দিন চলে যায় হু হু করে,
বছর নাকি জল?
বক্সীঘরে রান্না করে
অন্য মেয়ের দল।
এখন তো মোবাইল ফোনের যুগ। রান্নাঘরের মেয়েরা অষ্টপ্রহর এক কাঁধ উঁচু করে, মোবাইল কানে চেপে, কুটনো কোটা থেকে খুন্তি নাড়া – সব করে। একই সঙ্গে ফোনের বন্ধু আর আমাদের সঙ্গে কথা বলে সমান দক্ষতায়।
রান্নাঘরের একটি বৌয়ের দু’টি মেয়ে, পিঠোপিঠি বয়সের কিশোরী। একই ক্লাসে পড়ে। নামদুটো, ধরে নিই – রানু আর রিমি। দু’জনেই মাধ্যমিকে বসল। বড়ো রানুটা পারল না বেড়া টপকাতে। ছোটটা পেরিয়ে গেল। এবার যা হওয়ার, তাই হল। রানুর সম্বন্ধ দেখা শুরু হল আর রিমির জন্যে একাদশের বই এল। বছরখানেকের মধ্যে রানুর বিয়েও হয়ে গেল। একমাস গেল না, ছোট রিমিও মোবাইল ফ্রেন্ডের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালাল। হায় রে কপাল! পরের পুজোয় দু’জনের দু’রকম খবর পেলাম। রিমি তার বন্ধুর সঙ্গে চলে গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোর। কোনো কাজ জুটিয়ে থেকে গেছে সেখানে। তার বন্ধুটি অন্য সঙ্গিনী খুঁজে নিয়ে তাকে ফেলে পালিয়েছে। আর রানুর বরের সারাবছর রোজগার করার মতো কাজ থাকে না। কিন্তু একটা কাজ সে নিয়মিত করে। সেটা হল বৌ পেটানো। নবমী এসে পড়তে খোঁজ নিলাম, ‘কি গো বৌ, রানুর বাড়ি তো পাশের গ্রামে, পূজোয় আসবে না এবছর?’ উত্তর পেলাম, মেয়ে হয়েছে রানুর, হয়তো সেই নিয়ে ব্যস্ত। আমি শুধোলাম, ‘নাতনি কেমন হয়েছে?’ যে উত্তরটা পেলাম এবার, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। রানুর শাশুড়ি বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা পছন্দ করে না। একবার বাপ মা গিয়েছিল জোর করে, বসতে বলেনি। যে ছেলের যথেষ্ট রোজগার নেই, তার মায়েরও এত তেজ! লক্ষ্মীপুজোর দিন রানু এল সকালে মেয়ে কোলে নিয়ে। এসেই বলল, আমাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। তার মা অনেক বুঝিয়ে, অনুনয় করে তাকে একটা রাত রেখে দিলে। পরদিন আমরা শহরে ফেরার পথে রাস্তায় ফোনে খবর পেলাম, বাপের বাড়ি একরাত থাকার জন্য রানু বেধড়ক মার খেয়েছে শ্বশুরবাড়িতে, থানা-পুলিশ হয়েছে। কর্তা শুনে বললেন, গ্রামে এসব আখছার হয়।
বছর দুয়েকের মাথায় পুজোর একটু আগে একটা ঘটনা ঘটল। নিত্যদিন মার সহ্য করতে না পেরে রানু পালিয়ে এল বাপের বাড়ি। ততদিনে আবার একটি ছেলে হয়েছে তার। এবার একেবারে পঞ্চায়েতে বিচার বসল। কিন্তু সে বিচারসভা ঘিরে ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল জনা পঞ্চাশ ‘মেয়ে-মানুষ’। প্রথমদিকে রানুর শাশুড়ি আর তার ছেলে রোগা শরীরে সিংহনাদ করছিল – বক্তব্য হল, বৌ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে যখন, তখন আর ঘরে তুলব না। কিন্তু পঞ্চাশটি মারমুখী রাজসিক আকৃতির নারকেল কাঠির গুচ্ছ এগিয়ে আসছে দেখে সিংহনাদ, ইঁদুরের কিঁচকিঁচে পরিণত হল। ঝাঁটাবৃত্তের বাইরে জনা চারেক লাঠিধারী পুলিশও ছিল। বিচার সভায় আর মারব না বলে কান মুলে রানুকে নিয়ে শাশুড়ি আর তার ছেলে বাড়ি গেল। কর্তার মুখে বিস্তারিত এসব কাহিনী শুনে, বললাম,
- আবার মেয়েটাকে তো সেই নরকেই সবাই পাঠাল। শাশুড়ি আর তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিলেই তো হত।
কিন্তু কর্তা বললেন,
- ব্যাপারটা অত সোজা নয়।
- কেন?
