মনে ডালপালা মেলে পিছুটান
কানে আনকোরা হেঁশেলের গান।
বিয়ের পরে শাশুড়িকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
- আচ্ছা মা, যেদিন প্রথম তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, সেদিন তুমি কী করে নিশ্চিত ছিলে, যে আমাদের বিয়ে হবেই? আমি তো নিশ্চিত ছিলাম না।
- আমি নিশ্চিত ছিলাম, তুমিই এ’বাড়ির বৌ হবে।
- কিন্তু কী করে, সেটাই তো জানতে চাইছি।
- আমার মনের ভেতরে কেউ বলছিল।
- কিন্তু, কেন বলছিল, কোনো কার্যকারণ তো থাকবে।
- হুঁ, কার্যকারণ ঠিক নয়, অন্য কথা। তুমি বিশ্বাস করবে না।
- আচ্ছা, তুমি বলো তো। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন পরে হবে।
- ও’সব বলতে গেলে এখন সাতকাহন খুলে বলতে হবে।
- সাতকাহন? তার মানে তো অনেক পুরোনো গল্প। বল বল। প্লিজ প্লিজ।
- এ’পরিবার এই ভিটেতে আছে, তা দু’শ’ বছরের কিছু বেশিই হবে।
- আচ্ছা! তার আগে কোথায় ছিল?
- উড়িষ্যার রানীগুড়ায়, যদিও ওদিকটা বৃহত্তর বাংলারই অংশ ছিল তখন। বর্গী আক্রমণের সময়ে নিমাইচরণ এবং রূপচরণ দাসমহাপাত্র নামে দুই ভাই তাঁদের মামার বাড়ির ভিটেতে বসবাস শুরু করেন। দাদুর পুত্র ছিল না বা মৃত্যু হয়েছিল – কিছু একটা হয়ে থাকবে। সেই থেকে এই পরিবার এই ভিটেতেই আছে।
- ভালো কথা। তার সঙ্গে আমাদের বিয়ের কী সম্পর্ক?
- নিমাই এবং রূপ বৈষ্ণব ছিলেন। তাঁরা এই ভিটেতে গোপীনাথ আর রাধারাণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
- বৈষ্ণব? একটা কথা জানো মা, এখন আমি যে হাওড়া আন্দুলের কলেজে পড়াই, সেই নামের একটা ইতিহাস আছে। চৈতন্যদেবের প্রভাবে – নামসংকীর্তন, ভক্তদের ধুলোয় গড়াগড়ি – এইসব ঘটনার প্রভাবে ঐ জায়গাকে সকলে আনন্দ-ধূল নামে ডাকতে থাকে। আনন্দ-ধূল কালক্রমে লোকমুখে আঁদুল হয়ে যায়। তারপর ইংরেজি বানানের প্রভাবে হয় আন্দুল। এ’কথা কলেজে চাকরি পাবার পরে প্রথম বলেছিলেন আমার বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের স্যার সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তারপর ঐ সংক্রান্ত আরও অনেক কাহিনী শুনেছি আন্দুলে। সরস্বতী নদী যেখানে ভাগীরথী-হুগলীতে মেশে, সেখানে শঙ্খরোল করে মেয়েরা চৈতন্যকে বাংলা থেকে বিদায় জানান। ঐ জায়গার নাম হয়ে যায় শাঁখরাইল। পরে আবার ইংরেজি বানানের অনুসরণে লোকে সাঁকরাইল বলে। ধূলাগড়ি বলেও একটা জায়গা আছে। সরস্বতী নদীর যে পাড়ে আমাদের কলেজ, সেদিকটা বৈষ্ণব-অধ্যুষিত। আর ও’পাশটা শাক্তদের। আমাদের কলেজের বিল্ডিং-এর ভিত খুঁড়তে গিয়ে, বসা অবস্থায় কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। বৈষ্ণবেরা নিজের জমিতে ধ্যানাসনে মৃতদেহ সমাধি দেয়। পোড়ায় না।
- আমাদের পরিবারেও মৃতদেহ দাহ হয় নিজের জমিতে। জায়গাটাকে সমাধি বলা হয়।
- তাই নাকি, পূর্ব পুরুষদের সমাধি আছে এখানে? কোনদিকে? আমাকে দেখাবে?
