৩
আমাদের অনবসর চলেছে বিরামহীন। এর মধ্যে শুধু অনলাইনে ক্লাস করা নয়, আরও হরেকরকমবা জিনিস জীবনে যোগ হয়েছে, আরও নিত্যনতুন রোজই কিছু না কিছু হয়ে চলেছে। সেমিনারের বদলে সব কলেজে রাশি রাশি ওয়েবিনার শুরু হয়েছে। আমরাও আয়োজন করে ফেলেছি বেশ কয়েকটা। অনলাইন কুইজ, অনলাইন আঁকা, নাচ, গান, ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। আর সবচেয়ে যেটা মজার, সেটা হল, এসব শেষ হবার পরে ফিডব্যাক ফর্ম পূরণ করলেই, অনলাইন সার্টিফিকেট চলে আসে ইমেলে। আমরা প্রযুক্তি শিখে পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিভাগ থেকে একটা ভৌগোলিক কুইজের আয়োজন করেছিলাম। দেখি, প্রাক্তনীদের কল্যাণে সমাজমাধ্যম বেয়ে সারা দেশের আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সেই কুইজে অংশ নিয়েছে। আমরা আনন্দিত তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অনলাইনের ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত। আমরা বিভাগের, আবার পুরো কলেজের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল করেছি। নানান অনুষ্ঠান সেখানে আপলোডও করছি। নতুন ভর্তির পর নবীনবরণ, বিদায় অভ্যর্থনা, বার্ষিক উৎসব, দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ—বাকি নেই কিছুই। ডিজিটালভাবে যে একটা কলেজ এইভাবে চলতে পারে, নিজে চোখে যদি না দেখতাম—মানে কেউ যদি গল্প করত—তাহলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের চ্যানেল খুলেছে – কেউ গানের, কেউ পড়ানোর, একজন আবার দারুণ দারুণ রান্না শেখায়, আর বেশ কয়েকজন করেছে হস্তশিল্পের। একটু দেরিতে হলেও ইভেন সেমেস্টারের পরীক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ পড়েছে এবার। নিয়মটা একটু আলাদা। তারও প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। সব কাজ চললেও, সমস্যা একটাই। যাতায়াতের সময়টা বেঁচে যায়। ক্লান্তি আসে কম। তাই প্রাণটা খালি খাই খাই করে। রান্নাঘরে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলে জোরকদমে। এই যেমন আন্তর্জালে দেখে দেখে জিলিপি বানাতে গিয়েছিলুম, কুড়মুড়ে হয়নি, ন্যাতানো মতন—খেয়ে মন ভরল না। তারপর একদিন ছাত্রীর চ্যানেলে দেখে ডালগোনা কফি বানিয়ে ফেললুম সন্ধেবেলা। সবে যুদ্ধজয়ের আনন্দ উপভোগ করব, মোবাইলে ভেসে উঠল পরীক্ষার মিটিং বসবে একটু পরে। ব্যস, সব সরিয়ে আবার কম্পিউটার, শেষ হতে হতে রাত সাড়ে দশটা। খাওয়া, ঘুম কাজকর্ম কোনোকিছুরই কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই এখন।
এর মধ্যেই বারবার কর্ণাবতীর ফোন বাজে,
— জেঠিমা, ডাক্তার এসে দেখে গেছে। আমরা ভেবেছিলাম মেনি, কিন্তু আপা হুলো বেড়াল। তাহলে তো ভব আপার নামে ভাল নামটা ভগবতী রাখা যাবে না। বতী বংশ তো বাড়ল না।
— বতী বংশ?
— হ্যাঁ আমরা দু’বোন কর্ণাবতী, রঞ্জাবতী। আমার কুকুর স্মোকি লামা ওরফে পদ্মাবতী, বোনুর পাখি সত্যবতী, তাই এ ভেবেছিলাম ভগবতী হবে।
— বতী হল না বান হবে। ভগবান।
— বিড়ালের নাম ভগবান! হায় ভগবান! এসব উৎপটাং চিন্তা তোমার মাথায় আসে কী করে গো জেঠিমা? আমি তো অন্য নাম ভাবছি। আমাদের বুড়ো দাদা অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলিয়ে আপার নাম আপেন্দ্রনাথ রাখা যাবে?
— আপেন্দ্রনাথ বিড়াল বাবা ঠাকুর? সহজ করে আপন কুমার হলে কেমন হয়?
— না না, নামের একটা ভার হচ্ছে না। তবে পয়েন্ট হল আপ যুক্ত ইন্দ্র কোনো মানে নেই। তুমি ঠিক বলেছ, আপনেন্দ্রনাথ হবে?
