৭
অন্নদাদি আমাদের বাড়ির অনেক পুরোনো খবর জানেন, যা আমি চোখে দেখিনি, কিন্তু আগে হত। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিটিও ভারী অভিনব। বেশ নাটকীয়তা থাকে। একদিন সকালে উঠোনের একটি কোণ ইশারায় দেখিয়ে আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, আর গান ধরলেন - 'সব সখীকে পার করিতে নেব আনা আনা, শ্রীমতীকে পার করিতে নেব কানের সোনা'। গল্পের গন্ধ পেয়ে আমিও টানটান হলাম। ও মা! তারপরে বুড়ি ফুল তুলছে, মালা গাঁথছে, মন্দিরের কাজ করছে, কিন্তু ঠোঁট আর ফাঁক করছেনা। আসলে পরীক্ষা করছে আমার ধৈর্য কতখানি। শেষমেশ সেই দুপুরের খাওয়ার পর তাঁকে চেপে ধরলাম -
— ও অন্নদাদি, সকালে উঠোনের কোণটা দেখিয়ে যে গান ধরলেন, তার কারণটা বলুন।
— সেসব অনেক আগের কথা। চৈত্র মাসে গাজনের দিনে আশপাশের গ্রাম থেকে কাঁচা বয়সের ছেলে ছোকরা যারা গাজন সন্ন্যাসী হত, তারা আসত, তাদের মাথায় পাটের বিঁড়েতে দইয়ের হাঁড়ি। হাঁড়ির ওপরে আম্রপল্লব। রাতে উঠোনের ঐ জায়গাটায় তারা হাততালি দিয়ে নেচে নেচে গাজনের গান গাইত।
— কিন্তু আপনি তো তখন রাধাকৃষ্ণের গান গাইছিলেন অন্নদাদি। গাজনের গান তো শিবঠাকুরের।
— আশপাশের গাঁয়ের ছেলে তো সব। তারা শুধু গাজন নয়, আরও একদিন আসত।
— কবে?
— জন্মাষ্টমীর পরের দিন মন্দিরে নন্দোৎসব হত। সেই দিন। এ বাড়িতে সাত গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ত উৎসব দেখতে।
— তাই নাকি? কিন্তু ব্যাপারটা কী, ঐ উৎসবে কী এমন হত?
— ব্যাপারটা হল, জন্মাষ্টমীর দিন ছেলে জন্মেছে। তাই বাবা নন্দ আনন্দে উৎসব করছেন। সেই উৎসব বাড়িতে পালন হত। কলাপুঞ্জা থেকে কীর্তনের দল আসত। শ্রীরাধিকার নামে পালাগান হত। গাইতে গাইতে ঐ কীর্তনিয়ারা পুরো ভিটেটাই প্রদক্ষিণ করত।
— আর সেই ছেলের দল?
— তোমার দাদাশ্বশুরের ঠিক করা এক বৈষ্ণব পরিবার ছিল। তারা নন্দোৎসবের বিশেষ নাচে গানে দক্ষ ছিল। তাদের বাড়ির টুকটুকে ছোট ছেলেটাকে তোমার শাশুড়ি ডানদিকে আঁচল করে শাড়ি পরিয়ে দিত। কিছু গয়না গাঁটিও পরানো হত। সেই ছেলেটা নন্দরানী হত। মাথায় দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে সে যশোদা মা হয়ে নাচত। অন্য ছেলেরা গোপী হয়ে নাচত। সঙ্গে মন্দিরে পুজো চলত। সকাল দশটা এগারোটা থেকে এইসব নাচ, গান, কীর্তনের অনুষ্ঠান চলত বিকেল পর্যন্ত।
— বা রে বা, বেশ তো। খুব জমজমাট ব্যাপার। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার কিছু ছিলনা। এত লোক যে আসত।
