একদা যে কতিপয় চলচ্চিত্রের গান "দেখলে" উদ্বেলিত হতাম, তাদের মধ্যে একটি হল "আকে চলি, বাঁকে চলি/ চৌরঙ্গিমে ঝাঁকে চলি/ পান্তাভাতে টাটকা বেয়গন পোড়া।"
এটি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। নিখুঁতভাবে ভ্রূ প্লাক করা, গালে বিখ্যাত টোল এবং আশ্চর্য রকম ধ্রুপদী সুন্দরী ফসল কুটতে কুটতে একটুও ঘামেন না। ক্লান্ত হন না। এইসব তখন চোখে পড়তো না। শাবানার ঠোঁটে ভীষণ সোফিস্টিকেটেড ব্রাউন লিপস্টিক। তিন বোনের মধ্যে কটকটি কিরণ ভৈরোলেকেই তাও একটু গ্রামের মেয়ে মনে হয়। সেই ভালো লাগা ভুলে গেছি। কিন্ত মাথায় ঐ পান্তাভাতে টাটকা বেয়গন পোড়া থেকে গেছে। আমি কখনো পান্তাভাতের সঙ্গে বেগুনপোড়া খাই নি। বেগুনপোড়ার সঙ্গে গরম রুটি। পান্তাভাতের সাইড ডিশ আলাদা। একসময় পান্তা ছিল কৃষকের পেটভরা পুষ্টিকর জলখাবার। এখন সেটা মেইনকোর্স।
আমাদের বাঙালবাড়িতে খুব গরম পড়লে পান্তা খাওয়া হত। সকালের ভাত জল ঢেলে বিকেলে খাওয়া নয়। পান্তার একটা আলাদা প্রস্তুতি আছে।
রাত্রিবেলা ভাতে জল ঢেলে রাখতে হবে। এবং সেই ভাত থাকবে বড়ো পাথরের বাটিতে। না। কস্মিনকালেও এই পান্তার সঙ্গে বেগুনপোড়া নয়। পান্তার সঙ্গে মাস্ট ছিল (ছিল বলছি কারণ বাবা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ি থেকে পান্তাও চলে গেছে) কাসুন্দি, পেঁয়াজ লঙ্কা আর মৌরলা মাছের চচ্চড়ি। কয়েকটা মাছ ভাজা পড়বে। কাসুন্দি হবে প্রবল ঝাঁঝসম্পন্ন। চোখে একটু জল চলে আসবে ঝাঁঝে। লেবু থাকবে কাগজি বা গন্ধরাজ। কাসুন্দি, পেঁয়াজ আর মাছভাজা দিয়ে পান্তার প্রথমার্ধ। ইন্টারভেলের পর মৌরলা বা ময়া মাছের চচ্চড়ি। মাছের চচ্চড়ি কিন্ত কষকষে করে রাঁধতে হবে। একেবারেই ঝোলঝোল চলবে না। মাছ কষে ভেজে নিয়ে অন্য তেলে ছাড়া হবে ঝিরিঝিরে করে কাঁটা আলু। পেঁয়াজ। এই মাছের চচ্চড়িটি হবে একেবারে ঝরঝরে। একটুও জল থাকবে না এমন করে কষাতে হবে! এর সঙ্গেই পাত আলো করে থাকবে নুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ বেশ মোটা করে কাটা আর অবশ্যই গন্ধরাজ লেবু। অথবা কাগজি লেবু। পাতি লেবু নৈব নৈব চ। শুধু কাসুন্দি দিয়েও পরিপাটি করে নাকী অনেকটা ভাত খাওয়া যায়।
পান্তা ইজ ডেলিকেসি। শুঁটকি সহযোগে পান্তা খাওয়া নাকি আরো গভীর ডেলিকেসি।
এটা অবশ্য শোনা গল্প।
অমুকবাবুর বাড়িতে তমুকবাবু জামাই এলেন। বেশকিছু আগেকার দিনের ঘটনা তো! জামাই আসা মানে হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। সকালে লুচি তরকারি, দুপুরে পোলাও কোর্মা, জলখাবারে পিঠে পুলি আবার রাতে পরোটা মাংস। এইরকম যখন কয়েকদিন চলছে, তখন ঘোর বাঙাল অমুকবাবুর শখ হল যে জামাইকে একটু অন্যরকম কিছু খাওয়াতে হবে। বিলেতে থাকা জামাই। বিয়ের পরে প্রথম এসেছে, আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই। আর সেইসময়ে জামাইরা ঠিক বাড়ির ছেলে হয়ে ওঠে নি। বারমুডা আর টি পরে শ্বশুরের সঙ্গে আড্ডা দিত না। তো এই জামাইসুলভ তমুকবাবু পরপর এত পোলাও কালিয়া খেয়ে একেবারে গলদঘর্ম হয়ে গেছিলেন। তিনি সকাল থেকেই মুখিয়ে আছেন নতুন কিছু খাবেন। বিলেতে থেকে স্যুপ আর সেদ্ধ মাংস, স্যালাড খেয়ে অভ্যেস হয়েছে তাঁর। এইবার রাত্রিবেলা আসনপিঁড়ি করে তাঁকে খেতে বসানো হয়েছে। বাঙালি মাত্রেই জানেন যে পান্তা কখনো ডাইনিং টেবলে বসে খাওয়া যায় না। রাজস্থানের গাঁয়েঘরে একটা রীতি আছে। ঘোর গরমের দুপুরে শুধু কাঁচা পেঁয়াজ খেতে হয়। কিন্ত সেটা খেতে হবে ক্ষেতের পাশে বসে। দুই হাতের মধ্যে পেঁয়াজ নিয়ে এমনভাবে তাকে থ্যাঁৎলাতে হবে যে শুধু পেঁয়াজ আর রুটি মনে হবে অমৃত। কিন্ত ঐ পেঁয়াজ ঘরে বসে খেলে স্বাদ নেই। অবশ্যই থ্যাঁৎলানোর মারপ্যাঁচ আছে। ওমনি পান্তা রাখার ও মাখার জন্য হাত ও মারপ্যাঁচ জানা চাই। আর ফটফটে পরিষ্কার মেঝে চাই। পাশে বড় কাঁসার গ্লাসে জল রাখা থাকবে।
সেইরকম করেই তমুকবাবুকে বসানো হল। তিনি প্রবাসী বাঙালি। তখন হালে বিলিতি বাঙালি। হাঁসফাঁস করতে করতে পাজামা আর ফতুয়া, হালে যাকে ফ্যাব ইন্ডিয়ার হাফ কুর্তা বলে, তাই পরে খেতে বসলেন। শাশুড়িমাতা একগাল হেসে সামনে পান্তা ধরে দিয়েছেন। শ্বশুরের মুখে হাসি ধরে না। খাইয়া দ্যাহো, আমাগো বাঙালদ্যাশের ডিশ।
জামাইয়ের জন্য আগের দিন ভাত রাঁধা হয়েছে। ফ্যান গালা হয়েছে যত্ন করে। চার পাঁচঘন্টা ধরে সে ভাত ঠান্ডা করে শাশুড়ি জল ঢেলেছেন। জল ঠিক ভাতের এক ইঞ্চি ওপরে থাকবে। না বেশি, না কম। এইবার নরম সূতির কাপড়ে বিশাল পাথরের বাটিতে ভাত ভেজানো হয়েছে বারো ঘন্টার ওপরে।
তমুকবাবু দেখলেন ভেজা ভাত। পান্তা তো জল ঝরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও অনেক বাড়িতে পান্তার জলটুকুও পরমতৃপ্তিতে পান করা হয় হাপুসহুপুশ করে। কাসুন্দি আর লেবু লঙ্কা মিশে সে জল একেবারে অমৃতধারা।
তমুকবাবুকে যদিও জল ছেঁকেই দেওয়া হয়েছে, চারপাশে বাটির ছড়াছড়ি। ছোট ছোট বাটিতে কাসুন্দি, লঙ্কা পেঁয়াজ, আলু ভর্তা, কলমি শাক ভাজা, লঙ্কা রসুন দিয়ে বড়ি ভাজা গুঁড়ো, ইলিশ ভাজা, শুঁটকি, ময়া মাছের বাটি চচ্চড়ি শোভা পাচ্ছে। পাশে আরেকটা ছোট চকচকে কাঁসার বাটিতে টলটলে সোনালি সর্ষের তেল। এমনকী শেষ পাতে খাবার জন্য দই আর গুড়। সেও নাকী পান্তাযোগে খায়। অনেক ভেবে চিন্তে সেদ্ধ-বিলাসী তমুক বাবু হাত বাড়ালেন।
এরপরে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন যে যদ্দিন তিনি শ্বশুরালয়ে ছিলেন, রোজ পান্তা খেয়েছেন শুঁটকি সহযোগে এবং বিলেতে ফিরে গিয়ে গিন্নির সঙ্গে পপ আপ রেঁস্তরা অ্যান্ড টেক অ্যাওয়েও খুলেছেন। এ হল ইউরোপের কথা। তাই অস্ট্রেলিয়ার মাসটারশেফের কাহিনি খুব নতুন কিছু নয়। তবে দিনকাল কিছু আগে ছিল, নেটের রাজ্য রমরমা ছিল না বলে তমুকবাবু ও তাঁর গিন্নি আর সেলিব্রিটি হয়ে উঠতে পারেন নি।
অহমিয়া ভাষাতে পঁইতা বা পন্তাভাত। ওড়িশা, ঝাডখন্ডে পাখাল, কেরলে পাঝাম কান্জি, তামিলনাড়ুর পুঝায়া সাঝাম, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গনাতে চাদ্ধিলাম। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশে স্রেফ পান্তা।
অ্যানথ্রোপোলজিস্ট তপন কুমার স্যান্যাল বলেছেন যে দক্ষিণ এশিয়াতে প্রোটো অ্যাস্ট্রালয়েডরা দিনে একবার রাঁধতেন। কারণ অবশ্যই দারিদ্র এবং সস্তায় পুষ্টি। দিনের শেষে ভাত রাঁধো।জল দিয়ে রেখে দাও। ভরপুর স্বাদ। খরচ কম। পুষ্টিকর আর পেটভরানো।
মোগল আমলে যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত, সেসব ছিল ওপেন এয়ার কনসার্ট। মুক্ত মঞ্চ আর কী! ভাবা যায়। সপ্তদশ শতকে খেয়াল গান শুনতে শুনতে বৈঠকি মেজাজে শিল্পরসিকরা পান্তা খাচ্ছেন! পান্তা খাওয়া ইজ আর্ট !
ফ্রে সেবাস্টিয়ান ম্যানরিক সায়েব বঙ্গ দর্শন করে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে গরিব লোক পান্তা খায় নুন লঙ্কা পেঁয়াজ আর শাক দিয়ে। ধনীতে পান্তা খায় ঘি, মাখন, দুগ্ধ দিয়ে। জগন্নাথধামে প্রসাদেও খিরি মানে দুধভাত আর পাখাল মানে পান্তাভাত চলে। ভুবনেশ্বরে বিখ্যাত ডালমাতে পাখাল হটকেক। পালি ভাষাতে পাখালিবা। সংস্কুততে প্রক্ষালনা মানে যাকে ধৌত করা হয়েছে। ষোলোশ শতকের কবি অর্জুনদাস তাঁর কল্পলতা গ্রন্থে পাখালের কথা বলেছেন। সে কী একরকমের পাখাল? দহি পাখাল। চুক্কা পাখাল। কারিপাতা, ভাজা জিরা গুঁড়ো আদাকুচি মাস্ট। সাজা পাখালে তখনই তখনই ভাত রেঁধে জল ঢালা। মিঠা পাখাল। সঙ্গে থাকবে আখ, জিরা গুঁড়ো, দই, আদা। সুবাস পাখাল তো গন্ধরাজ পান্তা। জুঁই, মোগরা, চাঁপা, আদার গন্ধে সুবাসিত। ভাবলেও স্বর্গ ! শুধু পারিজাতখানি নেই! খ্রিস্টপরবর্তী বারোশো শতক থেকেই মহাপ্রভুর ভোজে পাখাল যায়।
মোগল আমল থেকে হাল আমল। পান্তা ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে হিট। দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হল। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হল। পান্তা রিফিউজি মানুষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে এলো। খাস ঘটি বাড়িতে দশমীর দিন পান্তা সহযোগে ইলিশ আর কই মাছ ভাজা, সঙ্গে কচুশাক। পান্তার আর এদেশ ওদেশ রইলো না।
অসমে পান্তা বা পন্তাভাত গ্রীষ্মকে স্বাগত জানায়। সন্ধেবেলা ভাত রেঁধে তাকে বাঁশের পাত্রে ঢেলে, আলু আর ছোটো ছোটো পেঁয়াজ ভাতের মধ্যে রেখে বাঁশের ঝাঝরি দিয়ে ঢেকে, মাটির উনুন নিভিয়ে গরম ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে রাখতে হবে সারারাত। উষ্ণতা পরম মমতায় ঘিরে রাখবে তাকে। ভাত ঝাঁঝালো হবে আর নরম। খাবার পাতে কী মিষ্টি সেই আলু আর পেঁয়াজের স্বাদ! মরি মরি!
ইচ্ছে আছে নিজে কিছু করার? স্বাধীনভাবে? সামান্য কিছু মূলধন আছে? একটা পান্তা স্পেশাল পপ আপ রেস্তঁরা ট্রাই করুন। খাদ্য বিশারদ থেকে খাদ্য স্টাইলিস্ট। সবাই বলছেন পান্তার বিস্তর গুণ। প্রোবায়োটিক আর অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর। ভিটামিন বি টুয়েলভ আর ভিটামিন বি তে ঠাসা। খাদ্যবিশারদরা বলছেন, একশো গ্রাম চালের ভাতে আয়রন থাকে তিন পয়েন্ট চার মিলিগ্রাম। সেটা পান্তাতে হয়ে যায় তিয়াত্তর পয়েন্ট নব্বই মিলিগ্রাম! পটাসিয়াম আটশ মিলিগ্রামের ওপরে হয়ে যায়। ক্যালসিয়াম সাঁই সাঁই করে একুশ থেকে সাড়ে আটশ মিলিগ্রাম। এইসব লিখে দিলে রেস্তঁরা চলবে না। দৌড়াবে। শুধু নববর্ষে পান্তাথালি বা পান্তাপ্ল্যাটার নয়। সারাবছর লোকে চাইবে এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে। আর সবশেষে লিখে দিতেই পারেন সেই অবধারিত হিট বাক্যগুলি।
সস্তায় পুষ্টিকর। স্বাস্থ্যকর! স্বাদ, টকটক!
অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট!
তারপরেও পান্তা খেলে ওজন কমে!
আর কী চাই?
"ফ্রে সেবাস্টিয়ান ম্যানরিক সায়েব বঙ্গ দর্শন করে লিখেছিলেন, বাংলাদেশে গরিবলোক পান্তা খায় নুন লঙ্কা পেঁয়াজ আর শাক দিয়ে। ধনীতে পান্তা খায় ঘি, মাখন, দুগ্ধ দিয়ে। "
কাম সারছে! :))
অসাধারণ লেখা
পান্তা নিয়ে এমন লেখেন
পান্তা খেয়েই একটু দেখেন।
পেঁয়াজ এবং ডালের বড়া
রুই এর লেজা ভাজা কড়া।
পান্তা ভাতে মিষ্টি দই গুড় দিও ভাই
নারকেল কোরা একমুঠো চাই।
খুব ভালো। রোজ পান্তা খেলে কেমন হয়!
পান্তা বড় প্রিয় খাদ্য। খুব ভাল লাগল।
দারুণ ।
আমরা এদেশিয়, মানে ঘটি। ছোটবেলায় পান্তা ভাত খুব একটা খাই নি। খেতে শিখলাম বড়বেলায় এসে আর তার পর এখন যাকে বলে পরম ভক্ত , তাই। এত ইতিহাস জানতাম না। শিখলাম অনেক কিছু। বেশ ভালো লাগল।
ভালো লাগল
ঘি দিয়ে পান্তা কেমন লাগবে? আদেখলা হঠাৎ বড়লোক সম্পর্কে প্রবাদ আছে - খাব খাব কী, পান্তাভাতে ঘি।
গ্রীষ্মকালে চব্বিশ ঘন্টা জল ঢালা ভাত ফ্রিজের বাইরে রাখলেই পান্তা। ঈষৎ টক স্বাদ। ভাতের দানাগুলো নরম হয়ে আধভাঙ্গা। কয়েক ছটাক শর্ষের তেল, কাঁচা পেঁয়াজ, আর গোটা দুই শুকনো লঙ্কা সাঁড়াশিতে চেপে ধরে পুড়িয়ে নেওয়া। আলু পেঁয়াজ ভাজা ও ডালের বড়ার সঙ্গতে অবর্ণনীয় স্বাদ। আর ভাতের শেষে শর্ষের তেল আর শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝ মেশানো ঘোলা জলই আসলে অমৃত!
অনবদ্য........
আমরা বাঁকড়ি রা খাই আমানি...ঐ সুপার পান্তা আরকি ...আরো লম্বা সময় ভেজানো আরো টকটক.... মমম স্বর্গের সংগে কোনো তপাত্ নেই