৬
আমার স্মৃতির মাঝে
কত যে নীলাভ তারা -
কেউ বা ধূসর,
কেউ খুব জ্বলজ্বলে।
তারার মাঝারে জ্বলে
মায়েদের মুখ।
চেয়ে থাকে অনিমেষ -
হাসে আর কত কী যে বলে।
সেবারে উল্টোরথের মেলা দেখতে আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি এলাম। কাছেই ডেমুরিয়ার জগন্নাথের খুব বড় করে রথযাত্রা হয়। তার নিয়মকানুন সব পুরীর মত। এমনকি রথের নকশাও একরকম। বিরাট মেলা হয়। আসলে ওড়িশার সীমান্ত এলাকা বলে রথযাত্রাই এ তল্লাটের মূল উৎসব। দুর্গাপুজো নয়। বিয়ের পরে শহরে ফেরার সময় সকলে বলত, বৌমা রথে আসছ তো? কিন্তু রথের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা থাকে আর পরে মেয়েদের ইস্কুলের পরীক্ষার জন্য রথে কোনোদিনই আসা হত না। এবারে কী করে যেন উল্টোরথের সময়ে দিন চারেক ফাঁকা পাওয়া গেল। আর পাঁপড়ভাজা, জিলিপি, ফুচকা, ঘুগনি, এগরোল দিয়ে প্রত্যেকটা রাত কাটল খুব জমজমাট। দিনের ঘটনা বলতে একটু সময় লাগবে।
আমাদের খিড়কি পুকুর আর সদর পুকুরের মাঝখান দিয়ে আছে ঘাস-বিছোনো পায়ে-চলা রাস্তা। পুকুরধারে, সেই যেখানে বাঁশঝাড় আর কেয়াঝোপের মধ্যে অনেক কই মাছের বাসা, ঠিক তার মুখোমুখি পুতুলপিসিদের বাড়ি। এ বাড়ির দুই কন্যে আজ সকাল থেকেই সেখানে। আজ ওদের বনভোজন। পুতুলপিসির ছেলে ফুচন এই চড়ুইভাতির মূল উদ্যোক্তা। পুতুলপিসি আর মণিপিসি দুই বোন। ভারি মজার মানুষ। বাঁশপাতার মত পাতলা চেহারা, আর বাঁশির মত সরু কিন্তু তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ। তারা আমাদের কোনো একটা সম্পর্কে পিসি। তবে সম্পর্কটা যে ঠিক কী, সেটা কেউই বুঝিয়ে বলতে পারে না। বহুকাল একসঙ্গে ওঠা-বসা, খাওয়া-ঘুম, লড়াই-ঝগড়া করে, দুই বাড়ির অস্তিত্ব কবেই এক হয়ে গেছে। কর্তারা গল্প করেন ছোটবেলায় এই দুই পিসির সঙ্গে তেনারা চড়ুইভাতি করতেন। তা আজ ও’বাড়ির ফুচন আর এ’বাড়ির রঞ্জা-কর্ণা যে বনভোজন করবে, এ আর বেশি কথা কী? সেই কবেই তো এস. ওয়াজেদ আলি বলে গিয়েছিলেন – ট্র্যাডিশনের নড়চড় হয় না। পুতুলপিসির মেটে দালান, বাঁশের কাঠামোয় খোড়ো চাল, সামনে উঠোন, পাশে পুকুর। দাওয়ায় মাদুর পাতা। ওখানে থাকে এক দঙ্গল বেড়াল। বাড়িতে রান্নাঘরের পিঁড়ের পাশে, দেয়ালের কুলুঙ্গিতে, দালানের থামের আড়ালে সব জায়গাতেই মিয়াও মিয়াও। একটু সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। দেখেশুনে না চললেই বেড়ালের ঘাড়ে পা। কর্ণা একবার সাদাতে-খয়েরিতে মেশা একটা বেড়ালছানা পুষেছিল। তার নাম ছিল পিঙ্কু। সচরাচর এ’বাড়ির বেড়ালেরা বক্সিবাড়ি খুব একটা যায়-টায় না। যখন পিঙ্কু ছিল, তখন দেখতাম, ঠিক রাত আটটা নাগাদ, পিঙ্কু দোতলায় আমাদের ঘরের সামনে চলে আসতো, আর ফুচনের বেড়াল – পল্টন – লাইন করে আমাদের ভাঁড়ারঘরের টালির চাল টপকে দোতলার বারান্দায় ঢুকত। পিঙ্কু সমেত ছ-সাতটা বেড়াল লম্বা বারান্দায় ঘুরে ঘুরে থাবার বাড়ি মেরে বেশ কিছু ছোট-বড় পোকার ভবলীলা সাঙ্গ করত। কিন্তু সেগুলো মুখে দিত না। এটা ছিল ওদের খেলা।
যাই হোক, আজ সকাল থেকে কাজ অনেক হাল্কা। মেয়েদের পাত্তা নেই। তাই ছোটাছুটি বকবকও নেই। সময় কাটে না। বনভোজনের তোড়জোড় দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ও বাবা, এ কী দেখি? এ তো শুধু তিন মূর্তি নয়, আশপাশ থেকে কচিকাঁচা আরও গোটাকয় জোগাড় হয়েছে। কিন্তু মেনুটা কী? বাসনকোসন কই? চুপচাপ নজরদারি শুরু করলাম।
মায়ের শাড়ি আর যোগাড় করা নীল পলিথিন জুড়ে ফুচন একটা আপাত স্থায়ী তাঁবু বানিয়ে রেখেছে। সেখানেই বনভোজনের অস্থায়ী আস্তানা। মাদুর পেতে ভিতরে সব বসে রয়েছে। হাহা হিহি চলছে। তাঁবুর পাশে মাটিতে দু’খানা গর্ত আর তিনটে মাথা বানিয়ে উনুন করা রয়েছে। ফুচন কল টেনেটেনে চাল ধুচ্ছে। রাজকন্যেরা রাঁধতে জানেন না। ফুচনাই তার মানে আজ রাঁধুনি। কিন্তু আনাজপাতি কই? নুন-ভাত নাকি ভাতে-ভাত – কী দিয়ে উদরপূর্তি হবে? এখানে একটা ঝুড়িচাপা কী রয়েছে? দেখলাম বেশ কিছু কাঁচা-পাকা টমেটো। মাঠ থেকে তুলে এনেছে মনে হয়। রুণাদার চাষ করা বারোমেসে হাইব্রিড টমেটো তার মানে। হঠাৎ একটা গলা চেঁচিয়ে উঠল –
– ঐ দেখ দিদি, মা এসে গেছে। আমাদের টমেটো দেখছে।
– দেখতে তো হবেই। আজ কী কী ভাল ভাল রান্না হচ্ছে জানব না?
