১৮
গ্রামে এলে পাখির ডাকে ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায়। এইসময়টা মেঠো পথে একটু হেঁটে বেড়াতে বা নিদেন পক্ষে বারান্দায় দাঁড়াতে খুব ভালো লাগে। মনটা শান্ত থাকে। একটা কুয়াশা ভেজা শীতল বাতাস শরীরে আদরের স্পর্শ দিয়ে যায়। আজ অবশ্য অন্যদিনের মত, অত শান্ত নেই চারপাশ। কারণ সেজজেঠুর উঠোনে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। ঠক ঠকাঠক বাঁশের শব্দ উঠেছে। কালকে বাবার কাজ। ঐ অত সকালে একটি ছোট বালিকা আমার নজর কেড়ে নিল। ওর নাম টিয়া। এবারে এসেই দেখলাম, আগে দেখিনি। টিয়ার মা মেজদাদার ঘরে ঘরকন্নার সাহায্যকারী। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা চলে এসেছে, মানে ওর মা কাজে লেগে পড়েছে। ফুটফুটিটাকে দেখলেই, আমি - টিয়া টিয়া টিয়া, অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে - বলে গান ধরি। আর টিয়া টকটক করে কথা বলে, ভারি মজা লাগে।
—এ্যাই টিয়া, ঠান্ডা আছে। জামার পিঠ খোলা কেন, এদিকে আয়, লাগিয়ে দিই।
—সেন নেই।
ওমা, সত্যিই পিঠের চেন কেটে গেছে। একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দিলাম।
—ওবাড়ি গিয়ে মার কাছে বোস, নইলে এবাড়ি আয়। ঠান্ডা লাগবে। হাতে ওটা কী?
—প্যায়ারা। হনু বাস্সা এট্টু খেয়ে ছুঁড়ছিল। আমি কুড়িয়ে খাইসি।
—এ্যাঁ, তুই হনুমানের এঁটো খাচ্ছিস, চল তোর মায়ের কাছে। আমি বিচার করব।
—হি হি হি।
টিয়ার হাত ধরে তার মায়ের কাছে দাঁড়াই। সে রান্নাঘরে গ্যাস ওভেনের দিকে ফিরে চা করছে।
—দেখো টিয়ার মা তোমার মেয়ের কীর্তি, বকে দাও তো।
—(টিয়ার মা একগাল হেসে সামনে ফেরে) ভালা আছ দিদি?
আমি চমকে প্রথমবারের মত তার দিকে ভালো করে তাকাই। তার ছাপা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা তোলা, ঘোমটায় কপাল ঢাকা আর দুই কানের পাশে আটকানো। ওর সঙ্গে আগে মুখোমুখি হইনি। টিয়াকে দেখে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি ওরা মুসলমান। না এতে আমার আপত্তি কিছু নেই। আসলে এটা নতুন দেখলাম। আতি চাচা এত তো আমাদের বাড়িতে আসত। দাওয়ায় বসত, কিন্তু ঘরে বসতে দেখিনি। রান্নাঘরেও কোনদিন মুসলমান মেয়ে বৌকে কাজ করতে দেখিনি। আমি সহজ ভাবে টিয়ার মায়ের সঙ্গে আলাপ জমাই। পঁচিশ বছর পড়াচ্ছি, দারোয়ান থেকে প্রিন্সিপাল, অভিভাবক থেকে ভেন্ডার, মন্ত্রী থেকে ছাত্রনেতা - অনেককেই সামলাতে হয়েছে। মনের বিস্ময় ভাব লুকোতে অনেকটাই শিখে গেছি। কিন্তু আমাদের ছোটবেলার কালের তুলনায় এখন বিভেদের প্ররোচনা অনেকটাই বেশি, সেখানে এমন মিলমিশ হচ্ছে কীকরে? তবে কী, ওদিকে বাঁধন যতই শক্ত হল, এদিকে