— তোর বিড়াল, তুই যা নাম রাখবি তাই হবে।
— না না, তা কেন? আমি তো মতামত চাইছি। আর জানো তো জেঠিমা, আমি আপার সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলে যাই, আর ও ও মিয়াও, ম্যাও, অ্যাও করে সব কথার উত্তর দেয়। তাহলে কি আপনেন্দ্রনাথ ফাইনাল?
— একদম ফাইনাল – আপনেন্দ্রনাথ বক্সি তর্কবাগীশ বিড়াল চূড়ামণি।
এমনিভাবে ভালো-মন্দে মিশে দিনগুলো কাটে। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর বাতাসে পুজোর গন্ধ এসে যায়। ওরা চলে নিজের নিয়মে, সেখানে অসুখ বিসুখ বাদ সাধতে পারে না। লকডাউনের মধ্যেই দুর্গাপুজো আসে, আবার তিথি, নিয়ম পাঁজিপুঁথি মেনে চলেও যায়। বিয়ের পর এই প্রথম পুজোতে শ্বশুরবাড়ি যেতে পারলাম না। দেওর ওখানে থেকে যতটুকু করার করেছে। কর্তার খুবই মন খারাপ। ঐ ফোনে পাঠানো ছবি আর ভিডিও কলে যতটুকু হয়, আমাদের উপস্থিতি ততটুকুই রইল। গাঁ গঞ্জে প্রথম থেকেই বেড়া, ব্যারিকেড, পাহারা বসিয়ে বাইরের লোক ঢোকা নিষেধ ছিল। শচীন কাকু যখন চলে গেলেন কলকাতায়, তখনও তাঁর নশ্বর শরীর সাত পুরুষের ভিটেতে নিয়ে যাওয়া যায়নি। তাই ওখানে পুজো করা সম্ভব হল। কারণ মৃৎশিল্পী থেকে পুরোহিত সকলেই এক গাঁয়ের মানুষ। আর প্রথম পর্বে অসুখটাও গ্রামে সেভাবে ছড়ায়নি। শহরের পরিস্থিতি আলাদা। বুকে ছুরি মেরে আমরা ঘরবন্দি রইলাম। মেয়ে সারাক্ষণ তার ফোনে দিদির সঙ্গে কলে রইল আর পুজোতে কখন কী কী হচ্ছে তার রানিং কমেন্ট্রি শুনতে লাগল। সপ্তমীর দুপুরে পোনা মাছের কালিয়া দিয়ে ভাত মেখে সে চুপ করে বসে আছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম
— কী রে? বসে আছিস? খা।
— মা দিদি তো নিরামিষ খাচ্ছে।
— হ্যাঁ, সে পুজোর যেমন নিয়ম। আমরা এখন ওখানে থাকলে নিরামিষই খেতাম।
— এইসব নিয়মগুলো কী করে আসে বল তো? কে বানায় এসব নিয়ম? আর কবে কে কী বলে গেছে, সেই সব মানেও লোকে – অদ্ভুত। এই যে তুমি বলেছিলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে, তোমার মামার বাড়িতে মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ হয়। আগে কে কী করত, এখনও এসব হবে? কোনো মানে হয়?
— হুঁ, মানে তো হয়। কারণ এই প্রথার পিছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে।
— কী কারণ?
— শোভাবাজারে বিয়ের অনুষ্ঠান অগ্নি সাক্ষী করে হয় না, নারায়ণ সাক্ষী করে হয়। নারায়ণের কাছে তো আমিষ চলে না, তাই নিরামিষ করা হয়। আর আমার মামার বাড়ির পূর্বপুরুষেরা দৌহিত্র বংশে ও বাড়িতেই থাকতেন। তাই নারায়ণ সাক্ষী রাখার ঐ আচার থেকে গেছে। এই প্রথার সঙ্গে জুড়ে আছে ইতিহাস। প্রথাটা বদলে দিলে ইতিহাসটাও চট করে হারিয়ে যাবে। পরের প্রজন্মের কাছে তথ্যটা আর প্রবাহিত হবে না।
— বুঝলাম, কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো আর ইতিহাস নেই, গোপীনাথের জন্য নিরামিষ।
— না জেনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা বুদ্ধির কাজ নয় বাবু।
— আরও কোনো গল্প আছে? আমি তো জানি না।
— ছোট ছিলে জানতে না। এখন বড় হচ্ছ – জানতে পারবে।
— বল তবে।
— তুই মুখটা চালা, ভাত শেষ কর, তবে বলব।
— এই তো খাচ্ছি। বল।
— তোর বাবা, কাকার ওপরের বাবাদের নাম জানিস?
— হুম। বাবার বাবা অমরেন্দ্রনাথ দাসমহাপাত্র। তাঁর বাবা তারিণীপ্রসাদ।
— তারিণীপ্রসাদের বাবা?
— জানি না।
— গোবিন্দ প্রসাদ।
— ও হ্যাঁ হ্যাঁ, যাঁর বৌ আগের শারদা।
— ঠিক। তাঁর ওপরে?