– তুমি কি আজ এখানে খাবে জেঠিমা? যদি খাও, তবেই মেনু বলা হবে। নইলে বাড়ি যাও।
– তা বেশ, তবে এখানেই খাই।
– হুররে! তবে একটা শর্ত আছে, তুমি রান্নাবান্না কিছুতে হাত দিতে পারবে না। এখানে যা হবে, মুখ বুজে তাই খেতে হবে। বল, কবুল?
– কবুল। দেখব তোরা কেমন কাবিল।
– হে হে, আবার পালাচ্ছ কেন?
– রান্নাঘরে আমার মিল বন্ধ বলে আসি গে যাই।
– চট করে বলে পট করে চলে এস।
আমি চলে এলাম অন্য কারণে – আসলে আমি আড়ালে থেকে দেখব এদের প্ল্যানটা কী। একটু পরে গাছের, ঝোপের আড়ালে আড়ালে প্রকৃতিপ্রেমী সেজে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। এবারে দেখি সব কচিকাঁচা তো নয় বাবা, একজন দিদি-স্থানীয়াও আছেন, ভাত রাঁধছেন। কিন্তু দিদিটি কে? চেনা মুখ তো নয়। এ কোথা থেকে এল? যাক, পরে তো জানা যাবেই।
এমন সময়ে চ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে আমার গাড়িটা উঠোনে উঠে এল। গাড়ির হর্নটা অনেক দিন হল ফেটে গেছে। কিন্তু ফাটা আওয়াজটা সকলে চিনে গেছে বলে আর পাল্টানো হয় না। গাড়ির ভিতরটা গাছে গাছ। কর্তা উল্টোরথের মেলা থেকে তার শখের গাছ কিনে ফিরছে, কিন্তু এই রে! গাড়ির পিছন পিছন দৌড়ে আসছে পুতুলপিসি।
– ও বাপুরে, গটে গছো দে রে। গটে নারকেল চারা দে রে। গটে সুপারি চারা দে রে।
যাব্বাবা, এবার তো এদিকেও মারকাটারি সিনেমা হতে যাচ্ছে। দু’দিকে চোখ-কান দেওয়া ভারি মুশকিল।
– খবরদার আমার গাছে চোখ দেবে না। তোমাকে তো বললাম টোটো ভাড়া করে দিচ্ছি, টাকা দিয়ে দিচ্ছি। যা প্রাণে চায়, সেই গাছ কিনে নিয়ে এস। আমি যেগুলো কিনেছি সেগুলোই তোমাকে নিতে হবে নাকি? আমি দেব না।
– তু সকাড়া পুতলা পুতলা ডাকিথিলু ক্যানে?
– সকাল সকাল একটু আওয়াজ দিয়ে রাখলাম, আমি আছি, এই পৃথিবীতে আবার জমি নিয়ে লড়াই হবে।
– ব–য়ে গেল। তু ঘরুয়া নারকেল চারা কী এনেছিস দেখি।
– ঘরুয়া? আনিনি।
আমি রুণাদার কানে কানে জিজ্ঞেস করি, ‘নারকেলের ঘরোয়া, বুনো – এসব ভাগ আছে বুঝি?’
রুণাদার হাত কাজেকর্মে অবিরাম চলে। কিন্তু কথা বেশি বলে না। অন্তর্মুখী মানুষ। উবু হয়ে নারকেল ছাড়াতে ছাড়াতে আমার কথা শুনে ধপ করে বসে যায় আর বেশ একচোট হাসে। অনেক পরিবার নিজেদের নারকেল থেকে ঘরে চারা করে, তার দাম ষাট-পঁয়ষট্টি টাকা। তবে নার্সারির নারকেল চারা প্লাস্টিকে মোড়া, নির্দিষ্ট পরিমাণ লম্বা। সেগুলোর দাম একশ’ টাকা বা তার বেশি। গাছপিছু চল্লিশ টাকা বাঁচানোর জন্য পুতুলপিসি উদ্গ্রীব। বুনো নারকেল কিছু হয় কিনা রুণাদার জানা নেই। থাকতেও পারে হয়তো চাঁদের পাহাড়ে সেই বুনিপের দেশে, তবে এখানে এমন কিছু নেই। যাই হোক, কথোপকথন চলতে থাকে।
– দেখ পুতুলপিসি, তুমি তোমার জমির সীমান্ত পেরিয়ে আমার জমিতে গাছ লাগাচ্ছ। যেদিন আমি সীমান্ত মেপে সোজা টানব, সেদিন সব গাছ আমার হবে। হো হো হো হা হা হা।
(বাবারে এ যে যাত্রাদলের হাসি! রেডিওতে ছোটবেলায় অভিনেতা শান্তিগোপালের গলায় এমনই শুনেছিলাম মনে হয়।)
– শোন বাপু, ওধারে নবু সৎপতি সগ্গে গেছে। তার পুও মঙ্কুয়া লন্ডন থেকে আমাকে কী বলছে জানিস, ‘তুমি তো একদিন মরে যাবে, জমির সীমান্ত নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?’ আমে ভি কই দেলা, তু ম্যানে ভি তো একদিন মরি জিবু, বাঁচিবু নি? হুঁ হুঁ বাবা, আমার ফুচনটা আছে, তার সংসার হবে, ছেলেপুলে হবে, জমি গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে না?
