আমি জীবনে দু’বার পান্তা খেয়েছি। প্রথমবার খেয়ে মনে হয়েছিল ভুল হয়েছে কোথাও। ভুল শুধরে নিতে দ্বিতীয়বার খাই এবং উপলব্ধি করি ব্যাপারটা ভুল নয়, ভবিতব্য। ভুল যদি কারও হয়ে থাকে তবে তা আমার আর পান্তার কপালের। সুখী সহাবস্থানের ভবিষ্যদ্বাণী কারও কুষ্ঠিতেই লেখা নেই।
এত মুষড়ে পড়ার কিছুই ছিল না। কত লোকে ফুচকা খায় না, নাকি অসহ্য টক। কত লোক ভালোবেসে মুলো খায়, নাকি রাঁধতে জানলে অমৃত লাগে। তাদের কাউকে কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, লোকগুলো বেসিক্যালি ভালো। কাজেই জানি খাদ্যাখাদ্যের পছন্দ-অপছন্দ নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং সে দিয়ে লোকের গুণাগুণ বিচার করা মূর্খামি।
তবু মুষড়ে পড়লাম। এর দু’টো কারণ হতে পারে। এক, আমার দূরদৃষ্টি প্রখর। তখনই টের পেয়েছিলাম দু’হাজার একুশ সালে রান্নাবান্নার রিয়েলিটি শো-তে পান্তা, স্মোকড রাইস ওয়াটারের ডিজাইনার গাউন পরে মুচকি হেসে মন্দাক্রান্তা চালে এসে দাঁড়াবে - বিশ্ব-ফুডিসমাজ অভিবাদনে নুয়ে ও অভিনন্দনে ভেঙে পড়বে। আপামর বাঙালি হয় বন্দনায় নয় বিদ্রূপে বাজার গরম করবে। আর পান্তার প্রতি প্রেম বা কাছাকাছি কোনও তীব্র অনুভূতি বুকে পোষা থাকলে সেই বাজারে আমি হইহই ভেসে যেতে পারব। অন্তত সাতটা দিন আমাকে ক্যান্ডিক্রাশ খেলে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে না, সামাজিক মাধ্যমে পান্তা-স্পেশালিস্ট হিসেবে মতামত প্রকাশ করেই টাইমপাস হয়ে যাবে।
হুল্লোড়ে মাততে না পারার গ্লানি অপরিসীম স্বীকার করে নিয়েও বলব, মুষড়ে পড়ার কারণ সেটা ছিল না। যেটা ছিল সেটা জীবনে আরও কয়েকবার মালুম পেয়েছি। যখন টের পেয়েছি, এ জীবনে ফরফরিয়ে বাঙাল বলতে পারব না। যখন মেনে নিয়েছি আমার নাক এ জীবনে ইলিশের গন্ধ হ্যান্ডল করতে পারবে না। বেসিক্যালি, আমার বাঙালত্বের দাবিতে বড় বড় ফোকর থেকে যাবে। পান্তা না-পোষানো, সেই ফোকরের লিস্ট লম্বা করবে আরও।
প্রশ্ন উঠতে পারে, দাবির বেসিসটা কী? আমি জন্মেছি বালি নার্সিংহোমে, বাবা-মায়ের জন্মের হাসপাতালদের নাম জানি না, একজনের নির্ঘাত রেল কোম্পানির কোনও কলকাতার হাসপাতাল, অন্যজনের শিবপুরের। মাতামহ-মাতামহীর ঢাকা-বিক্রমপুরের গোটা সংসার তুলে রাতারাতি দেশছাড়ার হাড়হিম গল্প শুনেছি অগুন্তিবার। পিতামহ চাকরির সূত্রে বরিশাল শেষ কবে দেখেছেন জানি না, পিতামহী দেখেছেন চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে চলে আসার সময়। এ সবই ঘটে গেছে যখন আমি কারও মনে ইচ্ছেফিচ্ছে হয়েও ছিলাম না।
তবু আমি আগে বাঙাল, পরে বাঙালি। আজীবন ইস্টব্যাংগল, আমরণ লালহলুদ। শবাসনে ক্যান্ডিক্রাশ খেলতে খেলতে বাঙালদের জেদ, পরিশ্রম, স্ট্রাগলের গৌরবের আঁচ পোহাই। অর্চিষ্মান শিউরে ওঠে, ওরে বাবা কুন্তলা আস্তে কথা বল। অনুনয় করলে যুক্তি দিই, বাঙালরা খোলা মনের লোক কি না, আস্তে কথা বলতে পারে না। বাঙাল-ঘটির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের মান্ধাতাপনা এবং অযৌক্তিকতা নিয়ে আপনি যত খুশি অকাট্য যুক্তি সাজাবেন সাজান, সব যুক্তিতে ঘাড় নাড়ব কিন্তু মনে মনে অটল থাকব। কীসে, সে আর মুখ ফুটে না-ই বললাম।
