৬
একটা কলম ভেঙে গেলে
নতুন কলম আনি।
কোন বেহালার নতুন ছড়ে
অশথ গাছের শেকড় নড়ে
এই জীবনের বাগান জুড়ে
কলম বিকিকিনি।
যাইহোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। দেওরের প্রস্তাব শুনে দুই মেয়ে নাচতে নাচতে বাইকে করে চলে গেল। আমিও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সকালবেলা মতি আর তার ছেলের এপিসোডটা ভুলে গেলাম। মেয়েরা বেরিয়ে যাবার ঘন্টাখানেক বাদে একটা ঘটনা ঘটল। আমাদের এক প্রতিবেশী বৌ তার বালিকা মেয়েকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দোতলায় আমার কাছে এল। বৌয়ের মুখ চোখ দেখে অবাক হলাম। হয়েছেটা কী? ওরাও আমাদের মতোই এখানে সারাবছর থাকে না। পশ্চিমা শহরে থাকে, ছুটিতে আসে। কন্যাটি বাচ্চাবয়স থেকে বেশ গোল ফুলের মতো মুখ। সবাই ফুলকলি বলে ডাকে, আর আমি বলি ফুলকপি। মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে ফুলকপির মা আমাকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে এল। কিন্তু এত হাঁউমাউ করছে, আসল কথা বুঝতে বেশ সময় লেগে গেল।
ফুলকপির মায়ের বয়ানটা সংক্ষেপে এরকম – ফুলকপির একটা ফোন আছে। কারণ শহরে ও যখন ইস্কুল থেকে ফেরে বাবা, মা কেউ বাড়ি থাকে না। একজন আয়া থাকে। সেই ফোনে শুধু ওর বাবা আর মায়ের নম্বর সেভ করা আছে। বলা আছে যে বাবা মা বাড়িতে না থাকলে অচেনা নম্বর থেকে কোন ফোন এলে ধরবেনা। আজ ফুলকপিকে ওর মা পড়তে বসিয়েছিল, ফোনটা নিজের কাছে রেখেছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অচেনা নম্বর। ওর মা ভাবলো হয়তো ওর কোনো ইস্কুলের বন্ধু ফোন করছে। ফোনটা ধরে সাড়া দিল। কিন্তু অবাক হয়ে শুনল এক নরম পুরুষের গলা। মায়ের কথা শুনে আমি তো হতবাক।
– হ্যালো, আমি বলছি, চিনতে পারছ আমি কে?
– হুঁ। (মা সাড়া দিল)
– একবার বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে?
– (মা নিশ্চুপ)
– কী হল, কথা বলছোনা? কোন ভয় নেই। একটু বেরিয়ে এসোনা! বেরিয়ে ডানদিকে বড় আমগাছটার পিছনে। তোমার সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে, প্লিজ প্লিজ।
মা কানে ফোন ধরে বড় আমগাছটা দেখার চেষ্টা করছে। বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে উঠে গেছে, আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে। পেয়েও গেল। ঐ তো, একজন কানে ফোন। ঐ কি ফুলকপিকে বাড়ি থেকে বেরোতে বলছে। ছেলেটাকে ফুলকপির মা মুখ চেনে। বর্ণনা শুনে বুঝলাম, আমিও তাকে চিনি। ওর মা বাইরে কোথাও কাজ করে। আর যা হয়, বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো ছেলে, ছোটবেলায় যতটা অপাপবিদ্ধ ছিল, এখন ততোটাই পাজির পাঝাড়া হয়েছে। ওর নামটা অত মনে নেই। কারণ গ্রামে অনেকদিন ছিলনা। খবর পেয়েছিলাম ছেলেটা শহরেও ছোট খাটো অপরাধে হাত পাকাচ্ছে।
সে যাই হোক, ঘটনাটা শুনে প্রমাদ গণি, এমন তো হবার কথা নয়। অজানা বিপদের আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে গেল, শিউরে উঠলাম। ছোটবেলা থেকে দেখছি ওকে। আমার মেয়েরা আর ফুলকপি তিনজনেই দাদা বলে ডাকে, এভাবে তুমি তুমি করে কথা বললো কেন? কিন্তু ফুলকপি কি কিছু জানে? জানলে কতটা কী? ক্ষণিকের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। ঠান্ডা মাথায় ট্যাকল করতে হবে।
কয়েকটা জেলি লজেন্স নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ফুলকপি পটেটো চিপস নয় লজেন্সের পোকা – আমার মতোন। কায়দা করে ওকে বলি যে আমরা একটা নতুন খেলা খেলব – ফুলকপি রাজি। খেলার নিয়ম হল, এই ঘরে বেশ কয়েকটা জেলি লজেন্স বিভিন্ন জায়গায় লুকোনো আছে। আমি মন্ত্র বলে স্টার্ট বলব। ফুলকপি এক একটা খুঁজে পেলে আমি একটা করে প্রশ্ন করব। ফুলকপি ঠিক উত্তর দিতে পারলে আবার লজেন্স খুঁজতে পারবে। কিন্তু উত্তর দিতে না পারলে আর লজেন্স পাবেনা। উত্তর দিলে এইভাবেই পরপর চলবে। যা হোক, খেলা শুরু হল।
– দেখ বাবাজী দেখবি নাকি দেখরে খেলা দেখ চালাকি, ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ। স্টার্ট।
– পে – য়ে – ছি জেম্মা। লাল জেলি
– প্রশ্ন এক – তুই গ্রামের কোন দাদাকে ফোন নাম্বার দিয়েছিলি?
– না তো।
– ঠিক আছে, আবার মন্ত্র বলছি। লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক করে যাই তীর ধনুকে, ছাড়ব সটান ঊর্ধ্বমুখে, স্টার্ট।
– সে – কে – ন্ড পেয়ে গেছি জেম্মা, সবুজ জেলি। (ফুলকপি খুবই উত্তেজিত)
– দারুণ! প্রশ্ন দুই – তুই নিজের ফোনটা কাউকে দিয়েছিলি ফোন করার জন্য?
– হ্যাঁ তো, মতি পিসিকে। (আমার বুকের ভিতরে হাতুড়ি পেটে। মতি তার মানে এর সঙ্গে জড়িত?)
– ঠিক আছে, গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা, খাপ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা, এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা, এইবার বাণ চিড়িয়া নামা – চট । স্টার্ট।
– হাহ হাহ হা, জেম্মা, তিন নম্বর পেয়ে গেলাম হলুদ জেলি।
– এক্সেলেন্ট! এবার বল, যাদের নিজেদের ফোন আছে, তারা অন্যের ফোন নেয় কেন?
