলার মাঠে ইংরেজের দল ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে।
– মা আমার ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে। কাল জিরে ধনে দিয়ে সেনবাড়ির মত পাতলা পোনা মাছের ঝোল করবে?
– ঘরে তো নোনা মাছ ভর্তি। বাবাকে বল তাহলে কাল হুইল ছিপ বা জাল ফেলতে। রুই বা কাতলা যদি ওঠে। পোনা মাছ না থাকলে কী করে ঝোল খাবি?
– বাড়িতে তো কখনো সখনো ওরকম ঝোল কর, রোজ কর না কেন?
– কী করে করব বল? তোর বাবা পোনা মাছ আনতে চায় না, খেতে চায় না। এ বাড়িতে তো তেল মশলা, পেঁয়াজ, সর্ষেবাটা, টক এসবের চল বেশি। জিরে ধনের ঝোলকে বলে সেদ্ধ ঝোল। খেলে নাকি পেটে চড়া পড়ে যাবে।
– অ্যাঁ – অ্যাঁ, আমরা খাব।
– যাকগে, এসব কথা ছাড়। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমার দাদু বিকাশচন্দ্রের পরিবার, আর ছোটপিসিদিদার পরিবারে শনির দশা শুরু হয়। ১৯২১-এ আমার বড়দাদু, মানে শরৎ – কুমুদিনীর জ্যেষ্ঠপুত্র সতীশচন্দ্রের তেত্রিশ বছর বয়সে স্প্যানিশ ফ্লু-তে অকস্মাৎ মৃত্যু থেকে এই বিপর্যয়ের শুরু।
– ফ্লু-তে? মানে কুমুদিনীর বড় ছেলে জ্বর হয়ে মারা গেল?
– হ্যাঁ, ডালহৌসি পাড়ায় মার্কেন্টাইল বিল্ডিংয়ে ওঁর বড় অফিস ছিল। বাবার কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে, নানা কোয়ালিটির কাগজ, তার কালি, অন্যান্য উপকরণ মানে নানারকম প্রিন্টিং গুডসের ব্যবসা ছিল। দেশে তখনও কালি কলমের উৎপাদন তেমনভাবে শুরু হয়নি। ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে টাইপ রাইটার, নানা ধরণের কাগজ, কালি কলম, পেনসিল – এসব আমদানি করা হত। আর সতীশচন্দ্র এগুলো বিভিন্ন স্তরের গ্রাহকের কাছে অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই করতেন। সেই অফিসের কিছু কাগজপত্র, তাঁর স্বহস্তে লেখা হিসেবের খাতা আজও পরিবারের কাছে আছে। যদিও কালিতে চুবিয়ে কলম দিয়ে লেখা আজ অনেকটাই আবছা হয়ে গেছে। যাই হোক, সে সময়ে ধীরে ধীরে বড়ছেলে হিসেবে তিনি বাবার সব দায়িত্ব নিচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯২১-এর এক বিকেলে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরে সেই যে শুলেন, আর উঠলেন না। দু’দিন ঐভাবে কাটল। তিনদিনের দিন তাগড়া জোয়ান ছেলে শেষ হয়ে গেল। পিছনে রয়ে গেল বাবা-মা, দুটো ছোট ছোট ভাই, নিজের বৌ প্রতিমা, আর তিনটে বাচ্চা – মুকুল, বকুল আর সুকুল। মেয়ে গীতার শিশুকালেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মুকুলের তখন সাত-আট বছর হবে, বকুল তখন আড়াই, সুকুল তখন ছ’মাসের। আমার দাদু বিকাশচন্দ্রের বয়স তখন আঠেরো আর ওঁর ওপরের দাদা ক্ষিতীশচন্দ্র তখন কুড়ির কোঠায়। দু’জনের কারোরই সংসারের হাল ধরার বয়স হয়নি। রাজবাড়িতে আতুপুতু করে মানুষ হয়েছে। কষ্ট করে বড় হলে, তাও একটা ম্যাচিওরিটি থাকত।
এই স্প্যানিশ ফ্লু-তেই ১৯১৮ সালে মৃত্যু হয় চিকিৎসক আর জি করের। ১৯৯৮ সালে প্লেগ মহামারী তাঁর কাছে হার মানলেও, এবারে অন্য রূপে এসে মহামারী তাঁর প্রাণ কেড়ে নিল।
এদিকে শোভাবাজারের বাড়িতে, বড় ছেলের শোক শরৎচন্দ্র সইতে পারলেন না। দু’বছরের মধ্যে ১৯২৩ সালে হৃদরোগে তাঁর মৃত্যু হল। কুমুদিনী রাজবাড়িতে বসে নানা সমাজ সেবায় অংশ নিয়েছেন, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করতেন শুনেছি। কিন্তু বাড়িতে মাথায় তাঁর ডাকসাইটে ব্যবসায়ী শরতের ছায়া ছিল। সেই ছায়া সরে যেতেই নানা পারিবারিক জটিলতা শুরু হল। কুমুদিনীর মত আলোকপ্রাপ্তা নারীর পক্ষে ঠাকুর-দেবতা নিয়ে কঠোর বৈধব্য যাপন সম্ভব ছিল না। তিনি তখন সেজ ছেলে সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। সুরেনকে ছোটবেলায় হাটখোলা দত্ত বাড়িতে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।
– কঠোর বৈধব্য জীবন? কীভাবে থাকতে হত বিধবাদের?