- হ্যাঁ। বাপুকে (আমার বর) বোলো, নিয়ে যাবে।
- আচ্ছা, তারপর বল।
- রূপচরণ সন্ন্যাসী হয়ে চলে যান। তাঁর কথা আর জানা যায়নি। নিমাইচরণের ছেলে জগদ্বন্ধু, নাতি সন্তোষ। তাঁর ছেলে গোবিন্দপ্রসাদ, আমার দাদাশ্বশুর। এই সন্তোষ ছিলেন গড় কৃষ্ণনগরের জমিদারের নায়েব বা বক্সি।
- আচ্ছা, সেইজন্যই সকলে বলে বক্সিবাড়ির বৌ দেখতে এসেছি।
- হ্যাঁ, সেই থেকে লোকমুখে বক্সিবাড়ি হয়ে গেছে। পূর্বপুরুষেরা গ্রামে যে বাজার বসিয়েছিলেন, তার নাম এখনও বক্সিবাজার।
- গড় কৃষ্ণনগর মানে? নদীয়ায়?
- না না, এটা মেদিনীপুরের পুরোনো হিজলীর নবাব বা রাজার অধস্তন মহাল।
- এই যে পরপর ছেলেদের নাম বলছ, সব এক ছেলে? বাকি কেউ নেই?
- মেয়েরা ছিল। তবে সব একটা করেই ছেলে ছিল। শুনেছি এই সন্তোষের এক কাকা জন্মেছিলেন – অপর্তি, কিন্তু তাঁর কোন সন্তানাদি হয়নি। অল্পবয়সে মারা যান। সন্তোষের সময় থেকে এই পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি খুব বেড়ে যায়। কিন্তু পুত্র জন্মায় না। তখন গোবিন্দের কাছে মানত করে পুত্র হল। সন্তোষ নাম রাখলেন গোবিন্দপ্রসাদ। গোবিন্দপ্রসাদও যোগ্য সন্তান হয়ে সন্তোষের সময়কার প্রতিপত্তি ধরে রেখেছিলেন। গোবিন্দপ্রসাদের স্ত্রী, মানে আমার দিদিশাশুড়ির নাম ছিল শারদা।
- কি!!! তালব্য শ-য়ে শারদা? আমার মতন?
- হ্যাঁ, তোমার চার-পুরুষ আগেও এ বাড়ির বৌয়ের নাম ছিল শারদা।
- দেখ মা, এক নাম হতেই পারে। সেটা কিছু নয়, তবে বাঙালি বাড়িতে ঐ এক সারদামণি মা। মেয়েদের নাম চট করে সারদা বা শারদা রাখা হয় না। তাই এটা একটু অদ্ভুত, তা সত্যি।
- আরও একটা কথা আছে। আমার ছেলে, মানে তোমার বর যখন জন্মায়, তখন অনেক দিন অসুস্থ ছিল, অনেক চিকিৎসা করতে হয়েছে। তখন রোজ গোপীনাথের কাছে ওর নামে তুলসী দেওয়া হত। সুস্থ করে বাড়ি ফেরার পর, ছেলের নাম রাখা হল তুলসীপ্রসাদ। গোবিন্দপ্রসাদের স্ত্রীর নাম শারদা ছিল, তারপর বাপু এসে বলল, ওর বান্ধবীর নাম শারদা, বিয়ে করতে চায়। আমার আর কোনো ছেলের নামে তো প্রসাদ নেই। দু’জনের জীবনই কৃষ্ণের ইচ্ছায়। আমার বিশ্বাস হল – এ গোপীনাথেরই ইঙ্গিত। এ মেয়েই এ বাড়ির বৌ হবে। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম। এর পিছনে তোমার কথা-মত কার্যকারণ তো আছে, তবে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। তাতে কী? আমার বিশ্বাস আমার কাছে।
- হুম, গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আগের শারদা কেমন ছিলেন?