— জানা নেই।
— জেনে নে, গোবিন্দর বাবা সন্তোষ। সন্তোষের বাবা জগদ্বন্ধু। জগদ্বন্ধুর বাবা নিমাইচরণ। পরম বৈষ্ণব। নিমাইচরণের ছোট ভাই রূপচরণ সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন।
— মানে? ছোটবেলায় যে তুমি বলতে সবচেয়ে উঁচু সেই রাধা-কৃষ্ণ—বুড়ো জোড়া দেবদারুর মাথায় এক সন্নিসী ঠাকুর থাকেন। তাই বাড়িতে দুষ্টুমি করা যাবে না। সেই সন্ন্যাসী রূপচরণ?
— হ্যাঁ তিনি আর কোনোদিন বাড়িতে ফিরে আসেননি। তাই তাঁর সন্ন্যাস জীবনের নাম বা খবর কেউ জানে না। রূপ, নিমাই দুই ভাইয়ের আদি বাড়ি ছিল বালেশ্বর জেলার জলেশ্বর থানার রাণীগুড়ায়, মতান্তরে সুবর্ণরেখার পাশে উত্তরাঢ়ী গ্রামে।
— এখানে এলেন কেন? জমি কিনে চাষবাস করার জন্যে?
— রূপ, নিমাই মামার বাড়ির সম্পত্তি পেয়ে এখানে এসেছিলেন। শুধু শুধু ভিটে ছেড়ে কেউ আসে? অন্য আর একটা দরকার ছিল।
— কী দরকার?
— সময়টা আন্দাজ করতে পারিস?
— না।
— তোকে ধরে আট পুরুষ, মানে ধরে নে আড়াইশ’ বছর আগের কথা। তিন পুরুষে একশ’ বছর ধরলে ওরকম সময়ই হবে। আড়াইশ’ বছর আগে মারাঠা বর্গীদের বারংবার আক্রমণে উড়িষ্যা আর মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল। সুবর্ণরেখা নদীর পশ্চিমদিক অবধি মারাঠারা অধিকার করে নিল। পুবদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজদের আস্তানা। দু’পক্ষের যুদ্ধ বিগ্রহ, লুটপাট লেগেই আছে। একদিকে বর্গীরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হরবখৎ মানুষ খুন করছে, মেয়েরা অত্যাচারিত হচ্ছে, আবার পুব দিকের ডাকাত, দুষ্কৃতীরা এদিকে অন্যায় করে মারাঠাদের আশ্রয় নিচ্ছে, সাধারণ মানুষের ভয়ানক দুর্দিন। অন্যদিকে এই অবস্থায় সাহবন্দরের জমিদার জলেশ্বরের প্রজাদের ওপরে ডবল অত্যাচার শুরু করে দিল। ওপাশে অত্যাচারে ময়ূরভঞ্জের রাজারাও কম যান না। সব মিলে জমি আর ফসলের ওপরে নানা চরণে ট্যাক্স দিতে দিতে প্রজাদের নাভিশ্বাস উঠল। ঐ সময়টাতে বহু মানুষ নিজেদের ভিটের মায়া ছেড়ে পুবদিকে সরে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। নিমাইচরণ হয়তো সেই পথেরই পথিক। আনুমানিক আড়াইশ’ বছর আগে আমাদের আজকের এই ভিটেতে তিনি গৃহদেবতা গোপীনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
— এসব কথা তুমি জানলে কী করে?
— বিয়ের পর গল্প শুনেছি বড়দের কাছে। পুজোর সময়ে নতুন বৌ যখন যেতাম, আমার তো তেমন কাজ থাকতোনা। আমি তখন দিনরাত বসে তোর কাকামণির সংগ্রহের সব বই পড়তাম। তখনই পড়েছিলাম যোগেশচন্দ্র বসুর “মেদিনীপুরের ইতিহাস” – সেখানে এইসব দিনের কথা বিস্তারিত লেখা আছে। সেকালে যেসব পরিবারের ধন জন লোকবল ছিল, তারা কিছুটা ভালভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছিল। দুর্যোগ প্রাকৃতিক হোক বা সামাজিক, গরীব মানুষের বিপন্নতা সবসময়েই বেশি থাকে।
— গোপীনাথের মন্দির কেন করলেন? অন্য কত ঠাকুর আছে।
— তার কারণ সেই চৈতন্যদেব।
— কী করে? সে তো নিমাইচরণ থেকে আরও আড়াইশ’ বছর আগের ব্যাপার।
— আরে বাবা, চৈতন্যদেব বাংলা থেকে পুরী যাবার পথেই পড়ে জলেশ্বর। জলেশ্বরে নাকি তিনি বিল্বেশ্বর শিব দর্শন করতে গিয়েছিলেন। এই পুরো যাত্রায় যে হরিনামের তরঙ্গ ওঠে, তাতে হাজার হাজার পরিবার বৈষ্ণব হয়ে গিয়েছিল। ধরে নিতে হবে নিমাইচরণও তেমন পরিবারের ছেলে।
— আচ্ছা, তারপর?
