৩
“গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মত –
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে।”
বক্সি বাড়ির চারপাশে রাতে ঝিঁঝিঁ ডাকে। দোতলার বারান্দা থেকে তারার আলোও চোখে পড়া দুষ্কর। চারিদিকে ঝুপসি গাছে আলো আটকে যায়। ঠাকুর মশাই গোপীনাথের দ্বার খোলেন। রোজকার মতো বেজে ওঠে বড় কাঁসর, ছোটো ঝালি। ঠাকুরমশাই আরতি করেন পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে। ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়।
রান্নাঘরে নতুন করে আঁচ পড়ে। সকালের ডাল অনেকটা আছে। বেগুন ভাজা হবে। আর একটা বিশেষ আইটেম রান্না হবে রাতে।সেটা হল গুগলির তরকারি। মেয়েরা খুব ভালোবাসে। বেগুনটা আজ মশলা দিয়ে ভাজা হবে।
একটা কাঁসিতে বেসন, চালের গুঁড়ো, আমচুর পাউডার, হলুদ, অল্প একটু কালোজিরে, একটু লঙ্কা গুঁড়ো আর নুন মিশিয়ে রাখতে হবে। বড় মোটা কালো বেগুনগুলো একটু মোটা চাকা চাকা করে কাটা হয়। মিশ্রণে একটু জলের ছিটে দিয়ে বেগুনগুলো ভালো করে মাখিয়ে তেলে ভেজে নিতে হবে। বাড়িতে এই মশলা দিয়ে বেগুন ভাজা সকলে পছন্দ করে। আমি অবশ্য খাবার সময়ে বেসনের ছাল ছাড়িয়ে ভেতরের বেগুনটা খাই। ওপরে পরত থাকলে, ভেতরের বেগুন সেদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু সরাসরি তেল ঢুকে বজবজ করেনা।
আর গুগলির স্বাদে আমি বিয়ের পরেই মজেছি। বাপের বাড়িতে এসব খাওয়ার চল ছিলনা। মেয়েরা ভীষণ ভালোবাসে বলে, কর্তা গুগলি পেলেই কিনে নেন। রান্নাটা একটু গরগরে মাখামাখা হয়। স্বাদটা পুরো মাংসের মতো লাগে। অথচ মাংসের থেকে অনেক সহজে কম সময়ে হয়ে যায়। আজও বিকেলে হাট থেকে কর্তা গুগলি নিয়ে এসেছেন।
গুগলিগুলো রান্না করার আগে ভালো করে ঘষে ঘষে খুব ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হয়। তারপর জল ঝরিয়ে গরম তেলে নুন হলুদ দিয়ে গুগলি ভেজে তুলে নিতে হয়। সেই তেলেই পেয়াজ লাল করে ভেজে নিতে হয়। তারমধ্যে ডুমো আলু, নুন, হলুদ দিয়ে ভেজে নিতে হয়। ভাজা হলে আদা, রসুন, টমেটো বাটা, নুন, চিনি, হলুদ, ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে নাড়তে থাকলাম। মশলা বেশ করে কষা হয়ে গেলে তেল ছেড়ে যাবে। তখন ভাজা গুগলি দিয়ে নেড়েচেড়ে একটু জল দিয়ে চাপা দিতে হয় কুড়ি মিনিটের জন্য। তারপর ঢাকা খুলে ধনেপাতা ও গরমমশলা ছড়িয়ে নামিয়ে দিলাম। ধনেপাতা না দিলেও হয়। এটা তো শ্বশুরবাড়ির রেসিপি বললাম। এর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমি একটু মাত্রা দিয়ে দিই। কড়ায় পেঁয়াজ ভাজার আগে সর্ষের তেলে হলুদ আর কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে দিই। এতে মশলা কষার পর যখন তেল ছাড়ে, তারপর জল দিয়ে ফোটানো হয়, তখন সুন্দর লাল রঙের তেল ওপরে ভাসে। নামানোর আগে কখনও ইচ্ছে হলে ধনেপাতা না দিয়ে ঘি, গরম মশলা দিয়ে নামাই।