এটা কেন হল ভেবেছি অনেক। হল, সম্ভবত, সোজা পথে আমার বাঙাল হওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হল বলেই। ঠাকুমা যে চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসে আর বাপের বাড়ি ফিরে যেতে পারলেন না - কারণ বাড়িটাই রইল না আর, সেই অবিচারের বিরুদ্ধে ঠাকুমার সঙ্গে সলিডারিটি দেখাতে গিয়ে আমি বাঙাল হয়ে গেলাম। সবার ঠাকুমাই রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনান, আমার ঠাকুমাও শোনাতেন। রান্নাঘরের মেঝেতে বসে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে দিতে আকাশ-অন্ধকার করে আসা মেঘ দেখিয়ে বলতেন, ওই দ্যাখ বকাসুর আইতাসে। আমি ভাত টপ করে গিলে না ফেললে বকাসুর নিতান্ত বিচলিত হবেন এবং বাড়াবাড়ি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবেন নির্ঘাত। বকাসুরের খপ্পর এড়িয়ে খাওয়া সেরে শুয়ে শুয়ে মোটা একটা বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে ছবি দেখাতেন ঠাকুমা। হলদে পাতায় ঝাপসা বরিশালের স্কুলবাড়ি, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সারি দিয়ে বসা ও দাঁড়ানো নামীদামী লোক, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসার কথা যাদের কল্পনাতেও আসত না। সে বইয়ের জায়গা-জায়গা রিডিং পড়ে ঠাকুমা প্রমাণ করে দিতেন, যে দুনিয়ার সব কৃতী মানুষেরই কোনও না কোনও পথে টিকি-বাঁধা আছে বরিশালে। ওই দুপুরগুলো আমাকে বাঙাল বানিয়ে দিল। ক্রিকেটমাঠে ভারতের প্রতি আনুগত্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতি রাগ, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য প্রকাশ এবং অবশেষে ভারতের জয়ের উল্লাস বা পরাজয়ের ক্ষেদে নায়াগ্রার বেগে বাঙাল বেরিয়ে আসত মামাবাড়ির টিভির সামনে হুমড়ি খাওয়া ভিড়ের মুখ থেকে, সেই উদ্দাম উত্তেজনার মুহূর্তগুলো আমাকে বাঙাল বানিয়ে ফেলল। কলেজে প্র্যাকটিকাল ক্লাসে হাইড্রোZএন বলে ফেলায় মুচকি হেসে চশমার ওপর থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে স্যার বলেছিলেন, Zআনতি পারো না? দ্যাশ কোথায়? আর চরিত্রগঠনের অঙ্গ হিসেবে স্কুলের দৈনিক ঝাঁটপাটের দায়িত্ব সারতে সারতে, সিঁড়িতে জড়ো করা ধুলো “পাড়াস না, পাড়াস না” বলে যেই না চেঁচিয়ে বন্ধুকে সতর্ক করলাম, অমনি সিঁড়ির রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে শুক্লাদি’ভাই বলে উঠলেন, ওপারের বুঝি? - দু’দশক এপার-ওপারের এই সব সমাপতনের মুহূর্তগুলো আমাকে বাঙাল করে তুলল।
ইলিশ না ভালোবেসে যতখানি বাঙাল হওয়া সম্ভব। আশৈশব পান্তা না ছুঁয়ে বড় হলে যতখানি বাঙাল হওয়া সম্ভব।
আমি শুঁটকির ওমে বেড়ে উঠেছি, কচুর কন্দ, ডাঁটা, লতি, পাতার পাহাড়ে চাপা পড়ে গেছি, জেনেছি যে পৃথিবীতে একমাত্র বিষাক্ত না হলে সমস্ত ঘাসপাতা বেটে খাওয়া যায় - খালি পান্তা আমার সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে গেছে।
অথচ পড়ার কথা ছিল না। ঠাকুমার স্মৃতিতে পান্তা ছিল। গরমভাতে ঘি মেখে পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে খেয়ে উঠে হাতপাখা নেড়ে হাওয়া খেতে খেতে লেবুপাতা চটকে জলঢালা গলাভাত খাওয়ার স্মৃতিতে ঠাকুমার চোখ চকচক করত। সে চকচকানি কখনও বাস্তবে রূপান্তরিত হতে দেখিনি আমাদের রান্নাঘরে, বা হলেও আমার চোখের আড়ালে ঘটেছে।
প্রথম যখন এই খামতি সারাব ঠিক করি, তিরিশের লাস্ট ল্যাপে এসে, ঠাকুমা গত হয়েছেন। মা-ও টাটা বলে হাওয়া। কিন্তু যার কেউ নেই, তার ইন্টারনেট আছে। আর ইন্টারনেটে আছে পান্তার রেসিপি। সে পান্তা প্রোবায়োটিক, এনরিচড ইন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস, ইটেন ইন সামার মান্থস। সে পান্তাভাতের ডিজাইনার বাটির চারধারে সাজানো গন্ধরাজ লেবু, কাঁচালংকা, পোড়া শুকনো লংকা, কাসুন্দি, আলুভাজা, আলুসেদ্ধ, পেঁয়াজ-কুচি, বাজারের মহার্ঘতম ইলিশমাছের বৃহত্তম গাদাপেটির পিস। শেষ শটে সে’বাটির ওপর জাপানি-পাখার মতো নারকেলের ফালি ছড়িয়ে দেয় ম্যানিকিওরড আঙুল।
