২
- মা, শ্বেত পাথরের টেবিলের গল্পটা বলবে বলেছিলে!
- টেবিলের গল্প? টেবিলের তো আর আলাদা কোন গল্প হয়না রে বাবু, এ হল টেবিলের চারপাশের মানুষের গল্প।
- সেটাই বল শুনি।
- শোন তবে। আমাদের ছোটবেলায় খুব রেডিওতে নাটক শোনার চল ছিল। যেদিন যেদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেত পাথরের টেবিল নাটকটা হত, সেদিন মা, মামা, মাসিরা সব কাজ ফেলে রেডিও ঘিরে বসত আর নানান মন্তব্য করত। নাটকটা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ সেই আড্ডা চলতেই থাকত। আলোচনার মূল কথা হল, এ তো আমাদের বাড়ির গল্প, সঞ্জীব বাবু কীভাবে জানলেন? ইত্যাদি। সেই সব গল্প থেকেই প্রথম জানতে পারি যে, আমার মামার বাড়িতে এককালে বিশাল এক নকশাকাটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল।
- নাটক থুড়ি গল্পটার সঙ্গে মিলটা কী?
- গল্পটা তোকে পড়তে হবে, তবে তো? মোবাইলে খোল, গুগলে আছে।
- আচ্ছা, ওয়েট, দেখি,
- বানান ভুল হচ্ছে, সঞ্জীব ঞ - এ জ এ দীর্ঘ-ঈ।
- পেয়ে গেছি, বল এবার - “শ্বেতপাথরের টেবিলটা ছিল দোতলায়, দক্ষিণে রাস্তার ধারের জানালার পাশে।…….”
- লাবণ্যর টেবিলটা ঠিক জানলার পাশে নয়, তবে সে ঘরে বড় বড় দরজার মত জানলা ছিল অনেকগুলো। চৌকোও নয়, পুরোপুরি গোলও নয়, আল্পনার মত ঢেউ খেলানো। বাহারি ফ্রেমের ওপর বসানো জেল্লাদার ভারি মার্বেল পাথর। ফ্রেমের চারদিকে কাঠের ঝালর, ঝালরের ভিতর পটলের মত কাঠের পুলি ঘুরত। মানে ঘোরানো যেত।
- দাঁড়াও দাঁড়াও - হুম পুরো মিলে যাচ্ছে। কাঠের ঝালর? সে কেমন জিনিস? তুমি দেখেছ কখনও?
- তোকে মার্বেল প্যালেসের মিউজিয়ামে নিয়ে গিয়েছিলাম মনে আছে? রাজেন মল্লিকের বাড়ি?
- হুঁ।
- সেখানে মেঝেতে নানা রঙের পাথর দিয়ে কার্পেট করা আছে।
- হ্যাঁ হ্যাঁ
- আবার সিলিঙে কাঠের কার্পেট ছিল একটা ঘরে।
- হ্যাঁ।
- ঐটা চোখ বুজে একবার ভাবলে কাঠের ঝালরটা অনেকটা স্পষ্ট হবে।
- দাঁড়াও একটু ভেবে নিই। নকশা করে জাফরি কাটা।
- ঠিক। আমি অবশ্য এমন একটা জাফরি কাটা ফ্রেমের টেবিল দেখেছিলাম আন্দুল রাজবাড়িতে। তবে সেটার টপ পাথরের ছিলনা। পুরোটাই কাঠের। আমাদের কলেজেরটার ফ্রেম সলিড নকশার, সেখানে কোন জাফরি বা ঝালর নেই। টেবিলটা লাবণ্যর বলছি, কারণ সেটা তার বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের যৌতুক হিসেবে এসেছিল।
- আচ্ছা! টেবিলটা তো দেখোনি বললে, লাবণ্যকে দেখেছ তুমি?
