৫
অষ্টমীতে সাত সকালেই কর্ণাবতীর ফোন -
- জ্যা-ঠা-ই-মা
-কী?
- তোমরা নেই, আমার ভীষণ বাজে লাগছে।
- কে বলেছে আমরা নেই। এই তো তোর সঙ্গেই আছি।
- এখানে তো নেই।
- তাতে কী? পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ চলছে, এতে আমাদের সকলকেই তো অবদান রাখতে হবে তাইনা?
- আমি তো যুদ্ধ করিনি, কী অবদান?
- তুই যুদ্ধ করিস নি? কী বলছিস রে? এই যে তুই পুজোতে উপস্থিত থেকে আমাদের না থাকার ফাঁকটা সামাল দিচ্ছিস, গ্রামের মানুষের ভালো থাকার যুদ্ধে সামিল হয়েছিস - এটাই তো তোর অবদান।
- ও! এটাও যুদ্ধ!
- অবশ্যই। তোকে মন শক্ত করে সব কাজ উতরোতে হবে। বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে। বাবা একা নিজের মাথায় দুর্গাপুজোর মত এত বড় দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা তো আছি। ভিডিয়ো কলে থাকবো। তোর সঙ্গে কথা বলব। চিন্তা কিসের?
- মন শক্ত করতে পারছি না। তোমরা মোটেই সব সময়ে আমার সঙ্গে কথা বলছনা। বালুসাই, চাঁদসই, মগধ, মুটরি, সমেশা, খুরমা, সোহাগিনী, বিনোদিনী - জ্যাটিমা - এসব গল্প কী আমাকে তুমি বলেছ?
- ও বাবা, এই সাত সকালে সব শুনে ফেলেছিস?
- সাত সকালে নয় গো জ্যাটিমা! কাল রাতে, তাই আজ ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে ক্যাচ কট কট করে ফেলেছি। আ-মি তো মিষ্টি খেতে ভালোবাসি - তুমি আমাকে বাদ দিয়ে এসব কথা কীকরে বললে, কেন বললে?
- আরে বাবা। রঞ্জা এবারে যেতে পারেনি, পুজো হয়ে যাচ্ছে, মনটা খুব খারাপ। তাই এসব গল্প করে ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম।
- না তাও, আমি খুব দুঃখ পেয়েছি, আমরা তো সবসময়ে একসঙ্গে শুনি, তাই।
- ওরে পুরোটা ওকে বলিনি। তোর জন্যেও রেখেছি।
- সত্যি?
- একেবারে তিন সত্যি। কিন্তু এখন আর কথা নয়, তুই চানে যা। অঞ্জলি দিয়ে খেয়ে, তার পর ঝটপট পুজোর কাজ সেরে নে।
ফোন রেখে আমিও এবারে বাড়ির কাজে হাত লাগাই। আজ একটু শুক্তো করব। সঙ্গে নটে শাকের ঘণ্ট আর আলু পটলের ডালনা। ওবাড়িতে পুজোর ভোগেও তো আজ একই মেনু হবে। তবে ওখানে শুক্তো করার প্রণালী আমার বাপের বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগণা এবং মামার বাড়ি কলকাতার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। সম্ভবতঃ এর মূল কারণ মেদিনীপুরের রন্ধনশৈলীর ব্যাকরণ অন্যান্য জেলার সঙ্গে মেলেনা। আমাদের শুক্তো একটু সেদ্ধ সেদ্ধ হয়। খেলে পেটটায় বেশ আরাম হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির শুক্তো ভীষণ মশলাদার, পেট, জিভ জ্বলে যায়। ওখানে শুক্তোর সব আনাজ আগে খুব ভালো করে ভেজে নেওয়া হয়। তারপর সর্ষের তেলে অনেকটা শুকনো লঙ্কা, জিরে, পাঁচফোড়ন, আদাবাটা, সর্ষে বাটা, চিনেবাদামবাটা, চারমগজ বাটা দিয়ে কষা হয়। তেল ছেড়ে এলে এবারে ভাজা আনাজ দিয়ে কষে জল, নারকেলের দুধ, নুন, মিষ্টি দেওয়া হয়। নামানোর আগে ভাজা লঙ্কাগুঁড়ো, ভাজা সর্ষের গুঁড়ো, চিনেবাদাম গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানে শুক্তোয় ঝোল থাকেনা, মাখামাখা হয় আর খুব ঝাল। অথচ ছোটবেলা থেকে ছড়া পড়েছি,