— এ’বাড়িতে দুর্গাপুজোর রমরমা শুরু হয়, নিমাইচরণের নাতি সন্তোষের আমলে। জমিজমা, সম্পত্তিও বাড়ে। নিমাইচরণের দুই ছেলে জগদ্বন্ধু আর অপর্তি। কিন্তু অপর্তির ছেলে ছিল না।
— মেয়েও ছিল না?
— সঠিক জানা যায় না। হয়তো কন্যাসন্তান ছিল। কিন্তু মেয়েদের রেকর্ড তো রাখা হয় না। তাই কালক্রমে সেই বংশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে।
— খুব খারাপ, তারপর?
— জগদ্বন্ধুর ছেলে সন্তোষ ছিলেন হিজলি রাজ্যের কোনো সামন্ত জমিদারের দেওয়ান বা বক্সি। তাঁর আমল থেকেই এই ভিটে বক্সিদের ভিটে বলা হত। সেই নাম এখনও রয়ে গেছে। দাসমহাপাত্র পদবী হলেও, লোকমুখে নাম বক্সি বাড়ি।
— সন্তোষ আমার কে হবে মা?
— তোর পিতামহের প্রপিতামহ, মানে ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবা। তোকে ধরে ছ’পুরুষ আগের মানুষ। মানে তোর থেকে দেড়শ’ দু’শ’ বছরের আগের মানুষ। তার মানে ধরে নে উনিশ শতক থেকে এ বাড়িতে দুর্গাপুজো হচ্ছে।
— দু’শ’ বছরের পুজো! আবার বৈষ্ণব মতে!
— প্রথমদিকে কিন্তু পুজো শাক্ত মতেই হত। বৈষ্ণব মতে হত না।
— তাই নাকি? এই প্রথাটা তাহলে সেই চৈতন্যদেব থেকে আসেনি?
— না, এই প্রথায় পুজো শুরু হয়েছে ধর একশ’ বছর আগে থেকে।
— ইন্টারেস্টিং। কারণটা কী?
— তোর ভব আপা, তাঁর ভাই তারিণীপ্রসাদ-এঁদের এক ভাগ্নের কীর্তি আছে এর পিছনে।
— তারিণীপ্রসাদের ভাগ্নে, মানে বোনের ছেলে?
— হ্যাঁ।
— তিনি কী করেছেন?
— ঐ ভাগ্নে ছিলেন ভবঘুরে প্রকৃতির। নামটা খুব সম্ভবত হরিশচন্দ্র। তিনি পায়ে হেঁটে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। দক্ষিণ ভারতের কোনো পরিত্যক্ত মন্দির সংলগ্ন জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পায়ে হোঁচট লাগে। কীসে হোঁচট লাগল দেখতে গিয়ে, ওঁর কেমন একটা সন্দেহ হয়। শেষে নিজেই চেষ্টা করে খুঁড়ে বের করেন এক অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি। নিজের তো ঠিক ঠিকানা নেই। মূর্তি কোলে নিয়ে হাজির হন তারিণীপ্রসাদের কাছে।
— কোন দেবীর মূর্তি গো মা?
— সেটা প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না।
— মানে?
— তোর বাবা বলে দেবীর চুল চূড়ো করে জটাবদ্ধ। সিংহাসনে বসে আছেন। ডান পা ভেঙে আসনে বসা আর বাম পা মাটিতে স্পর্শ করে আছে। দেবীর চার হাত, সিংহবাহিনী।
— তুমি দেখেছ?
— নাঃ, আমার বিয়ের আগেই মন্দিরে চুরি হয়েছিল, বলেছিলাম না তোকে!
— হ্যাঁ হ্যাঁ, কোন দেবী সেটা বোঝা গেল?
— হুম। কোন দেবীর মূর্তি সেটা জানার জন্য তারিণীপ্রসাদ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সভা বসিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতেরা বিচার করে বললেন, যে এটি বৈষ্ণবী রূপে চণ্ডী মূর্তি।
— তারপর?