- উনি একশ’ কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন।
- অ্যাঁ!! তখন অত জন্মদিন তো কেউ জানত না। তুমি নিশ্চিত – একশ’ কুড়ি?
- তিনিও বৌ, আমিও বৌ। অন্য বাড়ি থেকে এসেছি। ওনার জন্মের খবর তো বলতে পারব না। তবে আমি ওনাকে দেখেছি। ওনার মৃত্যুর সময়ে সকলে বলেছিল একশ’ কুড়ি বছর, তাই শুনেছি। হয়তো নির্ভুল নয়, তবু একশোর ওপর তো নিশ্চয়ই।
- আর দাদাশ্বশুর, গোবিন্দপ্রসাদ?
- না, তাঁকে দেখিনি। তিনি বহুদিন আগে মারা গেছেন। তখন বৌয়েরা বয়সে বরের থেকে অনেক ছোট হত। তাই বৌ-রা প্রায়ই অল্পবয়সে বিধবা হত। ইনিও তাই। তবে একটা কথা শুনেছি আমার শাশুড়ির মুখে।
- তোমার শাশুড়ির নাম কী?
- মোক্ষদা। শারদা আর মোক্ষদা, মানে শাশুড়ি-বৌমা এক পরিবারের মেয়ে।
- তাই নাকি? আচ্ছা, মোক্ষদার গল্পে পরে আসছি। ওনার মুখে কি শুনেছিলে?
- শুনেছিলাম, গোবিন্দপ্রসাদ মৃত্যুর আগে যুবতী বধূকে বলেছিলেন, ‘কাঁদুচু কেনি? বছর প্রতিদিনর জন্য দুই একরর ধান্অ তো রখি দৌউচু। এ্যাতে চলবুনি?’ মানে, কাঁদছ কেন? বছরের প্রতিটা দিনের জন্য দু’ একরের ধান তো রেখে যাচ্ছি। এতে চলবে না?
- বছরের প্রতিটা দিনের জন্য দু’ একরের ধান? মানে সাতশো তিরিশ একর ধানজমি?
শাশুড়িমা হেসে উঠলেন।
- এখন সাত একরও নেই।
- সে যাকগে, ঐ শারদার কথা বল। কি করত, কি খেতে ভালোবাসত?
- আমি বৌ হয়ে এসে দেখেছি, ও বুড়ি চাকুন্দা শাকের ভাজা আর পান্তাভাত খেতে ভালোবাসত। চাকুন্দা শাকের টকও খেত খুব।
- চাকুন্দা শাক? কোনোদিন শুনিনি। তোমরাও খাও? তুলসী খায়? আমার কিন্তু এসব খাওয়া বা রান্নার কোনো ধারণা নেই।
শাশুড়ি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে আমার গাল টিপে দিয়ে ছড়া কাটলেন –
মা রানছি লা - উ
পাতের তলায় থা - উ।
বৌ রানছি লা - উ
গাউল গাউল খা - উ।
তুমি যা করবে – পোড়া ভাত, আলুনি তরকারি – আমার ছেলে তা-ই খাবে। আর তুমি একা সব করবেই বা কেন? দু’জনে চাকরি কর। ঘরের কাজও তো দু’জনকেই করতে হবে।
আমি হেসে বললাম,
- তা ঠিক। তবে ঐ চাকুন্দা শাকটা ভাজা, টক এসব কী করে করে, একটু বলে দাও তো। কানে শুনলাম যখন, জানতে তো হবেই।
- চাকুন্দা একটা শাক, যাতে হলুদ রঙের ফুল ফোটে। আমার তো সাতজন পিসশাশুড়ি ছিলেন। মানে শারদার এক ছেলে, সাত মেয়ে। তার মধ্যে সেজ মেয়ে ত্রিবেণী কাছাকাছি থাকত। সে-ই ঐ চাকুন্দা যোগাড় করে, রান্না করে আনত। আমাদের এখানে সাধারণত রসুন দিয়ে শাক ভাজা হয়। তবে পেঁয়াজ দিয়ে, কাঁচা কাজুবাদাম দিয়েও ভাজা হয়। এই শাকটা ভাজার নিয়ম আলাদা। পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ভাজতে হয়। শেষে নারকেল কোরা ছড়িয়ে নামানো হয়।
- কাঁচা কাজু? কাজুবাদাম দিয়ে শাকভাজা? না, মানে, পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, এইসব রইসি রান্নায় যা কালেভদ্রে হয়, তাতে কাজু পড়ে। শাকভাজার মত রোজকার সাধারণ রান্নায় কাজু?
