ধরা যাক একটা বৃত্ত। সেটা ভেঙে তৈরী হচ্ছে কয়েকটা ছোট ছোট বৃত্ত। তাদের মধ্যে দু একটা আবার জুড়ে গিয়ে একটু বড় একটা বৃত্ত তৈরী হচ্ছে। এইভাবে অজস্র ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে গোটা অঞ্চলটায় একটা গতিশীল সাম্যাবস্থা যার মধ্যে মেঘের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের কেন্দ্র ও পরিধির বিন্দুগুলো। কর্মক্ষেত্রে বা কর্মজীবনে নারী হল এমনই একটা বিষয় যাকে কেন্দ্র করে নানারকম প্রশ্ন, সমস্যা, ধারণা ও বিশ্বাসের বৃত্ত অনবরত ভেঙে ও গড়ে কেন্দ্র ও পরিধির বিন্দুগুলো অনবরত অবস্থান পরিবর্তন করে চলেছে। যেমন আজ থেকে আড়াই-তিন দশক আগে মেয়েদের কাছে যে প্রশ্নটা বুলেটের মত ছুটে আসত ‘সংসার না কেরিয়ার’ কিম্বা আরও সোজাসাপ্টা ‘মেয়েদের কি চাকরী করা উচিৎ ?’ আজকের নারীর কাছে প্রশ্নগুলো আর এইভাবে আসে না। আমরা বুঝতে শিখেছি ‘কাজ করা’ আর ‘কেরিয়ার’ এক নয়। কিন্তু প্রশ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় নি বরং এই প্রশ্ন ভেঙ্গে আরও অজস্র প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের নারীদের সাপেক্ষে যেসব প্রশ্নের উত্তর আলাদা আলাদা।
কর্মরতা মহিলা গোষ্ঠীর একপ্রান্তে আছেন মহিলা শ্রমিকরা, যাঁরা চাষের কাজে, মাটি কাটায়, রাস্তা তৈরীতে, রাজমিস্ত্রির কাজে লেগে আছেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (ILO)-র একটা সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে এশিয়ার মধ্যে ভারত আর পাকিস্তানে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে কম আর সেই সংখ্যাটা ক্রমাগত কমছে। ১৯৯৯-২০০০ সালে যে হারটা ২৫.৯% ছিল এখন সেটা কমে হয়েছে ২১.৯%। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে কাজের সুযোগ পেলে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা পিছিয়ে থাকেন না, যদি না তাঁর যাতয়াতের রাস্তাটা খুব কঠিন বা কাজের জায়গাটা খুব দুরের হয়। দুই ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে ছেড়ে অনেকক্ষণ থাকতে হয়, এইটার সঙ্গে মেয়েরা কিছুতেই সমঝোতা করতে পারেন না। তাই যেসব জায়গায় পাকা রাস্তা হয়েছে বা বাচ্চা রাখার সুবিধে আছে এনরেগা প্রকল্পের সাফল্য সেখানে অনেক বড়, সেখানে অনেক বেশি মহিলা কাজে আসছেন। কিন্তু শহরের দিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের মহিলারা অনেকে দূরে গিয়ে বাঁধা মজুরীর কাজের বদলে বরং বাড়ির কাছাকাছি অনেক কম মাইনের পরিচারিকার কাজ (বা সেলাইয়ের কাজ বা এই ধরণের কোনও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ) করছেন যাতে সংসারের দেখাশোনাটাও চালানো যায়। বাঁধা মজুরীর কাজে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একটা হল এটা। অর্থাৎ সংসার ও বাচ্চাকে দেখাশোনা করার দায়িত্বটা এই বৃত্তের মেয়েদের কাজে আসা না আসার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় ব্যাপার।
কিন্তু কাজের জগতের অন্যপ্রান্তে যে মহিলারা আছেন সন্তানের দায়িত্ব বিষয়ে তাঁদের অবস্থান কি খুব আলাদা ? একেবারে অন্যবৃত্তের দুজন মহিলার কথা বলি। প্রথমটা আমাদের অত্যন্ত সুপরিচিতা ইন্দ্রা নুয়ির গল্প (সেই দুধ আনার গল্প নয়); তাঁর শিশুকন্যাটি যাতে নিজেকে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন মনে না করে সেজন্য উনি অফিসের টেলিফোন অপারেটরকে বলে রেখেছিলেন। বাচ্চাটি জানত ফোন করলেই মায়ের সঙ্গে কথা হবে, টেলিফোন অপারেটরই তখন ‘মা’ হয়ে বাচ্চার ইস্কুল-টিফিন-হোমওয়ার্কের খবর নিতেন। কেরিয়ারের উঁচু থেকে আরও উঁচু ধাপে উঠতে উঠতেও একজন মহিলা যে জীবনের এই দিকটা উপেক্ষা করতে পারেন না এটা তার উদাহরণ। দ্বিতীয়জন সুপ্রিয়া