শুন লো শুন লো বালিকা
রাখ কুসুম মালিকা
- কী রে, ঘুম ভাঙল?
- মা, কী স্বপ্ন দেখলাম জানো, আমি তোমার বড়পিসিদিদা, লীলা বসু, মানে সেনের বিয়েতে গেছি।
- তাই নাকি! তা কী কী দেখলি?
- অনেক লোক, নহবতে সানাই বাজছে। পাগড়ি পরা, চাদর কাঁধে লোকেরা ঘোরাঘুরি করছে।
- তারপর?
- আমি খেতে বসে গেলাম।
- বাঃ, কী কী খেলি?
- হলুদ রঙের পোলাও, বিরিয়ানি, আরও আরও অনেক রকম খাবার ছিল, কালিয়া, কষা মাংস, ফিশ ফ্রাই, এগ ডেভিল, কতরকম মিষ্টি, কিন্তু আমি পাচ্ছি না। শেষে একজন সেন বাড়ির মাছের ঝোল দিয়ে গেল।
- সর্বনাশ, লীলার বিয়েতে শেষে জিরে ধনে দেওয়া মাছের ঝোল খেলি। হো, হো, হি, হি, হি, বাপরে বাপ। আচ্ছা, কার কার সঙ্গে দেখা হল, বর কনে দেখেছিস?
- আবছা, মুখ দেখতে পাইনি।
- আর পালকি, ঘোড়ার গাড়ি কিছু দেখেছিস?
- না তো।
- হা হা হা, আর কিছু?
- আমি বিলে আর রবিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।
- কেয়াবাৎ। গিয়েছিস বিশ্বম্ভর মিত্রের নাতনি, শরৎ-কুমুদিনীর মেয়ে লীলার বিয়েতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে। সেই বিয়ে আর কৃষ্ণকুমার মিত্রের মেয়ে লীলাবতীর বিয়ে গুলিয়ে ফেলেছিস। তারপর?
- খুঁজতে খুঁজতে ঘুম ভেঙে গেল। পেলাম না।
- তাতে কী? ওঁরা তো এই বাড়িতেই আছেন।
- কোথায়?
- কেন? বইয়ের মধ্যে। ওঁদের লেখার মধ্যেই ওঁরা আছেন। সেকালের বিয়েবাড়ি সম্পর্কে তুই বেশি কিছু জানিস না, তাই ডিটেইলস কিছু দেখতে পাসনি।
এই দেখ সার্চ করছি মোবাইলে -
সেকালে বনেদি পরিবারের বিয়ের ভোজ নিয়ে কী লিখেছেন শরৎকুমারী চৌধুরানী:
‘...রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রুইয়ের মুড়া দিয়ে মুগের ডাল, আলুর দম ও ছক্কা। মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট। ইলিশ ভাজা, বেগুনভাজা, শাকভাজা, পটলভাজা, দই, মাছ আর চাটনি। তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপড়ভাজা। মিষ্টান্নের একখানি সরায় আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ। ইহার উপর ক্ষীর, দই, রাবড়ি ও ছানার পায়েস।’
- এই এত রকম?
- তখনকার লোক তো খেতেও পারত। অনেকেই পঞ্চাশখানা মাছের টুকরো বা একশোটা রসগোল্লা অনায়াসে খেয়ে নিত।
- এ্যাঁ!!!
- এই দেখ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজ নিয়ে কী লিখছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত:
‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। আগে গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। কিন্তু একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিত বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না। ’
- একদল লোক খুঁত ধরে খাওয়াদাওয়া পণ্ড করে দিত?
- হ্যাঁ রে, নিন্দেমন্দ, খুঁত ধরা, গাল পাড়া, ঘোঁট পাকানো, জাতপাত তুলে ভোজ বয়কট – এইসব নষ্টামি খুব ছিল।
- এ বাবা!
- আবার এটা কি জানিস, কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত জুতো চুরি করতে। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে। বিয়েবাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি আর পালকির পার্কিং প্লেস বানাতে হত।
- হি হি।
- বিবেকানন্দের ছোটো ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ওঁরা ছোটবেলায় জলখাবারে পাঁঠার মুড়োর তরকারি আর ষোলোটা করে রুটি খেতেন। তোরা তো নিজেদের ভোজনরসিক বলিস, পারবি পাঁঠার মাথা দিয়ে রুটি খেতে?
- ন্যাঃ বাবা। যেকালে যেমন খাবার। কিন্তু ঐ ঝগড়া-ঝগড়িটা খুব বাজে।
- কিছু কিছু জিনিস একালেও হত। খাওয়াদাওয়াতে না হলেও জামাকাপড়ে দেখেছি।
- কী রকম?