আচ্ছা! এইবার বোঝা গেল, পুতুলপিসি গাছের চারা মানে নারকেল আর সুপুরির চারার জন্য কেন পাগল হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতের সীমান্ত-সুরক্ষা পিসিকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে।
ওদিকে চড়ুই ভাতির খবর কী? কচিকাঁচাগুলো গাছের নিচু ডাল ধরে ঝোলাঝুলি, নাচানাচি করছে। এই মরেছে, নাড়াচাড়া পড়ার জন্য টপটপ করে ঐ ডাল থেকে ডেঁও পিঁপড়ে ক’টা নিচে পড়েছে, একটা সোজা ভাতের হাঁড়িতে। সেই দিদিটি দেখলাম অসম সাহসী। গরম হাঁড়িতে হাত ডুবিয়ে টক করে ভাত থেকে পিঁপড়েটা ধরে ফেলে দিল। এখানকার মেয়েদের সাহস দেখে আমি সবসময়েই অবাক হই। আমাদের রাঁধুনি মেয়ে-বৌরা রান্নাঘরে ইঁদুর ঢুকলে তাকে মোড়া চাপা দিয়ে আটকে হাতে করে তুলে ফেলে দেয়। যা হোক, এদিকে তো কথাবার্তা চলছে –
এমন সময়ে এদিকে মণিপিসির প্রবেশ।
– অ, বাপু, ফুচনের জন্য একটা মেয়ে দেখেছি, আজ সে এসেছে, তুই একটু কথাবার্তা বলে দেখ তো।
আরিব্বাস, ঐ সাহসী দিদিটি তাহলে ফুচনের পাত্রী! এই তো সবে কলেজ পাশ দিয়ে ফুচনটা রোজগারের চেষ্টায় আছে। এর মধ্যেই পাত্রী?
– পাত্রী! মেয়ে দেখা কি শুধু মুখে হয় নাকি? কই, মিষ্টি কই?
– আসবে আসবে, পুতুল পায়েস করছে, তোকে দেব।
– খুব ভাল, শুধু আমাকে দেবে? আমার মেয়েকে দেবে না?
– হ্যাঁ, রঞ্জাকু দিবা, কর্ণাকু দিবা।
– ও বাবা! আমার বৌকে দেবে না?
– হ্যাঁ, শারদাকু ভি দিবা।
– আগে নিয়ে এস, দেখি বাটির সাইজ কেমন, তারপরে ভাবব।
ব্যস, যেই না এ’কথা বলা, দুই বোন একেবারে হনহনিয়ে উল্টো মুখে হাঁটা লাগাল। ওদিকে আমি দেখলাম, পাত্রী দিদি টমেটোর চাটনি উনুন থেকে নামাল।
একটু পরেই দেখি, পুতুলপিসি একটা জামবাটি শাড়ি দিয়ে ঢেকে আনছে বটে, তবে সবাই দেখতে পাচ্ছে। বাটিটা একটু দূরে রেখে পিসি এগিয়ে এল। আবার শুরু হয়ে গেল, আমার কর্তার সঙ্গে টক্কর।
– কাঁই গো পায়েস কাঁই।
– পায়েস? পায়েসের কথা কেবে উঠলা? ঘরো পায়েসের চাল অছি নি? চালই নাই!
– অ্যাঁ, সে কী? মণিপিসি কইলা, পায়েস তুমি আমকু দবা, আমোর মেয়েদের দবা, আমোর বৌকু দবা, সব কাঁই?
– অ্যাঁ– অ্যাঁ! পায়েস খাবে, খুব শখ। ছাড় আগে নারকেল চারা ছাড়।
বলেই পুতুলপিসির চোখ চারদিকে ঘোরে। আমি রথের মেলা থেকে একটা পোর্সেলিনের নধর ষাঁড় থুড়ি নন্দী কিনে এনেছি। সেদিকে দেখে পিসি বলে, ‘এ কী র্যা?’
বলেই নন্দীটাকে কোলে নিয়ে, তার মোটা শিঙদুটো আমার কর্তার পেটে ঢুঁসিয়ে দিল। দাবি একটাই – নারকেল চারা, সুপারি চারা। এদিকে কর্তার তো কাতুকুতু লেগে গেছে। বাঁচার জন্য বলেই ফেলল, ‘ঠিক অছি ঠিক অছি বাবা, দিবা দিবা, আমোর থেকেই দিবা।’
অমনি পিসি দু’হাত তুলে দুপাক নেচে নিয়ে বলল, ‘আমি করেছি পনি পায়েস’। পেটে খিল লেগে যায় আমার। ভাগ্যিস আড়ালে আবডালে আছি। আমাদের রান্নাঘরের বৌরা পনিরকে বলে পনিক। পিসি দেখছি ‘ক’-টাও তুলে দিয়েছে। পায়েসের বাটিটা সামনে আসতেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তা মন্দ বানায়নি। চিনি, বড় এলাচ, পেস্তা কুচি আর কাজু দিয়ে দুধ ফুটিয়ে বেশ ঘন করেছে। তার পর পনির কিছুক্ষণ ভিজিয়ে তারপর তুলে খুব ভাল করে চটকে নিয়েছে। এবারে ছোট ছোট ছানার বল বানিয়ে ঐ ঘন দুধে ফুটিয়েছে। বেশ খেতে হয়েছে। পিসি নাকি মাঝে মাঝে ‘পনি’র বদলে পাস্তা ফুটিয়েও পায়েস করে। পদ্ধতি এক। পায়েস খেতে গিয়ে আমার এদিকে অন্য বিপদ হল। আমাকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে হল। আর পুতুলপিসির কান্ডকারখানার সামনে হাসি চাপতে গিয়ে, আমার অবস্থা হল অনেকটা বিরিঞ্চিবাবার সত্যব্রতের মত। আর এই সময়েই পাত্রীর হাত ধরে মণিপিসির প্রবেশ ঘটল।
– অ বাপু, জলির সঙ্গে একটু কথা ক। বৌমা তুমি ভি কথা কয়ে দেখ।
– মণিপিসি, তুমি পুতুলপিসিকে বোঝাও। একটা নারকেল চারা লাগাতে একশ’ টাকা মিনিমাম খরচ। কিন্তু গাছ লাগিয়েও তো তোমরা নারকেল খেতে পাবে না, তার চেয়ে একশ’ টাকায় চারটে নারকেল কিনে খাও না। শরীরটাও ভাল হবে।
পুতুলপিসির গোল চোখ একথা শুনে বনবন করে ঘোরে, আর কী দিয়ে আমার কর্তাকে জব্দ করবে তাই খোঁজে। আমি খুব গম্ভীর, মাথায় একটা ঝুনো নারকেল গাছ থেকে পড়িপড়ি করছে। মণিপিসি কথা ঘোরায়।
– অ বাপু আজ রাতো কর্ণাকু আর রঞ্জাকু আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব, রাতো খাইব। যেতে দিবি তো?