– সময়টা বিশ শতকের প্রথম দিক। বিধবাদের নিরামিষ খেতে হত। অনেক সময়ে স্বামীর মৃত্যুর পর কমবয়সী বিধবাদের তাঁদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। পতিগৃহে সাধারণভাবে তাঁদের স্থান হত না। তবে কুমুদিনী যখন বিধবা হন, তাঁর বয়স একান্ন। তাই সেরকম সম্ভাবনা হয়তো ছিল না। সিঁথির সিঁদুর মুছে, দেহের সব অলঙ্কার খুলে ফেলে, চুল কেটে, সাদা থান পরে, এক বেলা নিরামিষ খেয়ে খিদে চেপে তাঁদের বৈধব্য পালন করতে হত। না খাওয়া থেকে হত অপুষ্টি। ফলে অসুখবিসুখ শরীরে বাসা বাঁধত। শুধু আমিষ বর্জন নয়, মুসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারেও বাধানিষেধ ছিল, কারণ এসব খাবারকেও আমিষকে ধরা হয়। তাদের আলাদা নিরামিষ রান্নাঘর থাকত। আলাদা খেতে বসত। তাদের সামনে সবাই চর্ব্য চোষ্য, লেহ্য, পেয় খেয়ে যাবে। আর তারা সেদ্ধ ভাত, শাকপাতি খাবে – এই ছিল বিধান। বিধবারা মুখ বুজে সংসারে ঝি-গিরি করবে, বাকিদের সেবা করবে, করুণার পাত্র হবে। আর ঠাকুর-দেবতা নিয়ে শুদ্ধমনে পবিত্র জীবনযাপন করবে – এইটেই ছিল সমাজের দাবি। বহু বিধবাকে জোর করে তীর্থক্ষেত্রে রেখে আসা হত। চোখের আড়ালে কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি জায়গায় তাঁরা কীভাবে জীবন-যাপন করছেন – সে খবরও কেউ রাখত না।
– কুমুদিনীকে এসব করতে হয়নি তো মা? খুব কষ্ট।
– সেটা তো বলতে পারব না, কতটা রীতি উনি মেনেছিলেন বা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে একটা কথা আছে জানিস।
– কী কথা?
– কুমুদিনীর দুটো ছবি আছে আমার কাছে। একটা তরুণী বয়সের পোট্রেট, মেজ ছেলে জ্যোতিষের, মানে আমার মেজদাদুর আঁকা। হয়তো মায়ের কোনো ফটোগ্রাফ দেখে এঁকেছিলেন। আর একটা বেশ পাশ করে মুখ, পোজ দিয়ে তোলা ফটো। তখন পূর্ণ যুবতী। দুটোর একটাতেও মাথায় সিঁদুরের রেখা নেই। সাদা কালো স্পষ্ট ছবি। সিঁথি সাদা।
– তাই নাকি? কিন্তু এমন কী করে হবে? একান্ন বছরে বিধবা হলেন, বিয়ে হয়েছিল, কত বছর বয়সে?
– বিয়ে হয়েছিল তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে। ছবিতে মাথায় সিঁদুর নেই – তার মানে কি এটা হতে পারে, যে, উনি ব্রাহ্ম ভাবাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন? দেব বাড়ির মত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে বৌ হয়ে থেকেও উনি নিজের মতে চলতেন? কিন্তু নিশ্চিত হবার মত কোনো সূত্র এখনও পাইনি।
– কিন্তু জেঠিমা, শোভাবাজার রাজবাড়ি খুব রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু। সেখানে ব্রাহ্ম আদর্শ চলা কি সম্ভব?