- হ্যাঁ, এটা তো কাজুর জায়গা। আমাদের বাড়িতেও এককালে কাজুচাষ হত। তাই এ অঞ্চলে রোজকার বা নেমন্তন্ন – সব রান্নাতেই কাজু দেওয়ার চল আছে। গিমাতেও কাজু পড়ে।
- গিমা? সেটা আবার কি?
- ও একরকমের শাক, তেতো স্বাদের।
- ওকে! ওটা পরে হবে, ওয়ান বাই ওয়ান। চাকুন্দার টকটা বল কীভাবে হয়।
- এ টকটা আমসি দিয়ে হয়। বাড়িতে মাটির হাঁড়িতে আমসি করা থাকে।
- ওরে বাবা! আমসিটা তবে গিমার পরে হবে। টকটা বল। এটাও কি গিমার মত তেতো?
- না না। এটা মিষ্টি শাক। তাই অনেক সময়েই এই গাছে পোকা হয়। তাই খুব ভালো করে পোকা বেছে নিতে হয়। চাকুন্দার টকে আলু পড়ে না। কুমড়ো, ঢেঁড়স আর বেগুন ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। এবারে সর্ষে ফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আনাজগুলো হাল্কা ভেজে নেওয়া হবে। আনাজের সঙ্গে শাকের ঐ হলুদ ফুলও একসঙ্গে ভাজা হবে। তারপর জল দিয়ে সর্ষেবাটা আর আমসি দিয়ে কিছুক্ষণ ঝোলটা ফুটবে। তবে ঝোল বেশি থাকবে না, একটু মাখা মাখা হবে।
- আচ্ছা, শুনে তো বেশ সুস্বাদু মনে হচ্ছে।
- কথায় কথায় অনেক বেলা হল। তুমি এবার চান করে নাও। জানকীকে বলে দিয়েছি, বালতিতে তোমার চানের জল তুলে দেবে।
এ বাড়িতে দুটো নলকূপ আছে আর মোট আটটা পুকুর। খিড়কি পুকুরে মেয়েরা আর ছেলেরা চান করে, যদিও আলাদা সময়ে। সদর পুকুরে চান করতে আসে বাইরের মানুষেরা। মন্দিরের পুকুরে আর রান্নাঘরের পুকুরে কেউ চান করে না। কারণ চারিপাশে ঝুঁকে পড়া দেবদারু, কেয়াঝোপ, তেঁতুলের ঝুরি মিলে ও দুটো ছায়া হয়ে আছে। রোদ্দুর পড়ে না। বাকি তিনটে পুকুর ভিটেতেই, তবে বড় জঙ্গল। কাঁটা বাঁচিয়ে, পায়ে চলা পথ ধরে এগোতে হয়। ওদিকে সমাধিগুলি আছে আর কিছু সবজি চাষ হয়। কেবল একটা পুকুর আছে ধানমাঠে। কিন্তু আমি তো পুকুরে চান করতে পারি না। যদিও ইচ্ছে আছে ষোলোআনা। কিন্তু করবটা কী? আমি যে সাঁতার জানি না। তাই নলকূপের তোলা জল নিয়ে চানঘরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। দুটো নলকূপের একটা – বড় রান্নাঘরের মাঝখানে। আর একটা – ছোট রান্নাঘরের সামনে। বড় রান্নাঘরের নকশাটা অদ্ভুত। আমাদের আড়বালিয়ার দিকে অমন হয় না। এই নকশাটার একটা নাম আছে – চৌঘেরা। নলকূপ ঘিরে চারদিকে চৌকো দালান। দালানে টালির চাল আর মাঝখানে নলকূপের মাথা ফাঁকা। সেখান থেকে আলো আসে। একদিকের দালানে উনুন