- হুঁ, তবে স্মৃতি নেই। লাবণ্য আমাকে দেখেছে বলতে পারিস। তবে সরাসরি লাবণ্যর স্মৃতি না থাকলেও তার সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে আমার ।
- তুমি নাতনি।
- শুধু সেটা নয়, আরও কিছু।
- তাই নাকি, ইন্টারেস্টিং, কী শুনি।
- নিবেদিতা ইস্কুল থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে সেন বাড়িতে ঢুকে যেতাম সেসব কথা তোকে আগে বলেছি অনেকবার। এক বর্ষার বিকেলে শ্যাম পার্কের ধার দিয়ে যাওয়ার সময়ে ঝেঁপে বৃষ্টি এল, আমরা দু বোন আর মা - তিনজন দৌড়ে ঢুকলাম সেনবাড়িতে। আমরা বেশিরভাগ সময়ে বাচি মামা বা বাচি সেনের ঘরেই হুটোপাটি করতাম। বাকি মামারা অনেক বয়স্ক। সেদিন কী কারণে মা গিয়ে বসল হুঁকুজ মামার ঘরে। মামা মামী ঘরে নেই, কোথাও বেরিয়েছেন। অন্যরা বললেন এখনই এসে পড়বেন। লম্বাটে পুরোনো নকশার জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম আনমনে। এমন সময়ে কাক ভেজা, হেলমেট পরা লম্বা চওড়া হুঁকুজ মামা ঢুকলেন ঘরে। আমি খাটে পা ঝুলিয়ে বসা। চোখাচোখি হয়ে গেল। হেলমেট খোলা থমকে গেল। আমার দিকে কয়েক মূহূর্ত তাকিয়ে বললেন, “মাইমা!” পাশ থেকে মায়ের হাসির শব্দ শুনলাম। এ মাইমার নাতনি গো হুঁকুজদা, আমার মেয়ে। মায়ের গলা শুনে সম্বিৎ ফিরে হুঁকুজ মামা বললেন, “রাজকুমারী, তুমি! এ তোমার মেয়ে?” কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক হয়ে বললেন, হঠাৎ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এতদিন পরে লাবণ্য মাইমা কোথা থেকে এল? সেদিনই জানতে পারলাম, আমি আমার দিদিমা লাবণ্যপ্রভার দ্বিতীয় সংস্করণ।
- মানে? তুমি লাবণ্যর মত দেখতে? এটা তো খেয়াল করিনি এতদিন। দাঁড়াও দাঁড়াও ছবিটার সঙ্গে মেলাই। তাইতো মিল আছে বটে।
- হুঁ, মুখ, চুল, গায়ের রং সবই এক। আমার নিজের তো স্মৃতি নেই। যাঁরা দুজনকেই দেখেছিলেন, তাঁরা বলতেন। এই ছবিটা অনেক বয়সে তোলা। ঐ বয়সে পৌঁছলে আমাকে কেমন লাগবে সেটা দেখে নে। যাই হোক, তখন থেকেই লাবণ্যর কথা খুব জানতে ইচ্ছে করতো। যখনই লাবণ্য সম্পর্কে কথার পৃষ্ঠে কিছু শুনতাম, সেই খবরটা মনের একটা গোপন কুঠুরিতে যত্ন করে তুলে রাখতাম।
- এ তো ভারি আশ্চর্য, তুমি আমার আগ্রহটাও বাড়িয়ে দিচ্ছ। তারপর?
- আমার বাবা মায়ের বইয়ের নেশা ছিল। জ্ঞান হতে সে নেশা আমাকেও পেয়ে বসে। একদিন বড়মামা এসে বলে, “মাম আসছে রবিবার চলো সব আমার বাড়ি।
- কেন গো, ব্যাপার কি?