ছি ছি ছি, রানী রাঁধতে শেখেনি।
শুক্তুনিতে ঝাল দিয়েছে অম্বলেতে ঘি।
এবাড়িতে অম্বলেতে ঘি না পড়লেও শুক্তোয় এত লঙ্কা দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম প্রথমদিকে। আমাদের কিন্তু শুক্তোয় ভাজা মশলা দেওয়া হয়না। মা শিখিয়ে দিয়েছিল কাঁচা আদা বাটা, কাঁচা দুধ, আর ঘি দিয়ে শুক্তো নামাতে হয়। আমি অবশ্য ফোটানো দুধই দিই। আর ঘিও সবসময়ে দিইনা।
আবার ওখানে নটে শাকের ঘন্ট তৈরির প্রণালীও প্রায় একই - অনেক লোকের রান্না তো, তাই বড় পেতলের কড়ায় শাক আগে ভাপিয়ে নেওয়া হয়। এই রান্নায় আনাজ আগে ভাজার দরকার নেই। আলু, বেগুন, বরবটি, কাঁচকলা, গাজর, কুঁদরি, কুমড়ো দেওয়া হয়। এটাতে কড়ায় সর্ষের তেলে শুক্তোর মতোই শুকনো লঙ্কা, কাঁচা লঙ্কা, পাঁচফোড়ন দিয়ে, সর্ষে বাটা, চিনেবাদামবাটা, চারমগজ বাটা কষা হয়। এই রান্নায় আদা পড়েনা। মশলায় তেল ছেড়ে এলে কাঁচা আনাজ দিয়ে নেড়ে ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। আনাজ সেদ্ধ হয়ে এলে আগে থেকে ভাপানো শাক, হলুদ, নুন, মিষ্টি মিশিয়ে অল্প নেড়ে চাপা দিতে হবে। রান্না হয়ে গেলে শেষে কাঁচা সর্ষের তেল, ভাজা সর্ষের গুঁড়ো, বাদাম গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো ছড়িয়ে নামাতে হবে। তবে কাঁচা তেল ভাজা মশলার একটু আগে ছড়াতে হবে, যাতে ঝাঁঝ থাকে, কিন্তু কাঁচা তেলের গন্ধ না থাকে। নিজের বাড়িতে আমি অবশ্য এত মশলার কারবার করিনা। ফোড়ন দিয়ে, আনাজ, শাক মিশিয়ে চাপিয়ে দিই। এত মশলাদার খাবার ভালো লাগেনা। তবে ওবাড়িতে ভোগের ব্যাপার। তরিবৎ তো হবেই।
আলু পটলের তরকারির প্রণালী অবশ্য আমার বাপের বাড়ির থেকে তেমন আলাদা কিছু নয়। তবে জিরে, তেজপাতার সঙ্গে, শুকনো লঙ্কা আর কাঁচা লঙ্কা দুরকমই লঙ্কাই ফোড়নে পড়ে। আদাবাটা, টমেটো বাটা, হলুদ, নুন, মিষ্টি দিয়ে আগে থেকে ভেজে রাখা আলুপটল কষা হয়। এরকম রান্নাকে আমরা বলি ডালনা। ওবাড়িতে ডালনা শব্দের চল নেই। বলা হয় আলু পটলের নিরামিষ তরকারি। কারণ ভোগ না হলে এই তরকারি পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা আর নারকেলের দুধ দিয়ে কষা হত। ভোগ ছাড়া নিরামিষ রান্না ওরা করেনা।
রান্না শেষ করতে বেলা গড়ায়। পুজোর দিন কটা অনলাইন ক্লাস নেই, এটাই বাঁচোয়া। স্নানে যাওয়ার আগে চলভাষে আবার কর্ণার ঊজ্জ্বল মুখ ভেসে ওঠে।
- জেঠিমা, অন্নদা পিসি এসে গেছে। আর চিন্তা নেই।
- তাই নাকি। কখন রে?