– খুব সহজ। নিজের ফোনে টাকা ফুরিয়ে গেলে, অন্যের ফোন নিয়ে ছেলেকে ফোন করতে হয়, যাতে সে পয়সা ভরে দেয়।
– বাঃ, এই নে আরও দুটো জেলি। নিচে রান্নাঘরে পান্তুয়া আছে, খেয়ে আয়।
মতির কথা ভাবি, অবসন্ন লাগে। তুই কাজ করিস এ বাড়িতে। ফোনে টাকা ভরতে ও বাড়ির বাচ্চার ফোন নেবার তো কোন দরকার নেই। এই কৌশল করে ও মেয়েটার ফোন নম্বর যোগাড় করেছে। ফুলকপির মা কে বলি, চিন্তা কোরোনা। কর্তারা ফিরুক, আমি দেখছি। কিন্তু ওকে চিন্তা কোরোনা বললেও, আমার মাথাটা বিষে নীল হয়ে যায়। নানান সম্ভব অসম্ভব কথা মাথায় ঘুরতে থাকে। আচ্ছা, ওদের পরবর্তী টার্গেট কে? আমার কন্যেরাও তো ফুলকপির থেকে খুব বড় নয়।
রান্নাঘরে গেলাম না, মাথা কাজ করছেনা। এভাবে হবেনা। পর পর ঘটনা সাজিয়ে বিচার করতে হবে আমাকে।
আমার বাবা মা যখন খুব অসুস্থ, মতি আমাদের শহরের বাড়িতে ছিল। একেবারে টিপটপ এমনভাবে সব সামলাতো, ও না থাকলে আমি চাকরি, সংসার, বাবা মা সবকিছু সুচারু ভাবে সামলাতে পারতাম না। ওর জন্যেই পেরেছি। কিন্তু সব মুদ্রারই উল্টো পিঠ আছে। ঐ সময়ে লাগামছাড়া ল্যান্ড ফোনের বিল আসতে লাগল। টেলিফোনের অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, যে সাত আট ঘন্টা আমরা থাকিনা, পুরো সময়টাই মতি ফোন করে। প্রথমে পাসওয়ার্ড দেওয়া হল। কিন্তু বারবার ভুল টেপার জন্য ফোন ব্লক হয়ে গেল। সারাতে দেরি হল। বিল মিটিয়েও মাসের পর মাস মৃত টেলিফোন টেনে টেনে শেষ পর্যন্ত ল্যান্ড ফোন ছেড়ে দিতে হল। আমার মেয়ের কাছেও পুরোনো ফোন যে বাধ্য হয়ে এখন রেখেছি, তার কারণ ঐ মতি।
এবার পরের কান্ড ভাবি। শহরের বাড়িতে একদিন দেখি, গ্যাস ওভেনে কড়ায় টগবগ করে তরকারি ফুটছে, আর সেই অবস্থায় কড়া সমেত ওভেন কাত করে ধরে চটপটে মতি ওভেনের তলা মুছে নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিলে টি ভি সিরিয়াল দেখার সময়টা ঝঞ্ঝাট মুক্ত থাকে। ওকে ঐ কাজ করতে দেখে দূর থেকে আমি ককিয়ে উঠি, ‘ও কী করছ? থামো, থামো।’ মতি ঘাড় শক্ত করে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে – ‘কিচ্ছু হবেনা।’ কথাটা ঠিক, আমরাও যে বিষয়টা জানিনা, সেটার সম্বন্ধে এই কথাটাই বলি। ওকে শান্ত ভাবে বলি, ‘দেখ মতি বৌ, তোমার কর্ণের মত কবচ কুণ্ডল থাকতেই পারে। তোমার কিছু হবেনা। কিন্তু আমাদের তো অমন শক্তি নেই। আমাদের হবে। গ্যাসের একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে যে পুরো বাড়িটা উড়ে যাবে।’