- হারমোনিয়াম কিনেছি। তোর মাইমার অনেক দিনের শখ।”
বড়মামার কাছে ছুটে আসতে গিয়ে অসাবধানে হাত থেকে সঞ্চয়িতা পড়ে যায় আমার। বড়মামা হাঁ হাঁ করে ওঠে।
- “আঃ মাম। সাবধানে চল। বইটা নমো কর। রবিঠাকুরের বই বলে কথা। মাটিতে ফেলতে নেই। তোমার দিদা রবি ঠাকুরের বই বুকে নিয়ে ঘুমোতে যেত।” আমি মনে ভাবি, তাই বুঝি! ছোটোমামার বাড়ি আমাদের হাউজিংয়েই, ওপাশের ব্লকে। একবার বাবার হাত ধরে ঠাকুমার ঝুলি নিয়ে ওবাড়ি যাচ্ছিলাম। ব্লকের মুখে এসে যেই বাবা হাত ছেড়ে এগিয়ে গেছে, অমনি আমিও ওখানেই দাঁড়িয়ে বই খুলেছি। ব্লকের দরজায় নেড়িকুকুর বসে ছিল, দেখিনি। হোঁচট খেয়ে কুকুরের কোলে বইটা পড়ে গিয়েছিল। সাবধানে তুলে নিয়েছি। কুকুরটা কিছু বলেনি, আর বাবাও বকেনি। তাহলে রবিঠাকুরের বই হাতে থাকলে বেশি সাবধান হতে হয়! তাছাড়া দিদা সম্পর্কে ঝুলিতে একটা নতুন তথ্য জমা হল। লাবণ্য রবি ঠাকুরের লেখা ভালো বাসত।
- বাঃ। তুমি একবার বলেছিলে, লাবণ্য ভাঁড়ার ঘরে লুকিয়ে বসে বই পড়তো। তার মানে সে ঐ রবি ঠাকুরের বই?
- হতে পারে, তার সঙ্গে অন্য বইও ছিল।
- ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বুঝতে হবে। লাবণ্যর অত বড় টেবিল ছিল। ওটাতে বসেই পড়তে পারত।
- পড়তো তো, টেবিলে বসে পড়াশোনা করত। তবে সকলের সামনে নয়, লুকিয়ে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো তখন।
- লুকোবে কেন মা? পড়াশোনা তো ভালো জিনিস, লুকোনোর জিনিস নয়।
- পুরোটা শোন আগে। সব প্রশ্নের উত্তর পাবি।
মনীন্দ্র কলেজের পাশ দিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে শ্যামবাজারের দিকে গেলে আর পাশে বাগবাজার স্ট্রীটে অনেকগুলো বইয়ের দোকান ছিল। এখন আর দেখতে পাইনা। ঐ দোকানের সামনে গেলেই মায়ের কাছে আমার বায়না শুরু হত। কখনো মা কিনেও দিত। চটি চটি বই, রঙিন মলাট, উপনিষদের গল্প, অন্নদা মঙ্গল, বাইবেলের গল্প। মনীষীদের জীবনী। বাবাও অনেক বই আনত। আমার জন্য শুকতারা নেওয়া হত। বাবার পায়ে ব্যথা হলে, বাবা শুয়ে থাকত। আমি একহাতে খাটের ছত্রি আর এক হাতে শুকতারার খোলা পাতা পড়তে পড়তে বাবার পায়ে হাঁটতাম।
- হি হি, বেশ বেশ তারপর?