- এই একটু আগে, সেই পিছাবনির মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেছে।
- বলিস কী রে।
- শিগগির বসা, আর একদম হাঁটতে দিবিনা।
- আরে হ্যাঁ হ্যাঁ দোতলার মাঝের ঘরটায় বাবা পিসির থাকার সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছে।
- ঠিক আছে, এখন উনি বিশ্রাম নিন। পরে আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিবি।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, রাখছি এখন।
এই অন্নদা পিসি মানে আমাদের অন্নদা দিদি সম্পর্কে আমার একরকম ননদ। আমার শ্বশুরমশাইকে উনি জ্যাঠাবাবু বলে ডাকতেন। ভারি বর্ণময় এক চরিত্র। বয়স অশীতিপর না বলে এখন নবতিপর বলাই ভালো। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে একা একাই ঘুরে বেড়ান। স্বামী, পুত্র কেউই বেঁচে নেই। একাই থাকেন কুঁড়ে বেঁধে। আমার দিদি শাশুড়ি মোক্ষদা আর তাঁর শাশুড়ি আগের শারদা, সকলের বাপের বাড়িই উনি চেনেন। যাতায়াতও করেন। মোক্ষদা আর আগের শারদার বাপের বাড়ি যে জ্ঞাতি মানে কাঁজিয়ার মাইতি বংশের শাখা আর সে বাড়িতেও মন্দির আছে, সেখানে জ্ঞাতিদের সেবার পালা পড়ে আর সে বাড়িতেও দুর্গা পুজো হয়, তবে ঘটে পটে - মৃন্ময়ী মূর্তি আনা হয়না - এসব খবর উনিই আমাকে দিয়েছেন। ওই পরিবার ছিল পশ্চিম বাড়, জগদীশপুরের জমিদার। ও বাড়িতে এখন তিন তরফ। বড় তরফের মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সর্বমঙ্গলা কালী। এছাড়া লক্ষ্মী নারায়ণ, গোবিন্দ মূর্তিও আছেন। মেজ তরফের মন্দিরে আছেন লক্ষ্মী দেবী। তিনি সারাবছর পুজো পান। ঘটের পাশে তামা আর রূপোর কৌটোয় প্রতীক হিসেবে ধান থাকে। আর ছোট তরফের ঠাকুর হলেন শীতলা মা এবং রঘুনাথ। আমার মুখে এসব কথা শুনে কর্তামশাই তো থ। বাবার আর ঠাকুর্দার মামার বাড়ি সম্পর্কে কোন তথ্যই তার কাছে নেই। কোন দিন যায়ও নি। লম্বা, ফর্সা, সুন্দরী মোক্ষদা মারা যান ১৯৪৭ সালে অমর-বেলা মানে আমার শ্বশুর শাশুড়ীর বিবাহের পরে। ফলে ঠাকুমাকে স্বাভাবিক ভাবেই কর্তারা ছয় ভাইবোন কেউই দেখেনি। তবে আগের শারদা যেহেতু একশো কুড়ি বছর বেঁচে ছিলেন, আমার বড় আর মেজ ননদ তাঁকে দেখেছে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে আজও তাঁর একটা ছবি দেওয়ালে টাঙ্গানো আছে।
যা হোক, অন্নদা দিদি হলেন গল্পের ভাণ্ডার। আমি তাঁকে খুবই পছন্দ করি, তিনিও আমাকে ভালোবাসেন। কারণ বুড়ো মানুষের কথা কেউ শুনতে চায়না, সময় নষ্ট মনে করে। আর আমি তাঁকে ডেকে ডেকে গল্প শুনি। অন্নদা দিদি বলেন, আগের দিনে কথা ছিল, “যার আছে মাটি, তাকে দাও বেটি।” অর্থ খুব পরিষ্কার। যার জমিজমা আছে, সঙ্গতি আছে সে ঘরেই মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। সেই আপ্ত বাক্য মেনে, আমার দাদা শ্বশুর তারিণী প্রসাদের সাত বোনেরই বিয়ে হয়েছিল জমিদারের ঘরে। বড় জনের বিয়ে হল বালিসাইতে। তার পরের জনের বালেশ্বরের খরসুয়াতে, পরের জন মানে তৃতীয়া গেলেন বালিসাইয়ের কাছাকাছি গড় মুহুরি ওরফে গড় ভৌঁরিতে।