ম্যানিকিওরটা বাদ পড়ে গেছিল, তা ছাড়াও সব অনুষঙ্গ জোগাড় করতে পারিনি। তা ছাড়া আমার বাড়িতে আমার ওজন মাপার যন্ত্র থাকলেও, নুনের ওজন মাপার যন্ত্র না থাকায় দু’গ্রামের জায়গায় দু’চিমটি নুন দিয়ে গোঁজামিল দিয়েছিলাম।
এ সমস্ত কারণেই হবে, পান্তা খেয়ে বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল। অর্চিষ্মান সান্ত্বনা দিয়েছিল, শোন, এটা পান্তা না । এত ফ্যান্সি পান্তা হতে পারে না। ব্যাপারটা বেসিক্যালি জল দেওয়া ভাত। নুন লেবু লংকা দিয়ে মেখে খেয়ে নিতে হয়।
চাঙ্গা হলাম। মনে পড়ল ইউটিউবে বিকেলের ঝালমুড়ি সর্ষের বদলে অলিভ অয়েল দিয়ে মাখতে দেখেছি, চিনার বদলে কাজুবাদাম ছড়িয়ে খেয়ে বিগলিত মুখ করতে দেখেছি পাবলিককে। আমি পান্তানবিশ হতে পারি, কিন্তু ঝালমুড়ি রোজ খাই। ওটা আর যাই হোক, ঝালমুড়ি না। হয়তো অর্চিষ্মান ঠিক, হয়তো এটাও সত্যি সত্যি পান্তা না।
দ্বিতীয়বার প্লেন জল-ঢালা-ভাত নুন লেবু লংকা দিয়ে খেয়েছিলাম। সঙ্গে শুকনো লংকাটংকা পুড়িয়ে নিয়েছিলাম যতদূর মনে পড়ছে, তার বেশি উদ্যোগ দেখাইনি।
আগেরবারের থেকে কম অখাদ্য। স্টিল অখাদ্য।
সময়ের ফুঁয়ে প্রায় মিলিয়ে এসেছিল, এমন সময় মাস্টারশেফের ফাইনালে পান্তা রেঁধে কিশ্বর চৌধুরী আমার ক্ষত আবার দগদগে করে দিলেন। একবারের জন্যও মন নরম হয়েছিল কি? আরেকবার ট্রাই নেওয়ার আশা কি জেগেছিল? পান্তা দাগা দিয়েছে, স্মোকড রাইস ওয়াটার যদি কাছে টেনে নেয়?
নাহ্, নেবে না। জানি। বকাসুরের আগমনের দুপুরগুলোয় কাঁসার থালায় দেখা হলে পান্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার একমাত্র সুযোগ ছিল, তার যখন সদ্ব্যবহার হয়নি এ জীবনে আর চান্স নেই।
তার থেকে বরং এই গালে হাত দিয়ে বসলাম। কোনওদিন কোনও মাস্টারশেফে যদি কেউ গরম ভাত, মাখন আর আলুভাজা সাজিয়ে বিশ্বজয় করে, সে জয়ের স্রোতে পাল তুলে কাছা খুলে ভেসে যাব। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
যাক এদ্দিনবাদে e পাড়ায় পেলাম আপনাকে। আর পেলামই যখন এটাও জানিয়ে যাই আমি অবান্তরের বেজায় ভক্ত।
বহুদিন পর এই কলমের স্বাদ পেলাম। পান্তা-বিষয়ে আপনার সাথে সহমত আর আরও লেখা পড়তে পারার আশা জানিয়ে যাচ্ছি...
গরমকালে দুয়েকবার পান্তাভাত খাই, প্রায় প্রতি বছর। সাথে মুসুর ডালের বড়া বা মাছভাজা ইত্যাদি। আমার তেমন ভালোও লাগে না, খারাপও লাগে না। অন্তত হাইলাইট করার মতো কিছু মনে হয়না।
@আমি সামহাউ ইংরিজি এ লিখতে পারছি না তাই আপনাকে অ/আ বলেই সম্বোধন করছি। অসংখ্য় ধন্যবাদ। আপনি অবান্তরের বন্ধু জেনে এক্সট্রা খুশি হলাম।
@প্যালারাম, ধন্যবাদ। পান্তা বিষয়ে হাই ফাইভ।
@ ডিসি , আপনার উদাসীনতা দেখাতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু আমার খারাপই লেগেছে। কে জানে, অভিজ্ঞ কারও হাতের পান্তা খেলে হয়তো হত না.
আপনার লেখা ভালো লেগেছে। ইশ, পান্তাভাত আমিও একদম ভালোবাসিনা! একদম না! ভালো লাগলো একই মতের কাউকে পেয়ে।
@কেকে, হাই ফাইভ!
ইয়ে মতামত রাখার এবং দেবার এক্তিয়ার অবিশ্যি সক্কলের আছে...তা সে যতই এখান থেকে মারলাম তির.. গোছের হোক না কেন.... তা বেশ লেখা...