— আমাদের মন্দিরে একফুট উঁচু এক সোনার দুর্গা মূর্তি ছিল। হয়তো সন্তোষ সেই প্রতিমা নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেই মূর্তি মন্দিরে নিত্য পুজো হত। দুর্গাপুজোর সময়ে ঐ প্রতিমা দুর্গা মণ্ডপে স্থাপন করে পুজো করা হত। তখন শাক্ত মতেই পুজো হত। বলিও হত। কিন্তু একশ’ বছর আগে ঐ বৈষ্ণবী রূপে চণ্ডী মূর্তি ঘরে আসার পরে, তারিণী প্রসাদ মনে করেন যে এ হয়ত তাঁর প্রতি বিধাতার কোন নির্দেশ। সেই বছর থেকে সোনার দুর্গামূর্তির সঙ্গে দুর্গাপুজোয় ঐ মূর্তিও তারিণী প্রসাদ দুর্গা হিসেবে আরাধনা শুরু করেন। যেহেতু পণ্ডিতেরা বলেছিলেন এটি দেবীর বৈষ্ণবী রূপ, তারিণীপ্রসাদ পুজোর পদ্ধতি বদলে দিয়ে বৈষ্ণব মতে দুর্গাপুজো চালু করেন। পশুবলি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বলির অস্ত্র শস্ত্র তো ছিল – সেগুলো দিয়ে কুমড়ো আর আখ বলি দেওয়া হত। সেই থেকে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া শুরু হয়েছে, আর সে প্রথা আজও চলছে। তবে বলির কোনো পাট এখন আর নেই। নিরামিষ বলিও তারিণীর পুত্র অমরেন্দ্রনাথ, মানে তোদের ঠাকুরদা তুলে দিয়েছেন। এখন ধর তোরা যখন পুজোর ভার নিবি, তখন আবার নিয়ম বদলাতেই পারিস। এগুলো তোদের দু’বোনের মনের ব্যাপার। তোর বাবাও তো নিয়ম বদলেছে।
— কীরকম?
— মন্দিরে চুরি হয়ে যাবার পরে পুরোহিতেরা বিধান দিয়েছিলেন, যে মন্দিরে দোষ লেগেছে, আর মূর্তিতে দুর্গাপুজো করা যাবেনা। আমার যখন বিয়ে হয়, আমার তো খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি কলকাতার মেয়ে। পুজোয় শুনশান অন্ধকারে ঘটে পটে পুজো হচ্ছে। ১৯৯৪ থেকে এমন, আমি দেখলাম ১৯৯৯ এ। প্রতিমা নেই, ঠাকুরের মুখ দেখা নেই। শুধু ঐ আরতির সময়ে কাঁসর ঘণ্টা, ঢাকের আওয়াজ – ব্যস ঐটুকুই।
— এ বাবা, তারপর?
— তারপর তোর বাবা একটু থিতু হয়ে, আবার নতুন করে দুর্গাদালান বানিয়ে ২০১৬ থেকে মৃন্ময়ী মূর্তি পুজো শুরু করল। এখন যেখানে গোয়াল ঘর, সেই জায়গায় ছিল প্রাচীন দুর্গা মণ্ডপ, মাটির তৈরি। আর এখনকার দুর্গাদালান যেখানে, সেখানে ছিল ধানের মরাই।
— উফফ। ভাগ্যিস করেছিল। আসলে কী জানো মা, বাবা তো দেখছিল যে তোমার খুব মন খারাপ। তোমার মনটা ভাল করার জন্যে এত কাণ্ড করেছে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। হি হি।
— কিন্তু এই নতুন আদলে মূর্তিপুজোয় আবার একটা ব্যাপার হল, যা পুরোনো আমলের সঙ্গে মেলে না।
— সেটা কী?
— সাধারণত এইরকম বাড়ির পুজোর মূর্তি হয় একচালার। কিন্তু এখন একচালা প্রতিমা বিসর্জনের জন্য তোলা কষ্ট, জলের মধ্যে ঘোরানোর জন্য লোক পাওয়া যায় না। তাই তোর বাবা মূর্তি আলাদা করে দিয়েছে। একচালা প্রতিমার সিংহের মুখ হয়বদন, মানে ঘোড়ার মত হয়, কিন্তু আমাদের বাড়িতে স্বাভাবিক মুখ হয়।
— বুঝলাম। কিন্তু সেটা বাবা ঠিকই করেছে। আর পুরোনো নিয়ম কোনগুলো আছে যা আজও পালন করা হয়?
— সে তো অনেক আছে।
— যেমন?
— প্রথম হল বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পুজো হয়। ষষ্ঠীর সন্ধেয় বাড়ির সদর পুকুরে ঘট তোলা হয়। সপ্তমীতে নব পত্রিকা, মানে কলা বৌকে স্নানও করানো হয় ঐ পুকুরে। সন্ধি পুজোয় কোনোরকম বলির পাট নেই। দশমীতে অপরাজিতা পুজো হয়। আগে দুর্গাদেবীর সঙ্গে প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র পুজো হত। বড় বড় তরোয়াল, সড়কি ছিল। এখন আর হয় না। দশমীতে অপরাজিতা পুজোর শেষে সকলকে মানে পরিবারের সদস্যদের অপরাজিতা লতার বালা পরানো হয়। আর বাড়ি থেকে ক্রোশখানেক দূরে বড় জলাশয়ে শোভাযাত্রা করে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই নিরঞ্জন হয়।
— অস্ত্র পুজো এখন হয় না কেন?