- বাড়িতে আলমারি ভর্তি বই। আলমারির দখল নিয়েছি আমি, সেই আমার সাম্রাজ্য। বহু খন্ডের কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত, শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী, শতরূপে সারদা, শিশুসাথী, বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি, ব্রতকথা, দীনবন্ধু সমগ্র - আরও কত। সব বই নামাতাম। ইচ্ছে মতো পড়তাম। আবার নতুন করে গোছাতাম। এমন করতে করতে হঠাৎ অনেক সরু মোটা বই পেয়ে গেলাম, বইয়ের ভিতরে আমার ইস্কুলের লেবেল দেওয়া, কিন্তু সেখানে মায়ের নাম লেখা আর লেখা শ্রেণীতে প্রথম পুরস্কার। কোনোটা চতুর্থ শ্রেণী, কোনোটা ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, আবার কোনোটা সংস্কৃতে সর্বোচ্চ নম্বর, কোনোটা ইংরেজিতে, বিভিন্ন শ্রেণীতে। অবাক হয়ে মাকে ডাকি,
- “মা - আ!" মা হলুদ হাত আঁচলে মুছে এসে দাঁড়ালে মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, "মা তুমি ইস্কুলে ফার্স্ট হতে? তোমার এত্তো প্রাইজ?” মা হাসে। “বলে আমার মায়ের কড়া শাসনের ফল।” সব বই নাড়াচাড়া করি। শ্রেণী ধরে বইগুলো সাজাই। দিদার শাসনে মা এমন মন দিয়ে পড়েছে, যে একেবারে ফার্স্ট! লাবণ্য খুব কড়া মা যা হোক।
- নবম শ্রেণীর পরে আর কৈ মা?
- আর নেই।
- কেন?
- সে অনেক কথা পরে বলব।
- এখনই বলো না।
- সময় নেই।”
ঐ বই নাড়াচাড়া করতে করতে একদিন পেলাম ছবি দেওয়া, সাদা কালো বাংলায় লেখা উলবোনার বই। মলাটে কালো কালিতে সুন্দর টানা হাতে লেখা আছে লাবণ্যরানী বসু। মাকে দেখাই।
- “ও মা, দেখো।
- একিরে! এটা কোথায় পেলি? এটাতো আমার মার উলবোনার বই।
- কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, দিদার নাম লাবণ্যপ্রভা। এখানে তো লাবণ্যরানী লেখা আছে।
- আগের দিনে শ্বশুর বাড়িতে নাম বদলে দেওয়া হত।
- উল কি করে বোনে মা? আমায় শেখাবে?
- আমি অত পারিনা। সোজা উল্টো শিখিয়ে দেবোখন।
- মলাটে এটা দিদার নিজের হাতের লেখা?
- হ্যাঁ।”
পরদিনই অফিস যাবার সময়ে বাবাকে অর্ডার দিয়ে দিলাম - বাবা! অফিস থেকে উলের কাঁটা আর উল নিয়ে আসবে। আমার ধারণা ছিল, বাবার অফিসে সব পাওয়া যায়। আর বাবা যা আনে, সব অফিস থেকেই আনে। আর ছোটো মামা বলে দিয়েছিল, ভুলেও বাড়িতে দুষ্টুমি করার কথা চিন্তা করিসনা। তোর বাবা অফিস থেকে সব দেখতে পায়। অফিসের ছাদে টেলিস্কোপ বসানো আছে। খুবই ছোটো ছোটো দেখে। তবে দেখতে পায় নিশ্চিত। লুকিয়ে আমূল স্প্রে খেতে গিয়ে, চারদিক পরীক্ষা করতাম, বাবা কোথা দিয়ে দেখছে? বাবা কিছু বলতনা। কিন্তু মা বুঝে যেত। বাবাই বলে দিত নিশ্চয়ই। কি যে মুশকিল ছিল, কহতব্য নয়।
- হা হা হা হা, তুমি আমাকেও এইভাবে বোকা বানাতে চেষ্টা করেছিলে মা, পারোনি। কলেজ থেকে তুমি নাকি সব দেখতে পাও। তুমি কী বোকা ছিলে গো মা। ওভাবে দেখা সম্ভব নয়, এই সহজ কথাটা বুঝতে পারলেনা?
- কী করব বল বাবু, সে হল যুগের ধর্ম। ওটা ছিল, গুরুজনকে প্রশ্ন না করে নিঃশর্ত মেনে নেওয়ার যুগ।
যাই হোক, উল কাঁটা চলে এল। আর লাবণ্যর বই থেকে আমি নিজে নিজে নানা প্যাটার্ন রপ্ত করতে শুরু করলাম।
- উল দিয়ে লাবণ্য কী বানাতো?
- সেযুগে অত কেনা সোয়েটার তো পাওয়া যেতনা, তাই সব মেয়েই উল বুনতো, কুরুশ বুনতো। বাড়ির সবার উলের পোষাক বানাতো, আসবাবপত্র চাপা দেবার ঢাকা বানাতো।
- বুঝলাম, সে বই পড়ত আর উল বুনত। আর ঘর সংসার?
- ঘর সংসারও করত। তের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এল, কিন্তু সেই বিয়ে তো আমার দাদুভাই বিকাশ চন্দ্রের দ্বিতীয় বিবাহ। প্রথম পক্ষের ছেলে মানুষ করার জন্য ঘরে আনা বৌ। তখনকার অন্দর মহলে মেয়েদের বেশিরভাগেরই তেমন লেখাপড়ার চল তো ছিলনা। ঘরে ঘরে স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবাদেরও কমতি ছিলনা। আবার স্বামীরাও যে সকলে পত্নীনিষ্ঠ ছিল তাও নয়। তাই অন্দরমহলে অতৃপ্ত মেয়েলি আত্মাদের ভালোরকম কূটকচালি চলত, লাবণ্যকে দোজবরে আর সৎ ছেলের সৎ মা বলে উঠতে বসতে গঞ্জনা দিত। আমার দাদু ছিলেন রগচটা উড়ণচন্ডী মানুষ। তাঁর মধ্যে স্থিতধী লাবণ্য কোনদিনই মনের দোসর খুঁজে পায়নি।
- আর ঐ গল্পটার সঙ্গে আর কী কী মিল ছিল?
- গল্পে যেমন আছে কর্তা বাড়ি ফিরেই কোন চাকরকে জুতোপেটা করত, বিকাশ চন্দ্রও তেমন, পান থেকে চুন খসলে বাপের কুপুত্তুর, তখন হাতে জুতো, খড়ম, রূপো বাঁধানো লাঠি কিংবা চাবুক, যেটা হাতের সামনে থাকত, সেটারই সদ্ব্যবহার হত। স্বামীর দাপটে ভয়ে ভয়ে থাকতে থাকতে হার্টের অসুখ ধরে গিয়েছিল লাবণ্যর।
- ইশশ, তারপর?
- আমার দুই মামাই বাবার গল্প করলে বেশিরভাগ মার খাবার গল্প করত। আমার বড়দাদু সতীশ চন্দ্র স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যাবার পর, তাঁর দুই ছেলে মানে আমার বকুল মামা আর সুকুল মামাও তো এক আশ্রয়েই থাকত, বকুল মামাকে একদিন বড় বেলায় এমন মার মেরেছে, যে বকুল মামা বাড়ি ছেড়ে একদম ছোট পিসিমণুর বাড়ি মানে কীর্তি মিত্রের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। ঐ বাড়ি থেকেই বিয়ে হয়, তারপরে চাকরি পেয়ে অন্যত্র সংসার পাতে, বাড়ি আর ফেরেনি। আর সুকুল মামা সরকারি চাকরি পাবার পরে, তাকে চাকরি করতে দেবেনা বলে নিয়োগপত্র ছিঁড়ে দিয়েছিল।
- কে, বিকাশ চন্দ্র?
- হ্যাঁ, সুকুল মামার নামে চাকরিতে নির্দিষ্ট সময়ে যোগ না দেওয়ায় হুলিয়া বেরিয়ে যায়। শেষে সেন বাড়িতে তো উকিল ব্যারিস্টার, জজ ভর্তি। তাঁরাই চেষ্টা চরিত্র করে সুকুল মামাকে বাঁচান আর দাঁতি সেন সুকুল মামাকে নিজেদের শিমূলতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
- বাপরে, এ তো দেখছি,বহু কীর্তি। ভাইপোকে চাকরি করতে না দেবার কারণ?