বাঁধন ততই টুটছে? আমার ভাবনায় হঠাৎ একটা সম্ভাবনা দপ করে জ্বলে ওঠে। এমন নয় তো, নতুন মানুষদের চাপে এপারের ঘটি হিন্দু আর ঘটি মুসলমান হেঁসেলে এক হয়েছে! হঠাৎ চিন্তা সূত্র ছিঁড়ে যায়, সেই উদ্বাস্তু পরিবারের বধূটি বড়ি দেবার ব্যাপারে আমার বৌদির সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। পাশেই একটি বাড়িতে বড়ির দোকান দিয়েছে। সেখানে চাল থেকে নামিয়ে পাকা চালকুমড়ো দিলে দশটাকা লাভ। আমি মনে ভাবি, জমির সমস্যার জন্যে ওদের সঙ্গে এমন সহজ গতায়াত ছিলনা আমাদের। এখন কোন মন্ত্রে সব বদলে যাচ্ছে! বোধ করি একাত্তরের পুরোনো বাঙাল পরিবারটি এখন নবীন ঘটি। নতুন মানুষের ভয় এদের মনেও ঢুকেছে। অন্যদিকে ঐ নতুন মানুষদের যে কোন কর্মে সহজ নৈপুণ্যকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি। আড়বালিয়ায় এ এক নতুন সমীকরণ। বিয়ের পরে এখানে যখন আসতাম, বাবা মা আগে থাকতেই ঘাঁটি গেড়ে সব বন্দোবস্ত করে রাখত, আর আমরা এলে জামাই আদরে ব্যস্ত হয়ে যেত। আমি বাকি থাকা লেখালেখির ঝুড়ি নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসে থাকতাম। টাইমে টাইমে খাবার চলে আসত। কোনদিকে ভাবতে হতনা। আদরে বাঁদর ঠিক নয়, বরং বলা যায় আদরে গোবর ছিলাম। এখন ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় নামতে হয়েছে। বাবা মায়ের অবর্তমানে আড়বালিয়া নতুন রূপে আমার চোখে ধরা দিচ্ছে।
সকাল নটা বাজতে গেল, আজ থেকে এবাড়িতে ঊষা কাজ করবে। এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা। ভাবলাম সামনেই তো বাড়ি, যাই একবার ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, ব্যাপারটা কী। পায়ে পায়ে প্রথমবার ঊষাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ি। দেখি সামনের দাওয়াতে একটি অল্প বয়সী মেয়ে সেলাই মেশিনে ঝড় তুলেছে। মেয়েটির ছিপছিপে গড়ন, গম রঙা গা, পানপাতা মুখ, চোখ দুটি মায়াবী। আমাকে দেখে তার চোখে অল্প জিজ্ঞাসা আর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির রেশ দেখতে পেলাম, কিন্তু কথা বলার সুযোগ হল না, মেয়েটি ভারি ব্যস্ত। আন্দাজ করলাম, এ মেয়েটিই ঊষার পুত্রবধূ হবে। একটি মধ্যবয়সী পৃথুলা মহিলা পিছন ফিরে ঝুড়িতে বাসন সাজাচ্ছে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে আমার দিকে ফিরল। দেখলাম নিতান্তই ঘরোয়া এক ঘামে ভেজা বধূ, সামনের কয়েক গাছি চুলে পাক ধরেছে। বয়স আন্দাজ চল্লিশের কোঠায়, তার বেশি হবেনা। কিন্তু বোধ করি জীবনের বহু অভিজ্ঞতা তার মুখের ওপরে আঁকিবুঁকি কেটেছে। আমার নিজের ত্বকে বাষ্প, চুলে রঙ, ভ্রুতে ঢং - অনেক মোড়ক আছে, কিন্তু ঊষার এসবের বালাই নেই। গ্রামে কিন্তু এমন মোড়কের চল খুব ভালোরকমই আছে। শ্বশুর বাড়িতে মতি বউয়ের অতি চিকণ ভ্রু-রেখা দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। ঊষার সঙ্গে চোখাচোখি হতে আমি হাসলাম, সেও প্রত্যুত্তরে একগাল হেসে নিখুঁত আড়বালাইয়া টানে বলল,