– না আমি মেয়েদের ছাড়ব না।
– কী বললি, তোর এত সাহস?
– মেয়েরা দিনরাত তোমাদের বাড়ি পড়ে আছে, এই যে জিজ্ঞেস করলে, ঐ জন্যেই যেতে দেব না।
উফফ্, হাত পা অবশ, নারকেল গাছের তলা থেকে সরতে পারছি না। নারকেল মাথায় পড়ল বলে।
– হ, তোর যেমন কথা। আর এ দেখো মেয়ে, আমাদের বৌমা। দেখতে সাধারণ লাগে। কিন্তু হলে কী হব! কলেজে পড়ান, ডিপার্টোর হেডো।
আমার মাথায় নারকেল পড়ে গেছে, গাড়ির চারটে টায়ার ফেটে গেছে, একটাও টোটো পাওয়া যাচ্ছে না, হসপিটালে যাব। সব শেষ হয়ে গেল। আমি হেসে ফেললাম। যা হোক, এবার পাত্রী দিদির প্রতি সবার মনোযোগ গেল। কর্তা বাক্যালাপ শুরু করলেন।
– হ্যাঁ মা বস। এই আমার পিসি দু’জন মানে তোমার হবু শাশুড়িদের দেখেছ তো? খুব সরল মনের মানুষ, কিন্তু মাথায় অনেক টাকা দামের ছিট আছে।
– (মেয়েটি অধোবদন।)
– এরা সব সময়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। কিন্তু এদের জমি-বাড়ি সব আমার জমি দিয়ে ঘেরা। আমি যদি বেড়া দিই, এরা আর ঘর থেকে বেরোতে পারবে না।
– (মেয়েটি এবার হাসছে)
– কিন্তু এদের ওপরে আমি সবসময়ে লক্ষ্য, নজর রাখি। কেউ যদি এদের অযত্ন করে, আমার হাত থেকে তার আর রক্ষা নেই।
বাবারে, এ যে একেবারে শোলে সিনেমার স্টাইলে বাতচিৎ চলেছে।
কথাবার্তায় বেলা যায়। সবার পেট খিদেয় চুঁই চুঁই। এদিকে চড়ুই ভাতির উনুনে কেবল ভাত আর টমেটোর চাটনি হয়েছে। শেষে দুই বাড়ি থেকে তরকারির বাটি যোগান দিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়া গেল।
সন্ধ্যেবেলা কাটল রথের মেলা ঘুরে। মেলায় এক বিরাট তাঁবুতে ‘মরণ কুয়া’র খেলা বসেছে। তিনখানা বাইক আর একখানা চারচাকা গাড়ি এক বিরাট গামলার মত বেলনাকৃতি কুয়োর দেওয়াল বেয়ে গোল গোল ঘোরে, আর বাইরে কান ফাটে – ‘জীবন মরণ তিরিশ টাকা, তিরিশ টাকা!’ মেলায় এক প্রতিবন্ধী ছেলে ভিক্ষা করে। কর্তা এক চা-ওয়ালাকে ডেকে দশটাকা দিয়ে বলে, একে চা দাও। চা-ওয়ালা ছেলেটাকে দশ টাকাটা দিয়ে দেয়, এক কাপ চাও দেয় ফ্রিতে। এক ছোট শিশু মেলায় ঘোরে, হাতে অনেক ময়ূর পালক। পালকের আড়ালে সেই ঢাকা পড়ে যায়। কর্তা তাকে ডেকে বলে,
– ব্যাপার কী রে? এত ময়ূর পালক কিনেছিস কেন?
– আমি কিনিনি গো জেঠু, আমি বিক্রি করছি।
– সে কী রে, তুই এত ছোট বাচ্চা, এত ভিড়, সঙ্গে কে আছে?
– মা আছে গো, ঐ দিকে। বাবা সেই কলকেতায় কাজ করে। মেলার জন্যে পালক এনেছে এই এ্যাত্ত। আমি আর মা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করি। বাবা বিক্রি করে বাঁশি।
– তোর পালকের দাম কত?
– বেশি নয় গো, দশ টাকা।
তার কাছ থেকে পাঁচটা পালক কিনে নিই। মেলায় তিরিশ টাকায় মরণ আর দশটাকায় জীবনের খেলা চলে। অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি এক দশাসই নেড়ি কুকুর উদভ্রান্ত হয়ে মেলার মধ্যে খালি এদিক ওদিক করছে। হঠাৎ আমাদের সামনেই একদল মেয়ে পুরুষকে দেখে ঝাঁপিয়ে গেল, আর উ উ উ উ করে সে কী কান্না। মেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এ কি তোমাদের কুকুর?’ তারা হেসে বলে, ‘হ্যাঁ গো, মেলায় নিয়ে আসিনি বলে নিজে নিজে চলে এসেছে’। মান ভাঙাতে কুকুরটিকে তারা একটা দশটাকার বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দেয়। ফেরার পথে দেওরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সে তখন মেলায় ঢুকছে। পিছন পিছন লেজ নাড়তে নাড়তে আসছে ঘাড়কাটা। ঘাড়কাটা যে সে কুকুর নয়, পঞ্চায়েত অফিসে তার ডেরা। খুব ছোটবেলায় বাচ্চারা তার গলায় চুড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে কুকুর বড় হয়েছে, গলা বড় হয়নি। শেষে দেওরের চোখে পড়াতে, মিস্তিরি ডেকে তার চুড়ি কাটা হয়েছে। ঘাড় এখন ঠিক হয়ে গেছে, তবু ইতিহাস তো মরে না। তাই নামটা রয়ে গেল ঘাড়কাটা। খুব বায়নাদার কুকুর। আজ সাতদিন ধরে, মেলার আলো জ্বললেই দেওরের কাছে গিয়ে বায়না করে, মেলা যাবে। ঘুগনির শালপাতা চেটেচুটে খাবে, লোক দেখবে। কুকুরেরা সচরাচর আওয়াজে ভয় পায়। কিন্তু এর ভয়ডর নেই। মেলার আলোর দিকে ঘাড়কাটা নিঃসঙ্কোচে হেঁটে যায়।
দিনের পালা সাঙ্গ হয়ে রাত ঢলে আসে। সারাদিনের কথাগুলি মনে করে হা হা হি হি চলে। মেয়ে হঠাৎ বলে,
– পুতুল দিদা খুব মজার মানুষ না গো মা? সারাদিন হৈ চৈ করে। দিদার কোনো দুঃখ, মনখারাপ কিচ্ছু নেই। সেই যে একজন বসে থাকত ওদের দাওয়ায়, চুপচাপ, সে কোথায় গেল মা? সে কে?