- ছোটবেলায় মা, মাসি আমরা সকলে মিলে পুজোর বাজার করতে যেতাম। হেঁটে হেঁটে পায়ের দড়ি ছিঁড়ে, দরাদরি করে, পেটপুজো করে, গাঁটরি বাজার করে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। তারপর সকাল হলেই শাড়ি পছন্দ হয়নি বলে বাড়িতে বিরাট ঝগড়া লেগে যেত।
- সে কী! হা হা হা হো হো হো।
- আরো শোন, বিয়ের সময়ে প্রণামী শাড়ি নিয়েও গোলমাল হত। কয়েকজন আত্মীয় বলে দিতেন প্রণামী শাড়ি পছন্দ হয়নি। তাঁদের আবার দু’বার করে শাড়ি দিতে হত।
- বাবা! দানের শাড়ি ফেরত দিয়ে দিত?
- না না, ফেরত দিত না। দুটো করে নিত।
- এ বাবা!
- আরে এরকম সমাজে চালু ছিল। কেউ লজ্জা পেত না। আবার আমার বিয়ের পরপর, দুর্গাপুজোয় সব পুজোর কাজে যে বৌরা কাজ করত, তাদের শাড়ি দেওয়া হত।
- সে তো এখনও হয়।
- হয়, কিন্তু তফাৎ আছে। বেশ কিছু বৌ, নতুন শাড়ি নেওয়ার পরদিন বলত, শাড়ি কাটা পড়েছে। শাশুড়ি বলতেন, ঠিক আছে কাটা শাড়িটা দিয়ে যাও। বদলে দেব। কিন্তু তারা ফেরত দিত না। জোর করে আর একটা নিয়ে যেত।
- কী কাণ্ড রে বাবা।
- এখন এ ধরণের জিনিস অনেক কমে গেছে।
- পুরোনো দিনের কথা কী বলছিলে বল, শুনতে বেশ লাগে।
- শোন তবে, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ বইটা পড়বি। ঐ বইতে শংকর ত়াঁর সূপকার বা রাঁধুনি সত্তা নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। এত সরস, পড়তে খুব মজা লাগে। আবার স্বামিজীর দুই ভাই মহেন দত্ত আর ভূপেন দত্তও অনেক বর্ণনা লিখে গেছেন।
- কী রকম?
- এই ধর, গৃহস্থবাড়িতে কাঠের জ্বালে রান্না হত। ১৮৭৬ সালে লোকের বাড়িতে প্রচারের জন্য বিনামূল্যে কয়লা বিতরণ হত। বাড়িতে পাতকুয়োর জলে রান্না হত। পাতকুয়োতে একটা কচ্ছপ রাখা হত, যাতে জল পরিষ্কার থাকে। সেকালের কলকাতায় দারুণ শীত পড়ত। তাই শোওয়ার সময় এক মালসা আগুন ঘরে রাখা প্রয়োজন হত। সবসময়ে গায়ে জামা দেওয়ার তেমন প্রচলন ছিল না, কমবয়সী ছেলেরা খালি গায়ে, খালি পায়ে থাকত। নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার সময়ে চিনে কোট পরত। বড়রা পরতেন বেনিয়ান।
আর তাছাড়া শুধু সেকাল কেন, একালেও এ বাড়িতে – তোর বাবাদের ছোটবেলায় – বাড়িতে থাকার সময়ে পরার জুতো ছিল না। দূরে কোথাও যেতে গেলে হাওয়াই চটি পরে যেত। জমিদারের ছেলের এই অবস্থা, তবে সাধারণ মানুষের অবস্থা ভাব।
- কী বলছ?
- ঠিকই বলছি রে। তাছাড়া সেকালে তো ফ্রিজ ছিল না, গরমকালে সাহেব পাড়া থেকে ধনীঘরে ঘোড়ার কম্বলে মুড়ে বরফ আনা হত। গোঁড়া হিন্দুরা এবং বিধবারা আবার ম্লেচ্ছ বলে এই বরফ স্পর্শ করত না। আমার মা গল্প করত যে আমি যখন পেটে, মা তখন কয়েক আনা দাম দিয়ে বরফকল থেকে রোজ বরফ এনে কচমচ করে খেয়ে নিত।
- এ্যাঁ, শুধু বরফ কচমচ করে খেত, কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে নয়?
