নদী ধীর লয়ে ভাঙে
একূল, ওকূল।
আমার মনের গাঙে
অস্ফুট স্বপ্নের ফুল।
এমন চলতে চলতে, অফিসে একটি ছেলে আমাদের ল্যাবে যোগ দিল। বাড়ি দীঘার কাছে, রামনগরে। আমার থেকে বয়সে খানিক বড়, তবে অফিসে তো জুনিয়র, তাই একটু অ্যাটিট্যুড নিয়ে থাকতাম। তবে পরে বন্ধুত্ব হয়ে গেল, কারণ ছেলেটি ছোট থেকে আমার মত শুকতারা, আনন্দবাজার এবং অরণ্যদেব পড়ে। লামান্ডা, লুয়াগা, ডেভ কাকা, গুরান, বুড়ো মজ, মিস তাগামা, হীরো ঘোড়া, বাঘা নেকড়ে, হিজ বনমানুষ, স্টেগি ডাইনোসর, ফ্রাকা বাজপাখি আর ডায়ানা সকলকেই চেনে। তাছাড়া রিপ কার্বি, ডেসমন্ড, ম্যানড্রেক, নার্দা, লোথার, কার্মা, হোজো, রহস্যময় আট, ম্যাগনন, ফ্ল্যাশ, ডেল, জারকভ এদেরকেও চেনে।
কিছুদিন পরে ল্যাবের বড় দাদা মানে জগাদা আমাকে ডাকল –
- কি রে! TUMPA-র সঙ্গে এত গল্প করছিস, ব্যাপার কী?
- টুম্পার সঙ্গে গল্প মানে? আমার নাম তো টুম্পা।
- কী! তোর ডাকনাম টুম্পা? তুই তাহলে টুম্পা ওয়ান।
অমনি সবাই হো হো হা হা করে হাসতে লাগল।
- কী ইনোসেন্ট রে, তুই TUMPA জানিস না?
আমাকে হাঁ হয়ে থাকতে দেখে বলল, TUMPA মানে Total Uncultured Midnapurian Public Association. মানে, মেদিনীপুরের ছেলে।
আমার হাঁ মুখ বন্ধ হচ্ছে না দেখে আরও বলল –
- বাড়ি আর ইস্কুল করলে জগতটা চেনা যায় না মামণি। ভাষা শিখতে হলে, হোস্টেল-টোস্টেলে থাকতে হয়।
- গরর গরর
- রেগে যাচ্ছিস কেন! বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি। মেদিনীপুরের ছেলেরা তেল-চুপচুপে চুল নিয়ে কলকাতার কলেজে আসে। হোস্টেলে এসে শ্যাম্পু শেখে। বাড়ি থেকে ধামা করে মুড়ি আনে। ঘরে খিল তুলে মুড়িতে জল মেরে খায়, আর পড়া মুখস্থ করে। তারপর চাকরি-বাকরি বাগিয়ে কলকাতার ছেলেদের নাকের সামনে দিয়ে ভাল ভাল পাখি তোলে।
- পাখি তোলে?
- বুঝতে পারলি না? বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন ধর, তুই একটা মোটা পাখি। হেড ফ্যাট, তোর মাথা মোটা।
আরে! পেপার ওয়েট তুলছিস কেন? মারবি নাকি? ভেবে দেখ! তোর কেরিয়ার ভাল। আজ এখানে টেম্পু আছিস, কাল কোথাও পার্মেন্ট লেবার হতে পারিস। জেলার ছেলে কলকাতার জামাই হলে কলকাতায় তার একটা আস্তানা ফ্রি। তোর ভাই নেই। দু’বোন, বাবা-মার যা, তাই মেয়েদের। তোর একটা ভাল মার্কেট ভ্যালু আছে। তুই TUMPA টু-এর দিকে ঝুঁকছিস, এটা আমাদের রাডারে ধরা পড়েছে।
আচ্ছা, জগাদার কথাটা ভেবে দেখার মত। আমার মার্কেট ভ্যালু কত এটা তো কখনও ভেবে দেখিনি। জগাদার কথা অনুযায়ী, কলকাতার ছেলেরা তাহলে Total Envious Calcuttan Public Association, অর্থাৎ কিনা টেকপা। কিন্তু আমি তো আর ছেলে না, মেয়ে। মেয়েদের ঠিকানা বদলায়। যার নিজের ঠিকানার ঠিক নেই, তার কে টুম্পা, কে টেকপা, কে পরিযায়ী, কে উদ্বাস্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামাবারও কিছু নেই। যেখানে পাইবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলে পাইতে পার ...... হেঁ হেঁ।
মুখে এসব কিছুই বললাম না। শুধু মিষ্টি হেসে বললাম,
- Zoগাদা গো, তুমি আমাদের ‘দাদার কীর্তির’ ভোম্বলদা। তা তুমিও তো TUMPA, তোমার পাখি কই?