— বৃটিশ আমলে পুলিশ দু’ দু’বার ঘরে আগুন দিয়ে পুরো বাড়ি লুঠ করেছিল। তাই পুরোনো কিছু আর নেই। মন্দিরে যেটুকু ছিল, তা চুরিতে গেছে।
— মা তুমি কলাবৌকে কাপড় পরাতে জান?
— নিজে হাতে করিনি কখনও, কিন্তু স্বপন ঠাকুর যখন কাপড় পরান তখন পদ্ধতিটা দেখেছি। বাঁ হাতে কাপড়ের কম অংশ আর ডান হাতে বেশি। মাঝখানে কুঁচি দিয়ে কুঁচিটা সুতো দিয়ে কলা গাছের গায়ে বেঁধে দেন। তারপরে ডান হাতের কাপড়ের অংশ পেঁচিয়ে আঁচল দিয়ে ঘোমটা করা হয়। ঘোমটার খুঁটটা বাঁহাতের যে কাপড়ের প্রান্তটা ছেড়ে রাখা হয়েছে তার সঙ্গে গিঁট বেঁধে দেন ঠাকুর মশাই।
— আর কলা গাছের সঙ্গে যে আটটা গাছ বাঁধা হয়, সেগুলো আর লাল পেড়ে শাড়িটা কি একই সুতো দিয়ে বাঁধে?
— না না। নটা গাছ আর একজোড়া বেল অপরাজিতার লতা দিয়ে বাঁধা হয়, সুতো দিয়ে নয়।
— ওহ, আর প্রসাদ? সেটার কথা বল।
— এ বাড়িতে দুর্গা পুজোয় নরনারায়ণ সেবার নির্দিষ্ট প্রথা আছে। এখন থেকে শিখে রাখ।
— বলো, বলো।
— সপ্তমীতে পুজো শেষ হতে সন্ধে হয়ে যায়। পুজো শেষ হলে গ্রামের বাড়ি বাড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হয়। আর এবাড়ির প্রসাদ বিতরণের প্রোটোকল নিজের মত করে তৈরি করে গেছেন তোর ঠাকুমা।
— কীরকম?
— শালপাতার বড় বড় থালায় বসানো থাকে নানা মাপের শালপাতার বাটি, যাতে লুচি, তরকারি, সিমাইয়ের পায়েস, এসবের সঙ্গে খই, মুড়কি, নাড়ু, চিঁড়ে, ফল, সুজি এসব মিশে না যায়। নিয়ে যেতে গিয়ে লোকের বাড়িতে শেষে সব মিলে ঘাঁটা, মাখামাখি প্রসাদ যেন না যায়, সেজন্য ঠাকুমা কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছেন। তোদেরকেও এই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী বিরাট মহার্ঘ কোনো প্রসাদ না হলেও, প্রসাদ বিতরণে পরিচ্ছন্নতা, আন্তরিকতার যেন কোনো খামতি না হয়।
— ঠিক ঠিক। কিন্তু অষ্টমীতে তো কারোর বাড়ি প্রসাদ যায় না।
— যায় না, কারণ অষ্টমীতে গ্রামের লোক বাড়িতে আসে।
— ও হ্যাঁ, তাই তো। ঐ ব্রতীরা আসে।
— হ্যাঁ, অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে সকলে আসে, অঞ্জলি দেবার পরে তারা প্রসাদ পায়। আগে বাড়িতেই লুচি আলুরদম রান্না করে ভোগ দেওয়া হত, সকলকে বসিয়ে খাওয়ানো হত। এখন একশ' দেড়শ' লোক হয়ে যায় বলে দোকান থেকে লুচি, তরকারি, বোঁদে বা অন্য কোন মিষ্টি করানো হয়। হাতে হাতে প্যাকেট বিতরণ করা হয়। আর ঐদিন গোপীনাথের কাছে খিচুড়ি ভোগ হয়। গ্রামের ছোট বাচ্ছাদের নিমন্ত্রণ থাকে গোপীনাথের খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ার জন্য।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রচুর বাচ্চা আসে আর হুটোপাটি করে খেলা করে।
— নবমীতে তো জানিস, বাড়ির আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতি-বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা হয়।
— হ্যাঁ হ্যাঁ পিসিরা আসে। থাকে, খুব মজা হয়।
— দশমীতে দর্পণে বিসর্জনের পর, জ্ঞাতিগোষ্ঠী, পাড়া প্রতিবেশী সকলে মিলে খাসির মাংস ভাত খাওয়ার রীতি।
— হুম, গতবার তো তিনশ' লোক পেরিয়ে গিয়েছিল।
— হ্যাঁ।
— দেখ মা, পুজোয় কতকিছুই হয়, কিন্তু সবচেয়ে ভাল দিকটা হচ্ছে সবার সঙ্গে মিলে নানারকম খাওয়াদাওয়া করা।
— সে তো বটেই, বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবে খাওয়াদাওয়া মুখ্য তো হবেই।
— আচ্ছা মা তোমার বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির প্রসাদে কোনো পার্থক্য আছে?