- নিম্নবর্গে কে ক’দিন জেল খাটল, এতে খুব একটা কিছু তাদের সামাজিক ক্ষতি হয় না। কিন্তু বৌটার প্রতি জাতক্রোধ তৈরি হয়। ছাড়া পাওয়ার পর মেয়ে সন্তান থাকলে, মা মেয়ে দু’জনকে বার করে দেয়। আর ছেলে সন্তান থাকলে, বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে, মাকে বার করে দেয়। বাপের বাড়ি যখন দেখে – বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বা একা, মেয়ে সারাজীবনের মতো ঘাড়ে পড়ছে, কিছুদিন পরে তারাও রাস্তা দেখিয়ে দেয়। অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করে, অথবা কোনঠাসা হতে হতে কেউ কেউ ঘরের লক্ষ্মী থেকে সার্বজনীন হয়ে যায়। এইজন্য প্রথম সালিশিতে কাউকে গ্রেপ্তার করানো হয় না। ভয় দেখিয়ে সমঝে রাখার চেষ্টা হয়।
- বুঝলাম। রানুর কালপ্রিটরা কি ভয় পেয়েছে?
- তাদের তালু শুকিয়ে গেছে।
আমার শহুরে যুক্তি আর পুঁথিগত বিদ্যা বাস্তব প্রেক্ষাপটে যে কত ফাঁকা, সেটা পদেপদে এখন বুঝতে পারি।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে পুজো। সপ্তমীতেই দেখলাম, আরতির সময়ে রানু তার বর আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাদের ঠাকুরদালানে প্রণাম করছে। রানুর মেয়েটাকে কোলে নিলাম। বেশ টরটরি হয়েছে। তার দু’হাতে দুটো প্যাঁচানো চুড়ি কিনতে লোক পাঠালাম দোকানে। রান্নাঘরে ইশারায় বলে দিলাম চা জলখাবার দিতে। অন্য মেয়ে বৌরা ‘এসো জামাই এসো’ বলে আদর করে নিয়ে তাকে বসাল সেই চৌঘেরা রান্নাঘরের টেবিলে। আমি ভিতরে গিয়ে দেখি এক কাণ্ড। খাবার বাড়তে গিয়ে একজন বলছে, এখানে পঞ্চাশটা কাগজের প্লেট ছিল, কোথায় গেল? একজন বলছে, ওরে, পঞ্চাশ ধনে এনে এখানে রেখেছিলাম, কেউ নিয়েছিস? প্রতিটি কথায় পঞ্চাশ শব্দটা জামাইকে শোনানো হচ্ছে, আর খিক খিক, খুক খুক করে হাসছে মেয়ের দল। আমি দেখলাম এখানে বেশিক্ষণ থাকলে, আমারও হাসি চাপা দায় হবে। বক্সীবাড়ির রান্নাঘর নিজেই এখন একটা গরম কড়া। তাতে শব্দের ফোড়ন দিয়ে বৌ-পেটানো-জামাই-ভাজা চলছে। কাজের ছুতোয় বাইরে এসে আড়াল থেকে দেখি। ধিনিকেষ্ট জামাই মুখ গোঁজ করে বসে আছে।
কতগুলো ঝাঁটা?