- এসব লোকের কাজে যুক্তি বুদ্ধি খুঁজতে যাসনা। এসব হল নিজের খামখেয়াল।
- খাওয়া দাওয়ার মেজাজ কেমন ছিল?
- রইসি মেজাজ ছিল।
- সকালে আপিসের তাড়া, তখন ঠাকুর, চাকর, দাসদাসী সামাল দিত। আর সন্ধেবেলায় সেই টেবিল ঘিরে জমত বৈঠকী আড্ডা, সেইসময়ে লাবণ্যর ওপরে ভার ছিল নিত্য নতুন জলখাবার বানানোর, যাতে ইয়ার দোস্তরা রোজ চমকিত হয়, আর ধন্য ধন্য করে।
- বাব্বা, ধন্য ধন্য করা জলখাবার! সে কেমন ছিল গো মা?
- লুচি, পরোটা হল কমন, তার সঙ্গে রকম রকম তরকারি, সঙ্গে ভাজাভুজি।
- যেমন?
- যেমন ধর কিমার পুর ভরা শিঙাড়া, ভেটকির ফ্রাই, চায়ের সঙ্গে নানারকম নিমকি, সঙ্গে বাড়িতে করা কিছু মিষ্টি - এইসব।
- সে কী আমাদের বাড়িতে কিমার শিঙাড়া করোনি তো কখনও।
- এখন এত রিচ খাবার বাড়িতে কে খায় বাবু? পাঁঠার মাংসের যা দাম, তার কিমা জলখাবারে খেয়ে নেওয়া এখন সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট শক্ত।
- হুম, তা ঠিক, তবে শুনলে তো খেতে ইচ্ছে করে।
- তা করে, তবে ও ইচ্ছে দমন করাই মঙ্গল।
- এছাড়া আর কিছু?
- আর কিছু তো জানিস, কোন বিশেষ উপলক্ষ থাকলে মটন রোস্ট। সেন বাড়িতে যা নিয়ম ছিল, এ বাড়িতেও তাই।
- হা হা, সেই মোহনবাগান জিতলে রোস্ট হত,
- সেই উপলক্ষ তো ছিলই, সঙ্গে অন্য কারণও ছিল।
- যেমন?
- বিকাশ চন্দ্রের ওপরের ভাই, ক্ষিতীশ চন্দ্রের দিন কাটত ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মাছ ধরে, চুল রং করে, আর নানারকম শখ শৌখিনতা করে। এই ব্যাপারটাও সঞ্জীববাবুর গল্পটায় আছে। আমরা তো ওঁকে চোখে দেখিনি, কিন্তু বড়রা ছবি দেখিয়ে চিনিয়েছিল, ইনি হলেন গোঁফ দাদু। বাহারি চুল, পাকানো গোঁফ, গিলে করা পাঞ্জাবি, ধুতির কোঁচা, নানা ফ্যাশনের নাগরা আর আতরের সংগ্রহ - এই নিয়ে তিনি মেতে থাকতেন। গোঁফ দাদুর নাকি, রুপোর মাথা, হাতির দাঁতের মাথা, চামড়ার মাথাওলা, নানারকম লাঠির এক বিশাল ভাণ্ডার ছিল। সঙ্গে সব ম্যাচিং নাগরা কোনটা হরিণের চামড়ার, কোনটা মিনেকরা, কোনটা জম্পেশ নকশাদার।
- বল কী গো?