খাওয়া দাওয়া সেরে রাতে একটু নিচের বারান্দায় আড্ডা হয়। কিন্তু মেয়েরা আজ ছিনে জোঁক। ছোঁ মেরে আমায় নিয়ে গেল দোতলায়।
- এবারে বাকিটা বলো মা।
- সে অনেক কথা, আবার কাল হবে।
- না না প্লিজ মা। আজ আর একটু এগোতে হবে।
- হ্যাঁ জেঠিমা, শুরু করো।
- আসলে কি জানিস, দুই কুমুদিনীকে গুলিয়ে ফেলার জন্য শুধু গুগলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের সংসদ বাঙ্গালী চরিতাভিধানে পর্যন্ত দুই কুমুদিনী মিশে গেছেন। একজন কুমুদিনী বসুর বিষয়ে যে প্যারাগ্রাফ রয়েছে, তাতে একসঙ্গে দুই কুমুদিনী বসুর বইয়ের তালিকা রয়েছে। বইগুলো খুলে না পড়লে, শুধু ওপর থেকে বোঝা অসম্ভব।
- রবীন্দ্রনাথ মেরী কার্পেন্টার বইয়ের রিভিউতে কী লিখেছেন জেঠিমা?
- রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এই বইটিও শিখের বলিদানের মতোই ভালো হয়েছে। শিখের বলিদান বইটি ভালো লেগেছিল বলে তিনি বাড়ির ছেলেদের দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের হাতে পড়ে বইটির পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে।
- হা হা হা, তাই নাকি। দেখো মা, ঠাকুর বাড়ির ছেলেপুলেরাও আমাদের মতো।
- হুম। যাই হোক এই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, যে শিখের বলিদান (১৯০৪), মেরী কার্পেন্টার (১৯০৬), পূজার ফুল (১৯২৫), এবং বোঝবার ভুল (১৯২৭) আমার পূর্ব পুরুষ কুমুদিনী বসুর লেখা।
কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে দুটো জায়গায়। এক অন্তর্জালের আর পরিবারের সালের হিসেব মিলছেনা। আর ঐ কুমুদিনী বসুর স্বামী হিসেবে কোথাও ব্রাহ্মনেতা শচীন্দ্রনাথ বসু, কোথাও বসু মল্লিক পরিবারের প্রবোধচন্দ্র বসুর নাম আছে। এবং দুটি সন্তানের উল্লেখ আছে। কিন্তু পারিবারিক ইতিহাসের সূত্রে আমরা জানি, যে কুমুদিনীর স্বামী এবং আমার মায়ের ঠাকুরদা হলেন শরৎচন্দ্র বসু। তাঁদের পাঁচটি পুত্র এবং তিনটি কন্যা মোট আটটি সন্তান বয়োপ্রাপ্ত হয়েছে।
আর একটি সূত্র আছে। বোঝবার ভুল বইটা লেখিকা মানে আমাদের কুমুদিনী উৎসর্গ করেছেন বান্ধবী সুলাজিনী দেবীকে। লেখা আছে তিনি রণেন্দ্রমোহন ঠাকুরের পত্নী।
- সুলাজিনী কে?