রাজ যোশী; ইস্কুলে মেয়েদের কিছু সমস্যা হচ্ছিল বলে যিনি নিজের চাকরী ছেড়ে মেয়েদের পড়াশোনা নিজের হাতে নিয়েছেন, হোম স্কুলিং-এ অভ্যস্ত করেছেন, যার ফলাফল হল বাড়িতে পড়াশোনা করেই বড় মেয়ে এম আই টি তে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সুপ্রিয়া যোশী কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন। সবাই হয়ত চাকরী ছেড়ে দেন না কিন্তু একটা বয়সের পর কেরিয়ারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া, এম এস সি-র পর আর পি এইচ ডি করতে না পারা, পি এইচ ডি করেও স্কুল-কলেজে পড়ানো অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম চ্যালেঞ্জিং পেশায় ঢুকে যাওয়া, ডাক্তার / ইঞ্জিনীয়ার হয়েও যথেষ্ট কাজ করতে না পারা ইত্যাদি মেয়েদের মধ্যে খুবই সাধারণ ব্যাপার, যে কারণে মেয়েদের উচ্চশিক্ষাকে অনেকেই ‘লিকিং পাইপ’এর সঙ্গে তুলনা করেন। এই মহিলাদের সবাইকে প্রশ্ন করলে সবচেয়ে বেশি যে উত্তর পাওয়া যায় সেটা হল বাচ্চার পড়াশোনা-দেখাশোনা। অর্থাৎ শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নিরপেক্ষ ভাবেই এই বিষয়ে মেয়েদের অবস্থান গড়পরতাভাবে একই থেকে যায়। নুয়ির মত যাঁরা উপযুক্ত ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ তৈরী করতে পারেন তাঁরা টিঁকে থাকেন, যাঁরা পারেন না তাঁরা পিছিয়ে পড়েন বা হারিয়েই যান সুপ্রিয়া যোশীর মত।
কিন্তু সুপ্রিয়া যোশী-রা (মানে সুপ্রিয়া যোশীরাও!) তো এটাকে পিছিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়া বলে মনে করছেন না; বরং সন্তানের সাফল্যকেই নিজের সাফল্য বলে মনে করছেন মানে অন্ততঃ মুখে তাই বলছেন আর প্রভূত বাহবাও পাচ্ছেন। আর সন্তানের দায়িত্বটাকে মেনে নিয়ে সহায়ক ব্যবস্থাটা যতটা সম্ভব অনুকূল করে তোলাই যে উপযুক্ত সমাধান ডক্টর ইন্দ্রা নুয়িও সেকথা পরিস্কার করেই বলেছেন। তাহলে একবৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে গিয়ে পরিবর্তন কিছু হল না বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেল। যাতয়াতের-বাচ্চা রাখার ব্যবস্থার উন্নতি করে ক্ষেতের কাজে-ইঁটভাঁটায়-মাটি কাটায় মহিলা শ্রমিকদের যোগ দেওয়ার হার বাড়ানো যায় কিন্তু যে বিজ্ঞানী, পুলিশ, গোয়েন্দা বা সাংবাদিক প্রায় স্বেচ্ছায় নিজের রক্তজল করে তৈরী কেরিয়ার ছেড়ে ‘কম চাপের’ (এবং কম উন্নতির) পেশা বেছে নিয়েছেন তাঁদের ফেরা বা ফেরানোর গল্প অত সহজ নয়।
এইখানে এসে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কেরিয়ারের ‘গ্লাস সিলিং’ ভেঙে শিখরে পৌঁছেছেন যে মহিলা তিনিও যখন এই কথাই বলেন তখন আমাদের নতুনতর সংশয়ের জন্ম হয়। সমাধান খোঁজার আগে আমাদের নিজেদেরই কাটাছেঁড়া করে খুঁজে যেতে হয় সমস্যার প্রকৃত চেহারা। সোজা কথায় নিজেরদেরই প্রশ্ন করে জানতে ইচ্ছে করে মেয়েরা কেন এতটা সমঝোতা করে সন্তানের দায়িত্ব মেনে নেয়! এটা নিঃসন্দেহে এক সামাজিক নির্মাণ কিন্তু এর জন্য দায়ী করব কাকে? মাতৃত্বকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ তা এক বিকল্পহীন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তাহলে কি শুধু পিতৃতান্ত্রিক জোয়ালই মেয়েরা বয়ে চলে অনন্তকাল ধরে? পিতৃতন্ত্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মেয়েরা রোজ রোজ কম লড়াই তো করে না তাহলে এইখানে এসে এই সামাজিক নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের কেন সেভাবে লড়াই করতেই দেখা যায় না? কেন পি-এইচ-ডি ডিগ্রীধারী মেয়েটা বাচ্চার পড়াশোনার কথা ভেবে দুরের শহরের চাকরি ছেড়ে দেয়, কেন প্রবাসী মেয়েটা বছরে একবার দু-সপ্তাহের জন্য দেশে আসাটাও স্থগিত রাখে মেয়ের পরীক্ষার জন্য!
এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কারণ পিতৃতন্ত্রের অনুশাসনই একমাত্র বিষয় হলে ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণায় সমাজ যেখানে মাতৃতান্ত্রিক, সেখানে মেয়েদের গল্পটা অন্যরকম হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে যে রকম পড়লাম সুপর্ণা লাহিড়ি বড়ুয়ার লেখায়, সেখানে মেয়েদের অধিকার স্বাধীনতা দুইই যেমন অনেক বেশি সেই সঙ্গে দায়িত্বও অনেক বেশি। সেখানে উপার্জনের ভার মেয়েদের, সংসারের কাজ হয়ত ভাগাভাগি হয় কিছুটা কিন্তু প্রতিপালনের ভার নেই বলে পুরুষ সেখানে আরও নির্দায়। সন্তানসহ নারীটিকে ছেড়ে চলে গেলেই হল! উপার্জন তো মা করে, সে কি আর সন্তানকে ফেলে দিতে পারে! ফেলে দেওয়ার প্রশ্নই নেই, কিন্তু সন্তানের প্রতি এই যে বিকল্পহীন দায়বদ্ধতা আমাদের পরিচিত-অপরিচিত (পড়ুন মাতৃতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক) সবরকম কাঠামোয় মায়েদের রাস্তা এইখানে এসে মিলে যায় একই বিন্দুতে। আমরা পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনের বাইরেও কিছু একটা ভাবার / খোঁজার চেষ্টা করি, একটা নিরপেক্ষ কারণ, যেটা আমাদেরই তৈরী সমস্যা, যার সমাধান হওয়া বা না হওয়াটাও অন্ততঃ আমাদের হাতে আছে।
ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষ নিজের জন্য বাঁচে না, সন্তানের জন্য বাঁচে। সেখানে সন্তানের পড়াশোনা / বেড়ে ওঠা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যান নিজেদের স্বাধীন জীবনযাপনের কারণে নয়, সন্তানের পড়াশোনার সুষ্ঠু ব্যবস্থার জন্য। কারণ সন্তান তার বাবা-মা-এর স্বপ্ন, সম্পদ, ভবিষ্যৎ এবং বিনিয়োগ, তাকে যতদুর সম্ভব শ্রেষ্ঠ পরিকাঠামো দেওয়াই মা-বাবার লক্ষ্য থাকে। আমাদের নিরাপত্তাহীন সমাজে সেই ভাবনা খুব অন্যায়ও বলা চলে না। আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্ন যেখানে নেই সেখানেও বাবা-মা-র প্রতি কর্তব্য পালন করা, তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করা সন্তান আসলে বাবা-মায়ের সাফল্য হিসেবেই দেখা হয়। বাবা-মায়েরা মুখে বলেন সন্তান তার পছহন্দমত বড় হোক কিন্তু মনে মনে চান সন্তান যেন তাঁর চেয়েও প্রতিষ্ঠিত হয়। উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত বাবা-মা-র সন্তান যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত না হলে সে বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এই কারণেই ভবিষ্যত প্রজন্মের পড়াশোনা, বেড়ে ওঠাটার সঙ্গে কেউ বিশেষতঃ মায়েরা সমঝোতা করতে চান না। আজ নিজের কেরিয়ারের জন্য যে মা সন্তানের দিকে যথেষ্ট নজর দিতে পারছেন না, পনের বছর পরে তাঁর সন্তান যদি আর পাঁচজন তথাকথিত কেরিয়ারবিহীন মায়ের সন্তানদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে, তাহলে সে বড় আফসোসের জায়গা হবে। শুধু এই ভেবেই মায়েরা নিজের স্বপ্ন-উচ্চাশা কাটছাঁট করে সন্তানের টিফিনবক্স আর হোমওয়ার্কের খাতায় ঢুকিয়ে দেন। সোস্যাল সায়েন্সে ‘ডি’ পেলে তবু চলতে পারে কিন্তু অঙ্ক, ইংরিজী, সায়েন্স, কম্পিউটারে ‘এ’ পাওয়া চাইই চাই। এই আত্মত্যাগ আসলে একধরণের বিনিয়োগ, সন্তানের সাফল্যই যার একমাত্র ‘রিটার্ণ' (তবে তার সঙ্গে মূল্য হিসেবে সন্তানের অনেকটা আনুগত্যও দাবি করেন অনেক মা, সেটা অন্য আলোচনার বিষয়)। একধরণের ইচ্ছাপূরণের আশাও, মা-বাবার না পারাগুলো সন্তান পূর্ণ করবে, তার জন্য আত্মত্যাগ। সেসব আশা বা স্বপ্ন অনেকটাই শেষমেশ অপূর্ণ রয়ে যাবে জেনেও এই আত্মত্যাগটা চলতেই থাকে।