– সে ছিল পুতুল দিদার বর। মারা গেছে।
– তাই নাকি, সে আমাদের দাদু ছিল?
কচি বয়সে কথা গোপন করে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের সঙ্গে পুতুলপিসির বিয়ে দিয়েছিল গ্রামের লোক। গ্রামে এমন ঠকিয়ে বিয়ে দেওয়ার চল খুব বেশি। সেই থেকে সে ঘরজামাই হয়ে ঐ বাড়িতেই থাকত। পুতুলপিসি কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি যেতে পারেনি। সেই বরকেই খাইয়েছে, পরিয়েছে, চিকিৎসা করিয়েছে। শুনেছি যুবক বয়সে তার পাগলামি অনেক বেশি ছিল। বয়স হতে চুপচাপ বসে থাকত দাওয়ায়। মাঝেমাঝে আসত হেঁটে আমাদের বাড়ি, বৈঠকখানায় ঢালা কাঠের চেয়ারে বসে থাকত, চোখাচোখি হলে মৃদু হাসত। এক কাপ চা খেয়ে বাড়ি চলে যেত। এইভাবে থাকতে থাকতেই সংসারে অপাংক্তেয় মানুষটি একদিন ছুটি নিল। পাগল হোক আর যাই হোক, সেই বরের জন্য পুতুলপিসি টান করে চুল বেঁধে মাঝখানে সিঁথি করে সিঁদুর পরত, গলা তুলে ঝগড়া করত। আমাদের সমাজে স্বামী থাকা আর না থাকায় মেয়েদের সামাজিক অবস্থান, আত্মবিশ্বাস – সবকিছুই একটু এদিক-ওদিক হয়ে যায়। সিঁথি সাদা হবার পর থেকে পুতুলপিসির ঝগড়ার জোর কমে গেছে।
– জেঠিমা, তার মানে পুতুল দিদা যে এমন হৈ চৈ করে, সেটা মনের দুঃখ ঢেকে রাখার জন্য? এসব এত কিছু তো জানতামই না।
– মানুষের মনের খবর কেই বা রাখতে পারে বাবু।
– জেঠিমা, তুমি মোহনবাগানের গল্প বলতে গিয়ে বলেছিলে, স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। পুতুলদিদাও কি ভেঙে পড়েছে?
– এসব কথা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। বুঝে নিতে হয়। তবে আগের পিসি আর এখনকার পিসির মধ্যে কিছুটা তফাৎ তো আছেই। তোর জেঠুও ঐজন্য সবসময়ে দেখিস না পিসির সঙ্গে টরেটক্কা করে যায়? আগের পিসিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর রইল কুমুদিনীর কথা। নিজের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন।
– মোবাইলে বইটা বার কর তো দেখি।
এ কী গো মা! কত গান লেখা। উনি গানও জানতেন?
– জানতেন, লাবণ্যকে গানের জন্য উৎসাহও দিতেন।
– জেঠিমা, এই কবিতাগুলো তো দেখছি, দুঃখকষ্ট পেরিয়ে ঈশ্বরের কাছে যাবার কথা বলা হয়েছে।
– হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, খুব শোকের মধ্যে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে।
– স্বামীকে নিয়ে কিছু লিখেছেন বলছিলে তো, কোথায়?
– প্রত্যক্ষ দেবতা কবিতাটা দেখ –
“প – লাইয়া গেলে প্রভু আজিকে কোথায়,
তি – মির বরণ হায় নেহারি ধরায়।
দে – খিয়া রচনা মম কত হতে সুখী,
ব – ল “দেব” কী দেখ গো স্বরগেতে থাকি।”
কোথাও লিখেছেন,
“ওগো কেমন করে বলব সবায়
তুমি আমার কেমন ছিলে,
ঘোর আঁধারে স্তব্ধ করে
একা ফেলে চলে গেলে।”
আবার লিখেছেন –
“আমার মরম ব্যথা, কে বুঝিবে হায়,
সান্ত্বনা পাবার আশে,
চেয়ে দেখি চারিপাশে,
ভুলেও প্রবোধ দিয়া কেহত না যায়,
আমার মরম ব্যথা, কে বুঝিবে হায়।”
কখনও লিখেছেন,
“ও হে নিরদয় হও হে সদয়
দুখের পশরা নাশি,
আর মরম বেদনা সহিতে পারিনা
এস হে বাজায়ে বাঁশি।”
– হুম, স্বামী লেখাপড়া করিয়েছিলেন বলেছিলে না – বৌয়ের লেখাকে উৎসাহ, অণুপ্রেরণা জোগাতেন – বোঝা যাচ্ছে।
– নন্দনে শ্মশান কবিতাটা দেখ।
– পড়, শুনি।
‘এই ধরা ছিল মোর নন্দন কানন
হয়েছে এখন ইহা বিকট শ্মশান,
প্রাণের পুতুলি গুলি খেলিত যখন
ভাবিতাম মর্তে বুঝি এই স্বর্গধাম।
মর্ত্তের দেবতা মোর চলে গেল যবে
জানিনা কোথায় কোন স্বরগে নূতন,
হাতে ধরি তুলি নিল শ্রেষ্ঠ ধন যেটি
কি ভীষণ হাহাকার হৃদয়ে তখন।’
– দাঁড়াও দাঁড়াও মা, ‘তুলি নিল শ্রেষ্ঠ ধন’ – কার কথা এটা?