— ও বাবা, ছিলনা আবার! খুব ছিল। নন্দরানীর নাচ শেষ হলে সে দই ভর্তি হাঁড়ি মাটিতে ফেলে ভেঙে দিত। তারপর মাটিতে সেই ছড়িয়ে পড়া দইয়ের ওপরে ছেলেটা গড়াগড়ি দিত। এই অনুষ্ঠান শেষ হলে শুরু হত দুপুরে খাওয়ার পর্ব। পুরো উঠোন জুড়ে খেজুর পাতায় বোনা সরু লম্বা লম্বা চাটাই পেতে আসন করা হত। তাইতে বসে চলত নিরামিষ ভুরিভোজ।
— কেমন ভুরিভোজ একটু শুনি।
— ভাতের সঙ্গে আধভাঙা খোসা সমেত মুগের ডাল, আলু ভাজা, খামালু আর কুমড়ো দিয়ে ঘন্ট, মটরের তরকারি, চালকুমড়ো আর চালতা দিয়ে টক। সঙ্গে থাকত নারকেল কোরা মেশানো আখের গুড়ের পায়েস বা ক্ষীরিভোগ।
— গরমকাল বলে কি আখের গুড়ের পায়েস হত, অন্নদাদি? আমার বাপের বাড়িতে কিন্তু নলেন গুড় মানে খেজুর গুড়ের পায়েস হত শীতকালে।
— আ মলো যা। ঠাকুরের ভোগে কখনও খেজুর গুড় দেয়না। ও গুড়কে আমিষ ধরা হয়। ঠাকুরের ভোগ সবসময়ে আখের গুড় দিয়ে হয়।
— ওহ, আমি জানতাম না।
— নন্দোৎসবের ঐ জায়গাতেই মহরমের অনুষ্ঠানও হত।
— মহরম? গোপীনাথের ভিটেতে মহরম?
— জ্যাঠাবাবুর বাবা মানে তোর দাদাশ্বশুর তারিণীপ্রসাদ গান্ধীবাবার শিষ্য হয়ে জাতপাতের বেড়া বিসর্জন দিয়েছিলেন।
— অনুষ্ঠানটা কী হত?
— মহরমের দিন দুপুরবেলা মান্দারপুর থেকে মুসলমান ছেলেরা আসত মহরমের মিছিল নিয়ে। গোপীনাথের সামনের উঠোনে তারা লাঠি খেলা দেখাত। কেউ কেউ গালে ছুঁচ ফুটিয়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে মহরমের শোক পালন করত। আচার অনুষ্ঠান শেষ হলে চাল আর টাকায় বকশিশ নিয়ে তারা বিদায় হত।
— সত্যি আশ্চর্য অন্নদাদি, কীসব দিন, আমরা কিছুই দেখতে পেলাম না।
— তোমরা দেখবে কীকরে গো মা, গ্রাম কি আর সে গ্রাম আছে! মোবাইল এসে সব খেয়েছে। আজকাল কেউ কারোর বাড়ি যায়, এমন দেখেছ? আর গাঁয়ের ছেলেপুলে এখন এসব শিখবে? সন্ধে হলেই দেখো গে যাও আড়িয়ার ওপরে বসে সব নেশায় বুঁদ। অশ্রাব্য গালিগালাজ চলছে।
এবাড়ির নতুন পুরুত ঠাকুরেরাই কী সব পুরোনো নিয়ম কানুন জানে?
— পুরোনো নিয়ম কানুন মানে?
— শোনো মেয়ে জন্মাষ্টমীতে এবাড়ির মন্দিরের ভোগের তালিকা।
— বলুন (আমি তাড়াতাড়ি খাতা কলম খুঁজে আনি)
— আতপ চাল, সাদা তিল, গোটা মুগ, ছোলা, মটর, চীনা বাদাম ভেজানো থাকবে। সঙ্গে থাকবে আটকড়াই ভাজা, মরশুমি ফলমূল আর নাড়ু।
— আটকড়াই কী?
— নন্দরানী মা হয়েছেন। আঁতুড়ে আটকড়াই খাওয়ানোর নিয়ম। ছোলা, কলাই, মুগ, মটর, খেসারির ভাজা আর ঘরে তৈরি চিঁড়ে, মুড়ি খই – এই আট রকম ভাজা দিয়ে হবে আটকড়াই।
— বাঃ, দারুণ তো, শুকনোর ওপরে বেশ অয়েল ফ্রি ব্যালান্সড ডায়েট।
— বাঃ বেশ তো বললি, তুই নিজে না মেয়ের মা। ঐ ব্যালাম ডায়েট না কি বললি, তা কি শুধু ছেলের মায়েরা পাবে?