, চতুর্থ জন কেয়াবটতলায়, পঞ্চম জন মোহনপুরে, ষষ্ঠ কন্যা মানে দ্য গ্রেট ভব অপার শ্বশুর বাড়ি ছিল এগরায়। সপ্তম কন্যে গেলেন কাঁথির দুরমুঠে। গড় মুহুরি ওরফে গড় ভৌঁরিতে যিনি সংসার পাতলেন, তিনি হলেন ত্রিবেণী, স্বামীর নাম মহেন্দ্রপ্রসাদ আর পুত্রের নাম বিষ্ণুপদ রায়। বিষ্ণুর সঙ্গে বিবাহ হল আমার দিদি শাশুড়ি মোক্ষদার খুড়তুতো বোন আনন্দময়ীর। বিষ্ণু আর আনন্দময়ীর কন্যা হলেন আমাদের অন্নদা দিদি। সম্পর্কের জটিল গণনায় তিনি আমার নবতিপর খুড়তুতো ননদ, আর আমি তাঁর আক্ষরিক অর্থেই হাঁটুর বয়সী ভাজ। অন্নদা দিদি আমাকে বিশদে সম্পর্ক বোঝান, আমি গুলিয়ে ফেলি। অন্নদা দিদি ঠাকুর ঘরে আলপনা দেন, আমি চোখ গোল গোল করে দেখি। প্রথমে মোবাইলে ছবি তোলার বুদ্ধি করেছিলাম, কিন্তু মোবাইলের ওপরে বেশি ভরসা বুদ্ধির কাজ নয়। এখন নকশাগুলো দেখে দেখে এঁকে রেখেছি। পদ্মফুল, তা ধরা যাক চার রকমের, এমন ভাবে যে আল্পনায় গদা আঁকে, চক্র আঁকে, শঙ্খ আঁকে, জানতামই না। লক্ষ্মীর পায়ের গড়নের কত রকমফের আছে, লক্ষ্মীমন্ত পায়ের ছাপে চারটে আঙুল আঁকতে হয়, পাশে পাশে মাপমত ছোট ছোট লক্ষ্মীপেঁচার পা - নইলে অবলা বাহনটার মনে কষ্ট হবে - এসব কথাও আগে শুনিনি। আড়বেলিয়াতে এমন হতনা, বড়জ্যাঠাইমা তো আলপনা দেওয়ার সময়ে আমাকে কখনও বলেনি। আগে জানলে আমি পেঁচার পাও এঁকে দিতাম, আঁকতে তো কোন কষ্ট নেই, বরং আনন্দ আছে। অন্নদাদির আঙুল চলে যন্ত্রের মত, ঘর বেড় দিয়ে চলে লতা, কল্কা, ফুল, পাতা - আমি দেখে দেখে কাগজে এঁকে তাল রাখতে পারিনা। তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলে তাল রাখাও দায়। কাগজে আলপনা মকশো করছি মন দিয়ে, তাকিয়ে দেখি দিদি নেই। খুঁজে দেখি, তিনি চলে গেছেন ভেজা কাপড় মেলতে ছাদে। আমি তাঁর গল্পগুলি লিখে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু যতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছি ঐ ততক্ষণ, খাতা কলমে ব্যস্ত হয়ে গেলেই, দেখি দিদি নেই। তিনি রান্নাঘরে রাঁধুনিদের দুষ্টুমি ধরে ফেলেছেন। অন্নদাদির চলা বিরামহীন। কিন্তু সে চলা ঝড়ের মত বয়ে যাওয়া নয়। যতদিন তিনি বাড়িতে থাকেন, তাঁর শান্ত ব্যক্তিত্ব একটি মৃদু ঢেউয়ের মত সংসারের ওপরে ছলাৎ ছলাৎ করে। কেবল যখনই বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ ওঠে, তাঁর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বুঝি, ঐ পাকা বুড়ি, শণের নুড়ির মনে ভারি গর্ব যে তিনি গড় ভৌঁরির মেয়ে। গড় ভৌঁরি তো আর এলি তেলি জায়গা নয়, খোদ বাঁকুড়া রায়ের রাজধানী। অন্নদা দিদির গল্প কতটা ঐতিহাসিক ভাবে ঠিক, তা তো আমার জানা নেই। আমি শুধু অনুলেখক। তিনি কথা বলেন স্পষ্ট, মৃদু স্বরে, জিভ জড়িয়ে যায়না, কথার খেই হারিয়ে যায়না, কেবল একটি ছাপ রেখে যায়, তাকে অবজ্ঞা করে কার সাধ্যি।
- “চকা চকা ভৌঁরি
মামা ঘর চঁউরি।”
- ভৌঁরি কী অন্নদাদি?
- ভৌঁরি হল ঘূর্ণি, বাঁকুড়া ভুঁঞ্যার রাজধানী বলে কথা। লেখাপড়ার পৃষ্ঠ পোষক ছিলেন বলে তাঁর আর এক নাম ব্রাহ্মণ পাণ্ডে।
- কেন? উনি কি ব্রাহ্মণ?