—ছোটবাবুর মেয়ি? তোমার কতা অনেক শুনিসি বলো।
—তাই নাকি? তা কী শুনেছ শুনি।
—অনেক ভালা ভালা কতা গো দিদি। তোমারে একেনে সবাই ভালাবাসে। যেতি দেরি হল গো দিদি। আমারে আগে তো বলিনি তোমাদের বাড়ি কাজের কতা। আমি সেলাইয়ের অর্ডার ধরি নিসি। তাই খেটেখুটে রাতে শ্যাষ করিসি। এট্টু বাকি, তাই বৌমা মেশিনি বস্যে। এখন চল যাই তোমার কাছে। দোকানের লোক বৌমার থেকে কাপড় নে যাবানি। ওদের ফোন করি দিসি, এই কদিন কিসু নোবানি।
আমাদের বাড়িতে এসে ঊষা প্রথমে কলতলায় গত রাতের বাসন মাজে, রান্নাঘর গোছায়, সারা বাড়ি ঝাঁটপাট দিয়ে মোছে। ছাদে মাদুর পেতে বালিশ চাদর রোদে দেয়, ঘরের তাকগুলো ঝেড়ে মুছে নতুন খবরের কাগজ পাতে, একটা একটা করে জানালা, দরজা, বারান্দার গ্রিল সব ঝকঝকে করে মুছে ফেলে। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ঘরের সানশেডের ওপরে উঠে কবেকার তুলে রাখা পুরোনো ট্রাঙ্ক খুলে, ঝেড়েমুছে পিসিমণির করা কাঁথা বার করে ফেলল। নতুন, পুরোনো জামাকাপড় সব কেচে শুকোতে দিয়ে দিল। আমিও ওর গায়ে গায়ে ঘুরতে লাগলাম।
পরের দুদিন বাবার শ্রাদ্ধের কাজ, নিয়মভঙ্গ - ইত্যাদিতে কীভাবে যে সময় কেটে গেল তার হদিশ নেই। পাশের কাবাসীপাড়ায় বাবার মামার বাড়ি। আজও সে বাড়ি এক বিশাল যৌথ পরিবার। সেখান থেকে মামাতো কাকারা, দূর দূরান্ত থেকে মামাতো পিসিরা এসেছিলেন। সবার সঙ্গে সবার আজ কতকাল পরে দেখা, হাসি কান্না, গলাগলির পর্ব চলল দুদিন ধরে। কিন্তু এই বিশাল আয়োজন সামলাতে আমার কর্তা শ্বশুর বাড়ি থেকে রুনাদাকে আর আমাদের শহরের বাড়ির কাছ থেকে বিশু ঠাকুরকে নিয়ে এসেছিলেন। বিশু ঠাকুর একজন পোলাও বিশেষজ্ঞ। রুনাদা আর বিশুদা থাকায় ওদিকে আর আমাদের তাকাতে হয়নি। উত্তর চব্বিশ পরগণার এদিকে নিয়মভঙ্গে খাসির মাংস খাওয়ানোর রীতি। এর ভালোমন্দ বিতর্ক করতে গেলে বহু কথা উঠে পড়বে। তবে আমরা রীতি মেনেই চলেছি। আর অনেক লোকের মাংস রান্না, রুনাদার চেয়ে আর কেইবা ভাল করে সামলাবে! রুনাদা আমাদের বাড়িতে রান্না ভালো করার জন্য নিজের হাতে চাট মশলা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিজের কাজের প্রতি রুনাদার ডেডিকেশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনা। আমি ভালো করে জেনে নিয়েছি কীভাবে বানাল। গোটা জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, পুদিনা পাতা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করেছে রুনাদা। এর সঙ্গে মিশিয়েছে আদা গুঁড়ো। বাড়িতে যে আদাগুঁড়ো করা যায়, তা আমার ধারণাই ছিলনা। রুনাদার পদ্ধতি শুনে আমি তো চমৎকৃত। আদা ধুয়ে শুকিয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। খোসা ছাড়িয়ে ফেললে আর কিন্তু ধোওয়া যাবেনা। এবারে সরু সরু কাঠির মত করে আদাটা কেটে নিয়েছে। তারপর চার পাঁচ দিন ধরে চড়া রোদে শুকিয়েছে, এমনভাবে যাতে নাড়াচাড়া করলে ঝনঝন করে আওয়াজ হয়। এবার শুকনো আদাটা গুঁড়ো করে নিয়েছে। শেষে পুরো মিশ্রণটার সঙ্গে মিশিয়েছে আমচুর পাউডার, হিং আর নুন।
কাজ মিটলে এবার চিন্তা জমির সমস্যা মেটানো। দেখা গেল যে আমাদের আর প্রতিবেশীদের মানচিত্রের মধ্যে ফারাক খুব বেশি নয়, কয়েক ফুটের বিতর্ক। ভাই, বোন, বৌমা, জামাই সকলে মিলে জরুরী সভা বসে। একবার যখন ওদের থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়া গেছে, এই সুযোগ ছাড়া যাবেনা। এখন সকলে উপস্থিত আছে। সবার সামনে ওদের জন্য কয়েক ফুট যদি ছেড়েও দিতে হয় তাই সই। আগের প্রজন্মে দুই বাড়িতেই আবেগ ছিল বেশি, ফলে নমনীয়তা কম ছিল। তাই সমাধান হয়নি। যাই হোক আমিন ভদ্রলোক আসেন, সীমানায় সিমেন্টের খুঁটি বসিয়ে দেওয়া হয়। ওদের বাড়ির ছেলেগুলি আমার কর্তাকে, “জামাইবাবু, ও জামাইবাবু” বলে ডাকাডাকি করে, হাসি মশকরা করে। শুনে বেশ ভালোলাগে আমার। এতকাল তো আমি একটা দিদি পড়ে ছিলাম এদিকে, কিন্তু সম্পর্ক সহজ ছিলনা বলে আগে কথা হয়নি।
ঊষার সঙ্গে আমি বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছি। ওর সাত পুরুষের বাড়ির দেশ হল সাতক্ষীরায়। বাবা ছিলেন কবি। এক কবিগানের দলে গান বাঁধতেন, গান গাইতেন। মোটামুটি চলে যেত। কিন্তু কাল হল দাঁতের অসুখে। বাবার দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে অকালে পড়ে যেতে শুরু করল। অনুষ্ঠানে গানের কথার উচ্চারণে ত্রুটি হতে লাগল। বাবা গানের দল থেকে বাদ পড়লেন। ঊষাদের পরিবারেও নেমে এলো দারুণ অভাব। তারপরে ঊষাদের মত মেয়েদের যেমন কপাল হয় তেমন - চোদ্দ না পেরোতে বিয়ে, শ্বশুর বাড়ির গঞ্জনা, এঘাট, ওঘাট ঘুরতে ঘুরতে নানারকম কাজ শেখা, পেট চালানো আর ছেলেকে বড় করার জন্য দুরন্ত সংগ্রাম। স্রোতের টানে এসে পড়েছে আড়বালিয়ায়। সাতক্ষীরায় বাড়ি বলেই ও আড়বালাইয়া টানে কথা বলে।
গুগল ম্যাপে দেখে এলাম -
দুই ভুবনের বাঁকে,
বসিরহাট আর সাতক্ষীরা ভাই
পাশাপাশি থাকে।
কাঁটাতারের ফাঁকে ফাঁকে
খুঁটি অনেক পোঁতা,
মধ্যিখানে সীমান্তটা
মরা নদীর সোঁতা।