– খুব সম্ভবত বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র – মৃত্যু হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুয়ে, বলেছিলাম তোদের।
– হুঁ, বাকিটা পড়।
‘পুনঃ না দু’দিন যেতে নিল তনয়ারে
কত আর সয় বল এ ক্ষুদ্র পরাণ,
বার বার কি ভীষণ দারুণ যাতনা
ইহাতেই হায় কিগো হল সমাপন!’
– তনয়া কে?
– ছোট মেয়ে জামাই – ইন্দিরা আর রবীন মিত্রের মেয়ে, কুমুদিনীর নাতনি বিবি মিত্র। ছবি আছে আমার কাছে, কুঁচি দেওয়া ফ্রক পরে বসে আছে মায়ের কোলে। বালিকা বয়সে অ্যাপেন্ডিসাইটিস ফেটে মারা গেছে।
– হায় হায়! আগে বলেছিলে মা, তখন এতো কষ্ট হয়নি। কিন্তু কুমুদিনীর লেখাগুলো পড়ে যে বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তারপর পড়।
‘তবুও স্বর্গদ্বার মুক্তই রহিল
আরও লইতে মোর পরাণের ধন,
যাহার আশ্রয় করি দাঁড়াইনু এসে
সেও যে চলিয়া গেল পিতার সদন!’
– জেঠিমা, খুব যদি ভুল না হই, এটা সুরেন্দ্রনাথ, তাই তো? সেজ ছেলে – যার হাত ধরে শোভাবাজার রাজবাড়ি ছেড়ে হাটখোলা দত্ত বাড়িতে এলেন, সেও শ্বশুর বাড়িতে মারা গেল।
– একদম ঠিক। এই জায়গাটা দেখ,
‘পাষাণে বাঁধিল বুক হায় আজি শোকাতুরা
কি শেল বাজিল বুকে হয়ে আজ পুত্রহারা।
ক্ষণমাত্র না হেরিলে শূন্য হত চারি ধার
জন্ম শোধ গেল চলে আসিবে না ফিরে আর।’
– হায় ভগবান, বাইরের জগতে কাজ করে গেছেন, আর খাতায় নিজের দুঃখের কথা লিখে গেছেন। এত মৃত্যু, এত শোক।
– দুঃখ শুধু মৃত্যুর জন্য নয়, ওঁর বিদ্যাচর্চা, বহির্জগতে কাজকর্ম, চারপাশের লোক ভালমনে নেয়নি। যথেষ্ট গঞ্জনা দিয়েছে।
– কী করে বুঝলে?
– নিন্দুক ও হিংসুক কবিতাটা দেখ।
“নিন্দুক বলে ভাল নামে আমি
কালি দিতে ভালবাসি,
হিংসুক হৃদে পর সুখ দেখি
জ্বলিছে অনল রাশি।”
শেষে লিখেছেন –
“ভগবান দয়া কর এ দোঁহার প্রতি
তুমি না করিলে দয়া কি হবে দুর্গতি।”
নরের দংশন কবিতাটা দেখ কী লিখেছেন –
“ …
সুনামে কলঙ্ক যদি দেয় কোন জন,
অধার্ম্মিক ক্রূর মতি খল সেই জন।
আপন স্বভাব দিয়া হেরে সর্ব্ব জনা,
হিংস্র জীবের সম তাহার রসনা।
বিষ মাখা তীক্ষ্ণ বাণ খলের বচন,
সহিতে পারে কি তাহা সরল সুজন।
সর্পের দংশন জ্বালা সহা তবু যায়,
নরের দংশন জেন বড় বিষময়।
অহেতুক অপবাদ ফেলে দেয় শিরে,
দুর্ব্বল মানব তাহে কী করিতে পারে।
বৃশ্চিক দংশন জ্বালা হৃদয়েতে সয়,
নীরব অন্তর ব্যথা ঈশ্বরে জানায়।”
– ইশ – শ! আসলে চারপাশে মূর্খের দল। তারা মেয়েদের এসব কাজ, স্বাধীন চিন্তা মেনে নিতে পারেনি। খুবই স্বাভাবিক।
– কুমুদিনীর এই জীবন আর অনুভবের সঙ্গে আর একজনের খুব মিল পাই জানিস!
– কে?
– ভুবনেশ্বরী দেবী।
– বিবেকানন্দের মা? কেন?
– বসুদুলালী ভুবনেশ্বরী দেবী বিদূষী তো বটেই, এমনকি, ইংরেজি শিক্ষিত মহিলা। সিমলের নন্দলাল বসুর মেয়ে। বাপের বাড়িতে তাঁর জন্য মেমসাহেব টিউটর আসতেন। আর বিবেকানন্দের ইংরেজিতে হাতেখড়ি মায়ের কাছেই হয়েছিল এবং তিনি স্মৃতিধর ছিলেন, যে গুণের পরাকাষ্ঠা তাঁর বিশ্ববিজয়ী পুত্রের মধ্যে প্রকাশ পায়।
– অ্যাঁ, বল কী গো!
– কিন্তু সারাটা জীবন তাঁর দুঃখে ভরা – জনমদুখিনী।
– কেন?
