এটা গত বছরের কথা। নারীদিবসের কাছাকাছি সময়ে দু-সপ্তাহ ধরে তখন ‘নারীর ওপর হিংসা প্রতিরোধ পক্ষ’ পালন করা হচ্ছিল। তা সেই কারণেই বোধহয় কিছুদিন কোনো ছবিতে বা কোনো দৃশ্যে মেয়েদের ওপর কোনরকম আক্রমণ দেখাতে হলে সঙ্গে সঙ্গে কাগজে বা দুরদর্শনে একটা চলমান বিজ্ঞপ্তিও দেখানো হচ্ছিল এই বলে যে এই দৃশ্য কাল্পনিক, এই ঘটনার সমর্থন বা প্রচার কাম্য নয় ইত্যাদি। উদ্যোগটা ভালোই তবে এই প্রচেষ্টা দেখে আর একটা কথাও মাথায় আসে যে মেয়েদের ওপর হিংসা বা অত্যাচার কি শুধু শারীরিক? না, এই ‘ভারতের কন্যারা’ উত্তরপর্বে মেয়েদের ওপর হিংসা (শারীরিক) নিয়ে যেসব আলোচনা চলছে তার দিক থেকে নজর ঘোরানোর উদ্দেশ্য আমার একেবারেই নেই। বরং বলা যেতে পারে সেই প্রচেষ্টায় সামান্য সংযোজন এই লেখা। তবে নারীদিবস নিয়ে কথা উঠলেই যখন কিছু লোক খুব সমদর্শী হয়ে উঠে জানতে চান ‘পুরুষ দিবস’ কবে বা ‘মানুষ দিবস’ কেন নয়, তখন এই ঘটনাগুলর দিকে চোখ পড়ে যায়।
আসলে এই প্রশ্নের পেছনে রয়েছে অনেকগুলো ছোটবড় দেখা, যদিও নতুন কিছু নয়, সে সব সকলেরই দেখা, তবে ওই আর কি চেনা ঘটনাও তো মাঝে মাঝে নতুন করে ভাবায়, সেইরকম। প্রথমে গৃহবধুদের কথাই বলি। যে মেয়েরা ঘরেই থাকেন, সংসার সামলান (মানে তথাকথিত উপার্জন করেন না) ‘ঘরের বৌ’ কথাটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ছোট্ট’ তাচ্ছিল্য এক সময় তাঁদের গায়ে সয়ে যায়। কিন্তু ‘মেয়েছেলের বুদ্ধির’ ওপর আস্থা না রেখে ‘ব্যাটাছেলেরা’ যে তাঁদের আয়-ব্যয়ের-জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি নিজের বৌয়ের কাছ থেকে গোপন রাখেন ও তাঁদের মতামত ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন, ভারতীয় সংস্কৃতিতে সেটা বেশ চালু ব্যাপার। এর ফল কিন্তু অনেক সময় খুব খারাপ হয়, মহিলাটিকেও বিনাদোষেই যার ভার বইতে হয়। আমি এইরকম একজন মহিলাকে দেখেছি যাঁর স্বামী একটা ছোট কারখানায় কাজ করতেন। একটাই ছেলে, কলেজে পড়ছিল। স্বামীর আয়ের যেটুকু হাতে আসতো তাই দিয়েই সাধ্যমত সংসার চালাচ্ছিলেন মহিলাটি। কিন্তু পই পই করে বলেও স্বামীকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারেননি একবিন্দু, আর পারেননি কিছু সঞ্চয় করাতেও। মধ্যবয়সের যাবতীয় পরিচিত ব্যাধিই ভদ্রলোকের শরীরে ছিল, রক্তের উচ্চচাপ, শর্করা মাত্রাও ছিল বিলক্ষন চড়া। তাই নিয়েই তিনি নিয়মিত ধূমপানে আর মদ্যপানে যতটা অভ্যস্ত ছিলেন ততটাই নারাজ ছিলেন ডাক্তারে-ওষুধে। ভদ্রমহিলা চেষ্টা কম করেননি কিন্তু ‘মেয়েছেলে’র কথায় কান দেওয়াকে কবেই আর পুরুষোচিত কাজ বলে ধরা হয়! ফল যা হবার তাই, একদিন অফিসে কাজ করতে করতেই শিয়রে শমন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ। দুদিন হাসপাতালে যুদ্ধের পর ভদ্রলোক চলেই গেলেন একেবারে। ভদ্রমহিলা পড়াশোনা বিশেষ করেন নি, কর্মসংস্থানের উপায় কিছু জানা নেই, স্বামী সঞ্চয় বলতেও কিচ্ছু রেখে যাননি। ছেলেটার কলেজের পরীক্ষা দেওয়া হল না, সে এখন অন্নসংস্থানে ব্যস্ত, তার মা এখন বাড়ি বাড়ি রান্না করেন।