— বাপের বাড়িতে তো দুর্গা পুজো হয় না। আড়বালিয়াতে বোসেদের দুই শরিকের দালানে পুজো হয়। নাগ চৌধুরীদের এক রাত্তিরের বাড়িতে আর হাঁস ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হয়।
— এক রাত্তিরের বাড়িতে এখনও পুজো হয়?
— হ্যাঁ, আগের মত জাঁকজমক না থাকলেও হয়। পুজোয় আমাদের কোথাও যাওয়া হয় না বলে কোনোদিন দেখতে পাসনি। আড়বালিয়ার পাশে ধান্যকুড়িয়াতে সাউ, বল্লভ আর গাইন বাড়ির প্রাসাদে পুজো হয়। তবে এমন ধারা খই, চিঁড়ে, নাড়ু, সুজি, মুড়কির প্রসাদ আমাদের বাড়িতে হত সতীমার পুজোতে। তফাত বলতে এখানে পালো হয়, মানে নবমীতে পালো দিতেই হবে—নিয়ম। বিয়ের আগে পালো কোনোদিন খাওয়া দূরের কথা, নামই শুনিনি। আর বাপের বাড়িতে নারকেল নাড়ু গুড়ের, চিনির, সুজির হত, কিন্তু এখানে তোদের বাড়িতে সাদা তিল মিশিয়েও হয়—সেটা আগে খাইনি। বেশ ভাল লাগে। তবে নাড়ুর পাক আমাদের চব্বিশ পরগণায় শুকনো থাকে। ওটা খেতে ভাল লাগে। তোদের বাড়িতে পাকটা চিটচিটে, দাঁতে আটকে যায়।
— কেন? দু জায়গায় নাড়ুর পদ্ধতি কি আলাদা?
— না আলাদা নয়। গুড়ের গুণমানের তফাত হতে পারে। চব্বিশ পরগণার গুড় তো খুব উচ্চমানের হয়। মেদিনীপুরে তেমন নয়।
— ঐ আবার তোমার শুরু হয়ে গেছে মা, বাংলার শ্রেষ্ঠ জেলা উত্তর চব্বিশ পরগণা। আর সর্বোত্তম ঠিকানা হল আড়বালিয়া। কিন্তু আমার জন্যে সবার চাইতে ভাল পূর্ব মেদিনীপুর আর আমার গ্রাম মৈতনা।
— হা হা, তা দেখ জগতের চোখে না হলেও, আমার চোখে তাই। তোর কাকামণি যখন প্রথম আড়বালিয়া গিয়েছিল, তখন বলেছিল, যে মনে হচ্ছে শীর্ষেন্দুর লেখা থেকে এই গ্রামটা উঠে এসেছে।
— মা, তুমি হচ্ছ বাপের বাড়ির জঙ্গি সমর্থক।
— আচ্ছা বাবু, তুই কোন বাড়ির হয়ে লড়ছিস?
— বাড়ি ছাড়ো, নাড়ুর কথা হচ্ছিল। শীতকালে আড়বালিয়ার পাতলা মৌঝোলা গুড় অমৃত, সেটা আমিও মানি।
— শীতকালের মৌঝোলা হল খেজুর গুড়। নারকেল নাড়ু হয় আখের গুড়ে। তবে কী জানিস, ভেবে দেখেছি, গুড়টা আসল কারণ নয়। নাড়ুর তফাৎ হয় সামাজিক কারণে।
— সামাজিক কারণে? মানেটা কি?
- আড়বালিয়াতে নাড়ুর পাক দিত মা, জ্যাঠাইমারা। সহযোগিনী থাকতো, তবে তারাও আর্থিক বা পারিবারিক দিক দিয়ে হতদরিদ্র ছিলনা। সংসারী বৌ ঝিরাই থাকতো। তারা শিখেছিল তাদের মা, ঠাকুমাদের কাছ থেকে। একটা বংশ পরম্পরায় বয়ে যাওয়া কৌশল তাদের আয়ত্তে ছিল। এখানে দুর্গাপুজোর রান্নাবান্না, পুলিপিঠে, নাড়ু সব ঠাকুরের রান্নাঘরে যে বামুন বৌরা সারা বছর গোপীনাথের ভোগ রান্না করে, তারাই করে। পুজোয় তারাই যোগাড়যন্ত্র করে তাদের সহকারিণী ঠিক করে নিয়ে আসে। বাড়ির লোক হাত দেয়না। এই বৌদের জীবন যাত্রার মানটা অনেক নিচু তারে বাঁধা থাকে। তাদের মা, ঠাকুমারা হয়তো মাঠ, পুকুর, জঙ্গল থেকে শাকপাতা সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করেছে। তাই ওদের হাত আনাড়ি। আর জগৎটাও ছোট। উন্নত মানের পুলি পিঠে নাড়ু ওরা দেখেনি, চাখার সুযোগ পায়নি। তাই এরকম।
- বুঝলাম।
- আর একটা জিনিষ আছে, বাপের বাড়িতে একরকম চিঁড়ে মাখা হত, সেটা তোদের বাড়িতে হয় না।
- কেমন চিঁড়ে?