করা। সেদিকে রান্না হয়। একদিকে বাসন, মশলা আর আনাজ থাকে। একদিকে আসন পেতে লম্বা সারিতে খাওয়া দাওয়া। আর বাকি দিকটায় টেবিল চেয়ার পাতা। যাদের হাঁটু মুড়ে বাবু হয়ে বসা অসুবিধে, তাদের জন্যে। ঐ দিকেই দেয়ালের পাশে রান্নার গ্যাসের টেবিল আছে। ছোট রান্নাঘরটা ছিটে বেড়ার, মাথায় খোড়ো চাল, বাড়ির বাইরের দিকে আছে। ভিতরে জ্বালানি কাঠ শুকোনো থাকে। এই রান্নাঘরের দাওয়ায় উনুন করা আছে। শীতকালে রোদে বসে রাঁধুনিরা এখানে রান্না করে।
ঐ রান্নাঘরে প্রবেশ কিন্তু আমার পক্ষে সহজ হল না। আসলে ছ’টা ছেলেমেয়ে আর তাদের পরিবার সারাবছর কেউ তো পাশে থাকে না। উৎসবে বা দরকারে আসে। এদিকে বক্সিবাড়ির দালানে শ্বশুরমশাইয়ের আড্ডার মজলিস চলতেই থাকে। আর বাড়িতে কেউ এলে অভুক্ত ফেরে না। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। তাই সংখ্যা ঠিক থাকে না – দুপুরে ক’জন খাবে। শাশুড়ি মায়ের বয়স হয়েছে। অনেককাল এই জোয়াল টেনেছেন। নিজের মুখের খাবার হঠাৎ আসা অতিথির মুখে ধরেছেন। কিন্তু এখন আর পারেন না। বাবাও পঁচাত্তর পেরিয়েছেন। সময়ে ভাত দিতে হয়। সারাবছর তাই এতবড় হেঁশেল ঠেলতে, কুটনো, বাটনা সামলাতে গোটা চারেক মাইনে করা তত্ত্বাবধায়ক লাগেই। তার ওপরে মন্দিরের আলাদা রান্নাঘর। সেখানে আবার গোপীনাথের নিত্যভোগ হয়। এলাকার গরীব মানুষের দুপুরের ভরসা এই মন্দির। গত দু’শ’ বছর এমনই চলছে। দুই হেঁশেল মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক হল ছয়। তাদের ছানাপোনারা তো আছেই। তাদের পরিবারের লোকও হয়তো ডাব পাড়ে, জঙ্গল পরিষ্কার করে। দুপুরে তাদের পাতও পড়ে। সারাদিন গ্যাসে চায়ের জল ফুটছে। আর হা-হা- করে উনুন জ্বলছে। বিরাট লোহার কড়া। সেই রকম বড় খুন্তি। কড়ায় দু’পাশে আংটা লাগানো। খুন্তির হাতলটা দুটো আংটার মধ্যে ঢুকিয়ে কায়দা করে ঐ ভারী কড়া নামাতে হয়। সাঁড়াশির ব্যবহার এই রাঁধুনিদের জানা নেই। রান্নাঘরেও সাঁড়াশি নেই। খুন্তি নাড়ার সময়ে কড়া ধরতে হলে, কাপড় দিয়ে আংটা ধরে কাজ করতে হয়। যেহেতু আংটাওলা কড়া, তাই তরকারি চাপা দিতে হলে, টপাস করে কড়ার চেয়ে ছোটো মাপের কাঁসি দিয়ে ওরা চাপা দিয়ে দেয়। তারপরে তোলার সময়ে খুন্তি দিয়ে ঠেলে তুলে দেয়। কিন্তু ওটা কাত হবার সময়ে কাঁসির অন্য ধারটা ঝোলে ডুবে যায়। গোল গোল চোখ করে দেখলাম, তরকারি চাপা কাঁসিটা মেঝে থেকে তুলেই