– তাঁর স্বামী বিশ্বনাথ দত্ত জন্ম থেকেই অনাথবৎ। কারণ তাঁর পিতা দুর্গাচরণ পুত্রের মুখ দেখে সন্ন্যাসী হয়ে যান। বিশ্বনাথ কাকার সংসারে মানুষ। তাঁর স্ত্রীও ঐ খুড়শ্বশুরের অন্দরমহলে চিরকাল কষ্ট সয়েছেন। বিশ্বনাথ নামী আইনজীবী। অনেক টাকা রোজগার করতেন। কিন্তু যৌথ পরিবার তো। ভুবনেশ্বরীকে খুড়শাশুড়ির দাপটের তলায় আধপেটা খেয়ে থাকতে হত। যেদিন সংসারে কর্তৃত্ব পেলেন, সেসময়ে বিশ্বনাথ চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। বিবেকানন্দের এক কাকা তারকনাথ দত্ত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উকিল ছিলেন। তাঁর মেয়ের বিয়েতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য স্বনামধন্য ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের যাতায়াত ছিল।
– তখন সবাই আইন পড়ত, ভারি আশ্চর্য।
– তখন বড়বড় একান্নবর্তী পরিবারগুলো মামলায় মামলায় শেষ হয়ে যেত। নিজের বাড়ির উকিল না থাকলে পথে বসতে হত। তাই লেখাপড়াটা বেশিরভাগ সময়ে ওকালতির দিকে ঝুঁকে যেত। সে যাই হোক, সেই দেওর তারকনাথ উকিলের বিধবা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মামলা ঠুকে দিলেন। ঐ মামলাতে বিবেকানন্দ শেষজীবন পর্যন্ত জেরবার হয়ে গেছেন। তবে সেই সূত্রেই ভুবনেশ্বরীর স্বহস্তে দস্তখত পাওয়া গেছে।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ, বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর নিদারুণ অন্নকষ্টও তাঁকে সইতে হয়েছে। শেষ আঘাত আসে, যেদিন ভুবনেশ্বরী একষট্টি বছর বয়সে বেলুড়ে তাঁর ভুবনজয়ী পুত্রের মরামুখ দর্শন করেন।
– হায় হায়। এ যে সহ্যের অতীত ব্যথা গো মা।
– মনে ভাবি, ভারতবর্ষের ট্র্যাজিক নায়িকা শুধু তো রামায়ণের সীতা নন। এই ভুবনেশ্বরী, কুমুদিনী, আরও কত নারী – এঁরাও তো এক একজন সীতা, সকলেই নিজের বৃত্তে ট্র্যাজেডি কুইন। শুধু তাঁদের নিয়ে কোনো মহাকাব্য রচনা হয়নি, এইটুকু তফাৎ। তোদের বলেছিলাম না, যে লাবণ্যপ্রভার জীবনও সীতার মত।
– ভুবনেশ্বরী ঐ ব্যথার দামে যে অমর হয়েছেন মা।
– ঠিকই। কিন্তু ভুবনবিজয়ী ছেলে না থাকলে ভুবনেশ্বরীর ব্যথাও আর পাঁচটা মেয়েলি যন্ত্রণার মত হারিয়ে যেত না কী?
– হ্যাঁ, তা যেত।
– যোগ্য উত্তরসূরী না থাকার জন্য, অনেক কিছু করেও কুমুদিনী হারিয়ে গেছেন।
– জেঠিমা ভুবনেশ্বরী দেবীর বাবা এই নন্দলাল বোস কি শিল্পী?
– না না, শিল্পী নন্দলাল আলাদা। ভুবনেশ্বরীর বাবা সিমলের দেওয়ান ভবানীচরণ বসুর বংশধর নন্দলাল।
– এঁর ভাই পশুপতিনাথ বোস?
– আরে না না, পশুপতি বোস, নন্দলাল বোস দুই ভাই ছিলেন বাগবাজারের বসুবাটীর কর্তা।
– বসুবাটী? সেই চুনী বোস? খাদ্য নিয়ে বই লিখেছেন বলেছিলে?
– হ্যাঁ, ঐ বসুবাটী থেকেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের পরে রাখীবন্ধন উৎসব শুরু করেছিলেন। আর মোহনবাগান ভিলা ডিজাইন করেছিলেন যে স্থপতি, সেই নীলমণি মিত্রই বসুবাটীরও ডিজাইন করেছিলেন। এই বসুরা আবার আমাদের সেনবাড়ির আত্মীয়। পশুপতি বোস ছিলেন ভবনাথ সেনের জামাই। এখানে এককালে সিটি থিয়েটার চলত। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে মিটিং ডেকেছিলেন। এখানে তাবড় তাবড় লোক এসেছেন, এমনকি রামকৃষ্ণদেব পর্যন্ত।
– সত্যি!
– হ্যাঁ রে, সত্যি।
– এই কলকাতার মাটিই যে তীর্থক্ষেত্র গো জেঠিমা। সাধে কি আর সবাই কলকাতা যেতে চায়, থাকতে চায়। আমিও চাই।
– তীর্থক্ষেত্র বলে সবাই যেতে চায়, কিন্তু থাকতে চায় অন্য কারণে।
– কী কারণ?
– কী আবার, কলকাতা ছাড়া, বাকি বাংলা তুলনায় অনুন্নত, সুযোগ সুবিধে কম বলে।
– হা হা, তা ঠিক। মোহনবাগান ভিলা তো এখন নেই। বসুবাটী এখনও আছে জেঠিমা?
– আছে।
– দেখা যাবে? আমি তাহলে যাব।
– বাইরে থেকে অবশ্যই দেখা যাবে। কিন্তু ভিতরে যাওয়া যাবে কিনা জানি না। ফেসবুকে পুরোনো কলকাতার গল্প গ্রুপে দেখলাম, ঐ বাড়ির বংশধর শান্তনু বোস লিখেছেন, বসুবাটী বিক্রি হয়ে গেছে ২০০৮ সালে। এখন বাংলা সিনেমা এবং সিরিয়ালে যত ভূতের বাড়ি দেখানো হয় প্রায় সবগুলোর শ্যুটিংই নাকি ওখানে হয়। রীতিমত পয়সা খরচ করে ভৌতিক পরিবেশ এবং মাকড়সার জাল তৈরি করা হয়। ভেতরটা নাকি সিঙ্গাপুরের আর্কিটেক্ট ডেকে করানো হয়েছে।
– বিক্রি হয়ে গেছে মানে? কিনেছে কে?
– ঐ গ্রুপেই পড়লাম, হর্ষ নেওটিয়া কিনেছেন। হোটেল হবে।
– জেঠিমা একটা কথা বল, একশ’ বছরেরও আগে থেকে মেয়েরা লেখাপড়া শুরু করেছে। তাহলে আজও এই পুতুলদিদা, রান্নার পিসিরা লেখাপড়া করেনি কেন? পুতুলদিদাকে ঠকিয়ে বিয়ে দিল, সে প্রতিবাদ করল না কেন? ডিভোর্স করল না কেন? বল, উত্তর দাও।
– পুতুলদিদা কী করে প্রতিবাদ করবে? বাচ্চা বয়সে বিয়ে হয়েছে, প্রতিবাদ করলেও পরিবার পাশে থাকতনা। আর পড়াশোনা না করার মূল কারণ হল সুযোগ। রাজধানী শহরে, ধনী ঘরের মেয়েরা যে সুযোগ পেয়েছিল, একশ’ বছরেও সেই সুযোগ দেশের প্রতিটি কোণে দরিদ্র মেয়েদের কাছে আজও পৌঁছয়নি।
– কেন? কী করে পৌঁছনো যায়?