– ঋষি রাজনারায়ণ বসুর নাম শুনেছিস তো? খ্যাতনামা ব্রাহ্ম নেতা। তাঁর আত্মচরিতে লেখা আছে রাধাকান্ত দেবের এক নাতিকে তিনি ব্রাহ্ম করেছিলেন। আবার রাধাকান্ত দেবের এক ছেলে দেবেন্দ্র নারায়ণ বাহাদুর ওঁর সুরাপান নিবারণী সভার সদস্য হয়েছিলেন। তাছাড়া অন্যান্য বিষয়েও ঐ বাড়ির রেফারেন্স আছে। যুগকে কেউ এড়াতে পারবে না। যোগাযোগ হবেই। কেশব সেন নিজেই তো মেয়ের বিয়ে হিন্দু মতে হিন্দু বাড়িতে দিয়েছিলেন। তাই ওটা কোনো কথা নয়।
– যদি সত্যি হয়, তবুও তো ভারি অবাক করা ঘটনা বলে মানতেই হবে মা! অনেকটা সিনেমার মত। যোধা কৃষ্ণ নিয়ে আগ্রা যাচ্ছে আকবরের মহলে।
– হ্যাঁ এখানে হয়তো উল্টো। ব্রহ্ম ভাবনা নিয়ে রইলেন এমন মহলে, যেখানে গৃহদেবতা রাধারমণ – কৃষ্ণ।
– ব্রাহ্ম বৌরা বুঝি সিঁদুর পরে না জেঠিমা?
– সঠিক জানি না, তবে না পরাই উচিত। বইতে পড়েছি, ১৮৫০ নাগাদ যে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন হয়, তাতে আন্তর্বর্ণ বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সমর্থন, বাল্যবিবাহ রদ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত ছিল। বিবাহের রীতি হিসেবে বলা যায়, সাবালক পাত্র-পাত্রীরা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উপস্থিত হয়ে স্ব-স্ব ধর্মে বহাল থেকে ব্রাহ্ম রীতিতে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সাবালক হবার বয়স ধরা হয়েছিল চোদ্দো বছর। ব্রাহ্ম বিয়েতে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ হয়৷ শেষে বর-কনে, অভিভাবক, উপস্থিত অতিথিরা প্রার্থনা সভায় অংশ নেন এবং ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেন। যৌতুক দেওয়া নেওয়া ও বিরাট লোক খাওয়ানো, বিলাসিতা, আড়ম্বর এসব চলে না।
– কুমুদিনীর বিয়ের সময়টা কত সাল?
– ১৮৮৬-৮৭ হবে। আমার বড়দাদুর জন্ম ১৮৮৮-তে, তখন কুমুদিনীর বয়স পনেরো, চোদ্দো বছরে বিয়ে হয়েছে। এসব কথা তো শুনেছি বাড়িতে। সেই হিসেবে বলছি। আমি একটাই সান্ত্বনা খুঁজি জানিস, কুমুদিনী যদি ব্রাহ্ম আদর্শ বজায় রাখেন, তবে একাদশী পালন, চোদ্দো গণ্ডা উপোস, নির্জলা উপোস – এসব বোধহয় করেননি। তেমন কোনো গল্প শুনিনি কখনও। সঠিক জানার তো উপায় নেই, শুধু কল্পনা। আর একটা কথা কী জানিস, আমি পড়েছি, প্লেগের সময়ে কলকাতায় গুজব রটেছিল টীকা নিলেই লোক মরে যাবে। কিন্তু ব্রাহ্ম মানুষেরা এগিয়ে এসে টীকা নিয়েছিলেন। সেই প্রভাবও কি কুমুদিনীর প্লেগের লড়াইতে নামার একটা কারণ? কী জানি।
– কী জানি বলছ কেন?
– বলছি, কারণ ১৯২৫-এ স্বামীর মৃত্যুর পরে ওঁর যে কবিতার বই প্রকাশিত হয়, সেখানে বেশির ভাগ কবিতা কৃষ্ণকে স্মরণ করে। তবে কি অল্প বয়সের ব্রাহ্ম প্রভাব পরিণত বয়সে ছিল না?
– সেটা তো হতেই পারে জেঠিমা, উনি ধর্মত্যাগ তো করেননি। মানুষের জীবনে নানারকম পর্যায় আসে।
– আর জানিস, এই শরৎ বোস চরিত্রটাকে নিয়ে এসব কথা যত ভাবি, অবাক হয়ে যাই, অবিশ্বাস্য লাগে। নিজে ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা করছেন, সাহেব মেমের সঙ্গে দিবারাত্র খানাপিনা চলছে। প্রাসাদে বিলিতি জিনিস, ভোগ বিলাসের ফোয়ারা উঠছে। অথচ সন্তর্পণে বৌয়ের লেখালেখি, সমাজসেবার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। বৌ রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়ির গোঁড়ামি, সমাজের চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে, প্লেগের লড়াইয়ে নামছেন – সেসবে কোনো বাধা দিচ্ছেন না, এদের রোষ থেকেও বৌকে নিজের প্রতিপত্তি দিয়ে রক্ষা করে যাচ্ছেন, এমন বরকে হারালে, যে কোনো মেয়েই ভেঙে পড়বে – সে যত বড় নেত্রী হোক না কেন? মেয়েলি মনটা কোথায় যাবে? তাছাড়া কুমুদিনী তো শুধু সে যুগের যোদ্ধা নন, লেখিকা, কবি। সংবেদনশীল মন ছিল।
– কুমুদিনীর কবিতার বইটার নাম কী?