- হুঁ, বাঁকুড়া রায়ের এক বংশধর হলেন নেত্রানন্দ রায়। তাঁর দুই ছেলে রাধাবল্লভ ও শিববল্লভ। এই রাধাবল্লভের জামাই হলেন বালিসাইয়ের জমিদার বিক্রমাদিত্য রায়। শিববল্লভের চার পুত্র - কৃষ্ণপ্রসাদ, উমাকান্ত, গোবিন্দপ্রসাদ আর মহেন্দ্রপ্রসাদ। মহেন্দ্রপ্রসাদের এক নাতি সুধীর, আর তিন নাতনি হলেন অন্নপূর্ণা, অমিতা আর আমি, তোদের অন্নদাদি।
- অমিতা কে? মকরিদি?
- হুঁ, সেই। ডাক নাম মকরি। ওর বাড়ি এখান থেকে খুব দূরে নয়।
- হ্যাঁ হ্যাঁ পুজোয় গিয়েছিলাম একবার, মনে পড়েছে, সে তো বেশ চক মেলানো, মোজেইক করা বাড়ি। কত নাতি, নাত বৌ। অনেক লোক। ঘরের মধ্যেই দালানে দুর্গা পুজো হচ্ছিল।
- হুম, ওখানে পুজো হয়।
- আর বাঁকুড়া রায় মানে? চণ্ডী মঙ্গলের বাঁকুড়া রায়?
- হুঁ তিনি।
- বাপরে, তিনি তো ষোড়শ শতকের। নেত্রানন্দ কত দিন আগের মানুষ?
- (অন্নদাদি কর গুণে হিসাব করেন) তা ধর, দুশো বছর তো হবেই।
- এত কথা, এত নাম, এত সম্পর্ক তুমি মনে রাখ কীকরে বল তো?
অন্নদাদি বিষণ্ণ হাসেন। কর্তার কাছে শুনেছিলাম, অন্নদাদির বিয়ে বড় ঘরেই হয়েছিল। লতায়পাতায় চেনাশোনা ঘর। আমার শ্বশুরমশাইয়ের মামাতো ভাইয়ের শ্যালক তারাপদ পট্টনায়ক ছিলেন বর। এই পট্টনায়কেরা ছিল বংশ পরম্পরায় কবিরাজ। আজও ঐ বংশের ছেলেরা কলকাতায় বড় বড় ডাক্তার। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, চিকিৎসকের বাড়িতেও অন্নদাদির কপালে স্বামীসুখ সইলনা। অল্প বয়সে বিধবা হলেন, মধ্য যৌবনে কলকাতা থেকে তাঁর জোয়ান ছেলের অপঘাতে মৃত্যু সংবাদ আসে। অন্নদাদি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। তারপর বক্সি বাড়ির চিকিৎসায়, দেখাশোনায় আবার কিছুটা সুস্থ হলেন। তাঁর সোনাদানা, সহায় সম্বল অনেক কিছুই ছিল - কিন্তু দুষ্টু লোকের প্রতারণায় সবই গেছে। বিজনে এক জঙ্গলাকীর্ণ জমিতে তাঁর বর্তমান ছিটে বেড়ার একলা কুঁড়ে দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম। এইখান থেকে এই বয়সে তিনি সদম্ভে বেঁচে থাকেন, আত্মীয়দের বাড়িতে কিছুকাল থাকেন, যাঁরা তাঁকে ভালোবাসে, কিন্তু কারোর কাছেই বেশিদিন থাকেন না। আত্মীয়তার মায়া আছে, কিন্তু তার ছায়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন অপূর্ব কৌশলে। মনে ভাবি এ জীবনে কত রকম নারীরূপ, কত শত মাতৃ মুখ দেখতে পেলাম, যদি পূর্ব জন্ম থেকে থাকে, তবে এ তারই পুণ্যফল।
“অপরূপ হের আর, দেখ ভাই কর্ণধার,
কামিনী কমলে অবতার।
ধরি বামা বাম করে, উগারয়ে করিবরে,
পুনরপি করয়ে সংহার।।
করি নানা পরবন্ধে, ডাকিয়া খুল্লনা কান্দে,
শ্রীমন্তের মনে লাগে ব্যাথা।
জননী-ভকতি-শীল খুলিল কপাটের খিল,
মুকুন্দ রচিল গীত গাথা।।”