– সমাজ আর সরকার যদি একসঙ্গে সৎভাবে চেষ্টা করে, তবেই সম্ভব।
– মা, ও মা, একটা কথা – কুমুদিনী যেমন নিন্দুক আর হিংসুকের জ্বালার কথা লিখেছেন, বিদূষী ভুবনেশ্বরী দেবীকেও মূর্খ নিন্দুক, হিংসুকেরা খুব যন্ত্রণা দিয়েছে, তাই না?
– ঠিক তো জেঠিমা, মূর্খ আত্মীয়াদের হাতে বিদূষী মায়ের হেনস্থা দেখে হয়তো বিবেকানন্দ ছোট থেকেই বুঝেছিলেন, মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। বড় হয়ে নিবেদিতাকে খুঁজে নিয়ে এলেন। হতে পারে না?
– হ্যাঁ, হতে পারে।
– জেঠিমা, আমাদের কুমুদিনী যে নিবেদিতার সঙ্গে কাজ করলেন, তার কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে?
– পারিবারিক শ্রুতি ছাড়া সেভাবে প্রমাণ তো নেই, তবে ওঁর লেখা কবিতা দেখিয়ে আমার মা বলে গেছে যে সেটা ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে লেখা।
– কৃষ্ণা কীকরে জানল?
– মাকে বলেছিল লাবণ্য। সে নিশ্চয়ই শাশুড়ির কথা নিশ্চিত হয়েই বলেছিল।
– কই দেখি? কোনটা?
– এই ‘মিলন’ কবিতাটা দেখ।
“বান্ধববিহীন শুষ্ক শিলাতলে
ভ্রমণ করিয়া ফিরি
প্রদোষের সেই স্নিগ্ধ সমীরে
ফিরিতেছি ধীরি ধীরি।
সহসা সে দিনে কি দেখিনু সে যে
অতুলনা রূপ তারি
কমল নয়ন সরলতা মাখা
নয়ন ফিরাতে নারি।”
– আচ্ছা, তার মানে দেখা হল,তারপর?
– বড় কবিতা, মাঝখানে লিখেছেন–
“মধুর ভাবেতে ভরিল হৃদয়
মাধুরী তাহার দেখি
এমনি বুঝিবা খুঁজিত হৃদয়
কে তুমি বলনা সখি?
কমল হাতের পরশ আশায়
হাতে হাত দিনু তুলি,
মিলনের সেই পবিত্র পরশে
আপনারে গেনু ভুলি।
– মা লাবণ্যর কথা যদি সত্যি হয়, আমি যেন নিবেদিতাকে দেখতে পাচ্ছি। তারপর পড়।
“এমনি ভাবেতে মিলন মোদের
অজানা কি এক টানে
কোন খান দিয়ে কে জানে কেমনে
মিলে গেল প্রাণে প্রাণে।
নহি আর সেই আগেকার আমি
সুদূরেতে যাহা ছিল
বিধির বিধান আমারে আজিকে
অন্য সাজে সাজাইল।”
– আচ্ছা তার মানে সখির প্রভাবে ওঁর ভাবনা, জীবন সব কিছু পরিবর্তিত হল। তারপর পড় জেঠিমা।
“দুর্লভ তাহার সেই ভালবাসা
হয় নিকো আজও ক্ষীণ
হেরিয়া আমার ছেঁড়া খোঁড়া তার
বেতালা বেসুরো বীন।
তাহার কাছেতে হৃদয় বেদনা
সকল ভুলিয়া যাই
মম পরাণের আদেক খানিতে
দেখিতে যখন পাই।
কোথা ছিলে দেবি! কোথা ছিলে তুমি
ছিলে কোন অমরায়
আমার হৃদয় বেদনা বারিতে
আসিয়াছ এ ধরায়?
– মা কী যে বলি, মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
– জেঠিমা আমারও।
বারান্দায় বসে থাকি তিনজন, মুখে কথা সরে না। হঠাৎ আমাদের নজর পড়ে বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে বাইরের দিকে, এ কী, কী দেখছি আমরা? সকাল থেকে মাঝে মাঝেই ঝেঁপে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগেও হয়ে গেছে এক পশলা। এখন আকাশে মেঘ নেই। শুক্ল পক্ষের চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। আর তার সঙ্গে আকাশের কালো পর্দায় ফুটে আছে কত তারা। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু সমস্ত গাছের মাথায় সার বেঁধে বসে আছে অসংখ্য জোনাকি। এ কীকরে সম্ভব? অন্ধকারে তিনজন ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর বুঝতে পারি জোনাকি নয়, আসলে সব গাছের মাথায় জলের ফোঁটাগুলো সার বেঁধে জোছনায় অজস্র মোতি হয়ে জ্বলছে। সেই অপার্থিব দৃশ্যের সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মত কর্ণাবতী জিজ্ঞাসা করে,
– সব মেয়েকে পড়াশোনা করানো যাবে জেঠিমা?
– যাবে।
– এখন যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নিবেদিতা কেউ নেই।
– কে বলেছে নেই? সবাই আছেন।
– কোথায়?
– আমাদের বুকের মধ্যে।
– আমরা কি পারব?
– নিশ্চয়ই পারব, পারতেই হবে।
– জেঠিমা আমাকে একটু জড়িয়ে ধরোনা।
– মা আমাকেও।
সেই জোছনা ধোওয়া ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা একুশ শতকের তিনজন অসম বয়সী নারী। আকাশের কিছু তারা খুব উজ্জ্বল। ঐ তারার মধ্যে থেকে কে দেখছ আমাদের? ভুবনেশ্বরী? মার্গারেট? সারদামণি? তোমাদের আশীর্বাদে আলোকিত হোক আমার কন্যাদের সামনের চলার পথ।