– পূজার ফুল।
– শরৎ মারা যাওয়ার পরে, কুমুদিনী কি শোভাবাজার রাজবাড়ির পাট পুরো চুকিয়ে হাটখোলায় সেজ ছেলের বাড়িতে এলেন?
– হ্যাঁ। এমনকি রাজবাড়ির বিধবা ভাতা নামক মোটা মাসোহারাও গ্রহণ করতে তিনি পরে অস্বীকার করেছিলেন। হাটখোলার দত্ত বাড়ি আন্দুলের দত্ত চৌধুরী জমিদার বংশের একটি শাখা। অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী এই দত্ত চৌধুরী বাড়ির ছেলে। হাটখোলার দত্তরা আবার কলকাতার অন্য জমিদারদের মত ইংরেজ-ভজা বংশ ছিল না। বরং এই পরিবারে দেশাত্মবোধ প্রবল ছিল। নেতাজী সুভাষের মা প্রভাবতীও এই বংশের মেয়ে।
– তাই নাকি?
– কুমুদিনীর সেজ ছেলে সুরেন্দ্রনাথের বৌ আবার আন্দুল রাজবাড়ির মেয়ে।
– আন্দুলের দত্ত চৌধুরী?
– না না। আন্দুল রাজবাড়ি হল কর-রায়-মিত্র বাড়ি। প্রথমে ছিল কর, ইংরেজ ভজিয়ে উপাধি পেল রায়, পরে ছেলে নেই, তাই মেয়ের বংশে জমিদারী গেছে। তারা মিত্র। এই আন্দুল রাজবাড়িতে তিরিশ বছর বয়সে সুরেনের মৃত্যু হয়।
– মানে শ্বশুরবাড়িতে ঘুরতে এসে মারা গেল?
– হ্যাঁ। তার বৌ তখন সদ্য কিশোরী, কোলে কয়েকমাসের বাচ্চা। কিন্তু কেন যে সুরেন মারা গেল, সেই রহস্যের কিনারা আজও হয়নি।
– কিন্তু কেন? সেনবাড়ির অত অ্যাটর্নি রয়েছে কুমুদিনীর হাতে, কিনারা হল না কেন?
– পয়েন্টটা ঠিকই রেইজ করেছিস।
১৯২১ সালে স্প্যানিশ ফ্লু-তে জ্যেষ্ঠ পুত্র সতীশকে হারানোর ব্যথা কুমুদিনী সামলেছিলেন স্বামী শরৎকে আঁকড়ে ধরে। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী, ইংরেজি, ফরাসি ও ফার্সি ভাষায় সুপন্ডিত শরৎ, সর্বকাজে যিনি কুমুদিনীকে আগলে রাখতেন, সংসারের আঁচটি লাগতে দেননি গায়ে, যাঁর পরম আশ্রয়ে সাহিত্য সেবা, দেশসেবা দুইই চালিয়ে গেছেন নিশ্চিন্তে, সেই শরতের হাতটি ছেড়ে গেলো ১৯২৩-এ। পারিবারিক শ্রুতি বলে স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। শোক ভুলতে দ্বিগুণ উদ্যমে আবার কর্মে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। তৃতীয় পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঐ তেইশ সালেই পুরো পরিবারকে শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে নিয়ে যান হাটখোলার দত্তবাড়িতে। এর পরে কুমুদিনী এবং তাঁর উত্তর পুরুষেরা আর কোনোদিন ফিরে যাননি সেখানে। দু’বছর সেখানেই কাটে। ১৯২৫-এ শ্বশুরবাড়ি আন্দুল রাজবাড়িতে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সুরেন্দ্রের। ওটা তো কুমুদিনীর নিজের অধিকারের বাড়ি নয়। তাই ও’বাড়ি ছাড়লেন আবার। এবারে তিনি উঠে এলেন ফড়িয়াপুকুরের একটি ভাড়া বাড়িতে। তখন পরিবারে জ্যেষ্ঠ পূত্রবধূ প্রতিমা, তাঁর তিনটি কিশোর ও বালক পুত্র, মুকুল, বকুল ও সুকুল – পনেরো, তেরো আর এগারো বছর বয়স্ক। দুই পুত্র ক্ষিতীশ ও বিকাশ – পঁচিশ ও বাইশ বছর বয়স। কুমুদিনীর বয়স তিপ্পান্ন। না, সুরেন্দ্রের মৃত্যুর কিনারা করতে পারেননি কুমুদিনী। কিন্তু কেন?