ওরা চাপা দিচ্ছে। ধুয়ে নিচ্ছে না। আর বালিয়াড়ির ওপরে ঘর। ঝাঁটমোছ করার একটু পরেই আবার বালিতে বালি হয়ে যায়। কাজেই তরকারি চাপা কাঁসি থেকে রান্নায় বালি ঢোকার সম্ভাবনা প্রবল। হতে পারে তোলা জলে কাজ। সেজন্য ধুয়ে নেওয়ার সমস্যা। সে তো আমাদের আড়বেলেতেও তাই ছিল। কিন্তু সেখানে মা, জ্যাঠাইমারা নিজে হাতে কাজ করত। সাহায্যকারিণীরা থাকত, তবে এভাবে পুরোটা তাদের হাতে ছিল না। সব মিলিয়ে এই রান্নাঘর একেবারেই আলাদা। আমার বাপের বাড়ির অভিজ্ঞতার সঙ্গে একেবারেই মেলে না।
শ্বশুরবাড়ি যখন যেতাম, সকালবেলা শাশুড়ি মা আমার জন্য মৌরিবাটা সরবৎ নিয়ে আসতেন। ভেজা নোনা হাওয়া আর সকালের মিঠে আলোয় বসে ঐ সরবৎটা খেতে খুব ভালো লাগত আমার। শাশুড়ি বলতেন, সারা সপ্তাহ কলেজ কর, সরবৎ খেলে শরীর ঠান্ডা হবে। আমার বাপের বাড়িতে, রাতে মৌরি, মিছরি ভেজানো জল সকালে খেয়েছি কখনও, বিশেষ করে পরীক্ষার সময়ে। কিন্তু এমন মৌরিবাটা সরবৎ ওখানে হত না। সকালে এক একদিন এক একরকম জলখাবার হত। কিন্তু যেদিন লুচি হত, সেদিন আমার একটু কষ্ট হত। ময়দা দিয়ে লুচি হত, অথচ সাদা, ফুলকো নয়। একেবারে লাল, মোটা বোগড়া লুচি, তায় প্রায় পাঁপড়। আমি তো সমানে সন্ধান করতে লাগলাম, ময়দা দিয়ে এমন জিনিস হচ্ছে কীভাবে? তারপর উদ্ধার করলাম, এরা অনেকটা চিনি মিশিয়ে ময়দা মাখে। আর ময়ানের অনুপাতও ঠিক হয় না। বড় বড় লেচি কেটে ছোটো বেলে। সব মিলিয়ে কেলেঙ্কারি হয়ে যায়। লোকসংখ্যা বেশি। পাতলা ফুলকো হলে লুচি টানবে বেশি, সেজন্য করে কিনা জানি না। তবে অন্যরকম বললেও, ওদের জানা নিয়ম থেকে ওরা কিছুতেই বেরোতে চায় না।
তবে জাউ হলে দারুণ আনন্দ হত। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। শীতের সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি, খুব হৈ হৈ হচ্ছে। সবাই খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তড়বড়িয়ে খড়ের গাদাটা কাছ থেকে দেখতে গেলাম। দেখি, খড়ের গায়ে অনেক সাদা সাদা ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে, ঠিক যেন খড়ের ফুল। আর মাটির কাছের ছাতাগুলো লালচে। এগুলো দেখে সবাই আনন্দ করছে। এবার আমার সঙ্গে কর্তার যা কথোপকথন হল, তা এইরকম –
- এগুলো কী?
- ছাতু ফুটেছে, খড়-ছাতু।
- মানে? মাশরুম?
- হ্যাঁ, দারুণ খেতে। মাংসের মত। মাকে বলব আজ সকালে জাউ করতে।
- ঝাউ করা কী?