- দেখেছিস! বড় দাদা হয়ে ভাল কথা বোঝাতে গেলাম, অমনি দাগা দিয়ে কথা বলছিস? কী জন্তু রে তোরা? মেয়ে জাতটাই বেইমান।
অমনি মেয়ে বিজ্ঞানীর দল কলকলিয়ে উঠল।
- জগা ধরবে পাখি? একটা গাঁট। পাখি ধরতে গেলে কিছু ইনভেস্ট করতে হয় – সময়, টাকা। ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। অফিস থেকে টিউশন পড়াতে যাবে, রাত দশটায় মেসে ঢুকবে। টাকা, সময়, মন, ইচ্ছে যার কিছুই নেই, জিন্দেগিতেও কোনো পাখি তার দাঁড়ে বসবে না।
- হ্যাঁ, তোরা Soব জানিS। জ্যোতিষীর বোর্ড লাগিয়ে বসে যা। টু পাইস আসবে। আরে! এ ব্যাটা আড়ি পেতে সব শুনছে।
সবাই তাকিয়ে দেখি, টুম্পা টু হে হে-টাইপ দন্ত বিকশিত করে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর ধীরেসুস্থে সে টেবিল বাজিয়ে একটা গান ধরল। হেমন্ত মুখার্জির ‘মনে কি দ্বিধা রেখে’ গানটার একটা লাইন আছে ‘আকাশে উড়িছে বকপাতি’। সেটার প্যারডি করে গাইতে লাগল, আকাশে উড়িছে মোটা পাখি ....। আর কী হবে! অফিসে আমার একটা স্থায়ী নাম হল – মোটা পাখি। আর উপসংহার টানা হল, যে জগাদা খাঁচা পেতে বসে আছে, কিন্তু শিকগুলো এত ফাঁক ফাঁক, যে পাখি ঢুকেও বেরিয়ে যাচ্ছে, আর অন্য দাঁড়ে বসে যাচ্ছে। জগাদা আর কী করে, পাখিগুলি তার মুক্ত খাঁচায় রইল না বলে গুনগুন করতে লাগল। আমরা সকলেই জানি, জগাদা কেন হাড়কেপ্পন। হাজার-তিনেক টাকা মাইনেতে নিজের থাকা খাওয়া, বোনকে পড়ানো, বাড়িতে পাঠানো। ঐজন্যে খুব কিপটেমি করে। কিন্তু ঐ – পিছনে লাগার জন্য লাগা, সবাই গাঁট বলে ডাকে।
ল্যাবে আমাদের কাজটা ছিল, ভারতের কৃত্রিম উপগ্রহ ইনস্যাট টু বি-এর ইমেজ দেখে পশ্চিমবঙ্গের জলাভূমির মানচিত্র তৈরি করা। কিন্তু তখনও তো কম্পিউটার আরজিআইএস সফটওয়্যারের যুগ আসেনি। তাই সব চোখে দেখে করতে হত। যখন কোনো ধন্দ উপস্থিত হত – যে এই রংটা কীরকম ভূমি ব্যবহার বোঝাচ্ছে, তখন সন্দেহ নিরসন করতে সেখানে গিয়ে দেখতে হত। হয়তো ইমেজে কোথাও অদ্ভুত উজ্জ্বল একটা মেটে লাল রং দেখা গেল – বোঝা যাচ্ছে না ওখানে কী আছে – তখন ঐ জায়গায় গিয়ে দেখা গেল, ওখানে হয়তো কচুরি পানা রয়েছে। এই কারণে প্রায়ই আমাদের এদিক-সেদিক যেতে হত। কাছাকাছি সাইট থাকলে দু’জন করে যেতাম। আর দূরে যেতে হলে তিন-চারজন মিলেও যাওয়া হত। একবার আমাকে আর টুম্পা টু-কে যেতে হল গড়িয়ার দিকে এমন একটা সাইট সিয়িং-এ। ফেরার পথে ধর্মতলায় যখন নামলাম, তখন দুপুর রোদ, আর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সারাটা রাস্তা টুম্পা টুয়ের বকবক চলল, কলকাতা ময়দান, ফুটবল, খেলোয়াড়দের ঠিকুজি-কুষ্ঠি আর মহমেডান স্পোর্টিং, ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান মাঠের ক্যান্টিন নিয়ে। এতে আমার মনে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল। একতরফা জ্ঞান দেবার আগে শ্রোতা কী জানে, সে উৎসাহী না অনুৎসাহী সেটা তো জানতে চাইল না। তাছাড়া তুই ছেলে-জন্ম পেয়েছিস, বল পায়ে নিতে পেরেছিস, আমি পারিনি। তা বলে তুই দীঘার ছেলে, আমি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে জন্মেছি, এখানে বড় হয়েছি। আমার বাবা মোহনবাগান, মা মোহনবাগান; মামা, মাসি, জ্যাঠা, কাকা, চোদ্দগুষ্টি মোহনবাগান। আমার মামার বাড়ির পূর্বপুরুষ ১৮৮৯-এ মোহনবাগান তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। মানছি তুইও মোহনবাগান, তা বলে কলকাতা ময়দান নিয়ে তুই জ্ঞান দিবি, আর আমি শুনব? তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক, দশটা মেয়ে দেখা, বা কূটকচালি করার চেয়ে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকা ভাল। বিবেকানন্দেরও তাই মত। আমি ওঁর কথা খুব মেনে চলি। তাই নিজে কোনো খাপ না খুলে মিচকে মেরে সব কথা শুনতে লাগলাম।
ধর্মতলা ক্রসিংয়ে অনাদি কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটা একটা অদ্ভুত কথা বলল।
- এই দোকানটা চিনিস?