তবু বুকে পাটা -
পেস্টিজে টলোমলো।
কাকপানা মুখ,
আহা দেখে সুখ,
জামাইরাজাটি ভালো।
এমনি গোঁজ করে থাকা প্যাঁচা মুখ এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি আমি। অল্পবয়সে একবার পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি ছিলাম কয়েকদিন। একদিন গভীর রাতে দেখি ওয়ার্ডের সব আলো জ্বলে উঠল। ডাক্তার, নার্স – সব খুব ছোটাছুটি করে বেড রেডি করছেন। তারপর বেনারসী পরা এক সালঙ্কারা মেয়েকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হল। আনতে আনতে মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিল। বিশাল ওয়ার্ডের সেই অনন্ত সংখ্যক বেডে পড়ে আছি পেটকাটা মেয়ের দল। কিছুটা নির্বিকার উদাসীনতা, কিছুটা ক্রোধ, কিছুটা উদ্বেগ – সব খেলা করে মেয়েদের মনে। গরীব কিংবা বড়লোক, হিন্দু নাকি মুসলমান, বিয়েওলা বা অনূঢ়া, অল্পবয়সী না পাকাচুলো - সব ধরণের মেয়ে সাক্ষী রইল ঘটনার। চোখের পাতা এক হল না। এরপর সকাল হলে সিস্টারদের কাছ থেকে সব খুঁটিয়ে জেনে নিলাম আমরা। বরযন্ত্রে সতীচ্ছদ ফাটার এমনি তেজ – ফুলশয্যা, মৃত্যুশয্যা হতে যাচ্ছিল অল্পবয়সী বধূটির। কী সুন্দর মুক্তি পেয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি, এই ডাক্তার বাবুরা কী যে করেন, লড়াই ছাড়তে পারেন না। কী দরকার বাবা, আবার এদের বাঁচিয়ে তুলে কষ্ট দেওয়ার। শরীরের কষ্ট অপারেশন করে কমিয়ে দিলে মনের কষ্ট যায় বুঝি? এত লেখাপড়া করে ডাক্তারবাবুরা এসব বোঝেন না কেন? যা হোক, দু’দিন পরে মেয়েটি উঠে বসাতে, বীরের ছাঁদওলা বরটি দেখতে এল তাকে। আর তখনই শুরু হল খেলা – মেয়েদের শব্দজব্দ। পাকাচুলো এক রসিকা ওয়ার্ডের দরজার কাছেই ছিলেন। করিডোর দেখতে পেতেন। এক মিনিট আগেই সতর্ক করতেন – ‘ফাটাকেষ্ট’ আসছে। সে ঢুকলেই, মেয়েরা বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাছাবাছা গালি দিত। আমি তো বেশি গালি জানি না। মজাটা নিতাম। সেসব শুনে কান গরম হবার বদলে হুড়হুড়িয়ে হাসি আসত। হাসি চাপারও প্রয়োজন ছিল না। সিস্টারেরা নিজেরা কিছু বলতেন না বটে, আমাদের বারণও করতেন না। বরং তাঁদের হাঁটাচলায় বিরক্তি কেটে গিয়ে এক প্রসন্ন নৃত্যভঙ্গিমা ফুটে উঠত। বীরের ছাঁদওলা টাকলা মাথা বরটি মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকত। শেষের দিকে ওয়ার্ডে আর ঢুকত না। দরজায় দাঁড়াত। অন্য পেশেন্ট পার্টিরাও চিনে গিয়েছিল লোকটিকে। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে কেউ ঘৃণা ছুঁড়ে দিত দৃষ্টিতে, কেউ হাসিমুখে কানের পাশে দিয়ে যেত বিষমাখা তীর। মেয়েদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ আর খিলখিল হাসি দরজা পেরিয়ে তার মাংস ছিঁড়ে হাড় অবধি পৌঁছত।