- আরে দূর! ঝাউ নয় জাউ। খেলে বুঝবে।
সেদিন সকালের জলখাবারে খেলাম গরম গরম জাউ আর খড়-ছাতু ভাজা। সত্যিই দারুণ। জাউ আর কিছুই নয়। সেদ্ধ চালের খুদ দিয়ে তৈরি ফ্যান-ভাত, কিন্তু নুন আর অনেকটা নারকেল কোরা দিয়ে ফোটানো। আতপ চালেও হয়। তবে সেদ্ধ চালে মাড় ঘন হয়, তাই ভাল লাগে। এক কাপ খুদের চাল ফুটে গেলে, তাতে এক মালা নারকেল কোরা দিয়ে নামাতে হবে। পাতে ঘি বা মাখন দিয়ে খেলে আরো ভাল লাগবে। সঙ্গে এক গোলা আলুভাতে। তবে এখানে আলুভাতে বলা হয় না। বলে আলু মাখা। পেঁয়াজ আর শুকনো লঙ্কা ভেজে চটকে আলুর সঙ্গে মাখা হয়। এর সঙ্গে এক পাশে দিয়ে গেল ছাতু ভাজা। মুখে দিতে চমকে গেলাম। এমন স্বাদ পাইনি আগে। সত্যি সত্যিই মাংস ভাজার মত মনে হচ্ছে। আজ এত বছর পরে, ধানের গোলা আর নেই। তাই খড়ের গাদাও স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে। তবে এখনও পুজোয় সকলে বাড়ি আসে। দশমীতে দর্পণে শরৎশশীর বিসর্জনের পর, নিরামিষের পর্ব চুকলে, বক্সি বাজারে লোক পাঠানো হয়। সেদিন বাজারে যত খড়ছাতু ওঠে, পুরোটাই কিনে নেওয়া হয়। বাড়ির সকলেই, এমনকি ছোটরাও ছাতু বলতে অজ্ঞান। আমিও শিখে গেছি ছাতুর আইটেম – ভাজা, চচ্চড়ি, টক – এগুলো রাঁধতে। তবে এখন এটা আমি স্যালাড, ফ্রায়েড রাইস সবেতেই মেশাই। খড়ছাতুগুলো বোঁটা ছাড়িয়ে একটা পাত্রে জলে ভিজিয়ে দিতে হবে। ভালো করে চটকে ধুয়ে নিলে একটা লালচে জল বেরিয়ে যাবে। তারপর আলতো হাতে ওপরের আঁশ বা খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। বৃষ্টি হলে বা ভেজা আবহাওয়া হলে, সাদা ছাতুগুলোয় লালচে ছাল ধরে। খড়ের গাদায় নিচের দিকে ভেজা ভেজা থাকে বলে ছাতু লালচে হয়ে যায়। ঐ লাল ছাল অবশ্যই তুলে ফেলতে হবে। ছাল থাকলে স্বাদটা কষা লাগে। আঁশ ছাড়িয়ে, জলটা হাতে চেপে চেপে ঝরিয়ে নিতে হবে। এবারে বঁটিতে বা ছুরিতে এগুলো একেবারে কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে। এবারে ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ ভাজতে হবে। অর্ধেক ভাজা হলে মাশরুম কুচি দিয়ে খুব ভালো করে পেঁয়াজের সঙ্গে ভাজাভাজা করতে হবে। স্বাদমত নুন পড়বে। ইচ্ছে হলে কাঁচালঙ্কা কুচো মেশানো যায় বা শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে চটকে চিলি ফ্লেক্স বানিয়েও মেশানো যায় – যার যেমন ইচ্ছে। মাশরুম ভাজার সঙ্গে ঝিরিঝিরি আলু আর বেগুন দিয়ে নাড়লে, ওটাই চচ্চড়ি হয়ে যাবে। আর খড়ছাতুর টক বানাতে হলে, পেঁয়াজ পড়বে না। গোটা কালো সর্ষে আর কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মাশরুম ভেজে নিতে হবে। এখানে কিন্তু ছাতুটা হাল্কা করে ভাজতে হবে। নুন, হলুদ – স্বাদমত দিতে হবে। সর্ষেবাটার জলে আমসি চটকে নিয়ে জলটা কড়ায় ঢেলে দিতে হবে। ফুটিয়ে নিয়ে ঝোল ঝোল নামিয়ে নিতে হবে। শ্বশুরবাড়িতেই আমি মিষ্টি বাদ দিয়ে নোনতা টক খেতে শিখলাম।