— মানে?
— মানে হল, শুধু জন্মাষ্টমীর গল্প শুনে নেচে উঠলে চলবে? এ বাড়িতে রাধাষ্টমীও হত।
— ওরে বাবা, বলুন বলুন লিখে ফেলি। কথা তো ঠিকই।
— রাধাষ্টমী হল মেয়েলি ব্রত। সংসারের সুখশান্তি ও মঙ্গলকামনায় করা হত। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে শ্রীরাধিকার জন্মদিন।
— ওহ, তার মানে এটা হল মেয়ের জন্মদিন পালন। নিয়মগুলো কী?
— ভোগের নিয়ম প্রায় একই। কেবল একটুখানি তফাৎ আছে। জন্মাষ্টমী পুজো যেমন রাত বারোটায়, রাধাষ্টমীর পুজোর সময় উল্টো। পুজো হয় দিনের বেলা, দুপুর বারোটায়। নৈবেদ্যতে আতপ চাল আর সেদ্ধ চাল দুটোই লাগে। আর রাধারানী মেয়ে সন্তান। তাই আদর করে নাড়ু আবার তার সঙ্গে মুড়কি দেওয়া হয়।
— কেয়াবাৎ, একদম সঠিক নিয়ম। (হাততালি দিয়ে উঠি আমি)
"ছোট ছোট মেয়ে গুলি
কিসে হয় তৈরি।
কিসে হয় তৈরি?
ক্ষীর ননী চিনি আর
ভাল যাহা দুনিয়ার
মেয়েগুলি তাই দিয়ে তৈরি।।"
অন্নদাদির কথা বলতে বসলে ফুরোয়না। হঠাৎ ফোনটা ঝনঝন করে ওঠে। হুম, এতক্ষণ ফোনটা আসেনি কেন, তাই ভাবছি।
— জেঠিমা।
— বল মা।
— সব মিলিয়ে দেখলাম। ধুতি,শাড়ি, জামাকাপড় যা এসেছিল, সবই বিতরণ হয়ে গেছে। কেবল দুটো পড়ে আছে।
— কোন দুটো?
— ধোপা বৌয়ের শাড়ি, আর শীতলা মায়ের শাড়ি।
— কী বললি, শীতলা মায়ের শাড়ি পাঠানো হয়নি? আর গণেশের ধুতি?
— ওটা গেছে। যে নিয়ে গেছে, সে ভুল করে শাড়িটা ফেলে গেছে।
— সর্বনাশ। দর্পণে বিসর্জন কী হয়ে গেছে?
— না না হয়নি এখনও। আসলে প্রতিবার এগুলো তো জেঠু পাঠায়। এবারে তোমরা নেই, সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।
— তুই শিগগির গিয়ে স্বপন ঠাকুরকে বল, এখুনি বিসর্জন না করতে। আর রুনা জেঠুকে বল, বিসর্জনের আগে যে করে হোক শাড়িটা পাঠিয়ে দিতে। আর শোন, ধোপা বৌয়ের শাড়িটা নিয়ে চিন্তা নেই। লকডাউন বলে ও হয়তো আসতে পারেনি। রুনাদাকে বল, ওর ছেলেকে খবর দিলে সাইকেলে করে এসে নিয়ে যাবে।
— আচ্ছা, যাচ্ছি, যাচ্ছি।
ফোনটা কেটে যায়।
আসলে মা দুর্গা তো বাড়ির মেয়ে। মেয়ে যখন বাপের বাড়ি আসে, তখন কিছু না কিছু উপহার আনে। সেই সূত্র ধরে বাড়ির দুর্গার তরফ থেকে গ্রামের প্রাচীন শীতলা মন্দিরে মায়ের জন্য শাড়ি পাঠানো হয়, মানে শাড়ি পাঠিয়ে শীতলা মাকে বাড়ির উৎসবে আসার জন্য নেমন্তন্ন করা হয়। মায়ের সঙ্গে মন্দিরে ছোট গণেশ আছেন। তাঁর জন্য বাড়ি থেকে একটা ছোট কমলা পাড়ের ধুতি যায়। আবহমানকাল থেকে এই নিয়ম মানা হচ্ছে। এখন শাড়িটা ভুল করে পাঠানো হয়নি। বিসর্জন হয়ে গেলে প্রতিমা থেকে মা মুক্ত হয়ে যাবেন। তখন তো আর বাড়ির মেয়ে থাকবেন না। নেমন্তন্নও করা হবেনা। প্রথায় ছেদ পড়বে, তাই হুড়োহুড়ি।
একটু পরেই কর্ণা আবার ফিরে ফোন করে।
— জেঠিমা, শীতলা মায়ের শাড়ি পাঠানো হয়ে গেছে। আর আমি জানতাম না, রুনা জেঠু ধোপা বৌয়ের ছেলেকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে এসে শাড়িটা নিয়ে গেছে।
— যাক বাবা। খুব ভালো কাজ করেছিস তুই।
— জেঠিমা, বাড়িতে, মন্দিরে, রান্নাঘরে, বাগানে যারা কোন কাজ করে, তাদের পুজোতে জামাকাপড় দেওয়া হয়। কিন্তু ধোপা বৌ তো এবাড়িতে কাজ করেনা, তাকে শাড়ি কেন দেওয়া হয়?