ইণ্ডাকশন ওভেনটাও আবার মতি বৌয়ের খুব পছন্দ। কালো কাচের কুকটপটা ও ছোট্ট টেবিলের মত ব্যবহার শুরু করল। বাসন মেজে ধুয়ে জল সমেত ওটার ওপরেই রাখতে লাগলো। যত বোঝাই যে ওটা বৈদ্যুতিন যন্ত্র, হাজার বললেও শোনেনা। শেষে বিদ্যুতের দেবতা একদিন আর সহ্য করতে না পেরে দিলেন রামধাক্কা, মতি উলটো দিকের দেয়ালের ওপরে ছিটকে পড়লো। তার পরে ঐ কাজ বন্ধ হল। মিক্সার গ্রাইণ্ডার নিয়েও মতির দারুণ কৌতূহল। সব দেখিয়ে দিলাম, কোন বাটিতে কী হয়, কিন্তু মতির পরীক্ষা নিরীক্ষা করা স্বভাব। ও আবার যেকোনো বাসন ছোট সাইজের হলে বেশি পছন্দ করে। একদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মিক্সি খারাপ হয়ে গেছে। কারণ হল মতি মিক্সির চাটনি বানানোর ছোট বাটিটায় ঘণ্টা খানেক ধরে আদা রসুন বাটার পরীক্ষা চালিয়েছে। এগুলো গেল তো শুরু হল ইণ্ডাকশন ওভেনে বাসন পোড়ানো। হাজারবার বলে দিয়েছি,যে রান্না করার বাসন আর খাওয়ার বাসন আলাদা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মুড়ি খাবার পাতলা কাঁসিতে তরকারি গরম করলে সেতো পুড়বেই। তার ওপরে আমি বলেছিলাম বাসনগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করবে। না হলে কিছু বাসন মরচে পড়ে যাবে। মতি কিন্তু এমন ভাবে বাসনগুলো ব্যবহার করতে লাগলো যে অর্ধেক বাসন মরচে পড়ে গেল। পরে বুঝলাম, অন্য ব্যাপার আছে। বাসনগুলো মরচে ফেলে, পুড়িয়ে, কিম্ভূত কিমাকার করে, চোখের আড়াল করে ও বাড়ি নিয়ে যায়।
আমার প্রথম সংসার পাতার সময়ে ফুটপাত থেকে কেনা সব বাসনপত্র ছিল। পরে আবার ভাল একটু কিনেছিলাম। মতি আমার হেঁশেলের ভার নেবার পর, ধীরে ধীরে পুরোনো বাসনগুলো অজান্তে আমায় ছেড়ে অন্য সংসারে পাড়ি দিল। ঠাকুরের নকুলদানা, জল দেবার ছোট ছোট থালা গেলাস অদৃশ্য হল। এছাড়া চাল, চিনি, আটা, তেল বিষয়ে কী আর বলব, উহ্য থাক। শেষে এমন হল, মতি ছুটি নিলে আমরা হাঁফ ছেড়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচতাম। কী ছিল, কী রইল – একটা অডিট করার সুযোগ পাওয়া যেত। আমার দুই ভাইপো মতি বৌয়ের সাঙ্কেতিক নাম রেখেছে 'ব্রিটিশ' – কারণ ও আমাদের পরাধীন করে। এ তো গেল একটা দিক। আসলে শাশুড়ি বলে গিয়েছিলেন, যেসব মেয়েরা সংসারের, সমাজের মার খেয়ে টিঁকে থাকে, তাদের অন্তরে মধুর থেকে বিষের ভাগ বেশি থাকে। শান্ত, নিরীহ, ভদ্র মেয়ের পক্ষে নিম্নবর্গে টিঁকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তারা মরে।