(আবার! আমাকে অনাদির মোগলাই পরোটা আর কষা মাংস শেখানোর চেষ্টা হচ্ছে? যদিও শ্যামবাজারের গোলবাড়ির মত নয়, তবু এটাও ঐতিহ্যশালী) উত্তর না দিয়ে একটা তেরছা নজর হানলাম। ছেলেটা লক্ষ্য করল বলে মনে হল না। সে বলে চলল,
- এটা ১৯২৫ সালে তৈরি হয়েছে। অনাদির যিনি প্রতিষ্ঠাতা, সেই বলরাম জানা আমাদের ওদিকের লোক। মোহনপুরে বাড়ি। আমার ঠাকুরদার বন্ধু। বড়ছেলে অনাদি টাইফয়েডে মারা গেল। সেই ছেলের নামে দোকান। ছোটছেলের ছেলেরা, আশুতোষ আর ভবতোষ এখন মালিক। ছ’মাস করে পালা পড়ে। বড়দার যখন পালা পড়ে, তখন তার স্টাফ কাজ করে, আবার ছোড়দার পালাতে স্টাফ বদলে যায়।
- মানে ছ’মাস বেকার?
- না বেকার নয়, মাইনে দেওয়া হয়। বলরামবাবু মোহনপুরে ইস্কুল করেছেন। আমাদের বাড়ি থেকেও ছেলে আর মেয়েদের দুটো ইস্কুল করা হয়েছে তো। আমাদের বাড়ির পুরোনো মন্দিরটার অনেক বয়েস হয়েছিল, দেড়শ’, দুশ’ হবে। ভেঙে পড়ছিল। এখন সংস্কার করে যে মন্দির হয়েছে, সেটা এই বলরাম জানা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের কয়েকজন ছেলে এই দোকানের কর্মচারী।
- তা চেনা যখন, এখানেই খেয়ে নিই। পেটে তো ছুঁচো দৌড়োচ্ছে। আমি খিদে সহ্য করতে পারি না।
- খেপেছিস? এখানে খেতে ঢুকব? চেনা মুখ দেখলে ছেলেগুলো কেউ পয়সা নেবে না। নিজেরা ক্যাশে টাকা দিয়ে দেবে। ঐজন্যে আমি লুকিয়ে পালিয়ে যাই। চৌরঙ্গী কেবিনেও এক দশা, ওখানেও আমাদের গ্রামের ছেলেরা আছে। অন্য একটা জায়গায় চল।
তারপর রাজভবনের দিকে মুখ করে খানিক সোজা হেঁটে, ডানদিকের গলিতে ঢুকলাম।
- এই গলিটার নাম ডেকার্স লেন। বুঝলি?
(আচ্ছা, এটাই ডেকার্স লেন! বাবার মুখে অনেকবার শুনেছি, কিন্তু আসা হয়নি। এখানেই চিত্তদার দোকান আছে, বাবা বলেছিল) অপরিসর গলি, আর অসংখ্য খাবারের দোকান, চা থেকে চাউমিন, স্যান্ডুইচ সব কিছু। চিত্তবাবুর আদি দোকানের সামনে নর্দমার ওপরে বেঞ্চিতে বসে পড়লাম, মোটা পাঁউরুটি আর চিকেন স্টু কোলে নিয়ে। ডেকার্স লেনে আসা তো হল। একথাও শুনলাম, এত খাবারের দোকানের মধ্যে চিত্তদার দোকানের প্রতি ছেলেটার এত টানের কারণটা শুধু ঐতিহ্য নয়, চিত্তদার সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্কটাই প্রধান। চিত্তদা নাকি গরীব খেলোয়াড়দের বিনামূল্যে লিভার কারি খাওয়াতেন, দোকান এখন ভাইপোরা চালায় – এমন কত কথা ছেলেটা বলতে লাগল। মনে মনে অনেক বিচার চলতে লাগল। ছেলেটা ক্লাস টেনের পর থেকে হোস্টেলে। এমন ছেলেরা বিনা পয়সায় কোথাও খাওয়ার সুযোগ থাকলে ছাড়ে না। কিন্তু এ বলছে, অনাদি কেবিন, চৌরঙ্গী কেবিনে পয়সা নেবে না বলে লুকিয়ে পালিয়ে যায়, সুযোগ নেয় না। তাছাড়া কথা শুনে মনে হল, নিজের বাড়ির ইতিহাস, দোকানের ইতিহাস – এসবের মূল্য দেয়। মানে মূল্যবোধ আছে। তবে আরও পরীক্ষা প্রয়োজন। কলকাতার খাবারের ঘাঁতঘোঁত চিনেছে, মনে হচ্ছে বেশ পেটুক। সারাদিন এত বকবকানি চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সোজাসাপ্টা কথা। মেকি, মনমজানো কথার বালাই নেই।