- অন্তর্জালে জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশপরিচয় তৃতীয় খন্ড থেকে, সুলাজিনী দেবীর পরিচয় বার করেছি। সম্পর্কটা একটু ধৈর্য ধরে তোদের বুঝতে হবে।
ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ জগন্নাথ ঠাকুর। তাঁর পরে পরপর বলরাম, হরিহর, রামানন্দ, মহেশ্বর, পঞ্চানন ও জয়রাম এই ছয় পুরুষ। জয়রামের পুত্র দর্পনারায়ণের থেকে শুরু হয় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার। আর জয়রামের অপর পুত্র, দর্পনারায়ণের ভাই নীলমণির থেকে শুরু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।
- আচ্ছা।
- দর্পনারায়ণের পাঁচ পুত্রের দুজন হলেন গোপীমোহন ঠাকুর এবং হরিমোহন ঠাকুর। গোপীমোহনের পুত্র বিখ্যাত প্রসন্ন কুমার ঠাকুর। এঁর দৌহিত্র ভুজেন্দ্রভূষণ চ্যাটার্জি। তাঁর তৃতীয়া কন্যা সুলাজিনী দেবী। এবার হরিমোহনের পরপর উত্তর পুরুষেরা হলেন - নন্দলাল, ললিতমোহন, রঘুনন্দন। রঘুনন্দন ঠাকুরের স্ত্রী হলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও জ্ঞানদাসুন্দরী দেবীর কন্যা মুক্তকেশী। রঘুনন্দন ও মুক্তকেশীর পুত্র রণেন্দ্রমোহন ঠাকুর। অর্থাৎ দুই সহোদর ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে একজনের নাতনির দিক দিয়ে চতুর্থ পুরুষ এবং অপরজনের নাতির দিক থেকে চতুর্থ পুরুষের বিবাহ হয়েছে।
- এরকম ও হয়?
- হয়েছে তো দেখছি। রণেন্দ্র - সুলাজিনীর কন্যা লীলাদেবীও লেখিকা ও শিল্পী। তাঁর স্বামী হলেন, স্যার আশুতোষ চৌধুরীর ছেলে বিখ্যাত আর্কিটেক্ট আর্যকুমার চৌধুরী। সে যাই হোক। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের গোড়ায় এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সমাজের মাথা। একই সঙ্গে ক্ষমতাশালী এবং প্রতিভাধর। আমার পূর্বপুরুষ কুমুদিনীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যখন সুলাজিনী, এবং তাঁকে ইতি তোমার মিলন বলে সম্বোধন করে বই উৎসর্গ করেছেন, তখন এটাই প্রমাণ হয়, যে কুমুদিনীও ঐ ক্ষমতা ও প্রতিভাশালী সমাজের অংশ। মেরী কারপেনটার বইয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে মনে হয়, তাঁর সঙ্গে কুমুদিনীর খুবই সুসম্পর্ক। আবার বোঝবার ভুলের উৎসর্গ দেখে জানা যায়, ঠাকুর পরিবারের বংশধর ও বধূ সুলাজিনী তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এতে ও কিছুটা দিক নির্দেশ পাওয়া যায়, যে হতে পারে দুই লেখিকা এক ব্যক্তি।
- ঠিক আছে, কিন্তু প্রবোধ বসুমল্লিক, আর দুটো সন্তানের কথা কীভাবে এল?
- বলছি, বলছি, ধৈর্য্য ধর। ফেসবুকে রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়ি রক্ষা করা নিয়ে একটি প্রবন্ধ পেলাম। সেখানে জনৈক রামকুমার বসুমল্লিকের উল্লেখ পেলাম। যিনি বসু বংশজাত, কিন্ত পূর্ব পুরুষেরা বাংলার সুবেদার ছিলেন বলে মল্লিক উপাধি পান। তিনি বর্ধমান, হুগলি ও চব্বিশ পরগণার কিছু অঞ্চলের ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রী – প্রথম স্ত্রীয়ের এক পুত্র পার্বতী চরণ এবং দ্বিতীয় স্ত্রীয়ের দুই পুত্র জ্যেষ্ঠ রাধানাথ ও কনিষ্ঠ মহেশচন্দ্র। রাধানাথের জীবনকাল লেখা আছে ১৭৯৮-১৮৪৪। এই রাধানাথ নিজ ব্যবসায়িক কুশলতায় M/S Beauchamp কোম্পানির অংশীদার হন এবং Sir William Wallace নামে একটি মালপরিবহনকারী স্টিমারের মালিক হন। কালক্রমে তাঁর বংশধরেরা বসু পদবী পরিত্যাগ করে শুধু মল্লিক ব্যবহার শুরু করেন। কলকাতার বিখ্যাত রাজা সুবোধ মল্লিক এই বংশের কুলতিলক। ঐ প্রবন্ধে কিন্তু মহেশচন্দ্রের বংশধরদের কোনো উল্লেখ নেই। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, এই মহেশচন্দ্রই আমাদের মহেশচন্দ্র কিনা। কিন্তু এই বসু মল্লিকদেরও নিজস্ব কুল পুঁথি আছে। সেটা পড়ে দেখলাম ইনি অন্য মহেশচন্দ্র।
যাই হোক, তবে অন্তর্জালের বিভিন্ন স্থানে কুমুদিনী বসুর (মিত্রের) দুটি সন্তান কেন বলা হয়েছে, সেটি মনে হয় উদ্ধার করতে পেরেছি। কারণ রাজা সুবোধ মল্লিকের মা হলেন আর এক কুমুদিনী। তিনি দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্রের মেয়ে। রাজা সুবোধ মল্লিক হলেন, পূর্বে বর্ণিত রাধানাথ বসু মল্লিকের প্রপৌত্র। রাধানাথ - জয়গোপাল - প্রবোধ চন্দ্র - সুবোধ চন্দ্র। প্রবোধ চন্দ্রের স্ত্রী ঐ আমলের তৃতীয় কুমুদিনী। তাঁর দুটি সন্তান। সুবোধ চন্দ্র ও ইন্দুমতী। অন্তর্জালে যাঁরাই দু চার কথায় কুমুদিনী বসুর অণু জীবনী লিখেছেন, তাঁরা হয়তো দুই নয়, এই তিন কুমুদিনীকে গুলিয়ে ফেলেছেন, কারণ অদ্ভুতভাবে তিনজনেরই বাপের বাড়ি মিত্র, আর শ্বশুর বাড়ি বসু। তৃতীয় জনের ক্ষেত্রে বসুমল্লিক পদবীর বসু অংশটি প্রাথমিক। মল্লিক হল জমিদারদের মুসলমানী উপাধি।
- আগের দুই কুমুদিনী লেখিকা। ইনিও কি লেখিকা?
- না তেমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি।
- দেখো মা, আমার কাছে কিন্তু কুমুদিনীদের রহস্য সব সহজ হয়ে যাচ্ছে।
- কীরকম?
- প্রথম কুমুদিনী বসু (মিত্র) যাঁর স্বামী অতুল চন্দ্র বোস, আর বাবা মদনমোহন মিত্র, তিনি লেখিকা কিন্তু বিপ্লবী নন।
- ঠিক। তবে তাঁর অনেক লেখাতেই পরাধীনতার জ্বালা, শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ ধরা পড়েছে। তাই হাতে কলমে বিপ্লবী না হলেও সেই চেতনা ছিল।
- তৃতীয় কুমুদিনী বসু (মিত্র) - যাঁর স্বামী প্রবোধ বসুমল্লিক আর বাবা রাজকৃষ্ণ মিত্র, তিনি লেখিকা বা বিপ্লবী নন।
- হুম, লেখিকা নন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যাঁর ছেলে সুবোধ মল্লিক, তাঁর বিপ্লবী চেতনা ছিলনা, একথা কি হলফ করে বলা যায়!
- সুবোধ মল্লিক কে গো মা?
- তিনিও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। রাজা উপাধিটা তিনি দেশবাসীর কাছ থেকে পেয়েছেন। ইংরেজের উমেদারি করে নয়। উইকিপিডিয়ায় পড়ে নিস।
- আচ্ছা, দ্বিতীয় কুমুদিনী মিত্র লেখিকা, বিপ্লবী। আবার বলছো, বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে ভগিনী নিবেদিতার উল্লেখ রয়েছে। বিকাশ বোস তাঁর মা কুমুদিনীর সঙ্গে নিবেদিতার কাজের গল্প করে গেছেন। সেটা স্বকর্ণে শুনেছে বাবলি মাসি। সাক্ষী জীবিত। আবার ওনার লেখা বইও তোমার কাছে আছে জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। বিপ্লবী, লেখিকা, নিবেদিতার সহযোগী যে কুমুদিনী, তিনিই আমাদের পূর্বপুরুষ। এতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কেন বলছ লীলাবতীর মেয়ে কুমুদিনী আমাদের বংশের নন?
- কাল আবার বলব, আজকের মত এখানেই ইতি।