যারা টিঁকে থাকে তাদের বিষ যে কত তীব্র, তা আমার চেয়ে বেশি কে আর জানে। নিজেরা ধার করে বিয়ে করেছিলাম। মাইনে কম, ধার শোধ, বাড়ি ভাড়া সব মিটিয়ে যা ছিল, তাতে কষ্টে সৃষ্টে হিসেব করে চলতে হত। পুজোর সময়ে এমনও দিন গেছে নিজেদের সুতো কিনতে পারিনি, কিন্তু বাড়ির প্রথা মেনে সব কর্মী আর তাদের ছানাপোনার পোষাক এনেছি। আসলে জমিজমা থেকে রোজগারের চেয়ে খরচ অনেক বেশি। চাষের সময়ে শাশুড়ির ছিটে ফোঁটা গয়না বাঁধা রেখে সোসাইটি থেকে কৃষি ঋণ, আবার ফসল উঠলে ছাড়ানো – এইভাবেই চলতো। আর পুজোর সময়ে শ্বশুর শাশুড়ি নির্ভর করতেন ছেলেমেয়েদের চাকরির পয়সার ওপর। পুজোর কলকাতা ত্যাগ করেছি, নিজের বাবা মায়ের আকুল ডাকে ফিরে তাকাইনি, কোনদিন এই মেয়ে বৌদের কিছু দিতে কার্পণ্য করিনি। অথচ এরা আমার গায়ে একটা নতুন তাঁতের শাড়ি বা ঝুটো গয়না দেখলে চোখের বর্শা দিয়ে বেঁধে। বাড়ির পুরুষ মানুষ সামনে থাকলে গলে যায়, নানান ভাবে তোষামোদ করে। আমি যদি বলি, দোতলাটা ঝাঁট দিয়ে দাও, বলে নিচে অনেক কাজ, এখন সময় নেই। কর্তারা বললে তবে দোতলার কাজ করে। আমি মনে মনে হাসি, খুব ভালই বুঝি, আমি তো ওদের ব্যক্তিগত শত্রু নই। আমি যাই করিনা কেন, ওদের কাছে আমি সুবিধাভোগী নারীর প্রতিভূ। আর শাশুড়ি মায়ের মতো আমি তো এখানে থাকিনা, ওদের প্রতিদিনের সুখ দুঃখের শরীক হতে পারিনা। ওদের জগতে আমি অনুপ্রবেশকারী, বা হয়তো আমি ওদের কাছে শ্রেণীশত্রু। যতই করি, এরা আমারই ওপরে বিষ ঢালে। আমি শারদা – শিবানী – বারে বারে বিষের ঝাঁঝ প্রশমিত করে নীলকন্ঠ হই। বালিশে মুখ গুঁজে থেকেও মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে, মনের মধ্যে তিক্ত স্মৃতির স্রোত চলতে থাকে।
খেতে দেবার সময়ে এরা একটা কৌশল করে। যদি শুধু বাড়ির ছেলেরা খেতে বসে, তখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশি বেশি দেয়। আর যদি কখনও শুধু মেয়েরা খেতে বসে, খাওয়ার মাঝপথে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, ডেকে ডেকে সাড়া পাওয়া যায়না। আসলে রান্নাঘরের চৌঘেরা নকশা বলে খেতে বসার দালান আর তরকারিপাতি রাখার দালানটা বেশ দূরে। খেতে খেতে উঠে হদিশ করা যায়না। সবার খাওয়া শেষের মূহূর্তে আবার কোথা থেকে উদয় হয়ে এরা আরও দুটো তরকারি নিয়ে আসে। কিন্তু তখন তো খাওয়া আমাদের শেষ। কেউই আর ঐ দুটো তরকারি পাতে নেয়না। ওরাও বেগার ঠেলা দু একবার অনুরোধ করে তরকারির পাত্র ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যত খাবার বাঁচাতে পারবে, ততটাই ওরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, সহজ হিসেব। কিন্তু রোজকার খাওয়া নিয়ে ওদের সঙ্গে এত নিচে তো নামা যায়না, ওরা ওদের কাজ চালিয়ে যায়।