সেটা বুঝতে গেলে দেশের আর ওঁর নিজের পরিস্থিতি বুঝতে হবে। দেশে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের দামামা বাজছে। খুব সম্ভব কুমুদিনী লেখালিখি আর সমাজসেবার আড়ালে বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই অবস্থায় ইংরেজ পুলিশের সাহায্য চাওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।
আমার মা, মানে কৃষ্ণা বলত, যে সে যুগে এত চিকিৎসা, নিয়মিত চেক আপ – এসব তো ছিল না। উল্টে কেবল খাওয়াদাওয়ার বোলবোলাও ছিল। তাই সেজদাদুর মৃত্যু হয়তো স্বাভাবিকই ছিল।
– কিন্তু কিছুই কি জানা যায়নি?
– হ্যাঁ শুনেছি, খুব ভারি খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। মৃত্যুর পরে ঠোঁট নাকি নীল হয়ে গিয়েছিল। আমি ইন্টারনেটে খুঁজেছি, হার্ট অ্যাটাকেও মৃতদেহের এমন হতে পারে। সুরেন্দ্রনাথের বাবা শরৎও তো হৃদরোগে মারা গেছেন। ছেলেরও হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কোনো তদন্ত বা পোস্ট মর্টেম তো হয়নি। তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা ঐ নীল ঠোঁট দেখে গুজব ছড়িয়েছিল সুরেন বিষ খেয়েছে। আজ একশ’ বছর পরেও সেই কাঁটা আমাদের পরিবারে বিঁধে রয়েছে। যদিও আমি এসব মন থেকে মুছে ফেলেছি।
কিন্তু কুমুদিনীর কথা ভাবি। যাই ঘটে যাক, তিনি নিজের কাজকে অবহেলা করেননি। কারণ আমাদের বাড়িতে যে দু’টি বই আছে, তার মধ্যে কবিতার বই ‘পূজার ফুলের’ প্রকাশকাল ১৯২৫ এবং উপন্যাস ‘বোঝবার ভুল’-এর প্রকাশকাল ১৯২৭। তার মধ্যে আরও অনেক রকম কাজ করতেন শুনেছি। ট্রাজেডি হচ্ছে, বাইরে কর্মজগৎ যিনি, শত কষ্টতেও, বজায় রেখে যাচ্ছেন, তাঁরই প্রিয়জনেরা এক এক করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে যখন কুমুদিনীর সবচেয়ে সাপোর্টের দরকার, তখন জানা গেল, যে সতীশের বৌ প্রতিমা, যিনি সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন, তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত। পরিবারের বাকিরা যাতে সংক্রমিত না হয়, তার জন্য প্রতিমা কাশীর বাড়িতে চলে যান। যাওয়ার আগে ভ্রাতুষ্পুত্রী ভারতীর সঙ্গে বিকাশের বিয়ে দিয়ে যান তিনি। এই বিয়ের সময়কাল ১৯৩১। একবছর পরে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ভারতী। ঐ ছেলে হল আমার বড়মামা বিমান চন্দ্র বসু। কিন্তু বাড়িটা নাতির হাসিতে মুখরিত হতে হতেও থমকে গেল।
– কেন? আর কাশীর বাড়ি মানে? বাড়িটা কার?
– বাড়িটা বোসেদের। তখন বড় বড় পরিবারের কাশী, শিমূলতলা, দেওঘর, পুরী এসব জায়গায় বাড়ি থাকত। নাতি হয়ে তেমন আনন্দ হল না, কারণ ১৯৩৩-এ কাশীতে মারা যান প্রতিমা আর ফড়িয়াপুকুরের বাড়িতে এক বছরের ছেলে রেখে, মারা যান সদ্য মা হওয়া ভারতী।
– মারা গেল কেন?
– মা হলেও, এখনকার নিরিখে বাচ্চাই বলা যায়। প্রথম সন্তান হবার পর ছ’মাস না যেতে আবার পোয়াতি। ছেলের দু’বছর পুরল না, তার মধ্যে দু’বার গর্ভপাত হয়ে সে পৃথিবী থেকে ছুটি নিল।
– মেয়েদের জীবনটা কী গো জেঠিমা? এসব শুনলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তারপর কী হল?