সন্ধেবেলা ঐ রান্নাঘরেই, দেওরঝির সঙ্গে পুজোর প্রসাদ খেতে খেতে আড্ডা চলছিল। দেওরঝি বলে ওঠে,
- জেঠিমা, আজ সকালে রানুর বরের গোল্ডেন জুবিলি দেখেছ? মানে, ঐ পঞ্চাশ-পূর্তির কথা বলছি।
- হ্যাঁ, দেখেছি।
- মেয়েগুলো একশ’ দিন মার খেয়ে একদিন প্রতিবাদ করবে, আর কী হবে, ছেলেদের তো লেজ গজাবেই। এডুকেশন জেঠিমা এডুকেশন। মেয়েদের এডুকেশন দরকার।
- ছেলেদের সভ্যতা, ভব্যতা, মানবিকতার এডুকেশন দরকার নেই? রানু মাধ্যমিক পাশ না করলেও, প্রিলিমিনারি এডুকেশন তো পেয়েছে। ওর কনফিডেন্স নেই, কারণ রোজগার, খাওয়া পরার বিকল্প যোগাড় নেই।
- হুম, একটা কোনো রাস্তা প্রত্যেক মেয়েকে অর্জন করতে হবে, যাতে সম্পর্কের মধ্যে সে নিজের শর্ত রাখতে পারে।
দেওরঝির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই, দেখি ঐ উজ্জ্বল চোখ দিয়ে বেলারানী তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। সে আরো বলে চলে,
- ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এডুকেশন, আরও এডুকেশন দরকার জেঠিমা। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। এই কথাটা আগে শুনেছ জেঠিমা?
- (হেসে বলি) নারে, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে অন্য একটা কথা শুনেছি।
- কী?
- কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।
- জে - ঠি - মা! তুমি খুব বাজে, আমার লেগপুল করছো।
- করব না তো কী? যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।
- তুমি তো না-ও জানতে পারতে।
- দেখ্, বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন আমি ক্লাস ওয়ান। সরকার যখন গেল, তখন আমার বারো বছর – মানে এক যুগ চাকরি করা হয়ে গেছে। আমরা কেন্দ্রে কংগ্রেস আর রাজ্যে বামফ্রন্ট নিয়ে জীবন কাটিয়ে ফেললাম। সেই আমাকে তুই জিজ্ঞেস করছিস।
- হে হে, ভুল হয়ে গেছে।
- তবে তুই কেন্দ্রে বিজেপি, আর রাজ্যে তৃণমূল নিয়ে বড় হয়েও কথাটা শুনেছিস, তাই কনগ্র্যাচুলেশন।
- হা হা হা, আচ্ছা জেঠিমা – তুমি এখন রাজনীতি সচেতন হয়েছ, নাকি ছোট থেকেই ছিলে?
- প্রথম থেকেই, মানে ছোট থেকেই ছিলাম। কারণ আমি খুঁটিয়ে কাগজ পড়তাম রোজ।
- তোমাদের ছোটবেলায় কেমন দিন ছিল, আমাকে বলবে? আমি একটা ওয়েবজিনে মেয়েদের অধিকার নিয়ে লিখছি।
- রাজনীতি ঐভাবে বলতে পারব না। ছোটবেলার অনুভব, স্মৃতি – এগুলো বলতে পারি।
- তাই বল।
তৃণমূল, বিজেপি – এসব শুনে, রান্নাঘরের মহিলারাও কান পাতে। পঞ্চায়েত, একশ’ দিনের কাজ, সদ্য আসা কন্যাশ্রীও ঢুকে পড়ে আলোচনায়। বক্সীবাড়ির রান্নাঘরের মহিলা মহলে রাজনৈতিক আড্ডা জমে ওঠে। কয়েকজন একথাও বলে, যে, রানুর বিয়ে আর রিমির পালানোর আগে যদি কন্যাশ্রীটা এসে যেত, মেয়েদুটোর হয়তো এ দশা হত না।