একবার এমন হল, বাড়িতে অতিথি ছিলেন কয়েকজন। কর্তা দীঘা মোহনা থেকে কিং সাইজের পনেরোটা পমফ্রেট পেয়েছিলেন। এদিকে খাওয়ার লোক তার চেয়ে বেশ কিছু বেশি। তাই ঠিক হল, এত বড়ো মাছ, আধখানা করে কেটে রান্না হবে। আধখানাই একটা মাঝারি মাপের মাছের সমান। খাওয়ার সময়ে দেখা গেল, মুড়ো আর ল্যাজা গোনাগুনতিতে ঠিক আছে, কিন্তু আকারে অবিশ্বাস্যরকম ছোট। বোঝা গেল মাছ কাটার সময়ে এরা মাছগুলো দু টুকরোর বদলে তিন টুকরো করে পেটিগুলো পাচার করে দিয়েছে। অতিথিদের পাতে এতো ছোট মাছ দিয়ে পরিবারের মুখ নষ্ট হল। পদে পদে বুঝতাম, যে এদের সঙ্গে এঁটে ওঠা, আমার পক্ষে শুধু দুঃসাধ্য নয়, অসাধ্য।
আবার মাঝে মাঝেই দেখতাম রান্নার বৌরা এক একজন ঘোর কাজের মধ্যে হঠাৎ, হঠাৎ কয়েকঘন্টা কোথাও চলে যেত। কর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওরা কোথায় যায়? কর্তা খালি বলেন যে যার মতো থাকনা, সব জেনে কী লাভ? কিন্তু আমার কৌতূহল হত। তারপর একদিন আমার চাপাচাপিতে কর্তা বাধ্য হয়ে হাঁড়ি ভাঙলেন। বললেন, গ্রামে শহরের মতো নানারকম বিনোদন তো নেই। এদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা, বা তেমন কোন উচ্চ ভাবনাও নেই। তাই আবহমান কাল ধরে এদের একমাত্র বিনোদন হল অবৈধ সংসর্গ। সমাজের বহু শ্রেণী এর লাভ ওঠায়। আমি বললাম, এদের তো সব নাতি নাতনি আছে। কর্তা বলেন, তিরিশের কোঠায় সব নাতি কোলে ঘুরছে। এখন সরকারি সাহায্য বা নিজেরা নানারকম রোজগার করে একটু স্বাধীন হয়েছে, তাই জ্বালা মেটায়। জিজ্ঞেস করলাম, লোক জানাজানি হয়না? এখানে তো সমাজটা অনেক ছোট। উত্তরে জানালাম, অল্প লোক জানাজানি হয়। তবে এসব খবর সবচেয়ে বেশি রাখে স্থানীয় রাজনীতির কারবারীরা। কারণ কাকে ধরলে কার ভোট পাওয়া যাবে, এগুলো তারা নোট করে রাখে। স্মার্ট ফোন এখন এই বিনোদনে নতুন নতুন মাত্রা এনেছে। শুনে যতটা অবাক হই, তার চাইতে বিশ্রী লাগে। এতদিন ভেবেছিলাম গ্রাম জীবনের এই ভাঁজ গুলো না জানলেই আমার ভাল হত। কিন্তু এতদিন আমি ছিলাম নিরপেক্ষ, নিস্পৃহ দর্শক বা শ্রোতা। আজ সেই নরক আমার মত গৃহস্থের দিকে সরাসরি ফণা তুলেছে। না জানলে তো আরও বেশি বিপদ।
এবারে মনে মনে মতির বরকে নিয়ে আলোচনা করি। তাকে আমি চিনিনা, কোনদিন যেন চিনতে না হয় সেই প্রার্থনাই করি – মতিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও, সে শ্বশুরের ভিটেরই একধারে আবাস যোজনায় বাড়ি করেছে। আমি জানি ও এমন আশাও রাখে যে এখনকার বৌকে তাড়িয়ে বীর বরটি ওকে আবার ঘরে নেবে। মতির শাশুড়ি তিন নাতির সঙ্গে সে বাড়িতে থাকে – কারণ নিজের ছেলে দেখেনা। মতির ছেলেদের সঙ্গে বাপের যোগাযোগ আছে। যদিও তার এখনকার বৌয়েরও ছেলে হয়েছে। ছেলেদের বাপ যে বারবার জেলে যায়, সে ব্যাপারে শুনেছিলাম তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, সে একজন আড়কাঠি। এছাড়া সময়ে সময়ে জাল জুয়াচুরি আছেই। এতদিন সে আমার বা আমাদের মতো গৃহস্থের সংসার থেকে যোজন দূরে ছিল। কিন্তু তার ছায়া কি লম্বা হয়ে এবার এদিকে হেলছে? আমার কর্তা গল্প করে যে হায়ার সেকেন্ডারি পড়ার সময়ে, কর্তার এক সহপাঠীর দিদিকে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে, পিছন থেকে বস্তা ফেলে তুলে নিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবে বিক্রি করে দিয়েছিল মেয়ে পাচারের দল। কপাল ছিল বটে সেই দিদির, যাকে বিক্রি করেছিল, সে আর হাত বদল করেনি। অনেক বছর পরে সেই দিদি একবার দুটো বাচ্চা নিয়ে দেখা করে গিয়েছিল। কিন্তু বাপের বাড়ি আর তাকে জায়গা দেয়নি। তাই সেও ফিরতে পারেনি। আরও মনে পড়ে যায়, কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের বাড়ির এলাকায় থানা আর পঞ্চায়েত মিলে অন্তত চারটে পাচারকারী দল ধরেছে। সব টাকার থলি নিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ের গাওনা গাইতে এসেছিল। শাশুড়ি মায়ের কথা ভাবি। কোন পাঁকে পারিজাত ফোটাতে চেয়েছিলে মা গো – আমার যে চারিদিকে আঁধার। নানা টুকরো ঘটনা এলোমেলো সিনেমার মতো আমার মনের মধ্যে চলতে থাকে। থৈ পাইনা, কী করব। কর্তার ফিরতে রাত হবে। মেয়েরা আর দেওর আগে বাড়ি ফিরুক। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। কোনদিন কোন নাগদেবতাকে প্রণাম জানাইনি। আজ যদি পদ্ম গোখরো না বেরোত, আমি রান্নাঘরে থাকতাম, মেয়েদের হাতে ফোন থাকত। এমনও তো হতে পারে, আজ ওরা নেই বলে ফুলকপিকে একবার ট্রাই করল। মাথার শিরা টনটন করছে, আমি আর ভাবতে পারছিনা। পরক্ষণেই ভাবি, না না, ফোন নম্বরটা তো অন্য বাড়ির মেয়ের নিয়েছে। মূর্খ তো, ভেবেছিল ঘুণাক্ষরে কেউ জানতে পারবেনা। অবশ্য ফোন রিচার্জ করার জন্য সাহায্য চাইলে এ বাড়ির মেয়েরাও ফোন দিয়ে দিত। এবারে কেউ সাহায্য চাইলে সাহায্য না করার শিক্ষা দেব নাকি?
শুয়ে শুয়ে প্রহর গুণি, উৎকর্ণ হয়ে শুনি একটা শব্দ। নিচে দেওরের বাইকের আওয়াজ শোনা যায় যেন। দোতলার বারান্দা থেকে তাড়াতাড়ি মেয়েদের হেঁকে বলি, সাবান দিয়ে হাত পা ধুয়ে উপরে উঠবি। আর সেই অবসরে দেওরকে হুড়হুড়িয়ে সব কথা বলে ফেলি। সে সব শুনে বললে
– এখনই এত কিছু ভেবোনা। ছেলেটা ফুলকপির সঙ্গে আলাপ বাড়াতে চাইছে। আগেও একদিন পিছু নিয়েছিল। কীসব কাচের পাখি টাখি কিনে দিতে চেয়েছিল, মেয়ে নেয়নি। বাজারের লোকজন বলেছে আমাকে।
– তাই নাকি? খুব সাহস তো! বাজারে কী বলেছে?
– ঐ বলছিল, পণ্ডা ঘরর ঝিওর পুতুল নেই না কি গো, ঘনার পুও কাচের পাখি দোউচি। এর মধ্যে ফুলকপি একদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল, সেইদিন। তুমি আমাদের মেয়েদের সঙ্গেও কথা বল। ঐ ছেলেকে ছোট থেকে ওরাও তো দেখছে। ওকে খেলার সাথী ভাবে। বুঝতে পারছেনা যে ও এখন কী চীজ। মেয়েরা আলগা দিলে ও আরও মাথায় উঠবে। জগতে কি আর একটা ঘনার পুও আছে, চারিদিকে ভর্তি। ওদের বোঝাও বোঝাও, ভাল করে বোঝাও। ছোটদের জগৎ বড় হলে বদলে যায়, সেটা ওদের বুঝতে হবে। আর ঐ ছেলে সবার নজরে আছে। কিচ্ছু করতে পারবেনা।
বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায় আমার। তবে কাজ অনেক বাকি। কিশোরী মন, খুব সংবেদনশীল। মনে মনে কেবল কথা সাজিয়ে মহড়া দিতে থাকি। মেয়েরা কিছুটা বড় হয়েছে বটে, তবু অতটাও বড় নয়। ইস্কুলে পড়ে, মাধ্যমিক ক্লাসে পৌঁছতে বাকি। কী হতে পারে বা পারত, ওদের আর কতটুকু খুলে বলা যায়।
কর্তা ফিরলে মেয়েদের সঙ্গে সবাই মিলে আলোচনায় বসি, অনেক করে বোঝাই, ওরকম কেউ ডাকলে বাড়ির বাইরে যাবেনা, মিশবেনা, কথা বলবেনা। বড়রা সঙ্গে না থাকলে বাইরে একলা বেরোবেনা। মেয়েদের যুক্তিও কম নেই, ওদের মূল বক্তব্য হল,
– শহরে তো বন্দি জীবন কাটাই। এখানে এসেও তাই করব? তাহলে এখানে এসে আর লাভ কী?
– ছেলেরা বাজে হলে, আমাদের বন্দি থাকতে হবে কেন?
ওদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই আমার। এটাই যে সমাজের দস্তুর। প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবী করে ধমক দেওয়া ছাড়া পথটাই বা কী? আমার টরটরি মেয়ে তাও থামেনা, বলে
– কেন, তোমরাই তো বলেছ, সব সমান, গরীব বড়লোক কিছু নয়। বাবার পাঠশালায় কত মুটে মজুরের ঘরের ছেলেরা পড়তো, তারা তো এখনও বাবার বন্ধু। সবাই মানুষ।
– ঠিক কথা রে বাবু, কিন্তু ভেবে দেখ, তুই যাকে মানুষ ভাবছিস, সে যদি তোকে মানুষ না ভেবে মেয়েমানুষ ভাবে, তাহলে? তুই যার সম্পর্কে সবাই সমান এইসব উচ্চ ভাবনা ভাবছিস, তার মনোজগতে যদি তা না থাকে? তোরাই তো বলিস, ওরা মোবাইল নিয়ে সব সময়ে বাজে বাজে ছবি দেখে।
মেয়ে তার দীঘল চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে চোখে বেদনা ধীরে ধীরে মুক্তো জমিয়ে তোলে। কথায় কথা বাড়ে, প্রসঙ্গান্তর হয়। বড়কি মেয়ে বড় বড় চোখ করে সাপটা কেমন ফোঁস ফোঁস করছিল, কেমন করে তাকে কাবু করে বনদফতর নিয়ে গেল এইসব গল্প করে। আমরাও আগ্রহ নিয়ে শুনি। শুধু ছুটকি মেয়ে গম্ভীর হয়ে থাকে। তার মাথা ব্যথা করে। আমি সবই নজর করি। করার তো কিছু নেই। ছোটবেলা থেকে দাদা ডাকলেই সবাই দাদা হয়ে যায়না – এই সত্যের সঙ্গে তাকে নিজেকেই যুঝতে হবে।
তবে শুধু মেয়েদের বোঝালেই তো কাজ শেষ হয়না। মতি যে ঐ ছেলেকে সাহায্য করেছে, এটাও সত্যি। ওকে কি আর কাজে রাখা ঠিক হবে! শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন, এ বাড়িতে ওর ভাতের খুঁটো বাঁধা থাকা ভাল। সুতো কেটে দিলে সমস্যা কমার চেয়ে বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। ওটা মেটানোর ভার কর্তারা নিলেন।