- কী বলব বল? বরফ তো তখন সহজলভ্য ছিল না, তাই ওটা খুবই আকর্ষণীয় জিনিস ছিল। তাছাড়া, উনিশ শতকের লোক দিনে ভাত অনেক বেশি পরিমাণে খেত, যেমন ধর আড়াই পোয়া মত চালের ভাত, রাতে আধসের এবং উপযুক্ত পরিমাণ দুধ। দুধ পাওয়া যেত টাকায় দশ সের থেকে যোলো সের। চল্লিশ বছর আগে তোর বাবারাই দিনে চারবার ভাত খেত।
- চারবার ভাত?
- হ্যাঁ রে, সকালে ব্রেকফাস্টে পান্তা খেয়ে ইস্কুল – একবার ভাত। ইস্কুল থেকে দুপুরে টিফিনের ছুটিতে আবার বাড়িতে এসে গরম ভাত, তরকারি – দু’বার ভাত। ইস্কুল থেকে বিকেলে ফিরে এসে দুধ-ভাত। আবার রাত্তিরে ভাত-তরকারি। তাহলে ক’বার হল?
- চারবার ভাত মানুষ খেতে পারে?
- তখন পারত। আমরা তো শহরে থাকতাম। আমরা তিনবার ভাত খেতাম।
- তোমরাও?
- হ্যাঁ, সকাল সাড়ে সাতটায় হাল্কা ব্রেকফাস্ট উইথ পাঁউরুটি। দশটায় ভাত খেয়ে ইস্কুল, ইস্কুলে দুপুরে টিফিনে পাঁউরুটি, বিকেল সাড়ে চারটেয় ইস্কুল থেকে ফিরে এসে ভাত। আবার রাত দশটায় ভাত। তাহলে তিনবার হল না?
- হায় ভগবান! আমার একদম ভাত খেতে ভাল লাগে না।
- ওর’ম বলিস না রে বাবু, পণ্ডিতেরা বলেন, যে ভাত খাওয়ার ওপরে মেয়েদের সামাজিক সম্মান অনেকটা নির্ভর করে।
- সেটা কীরকম?
- কনসেপ্টটা হল, পশ্চিম ভারতে গম বলয়ে, মেশিন-নির্ভর চাষে মেয়েদের শ্রম তেমন লাগে না। পারিবারিক উপার্জনে মেয়েদের শ্রমের ভাগ কম। কিন্তু পূর্ব ভারতে ছোটো ছোটো জমি, তাতে যা ধান হয়, পুরুষমানুষ একার উপার্জনে পরিবারের সচ্ছলতা আনতে পারে না। একদিকে বীজতলা, ধান রোয়া, ধান ঝাড়া, ধান সেদ্ধ, ঢেঁকিতে ছাঁটা সব মেয়েদের কাজ। মেয়েদের শ্রম বিনা চাল রেডি হয়ে বাজারে যেতে পারে না। লাঙলটা পুরুষ দেয়। তার ওপর পরিবারের প্রয়োজনে সমানে হয় বিড়ি বাঁধা, টুকটাক অন্য কাজ মেয়েরা করে। এখানে যেমন মেয়েরা কাজুবাদাম ছাড়ায়। বীরভূমে মেয়েরা বেলের শক্ত খোসা থেকে ঘুনসির মালা করে। নানাভাবে মেয়েরা রোজগার করে। তাই পূর্বভারতে পশ্চিম ভারতের তুলনায় মেয়েদের সম্মান একটু বেশি।
- বা বা! এইরকম ব্যাপার! কে কী খায়, কী চাষ করে, তার ওপরে মেয়েদের সম্মান? এইজন্য চাপাটি বলয়ে মেয়েদের ওপর এত নিষ্ঠুরতা?
- হ্যাঁ। হতে পারে, এ তো আমার কথা নয়, পণ্ডিতেরা বলেন। তবে যাই হোক, রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রঞ্জা বুড়ি খুব ভুলভাল স্বপ্ন দেখে ফেলেছে।
- কেন, ভুলভাল কেন হবে? লীলা বসু, থুড়ি সেন আর লীলাবতী মিত্র গুলিয়ে গিয়েছিল শুধু। স্বপ্নে অমন হতেই পারে।
- শুধু তা নয় রে হাঁদা। তুই শোভাবাজার রাজবাড়ির মেয়ের বিয়েতে সেন বাড়ির মাছের ঝোল খেলি বললি তো? ও বাড়িতে মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ হয়।
- মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ? সে কী কথা? এ তো ভারি অন্যায়!
- সে তো কিছু করার নেই। রাধাকান্ত দেবের আমল থেকেই চলছে। তার আগেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই।