মানে ওই পান্তা বিষয়ে বলছিলাম আর কি! নুন আনতে পান্তা যাদের ফুরোয় এবং যাদের ফুরোয় না - এই দুই বাঘে-গরুতে (বা গুরু-চণ্ডালে) হঠাৎ একই পান্তা-ঘাটে জল খাওয়ার ধুম দেখে এই প্রশ্নটাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, এই ‘কেন খাবো’ প্রশ্নটি আসলে একটি যৌগিক প্রশ্ন যার ভাঁজ খুললে তিনটে প্রশ্ন পাওয়া যাবে, অবস্থাভেদে যার থেকে তিনরকম উত্তর পাওয়া যেতে পারে। উচ্চকোটির ‘হ্যাভস্' দের কাছে এই পান্তা-প্রেম যদি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া-জনিত হুজুগের প্রভাব (তাই খাবো) হয়ে থাকে, ‘হ্যাভ নটস্' দের কাছে এটাই ‘স্টেপল্ ফুড’, এর বেশি কিছু জোটানোই কঠিন (তাই খাবো)। কিন্তু এর মাঝে যে প্রশ্নটি দোল খাচ্ছে তা হল, পান্তাভাত বস্তুটি সত্যিই কতটা সুস্বাদু, যে অন্য অনেক কিছু ফেলে তাকেই খাওয়া যায়?
যথারীতি এই তিন নম্বর প্রশ্নটিই সর্বাপেক্ষা গোলমেলে, কারণ প্রথমত, কোন বস্তুর স্বাদ বিচারের কোনও সর্বজনস্বীকৃত মাপকাঠি নেই। তাই কোন পদ কার কাছে কতটা সুস্বাদু লাগবে, তা অনেকটা তার নিজস্ব অভ্যাস-নির্ভর আর কিছুটা ওই পদটির আর্থ-সামাজিক অবস্থান-নির্ভরও বটে। সে আলোচনায় পরে আসছি। দ্বিতীয়ত, উপকরণ বৈচিত্র্য, অর্থাৎ একই নামে প্রচলিত পদের উপকরণে ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর উপস্থিতি, পান্তাভাতের ক্ষেত্রে যে বৈচিত্র্যটা খুবই ব্যাপক। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পান্তাভাত নামে পদটি বিভিন্নভাবে তৈরি করার এবং বিচিত্র উপকরণ সহযোগে খাওয়ার নিয়ম আছে। তাই পান্তা ভাত আপনি খাবেন কি না, বা কতটা আগ্রহ নিয়ে খাবেন - তা নির্ভর করবে আপনি পান্তাভাত বলতে কি বোঝেন, তার ওপর।
এতদিনে পান্তাভাত কি ও কয় প্রকার, কতখানি স্বাস্থ্যকর, কতটা জিভে জল আনা, কোথায় কোথায় কি কি নামে ডাকা হয় কি কি দিয়ে খাওয়া হয় - সব আপনি মোটামুটি জেনে গেছেন। ভেবে কি একটু অবাক লাগছে, যে এতই পুষ্টিকর ও উপাদেয় আদ্যন্ত দেশী খাদ্যটিকে চিনে-জেনে নিতে অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারি দরকার হল কেন? প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা কিঞ্চিৎ জটিল, ধাপে ধাপে পৌঁছতে হবে। প্রথম কথা হল, গ্রামবাংলার যে পান্তা-সংস্কৃতি, তাতে পান্তা আদৌ কোনও ‘ডেলিকেসি’ নয়, বরং নেহাতই গরীবের পেট ভরানোর উপায়। রাতের উদ্বৃত্ত ভাতে জল ঢেলে রেখে, সাত সকালে সেটাই নুন দিয়ে খাওয়া বা দুপুরের খাবারের জন্য বেঁধে নেওয়া। স্বাভাবিক নিয়মেই তা কিছুটা ‘টকে গেছে’। তার ধরাবাঁধা ‘সাইড-ডিশ’ হল গাছের কাঁচালঙ্কা, কাঁচা-পেঁয়াজ (থাকলে), দু’ফোঁটা সর্ষের তেল কি লেবুর রস। এতে পেট ভরে আর সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। মন ভরানোর মত উপকরণ (ওই মাছ ভাজা-টাজা) আর তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার মত মন – দুই-ই নিয়মিত পান্তা-সেবীদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। তাই যে পান্তা বুড়ি তার পান্তা চুরি গেছে বলে নালিশ করতে গেছিল (উপেন্দ্রকিশোর), আর যে চোর সেই পান্তা চুরি করেছিল, তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন ‘পান্তা কেন খাও’, তারা কিছুতেই বলবে না ‘এমনি এমনি খাই’, বরং বলবে ‘গরম ভাত পাই না, তাই!’ আর সুযোগ পেলে তারা গরম ভাতের দিকেই ভোট দেবে। আর যারা চিংড়ি ভাজা-শুঁটকি চচ্চড়ি-বেগুন পোড়া-আলুভর্তা ইত্যাদি বিচিত্র উপকরণ সহযোগে উপাদেয় পান্তাভাতের (বা পইতা ভাত বা পাখাল ভাত) স্বপ্নে বিভোর তাঁরা বড়জোর ‘ঠাণ্ডা ভাত’ খান; তাকে কিছুতেই পান্তাভাত নামক ‘নিরুপায়’ খানা বলা যায় না।
তাই কিশোয়ার চৌধুরী তাঁর পদের পরিচয় দিতে গিয়ে যা বলেছেন, তা অর্ধসত্য। পান্তাভাত অবশ্যই গরীব মানুষের পেট ভরানো খাবার, যেটুকু তাঁরা যোগাড় করতে পারেন। কিন্তু মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার মঞ্চে পরিবেশন করা ‘সার্ডিন ফ্রাই’ সঙ্গতে ‘স্মোকড রাইস’ কখনওই সেই পান্তাভাত নয়। একে বড়জোর ঠাণ্ডা ভাত ও কয়েকটি পদ দিয়ে তৈরি একটি পেটভরা পরিপূর্ণ খাদ্যবন্ধ (প্ল্যাটার) বলা যেতে পারে যেরকম খাবার শখের পান্তা-ভোজীরা কখনও সখনও খেয়ে থাকেন।
কিন্তু এহ বাহ্য। কিশোয়ার চৌধুরী এটাও বলেছেন, যে এই পদ কোনও রেস্তোঁরায় পাওয়া যাবে না, কিন্তু বাঙালী সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি খুবই পরিচিত খাবার। অর্থাৎ কথাটা হল পান্তাভাত যত প্রিয়ই হোক, তার বিশ্ব-পরিচয়ে যাঁরা আনন্দে চোখের জল ফেলছেন, তাঁরা এই খাদ্যটিকে বা এই রকম আরও অনেক সুস্বাদু দেশীয় খাবারকে পরিবেশনযোগ্য মনে করতে পারেননি। সম্ভবত এর পেছনে আছে একধরনের শ্রেণী-সচেতনতা এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতা। পান্তাভাত তো দূরের কথা, বিদেশে ভারতীয় রেস্তোঁরায় ভারতীয় খাবার হিসেবে আপনি যা যা পাবেন (বেশির ভাগ বিভিন্ন মোগলাই খাবার) তা বাঙালীর পদই নয়। পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতীয় পদ হিসেবে পরিচিত হলেও সেগুলো সেখানকারও ‘বাড়ির খাবার’ নয়, মূলত রেস্তোরার পদ - যা উৎসবে-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। তাহলে পূর্ব-পশ্চিম মিলে বাঙালীর এই যে বিশাল আমিষ-নিরামিষ পাক-প্রণালী, রন্ধন সম্ভার (বিশেষ করে নানারকম সবজির পদ) তার প্রায় কিছুই কেন আন্তর্জাতিক হয়ে উঠল না? আপনি যদি পিৎজা-পাস্তা-রামেন-স্যান্ডউইচে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন, ইউরোপিয়ান-আমেরিকান সাহেবরা যদি অত্যধিক মশলাদার বাটার-চিকেন, মুর্গ-মুসল্লম বা বিরিয়ানি খেয়ে মুগ্ধ হতে পারেন, তাহলে সহজ উপকরণে বানানো আপনার রোজকার খাবার, সুক্তো, ঝিঙে-পোস্ত, মোচার ঘণ্ট, মাছের ঝোল, সুজির হালুয়া বা চিঁড়ের ফলার কেন বিদেশি পাতে পরিবেশন করা যাবে না? স্বাদে বা পুষ্টিতে তারা কি পিছিয়ে, নাকি আপনি নিজেই মনে করেন না এগুলো যথেষ্ট ‘স্মার্ট’ (খুবই বিভ্রান্তিকর একটি বিশেষণ) খাবার যা বাইরের দেশের লোককে বেড়ে দেওয়া যায়। প্রথম বিশ্বের সাদা নাগরিকদের খাদ্য-বস্ত্র-ভাষা-ধর্ম সবকিছুতে গলে যাওয়ার ঔপনিবেশিক মানসিকতাই আপনাকে চালিত করে নিজের বিষয়গুলি নিয়ে লজ্জিত হয়ে থাকার দিকে। যার ফলে পৃথিবীর খাদ্য তালিকায় একটা বিস্তৃত অঞ্চলের প্রচলিত খাদ্যগুলি অপরিচিতই হয়ে থাকে। একে যদি স্বাদের শ্রেণী-বৈষম্য বলি বোধহয় ভুল হবে না, কারণ এই ভাবেই আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে থাকা মানুষের খাবারের পদ রেস্তোরার মেনুকার্ডকেও ‘ডমিনেট’ করে যেখানে ‘ইন্ডিয়ান ফুড’ হিসেবে কচুর শাক বা লাউ-চিংড়িকে কল্পনাও করতে পারা যায় না!
অথচ কল্পনা করতে পারলে যে মন্দ হত না - এই মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতা তা দেখিয়ে দিল। অনেক জটিল ও কুটিল, অভিনব ও আশ্চর্য রন্ধন-পদাবলীকে পরাস্ত করে প্রথম তিনজনের মধ্যে জায়গা করে নিলো যে পদ, তা যথার্থ গরীবের পান্তাভাত যদি না-ও হয়, তার কিছুটা পরিবর্তিত সংস্করণ তো বটেই! যাবতীয় সংস্কারের পরও তা উপকরণ ও প্রণালীর দিক থেকে অনেকটাই সহজ-সরল। এইভাবে একটি বাহুল্যবর্জিত (পড়ুন গ্ল্যামার-বর্জিত) দেশি খাবারকে তুলে ধরে কিশোয়ার চৌধুরী নিঃসন্দেহে একটা বিপ্লব ঘটালেন। বিচারকরাও ‘শ্যাবি স্টিংকিং রাইস!’ বলে নাক না সিটকে তাকে সাগ্রহে জায়গা করে দিলেন। চেনা পান্তার এই স্বীকৃতিটুকুই শেফের মাস্টার-স্ট্রোক। এই রাস্তা ধরে এইবেলা খাদ্যের শ্রেণী-বৈষম্য চুরমার করে বাঙালীর ‘শ্যাবি ইয়েলো’ খিচুড়ি, ‘স্টিকি হোয়াইট’ সেদ্ধ-ভাত (ঘি সহযোগে) - আরও হাজারটা আমিষ-নিরামিষ পদকে বিশ্বের খাদ্য-মানচিত্রে জায়গা করে দেওয়া যায়। তাই পান্তা বলুন, খিচুড়ি বলুন, মুড়িঘণ্ট বলুন খেতে পারি, খাবো এবং খাওয়াবো কারণ জাস্ট ‘দারুণ লাগে’!
খিচুড়িকে কিন্তু আজকাল আর কোনো শেফই "শ্যাবি ইয়েলো" ইত্যাদি বলেননা। শেফ মহলে এখন খিচুড়ির বেশ কদর আছে। এই সেদিনও জেমস বিয়ার্ড পুরষ্কার প্রাপ্ত শেফ মনীত চৌহান কম্পিটিশনেই দিব্যি খিচুড়ি বানিয়েছেন (আর বেশ স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণেই "খিচুড়ি" বলছিলেন)। টুর্নামেন্ট অফ চ্যাম্পিয়নস এ। জিতেওছেন শেষ অব্দি।
খিচুড়িকে "শ্যাবি ইয়েলো" বলে নাকি? তীব্র আপত্তিকর।
বরং সবজি খিচুড়িকে আমার খুবই পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু খাবার বলে মনে হয়। এপারে চিকিৎকরাও অনেক সময় রোগীকে নরম সবজি খিচুড়ি দিতে বলেন।
আর পান্তার মর্যাদাই আলাদা
খিচুরির জাতভাই বিলি বেলে ভাত অথবা সম্বর রাইস কিন্তু শুধু দোকানে নয় , প্যাকেজড হয়েও পাওয়া যায়। এই দুটি এবং খিচুরি পাঁচতারা হোটেলেও পরিবেশিত হয়।
আলোচনা যদিও খিছুড়িতে সরে গেছে তবু সবাইকে ধন্যবাদ। ইয়ে ওই 'স্যাবি ইয়েলো' ইত্যাদি কিন্তু সেফ বা জাজ দের কথা ভেবে লেখা নয়,আমার নিজের কথা তো নয়ই। বহুদিন আগে শুনেছিলাম প্রবাসী বাঙালীর পরের প্রজন্ম পালে-পার্বণেও খিচুড়ি খেতে চায় না নাক সিঁটকে বলে 'স্যাবি ইয়েলো থিং' ইত্যাদি। লেখার সময় সেটাই মাথায় কাজ করেছিল। যাই হোক এখন খিচুড়ি অনেকটা পরিচিতি পেয়েছে জেনে ভালো লাগছে। আর দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের অবস্থা বোধহয় বাঙালী খাবারের চেয়ে ভালোই। বাইরের দেশে অনেকেই মোটামুটি ভালো দোসা-ইডলি-সম্বর খেয়েছেন বলে জানান। এই সব খাবার কি করে নিজেদের জায়গা করে নিল সেটাও একটা কৌতুহল বটে !