– দুর্যোগের যেন শেষ হওয়ার নাম নেই। পরের বছর ১৯৩৪-এ মাংস খেতে খেতে মাড়িতে হাড় ফুটে সেপটিক হয়ে মারা যান সতীশ – প্রতিমার জ্যেষ্ঠ সন্তান উনিশ বছরের সদ্য তরুণ মুকুল চন্দ্র। জানিনা আর সহ্য করার মত ক্ষমতা ছিল কিনা কুমুদিনীর। দেশের জন্য জীবনটা উৎসর্গ করলেন যিনি, তাঁর ওপর এ কী ঈশ্বরের অবিচার নয়?
পাগলের মত যখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, তখন আশ্রয়দাতা হয়ে আসেন বড় জামাই ভূতিবাবু আর তাঁর দাদা দাঁতি সেন। কুমুদিনীকে পরামর্শ দেন ফড়িয়াপুকুরের বাড়ি ছেড়ে তাঁর কাছাকাছি থাকতে। বৃহৎ যৌথ সেন পরিবার যাতে ছাতা হয়ে দাঁড়াতে পারে নিয়তি-তাড়িত পরিবারটির মাথায়। কুমুদিনী ফড়িয়াপুকুরের বাড়ি ছেড়ে উঠে আসেন বাগবাজারের শ্যামপার্কের ধারে, সেনবাড়ির লাগোয়া, নববৃন্দাবন মন্দিরের উল্টো দিকে দাঁতিসেনের একটি ফাঁকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে। আসার পর দাঁতি সেন উদ্যোগী হয়ে তাঁর শ্যালিকা লাবণ্যপ্রভার সঙ্গে বিকাশের দ্বিতীয়বার বিবাহ দেন। শুনেছি আর জি করের স্ত্রীও এই বিয়েতে খুব উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। লাবণ্য হল আর জি করের ছোট ভাই রাধাকিশোর করের নাতনি। যদিও আর জি কর অনেক আগে ১৯১৮ সালে মারা গেছেন, তাঁর সঙ্গে কুমুদিনীর প্লেগের লড়াইয়ের সময়ে পূর্ব পরিচয় ছিল। তাই এ সম্বন্ধে তাঁর কোনো আপত্তি হয়নি।
– আর জি করের স্ত্রীও এই বিয়েতে ছিলেন?
– হ্যাঁ থাকবেন না? লাবণ্য তো ওঁরও নাতনি। মা গল্প করত, যে উনি নাকি স্বামী মারা যাবার পর, ঠাকুরঘরে অন্য কোনো ঠাকুর না রেখে রোজ খুব ভক্তি ভরে আর জি করের ছবি পুজো করতেন, পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভোগ দিতেন। স্বামী গোল গোল চাকা আলুভাজা ভালবাসতেন বলে ওরকম আলু ভেজে পরিষ্কার সাদা আদ্দির কাপড়ে প্রতিটা আলুভাজার গা থেকে যত্ন করে বাড়তি তেল মুছে দিতেন। স্বামী ডাক্তার, বাড়তি তেল খাওয়া পছন্দ করেন না, সেইজন্য।
– সে কি গো মা? এত ভক্তি করতেন স্বামীকে? আর কিছু জান না ওঁর সম্পর্কে?
– হুম, বড়মামা ছোটবেলায় ওঁকে চোখে দেখেছে। বড়মামা মজা করত। বলত, বাবা রে, বড়মা? ভীষণ শুচিবাই। বুড়ি নানা অজুহাতে কেবল চান করছে, আর গোলা গোলা গোবর কপাৎ করে খেয়ে নিচ্ছে।
– গোবর? গোবর খেয়ে নিতেন? ম্যা গো ম্যা!
– আমার মা বলত, ওঁর সন্তান ছিল না তো, মনে মনে একা হয়ে গিয়েছিলেন। বৈধব্য জীবন সহ্য করতে করতে ওরকম বিকার হয়ে গিয়েছিল।
– আচ্ছা মা, ভারতী মারা গেল কেন? বাচ্চা হলে কি মেয়েরা মরে যায়?