- হুম সঙ্গে ছিল টুকটাক শেয়ারের ব্যবসা আর জমি বাড়ির দালালি। ঐ সবে ভালো কোন রোজগার হলে সঙ্গে সঙ্গে ইয়ারদের নিয়ে খানাসহ আড্ডা বসত সেই টেবিলে, তখন আবার মটন রোস্ট।
- বেশ, এবারে বুঝলাম। তুমি তো রোস্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলে, মাটনটা কিন্তু শক্ত ছিল মা, খেতে বা ভালোই হয়েছিল, তবে আরও নরম করতে হত, চিকেনটা যে করেছিলে পরে, ওটা ঠিক ছিল।
- হুম, মা দু একবার করেছিল ছোটবেলায়, আমি শিখতে পারিনি তখন। এই সুন্দরীদির বইতে দেখলাম বিশদে লেখা আছে।
- মাটনটা আবার করে করে হাত পাকাতে হবে তোমাকে মা।
- বইতে যা লেখা ছিল, তাই করেছি, কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়। ওখানে লেখা আছে মাংসটা কেবল নুন, গোলমরিচের গুঁড়ো আর লবঙ্গের গুঁড়ো দিয়ে মাখতে হবে। তারপর হাঁড়িতে ঘি দিয়ে গরম হলে মাংস ঢেলে ঢাকা দিতে হবে। জল মরে এলে ঢিমে আঁচে দুধ আর ময়দার ছিটে দিয়ে দিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কষতে হবে। তারপর গরম জল দিয়ে তেজ আঁচে সেদ্ধ করতে হবে। কিন্তু উনি অনেকটা মাংস হাঁড়িতে বসিয়ে কাঠকয়লার ঢিমে আঁচে রান্না করেছেন। আমার এদিকে মাংস অল্প, গ্যাসের আঁচ, তাছাড়া কড়ায় রান্না করেছি, হাঁড়ির এয়ার টাইট এফেক্টটাও আসেনি, যার জন্য মাংস সুসিদ্ধ হয়নি। এবারে আমি বুঝতে পেরেছি, মা কেন আগে মাংস প্রেশার কুকারে সিটি দিয়ে নরম করে নিত। এরপরের দিন করলে আমি আধসেদ্ধ মাংস, দুধ, ময়দা আর মাটন স্টকের ছিটে দিয়ে কষব দেখিস।
- হ্যাঁ মা, আমি আশীর্বাদ করছি, তুই পারবি, ঠিক পারবি, হি হি, চিকেন রোস্টটাতো ভালোই করেছিলি।
- আরে, চিকেনটাতো খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, বেশি সেদ্ধ হলে শেষে ভেঙে ঘেঁটে যাবে ভেবে গ্যাস বন্ধ করলাম। তারপর দেখি বোদা গন্ধ যায়নি। চিকেনের ক্ষেত্রে মাটনের মত ঘিয়ে মাংস ঢেলে চাপা দিয়ে দিলে হবে না। প্রথমে ভাজতে হবে, তারপর চাপা। সেভাবে করিনি, বইয়ে মাটনের যা পদ্ধতি ছিল, তাই করে ফেলেছি। শেষে বেশ খানিকটা রসুন, কাঁচা লঙ্কা আর শুকনো লঙ্কা মিক্সিতে বেটে মাংসে ঢেলে ভালো করে নেড়েচেড়ে দিলাম। তখন ঐ গন্ধটা গেল।
- হুম, কিচেন নাকি ল্যাবরেটরি!
- পাক্কা ল্যাবরেটরি। কিন্তু আফশোস যে সারাজীবন অ্যাপ্রেন্টিস রয়ে গেলাম, ওপরের ধাপে মা, দিদার মত আর প্রমোশন হলনা।
- হি হি হি হি।
এ যে শ্বেত পাথরের গল্প,
তা সে বিশদ নাকি অল্প!
গল্পের গরু উঠছে গাছে
বাইন্ধা তল্পিতল্প।
ও সে টেবিল নাকি আয়না
দেখে জাগে হৃদে কম্প।
ঝিলমিল ঝিলমিল আয়নায় ভাসে
যুগের দৃশ্যকল্প।
একটা ষণ্ড যাবে ছুটে,
পায়ে চাবুক ঠুকে ঠুকে।
লাবণ্য বৌ গুমরে মরে
রবিঠাকুর বুকে।