— ধোপা বৌ, আগে কাজ করত বাবু। তোমার বাবা, জেঠু, পিসিরা সব ওর কোলে পিঠে হয়েছে। এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু তার আগের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে পুজোতে একটা শাড়ি দেওয়া হয়। এটা তার হক।
— ঘটের শাড়ি, গামছা কী হবে জেঠিমা, তিনটে ঘটের ওপরে যে সাজানো রয়েছে।
— ওগুলো তিনজন ঠাকুরমশাই নেবেন। ওঁদের স্ত্রীরা শাড়িগুলো পরবেন। গামছাগুলো ওঁদের বাড়িতে ব্যবহার হবে।
— আর ঠাকুরমশাইরা পাবেনা?
— কেন, ষষ্ঠীর দিন পুরোহিত বরণ হয়নি?
— ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ধুতি, উড়নি, সিধে দিয়েছি তখন।
— পুজো শেষ হলে দক্ষিণা পাবেন।
— জেঠিমা, আজ নিরামিষ খাওয়া শেষ। মাংস রান্না হচ্ছে। তুমি মাংস করছ বাড়িতে?
— করছি, তবে তেল ঝালের মাংস নয়, স্টু বানাব।
— রুনা জেঠু রান্না করছে জেঠিমা, দারুণ গন্ধ উঠেছে।
— খুব ভালো। অনেক খেটেছিস। দায়িত্ব সামলেছিস। এবারে কব্জি ডুবিয়ে খা। বেলা হচ্ছে। দর্পণে বিসর্জন হয়ে গেলে, চানে যা। খেয়ে দেয়ে আবার ঠাকুর ভাসানে বেরোতে হবে। ঠাকুর বরণ করার লোক আছে তো?
— জেঠিমা, একটা কথা শোন, একটু আগে মা ফোন করেছিল, আসবে বলেছে।
— আরিব্বাস! এত বড় খবরটা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলি? তাহলে মা—ই করে দেবে বরণ। এবারে কোভিডের জন্যে পাড়ার মেয়ে বৌ বেশি তো থাকবেনা। তুই মন্দিরে যারা রান্না করে, তাদের বল, বরণের সব গুছিয়ে রাখতে আর বরণের সময়ে থাকতে।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাই জেঠিমা।
কোভিডের বিচ্ছিন্নতা মানুষকে দূরত্বের কষ্টটা একটু বেশি করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাই হয়তো সম্পর্কের বরফে উষ্ণতার ছোঁয়া লেগেছে। কোন কিছুর সব খারাপ তো হয়না। কোভিডের এটাই হল ভালো দিক। এ অসুখ হঠাৎ নিয়ে এসেছে এক অনাস্বাদিত অনিশ্চয়তা। জানি না, কাকে কখন হঠাৎ চলে যেতে হবে। এমন অসময়ে যাওয়ার কথা ভাবলেও ভয় লাগে। মেয়েরা ছোট আছে।
"এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ্ ডাকে আয়, আয়, আয়।
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতা কাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়।
যেতে পারি,
যেকোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো,
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না"
অনেক কাজ বাকি। মেয়েদের ফেলে যেতে চিন্তা হয়।