– যাওয়া উচিত নয়, তবে ঝুঁকি একটা থাকে, একটা শরীর থেকে আর একটা শরীর তৈরি করার তো ধকল আছে। তার জন্য পুষ্টিকর খাবার, বিশ্রাম, দুটো সন্তানের মধ্যে বিরতি – এসব দরকার হয়।
– ভারতীর শ্বশুরবাড়ি তো বড়লোক মা, খাবারের অভাব তো হবে না।
– খাবারের অভাব ছিল না হয়তো। কিন্তু ওর যা যা খাবার দরকার ছিল, যে যত্ন পাবার দরকার ছিল, সে সব দেখাশোনার মত লোকও তো ছিল না। কুমুদিনী শুনেছি নিজের কাজে ব্যাস্ত থাকতেন, সংসার দেখতেন না। প্রতিমা কাশী চলে যাবার পরে বাড়িতে তো আর মহিলা ছিল না। তাই ভারতী যত্ন পায়নি।
– জেঠিমা, একটা কথা বলছি, কংগ্রেস ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে বৃটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় তো ১৯২০ থেকে ২২। তার মানে স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর আবহেই দেশে আন্দোলন চলছিল?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা মা! কুমুদিনী লেখালিখি আর সমাজসেবার আড়ালে বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, একথা তোমার কেন মনে হল?
– অনেক কারণেই মনে হয়েছে। উনি যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটা আমার নয়, আমার মায়ের মানে কৃষ্ণার ধারণা। তাছাড়া বাবলিদি বলে যে, ওর বাবা, মানে আমার বকুল মামা ওকে বলে গেছে যে, কুমুদিনী প্রচুর লেখালিখি করতেন। বাড়িতে ওঁর লেখা আরো বই, পত্রিকা, খবরের কাগজের অজস্র কাটিং ছিল। উনি নাকি সংসারে মন দেবার কোনো সময় পেতেন না। ওঁর জীবিত দুই পুত্র বিকাশ এবং ক্ষিতীশ যথেষ্ট পড়াশোনা করেননি, তাঁদের বিলিতি জিনিসের প্রতি আসক্তি ছিল, আমার দাদু বিকাশ বোস বিলিতি কোম্পানিতে চাকরি করতেন, বিলাসী জীবনযাপন করতেন, তাই কুমুদিনী ছেলেদের মুখ দেখতেন না। তাঁদের প্রণাম নিতেন না। শেষ জীবনে, চিকিৎসার খরচও ছেলেদের থেকে গ্রহণ করেননি। বইয়ের রয়্যালটি আর পত্রিকার লেখা থেকে ওঁর উপার্জন ছিল। এতটা ইংরেজ বিদ্বেষ, এত মনের জোর উনি কোথায় পেলেন? এত স্বাধীনচেতা মনোভাব কীভাবে তাঁর মধ্যে এল? উনি দিনরাত কী কাজে ডুবে থাকতেন? কেন সংসারে সময় দিতে পারতেন না? এবারে সেই যুগের কথা যখন ভাবি, দেখি যে, ১৮৯৭ সালে শিকাগো ধর্মমহাসভা থেকে বিশ্বজয় করে দেশে ফেরার পরে কলকাতার যুবসমাজে বিবেকানন্দের প্রভাব খুব বেড়ে যায়। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভাল – এই আদর্শ যুবসমাজের মর্মে প্রবেশ করে। পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়ামাগার গজিয়ে ওঠে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পরে এইসব ব্যায়ামাগারের আড়ালে কলকাতায় গোপন বিপ্লবী সমিতির কার্যকলাপ বাড়তে থাকে।
– হুঁ, সে তো হবেই। স্বয়ং নেতাজী বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বইতে তো পড়েছি।
– ঠিক কথা। ভগিনী নিবেদিতাও তো এই সব সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। বাংলার অন্দরমহলে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহের আগুন বৃহত্তর সমাজের চোখের আড়ালে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। বিদেশি জিনিস বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। কুমুদিনী যে নিবেদিতার সঙ্গে ছিলেন, একথা তো সত্য। বাবলিদি জ্বলজ্যান্ত আমার দাদু বিকাশচন্দ্রের মুখ থেকে স্বকর্ণে শুনেছে।
– অন্দরমহলে বিদ্রোহ? মনে আছে মা সুবর্ণলতা। তুমি পড়ে শুনিয়েছিলে। সেগুলো শুধু গল্প নয়! সত্যি সত্যি ঘটেছিল?
– হ্যাঁ রে, সত্যি। সব সত্যি সত্যি ঘটেছিল। তাহলে দুয়ে দুয়ে চার করলে এটাই কি মনে হয় না, যে কুমুদিনী হয়তো লেখালিখি আর সমাজসেবার আড়ালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
– হুম, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, হয়তো নয়, নিশ্চিত জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ তো বিরাট ব্যাপার জেঠিমা। কিন্তু কাজের প্রমাণ কই? এগুলো কি কোনো গোপন কাজ ছিল?