প্রশ্ন হল মায়ের অখণ্ড মনোযোগই সত্যি সত্যি সন্তানের একান্ত প্রয়োজন কিনা যার জন্য ত্যাগসাধনটা মাকেই করতে হবে। কেনই বা এই প্রয়োজন নাকি এই সেই সামাজিক নির্মাণ যা আসলে নারীকে নিজের শিকলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা। এ প্রশ্নের উত্তরও বড় কঠিন কারণ শিশুর নানারকম অসুবিধের কারণ হিসেবে যে মনস্তাত্বিকরা মায়েদের পরামর্শ দেন সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলা। তাই একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মায়ের সঙ্গে সন্তানের বায়োলজিক্যাল কানেকশনের মাহাত্ম্য। হয়তো কিছুটা সেই মাহাত্ম্যেই মা-ও সন্তানের মধ্যে নিজের সবটুকু ভালোকে (বা আরো ভালোকে) দেখতে চাওয়ার আশাটা ছাড়তে পারেন না। এটা মায়ের অধিকারবোধেরই অঙ্গ। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মা সন্তানকে বংশপরিচয় দিতে পারেন না বলেও হয়তো নিজের অণু-পরমাণু-পারা-না-পারা কিছু কিছু সন্তানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে মায়েরাও কিছুটা ব্যাগ্রই থাকেন। সুতরাঙ সন্তানকে ‘মনের মত গড়ে’ তোলার বাসনা যে মায়েদের নিজেদের মনের মত জায়গা থেকে সরে আসতে কিছুটা হলেও ইন্ধন যোগায়, এটা মানতেই হয়। সমাজও সেটাই চায়, উল্টোটা হলে সেটা মায়ের স্বার্থপরতা হিসেবে দেখা হয়। সামাজিক নির্মাণের সবচেয়ে কঠিন অংশ এইটুকুই, যেটা শুধু প্রতিবাদ দিয়ে ভাঙা যায় না। তাই আমাদের মায়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ে, চাইল্ড কেয়ার লিভ চালু হয়, মেয়েরাই তাতে খুশীই হন, ‘উইমেন সায়েন্টিস্ট প্রজেক্ট’এর মঞ্জুরী দিনে দিনে কমতে থাকে। আর ‘প্যাটার্নাল লিভ’ এর কথা উঠলে হয় সেটা এটা-ওটা পাঁচ কথায় চাপা পড়ে যায় নইলে মেয়েরাই কেউ কেউ উল্টো গেয়ে ওঠেন, যেমন মানেকা গান্ধী বলেছেন ছেলেরা তো স্রেফ ছুটি কাটায়, বিদেশেও একজন বলেছিলেন, ছেলেরা প্যাটার্নাল লিভ পেলে পেপার (গবেষণাপত্র) লেখার কাজে খরচ করেন। কথাগুলো হয়ত পুরোপুরি মিথ্যে নয়, কিন্তু সদ্য পাওয়া পিতৃত্বের দায়িত্বে ছেলেদের ওপর আরো বেশি করে অংশ নিতে হলে এই ছুটির যে কোনও বিকল্প নেই, সেটা মেয়েরাও যেন বুঝতে চান না আর এইটাও একটা সামাজিক নির্মাণ। তবে সেটা আবার অন্য গল্প।
এই লেখার শেষে তাই কোনও স্পষ্ট সমাধানে পৌঁছোনো যাচ্ছে না, একটি অপরাধীকে নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। মাতৃত্বহীনতার অধিকার, মায়ের কেরিয়ার-শখ-আহ্লাদ সমস্ত অধিকারের দাবি নিয়ে সচেতন ও সরব হয়েও একজন মহিলা শেষমেশ কেন ঠিকঠাক মামণি হয়ে উঠতে চেয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে ফেলেন এখানে শুধু তার কারণ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কোনো ঘটনাই সম্পূর্ণ চিত্র নয়, কোনওদিনই হয় না; এ শুধু খণ্ড খণ্ড আয়নায় নিজের মুখের ছবি খুঁজে বেড়ানো, সেটাই উত্তর। ঠিক এক দশক আগে সদ্য মা হওয়া যে মহিলা এই মামণি করে রাখার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন* দশ বছরের মাতৃত্ব পেরিয়ে এসে আজ তিনিই সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টাটা করে চলেছেন। এটাই ঘটনা।
*(রেখেছো মামণি করেঃ গুরুচন্ডালী, ডিসেম্বর, ২০০৭)