এই গল্প কিছু নতুন নয়, কিন্তু আমার প্রশ্ন হল এই যে স্ত্রীর কথায় একেবারে কান না দিয়ে আখেরে তাঁকে এবং গোটা পরিবারকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া, এও কি একধরনের পারিবারিক হিংসা নয় ? আর দু-এক বছর কাটলে পড়াশোনা শেষ করতে পারলে হয়তো ছেলেটা ওই পরিবারকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখাতে পারত। কিন্তু স্বামীর যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে ওই মহিলাকে ঘরের বৌ থেকে ‘রান্নার মাসি’-তে বদলে (নেমে) যেতে হল এবং গোটা সংসারকে অকূল পাথারে পড়তে হল, সেই বিষয়টাকেও একরকমের হিংসা বলে চিহ্নিত করা আর তার হাত থেকে মেয়েদের মুক্তির কথাও বোধহয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
এমনিতে তো যাবতীয় ‘মেয়েলী’ ব্যাপারের ওপর যে খোলাখুলি নাক-শিঁটকানো এমনকি মেয়েরাও সেটাকে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। নাহলে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘পার্লামেন্টের একমাত্র পুরুষ’ বলা আর ঋতুপর্ণ ঘোষকে ‘হাফ-লেডিস’ বলা তো ভাবগত দিক থেকে একই রকম হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু সে আর হল কই! মেয়েকে আদর করে যাঁরা ‘বেটা’ বলেন, ছেলেকে কি আর তাঁরা আদর করে ‘বেটি’ বলতে পারবেন, নাকি তাকে গোলাপী জামা পরাতে চাইবেন! সে যাক, তবে যে মেয়েরা বাইরে কাজ করেন না, তাঁদের ‘মেয়েলী’ কায়িক শ্রমটার আর্থিক মূল্যায়নের প্রশ্নটা আজও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হলনা আমাদের সমাজে। অথচ সেটা হলে কিন্তু ওই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটার মত অনেকগুলো পরিবারই বেঁচে যেত। ‘হাত-খরচা’ নয়, রান্নাবান্না, সংসারের দেখাশোনা, বাজার-দোকান, কাচাকাচি, ঘর গোছানোর ‘বেতন’ হিসেবে যদি পরিবারের উপার্জনশীল মানুষটির উপার্জনের কিছুটা অংশ নিয়ম করে তাঁর স্ত্রীর হাতে আসত, তা হলে আখেরে সেটা বিড়ির ধোঁয়ায় না উড়ে, মদের দোকানের নর্দমা দিয়ে না বেরিয়ে সংসারের তহবিলেই জমা পড়ত। ঘরে বাইরের সমস্ত কাজ মিলিয়েই যে সংসারের মোট ‘দায়িত্ব’, আর যে তথাকথিত ‘রোজগার’ করে না, সে যে আসলে সংসারে ‘বেগার খাটে’ এই বোধটা সকলের মধ্যে এলে শুধু মেয়েদেরই নয় সকলেরই মঙ্গল হত। কিন্তু সে কথা বুঝবে কে ? ‘মেয়েছেলে’র বুদ্ধিতে বা কথায় চললে কি আর পুরুষসিংহদের চলে! তবে ‘মেয়েছেলে’দের যাঁরা ‘মহিলা’ বলেন, এই ব্যাপারে তাঁরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই, গৃহবধুদের বেতন পাওয়ার আধিকারের কথা একবার পেড়ে দেখুন না তাঁরা কেমন সমস্বরে রে রে করে উঠতে পারেন! স্বামীর উপার্জনে কিঞ্চিৎ অধিকার (মানে খরচ করার অধিকার বা জমানোর অধিকার) যেসব মহিলা ভোগ করেন তাঁরাও কিন্তু সেই অর্থকে নিজের উপার্জন বলে মনে করতে পারেন না সে যতই তিনি সংসারে উদয়াস্ত পরিশ্রম করুন না কেন! মেয়েলী শ্রমের এই যে অবমাননা, যা একটা মেয়েকে মানুষ হিসেবে পিছিয়ে দেয়, তার প্রভাব কিন্তু সংসারে পড়ছেই কিন্তু সেটা একটু অন্য প্রসঙ্গ।