– মা বলত, লাবণ্য বলে গেছে, কুমুদিনীর একটা নিজস্ব হাতির দাঁতের বাক্স ছিল, তাতে অনেক চিঠিপত্র ছিল। অনেক খবরের কাগজের কাটিং ছিল, কিন্তু সেগুলো লুকিয়ে রাখা হত, বাড়িতে। আর মায়ের জেজা মানে আমার গোঁফ দাদু ক্ষিতীশ চন্দ্র বসু সকলকে বলত, যে, “আমার মা কে ছিল জানিস? আমার মা সংসার ফেলে সিস্টার নিবেদিতার ইস্কুলে পড়াত, সেলাই শেখাত।”
– তাই নাকি? কুমুদিনী সেলাইও জানতেন?
– তখনকার দিনে সব মেয়েরাই সেলাই জানত। বাবলিদির কাছে ওঁর করা একটা টেবিল ক্লথ এখনও আছে। কিন্তু সেটা সাধারণ সেলাই বা এমব্রয়ডারি নয়, পুলড থ্রেড এমব্রয়ডারি। যে রঙের লিনেন কাপড়, সেই রঙের সুতো দিয়ে এমনভাবে সেলাই করা যাতে লেসের মত দেখতে লাগে। আরও একটা কথা আছে। ভারতী যখন মারা যায়, তখন শিশু বিমানচন্দ্রকে সেন বাড়িতে দত্তক নিতে চেয়েছিল। লাবণ্য বিয়ে হয়ে আসার পর, সেটা আর হয়নি। বহু বছর পর, আমরা যখন ছোট, বড়মামা খুব অর্থকষ্টে ছিল। ছেলেদের মানে আমার দাদাদের ইসকুলের মাইনে দিতে পারছিল না, তখন সেকথা শুনে নমে মামা একটা কথা বলেছিল আমার মনে আছে। আর কথাটা বাবলিদিও শুনেছে।
– কী কথা? নমে মামা কে?
– তোদের দাদু হবেন, নমে মামা হলেন মায়ের তিন পিসতুতো দাদার মধ্যে যিনি সবথেকে বড় – নমে সেন। উনি বলেছিলেন, “যার ঠাকুমা কবিতার বই, উপন্যাস লিখেছেন, বাংলা, ইংরেজি পত্রিকায় লিখেছেন, যিনি সিস্টার নিবেদিতার সহকর্মী, তার ছেলেদের কী অবস্থা!” মানে দুঃখ করেছিলেন।
– কুমুদিনী ইংরেজিতেও লিখেছেন?
– আমার মা তো তাই বলত। শোভাবাজারের বাড়িতে তো ওঁর জন্য মেম শিক্ষিকা আসতেন। তাছাড়া বাবলিদি গোঁফদাদুর কাছে সেই লুকোনো বাক্স দেখেছে। সেখানে ইন্ডিয়ান মীরার কাগজের অনেকগুলো কাটিং ছিল।
– কী বলছ মা! আমি যাব টাইম মেশিনে মা। কুমুদিনীকে সাহায্য করব। আমার কিন্তু রক্ত ফুটছে।
– ডোরেমনকে ডাক তাহলে। ওর ঐ দরজাটা দিয়ে দেবে। কিন্তু একটাই মুশকিল। সেকালের পত্রপত্রিকায় বাংলাটা বেশ শক্ত। ওঁর তো লেখালেখির ব্যাপার। বানান লিখতে পারবি তো? তোর সাহায্যের নমুনা পেয়ে শেষে কুমুদিনী যদি রেগে যান!
– মা-আ! তুমি যতটা ভাব, অতটাও বানানে কাঁচা আমি নই। আর সবসময় কি লিখতে হবে নাকি। আমি লুকিয়ে ছদ্মবেশে ইংরেজদের নাকের ডগা দিয়ে বন্দুক পাচার করব। ইংরেজ মারব, দুম দুম, শেষ।
– অ্যাই পাগল। চুপ কর তো। ইতিহাসটা জানতে দে। বল জেঠিমা।
– হা হা, আসলে রঞ্জাদের স্কুল ডায়োসেশনের ছাত্রী ছিলেন বিপ্লবী বীণা দাস। নেতাজীর গুরু বেনীমাধব দাসের মেয়ে। ওঁর কথা সবসময় ইস্কুলে শোনে, নাটক হয়। একটা বিল্ডিংও আছে, বীণা দাস ব্লক। তাই টাইম মেশিনে গিয়ে ইংরেজ মারবে, দুম দুম শেষ।
– অ্যাই, তুই টাইম মেশিন আনতে যা তো। এখান থেকে পালা। বল জেঠিমা। মহিলারা বিপ্লবীদের সাহায্য করত, তারপর?