- বাড়িতে কোটা মোটা চিঁড়ে জলে ধুয়ে মাখা হত। সে চিঁড়ে এখনকার দোকানের মত একবার জলে ধুলে কাদা হয়ে যায়না। শক্ত সুস্বাদু চিঁড়ে। নুন মিষ্টি, লেবুর রস, নারকেল কোরা আর তালের ফোঁপল কুচি দিয়ে ঝুরো ঝুরো করে মাখা হত। শেষে থাকত কর্পূরের স্বাদ। জ্যাঠাইমারা মাখত। কলা পাতায় ফল প্রসাদের পাশে এক আঁজলা করে ঐ চিঁড়ে থাকত। স্বাদটা স্বপ্নের মত ভেসে আসে।
- আমি তো এমন কক্ষনো খাইনি।
- বড্ড পরের যুগে জন্মেছিস রে মা। ওসব স্বাদের জাদু কাঠি যাঁদের হাতে ছিল তাঁরা আজ আর নেই।
- হুম, কপালটাই খারাপ। কিন্তু মা পালো! সেটা তোমার আড়বালিয়ায় নেই।
- ঠিক ঐ একটা পালোই বাকি সব কিছুকে দশ গোল দিতে পারে - এমনি তার গুণ।
- আচ্ছা মা, পালোর সাদা গুঁড়োটা আসলে কী? ময়দা?
- গ্রাম বাংলার এক ধরণের কন্দের আটার কিউব বলা যেতে পারে।
- মানে?
- মানে পালো একটা কন্দ জাতীয় ছোট গাছ, হলুদ গাছের মত দেখতে, পাতাটা হলুদের থেকে সামান্য মোটা। তার থেকে লম্বাটে গোল একধরণের কন্দ বেরোয়। ঐ কন্দ তুলে কুচি কুচি করে কেটে জলে চটকে তার ক্বাথটা বের করে নেওয়া হয়। অনেকটা নারকেল থেকে দুধ বার করার মতন। তারপর ঐ জলটা রেখে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সাদা একধরণের পদার্থ মানে পালোর শ্বেতসারটা নিচে থিতিয়ে পড়ে। তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। মাটি ফুটিফাটা হলে যেমন দেখতে লাগে, সেই আকারে ঐ সাদা অধঃক্ষেপটা অসমঞ্জস টুকরোতে ভেঙ্গে যায়। কেউ আবার ঐজলে একটু এলাচ বা অন্য কোন মশলা মিশিয়ে দেয়। তাতে একটা সুন্দর ফ্লেভার চলে আসে। এবারে ঐ টুকরোগুলো বয়ামে ভরে রাখা হয়। জলে মিশিয়ে এর শরবত আমার ভীষণ প্রিয়। আর পৈটিক গোলমালে একেবারে ঘরোয়া অব্যর্থ টোটকা। পুজোয় অবশ্য এটা সুজির মত রান্না করা হয়, কাচের অস্বচ্ছ ক্রিস্টালের মত দেখতে লাগে।
- আচ্ছা মা, প্রতিবার তো বাবা দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি বাড়ি প্রসাদ পাঠায়, আমি অষ্টমীতে সকলকে প্রসাদ দিই, এবারে তো আমরা গেলামনা। এবারে কী হবে? কে করবে এসব?
- হুম, এবারে প্রসাদ বিতরণ হবেনা রে বাবু।
- সেকী?
- এতবড় একটা অতিমারী চলছে, এখন লোক সমাগম তো করা যাবেনা, আর হাতে হাতে ছুঁয়ে কাউকে কিছু দেওয়াও যাবেনা। তাই প্রসাদ বিতরণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঠাকুরকে ডাক, সব কিছু যেন, তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়।
ঢাকের বাদ্যি, কাজললতা
নতুন কানের দুল,
মায়ের শাড়ি, গাঁয়ের বাড়ি
খোঁপায় গাঁথা ফুল।
মা যে কোথায়, সুর কাটে হায়
দৃষ্টি ইটে ঠেকে,
মা বেটিতে আকাশ কুসুম
জানালা দিয়ে দেখে।