তবে মেয়েদের যে বুদ্ধিহীন, বাকপ্রিয়, আবেগসর্বস্ব, রূপসচেতন ও লঘুচরিত্র এক ধরনের জীব হিসেবে দেখার মানসিকতা (যাদের কথায় কান দেবার দরকার পড়ে না!) যদি ভেবে থাকেন শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, সচেতন মেয়েদের এই হিসেবের বাইরে রাখা হয়, তো ভুল করছেন। সে ক্ষেত্রেও একটি মেয়ের ‘ইন্টেলিজেন্স ফ্যাক্টর’কে যতটা সম্ভব উপেক্ষা করা হয় এবং ‘বিউটি উইদাউট ব্রেন’ কথাটাও বেশ চলে!। যেমন ‘ও পারবে না’ বলে একটি মেয়েকে দিনের পর দিন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হল না, যার ফলে একটা সময়ের পর মেয়েটি নিজেকে প্রমাণ করতে না পেরে হতাশায় ভুগতে লাগল আর কেরিয়ারের দৌড়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ল। শিক্ষার উচ্চতম বিন্দু বলে মনে করা হয় যে অঞ্চলকে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষক ও বিজ্ঞানীমহলেও একটি মেয়েকে নানারকম ভাবে ছোট করার ব্যাবস্থা থাকে। কোন ছাত্রী বেশি নম্বর পেলে বা কোন কাজে এমনকি গবেষণার মত কাজেও বেশি এগিয়ে গেলে ধরে নেওয়া হয় মাষ্টারমশাইয়ের সঙ্গে তার গোপন আঁতাত আছে, কম নম্বর পেলে বা পিছিয়ে পড়লে বলা হয় তার বুদ্ধি নেই, তখন কিন্তু কেউ বলে না যে মেয়ে বলে শত্রুতা করে কম নম্বর দিয়েছে । শিক্ষিকা হিসেবে ছাত্র মহলে জনপ্রিয় হলে বলা হয় যে রূপ বা সাজগোজ দিয়ে মাত করেছে, জনপ্রিয় না হলে বলা হয় পড়াতে পারে না, যেটা ঠিক হতেও পারে, নাও হতে পারে। এই সব কথা ক্ষেত্রবিশেষে বেশ সোচ্চারেই বলা হয় যা মেয়েদের কানেও পৌঁছোয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে মেয়েদের রাখা হয় না বা রাখা হলেও তাঁদের মতামতকে যতটা সম্ভব উপেক্ষা করা হয়। মজা হল একটি মেয়ের কাছে সর্বত্রই আশা করা হয় ‘নম্রতা’ ‘কোমলতা’ ইত্যাদি কিন্তু প্রয়োজনমত সেই নম্রতাকেই ‘ন্যাকামি’ বলতে বাধে না। ঠিক তেমনি সঠিক কথাটি শুধুমাত্র স্পষ্ট (রূঢ় নয়!) করে বলতে পারলেই মেয়েটি হয়ে যায় ‘উদ্ধত’। অর্থাৎ বিভিন্ন পেশায় একটি মেয়েকে ওপরে উঠতে গেলে বিভিন্নরকম অদৃশ্য বাধার মোকাবিলা করতে হয়, যেটা এক অর্থে ‘ঠান্ডা হিংসা’র মতোই হয়ে দাঁড়ায় শেষপর্যন্ত। তবে এই হিংসাগুলো চট করে চোখে পড়ে না আর মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া এর কোনো সহজ সমাধানও নেই।
শুরুতে যে কথা বলেছিলাম। যে সময়ে ছবিতে-সিরিয়ালে মেয়েদের ওপর শারীরিক আক্রমণ দেখালে বিজ্ঞপ্তি দিতে হচ্ছিল সেই সময়েই কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে দেখানো যাচ্ছিল একটি মেয়েকে তার স্বামী কিভাবে উপেক্ষা করে চলেছে বিনা কারণেই। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষিত হওয়ার জন্য বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য কিভাবে একটি মেয়ে হেনস্থা হচ্ছে তার নিজের পরিবারের লোকের কাছেই! সেইসব দৃশ্যের জন্য কিন্তু কোন বিজ্ঞপ্তি দিতে হচ্ছিল না কারণ এইগুলোকে আজও ‘পারিবারিক হিংসা’ বলে ধরা হয় না। কিন্তু একটি মেয়েকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার জন্য (এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহননের পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য) এগুলোও কম নয়। তাই হিংসামুক্ত সমাজ চাইলে এই সব গুপ্ত হিংসা নিয়েও কিন্তু ভাবতে হবে!
(মেয়েদের কথা উল্লেখ করা হলেও এই লেখা আসলে কাউকে ছোট করে দেখার বিরুদ্ধে, তা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য।)