‘পুরুষ দিবস’ বা ‘জেন্টস্ সিট’ এইসব কথার মত ‘ছেলেদের লেখালেখি’ বলেও যেহেতু আলাদা কিছু শোনা যায় না তাই গোড়াতেই মেনে নেওয়া ভালো যে ছেলেদের লেখা বা ছেলেদের মত লেখাই হল লেখালেখির মূলস্রোত। সেই বিচারে মেয়েদের লেখা দুই প্রকার; যে লেখাকে মেয়েদের লেখা বলে চেনা যায় এবং যাকে চেনা যায় না। অভিজ্ঞতা বলে গল্প-উপন্যাস-কবিতা (প্রবন্ধ নয়) ইত্যাদি সৃজনশীল লেখালেখির ক্ষেত্রে মুলস্রোতে মিশে যেতে পারাতেই লেখকের সার্থকতা, তবেই তিনি বিস্তৃত (ও মননশীল) পাঠককুলের দাক্ষিণ্য পান, না হলে তিনি স্রেফ ‘মেয়েদের লেখক’ হয়ে থাকেন।
ব্যাপারটা কিঞ্চিত গোলমেলে। কারণ প্রশ্নটা এসেই যায় যে লেখকের নামের দিকে না তাকিয়েও মেয়েদের লেখা বলে আলাদা করে চেনা যাবে না কোন লেখাকে, আর চেনা গেলেই বা আপত্তি কোথায় ? ছেলেদের লেখা পড়ে তো কেউ তাকে ‘ছেলেদের লেখা’ বলে বিচার করেন না, স্রেফ ‘ভালো’ কিম্বা ‘ভালো নয়’ বলেই মনে রাখেন আর সেসব লেখা শুধু ছেলেরাই পড়েন তাও নয়। উল্টোদিকে মেয়েরা যে সবসময় শুধু মেয়েদের কথাই লেখেন এটাও ঠিক নয় বরং সেই রবিবাবুর কাল থেকে মেয়েদের কথা ছেলেরাই লিখে এসেছেন অনেক বেশি করে। তাহলে বিষয়বস্তুর দিক থেকে তফাতটা কিসের যা একজন লেখিকাকে প্রান্তিক করে রাখে ?
কিন্তু তফাতটা যে আছেই, সেটা অস্বীকার করে লাভ নেই। একেবারে সমকালীন কবি ও লেখিকা যশোধরা রায়চৌধুরীর কথা শুনি। এই ক’দিন আগে এক জায়গায় উনি লিখেছেন,
“আজও গভীর আগ্রহ নিয়ে উত্তেজনা নিয়ে কি আমাদের চেষ্টা করে যেতে হয়না মেয়েদের লেখালেখির সঙ্গে তার লিঙ্গচিহ্নের অদ্ভুত যোগাযোগ, আর পুরুষ কবিত্র প্রসাদ-করমর্দন-ডাক-উপেক্ষা-নীরবতা, সব পুরুষ কবির নাম মনে করে করে বলে, ও মেয়েদের নাম অবধারিত ভুলে গিয়ে, পরে, “আর, মেয়েরাও লিখছে, মেয়েদের মধ্যে এই যেমন আছে অমুক, তমুকেরা...” বলার স্বতঃসিদ্ধ অভ্যাস...এইসব বিষয়ে আলোচনা করার... যথাসম্ভব যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে?
কেমন অবাক হয়ে দেখি, আবার নিজের নির্লিঙ্গ (নাকি ওই নির্লিঙ্গতা আমার অস্বীকার প্রবণ বোকা কল্পনা শুধু, আসলে আমার কবিতাও কেবলই মেয়েলি তকমার যোগ্য, চাপাহাসির সঙ্গে যে তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে এযাবতকার অনেক কন্যার ওপর) কবিসত্তা ছাপিয়ে কেবলই দেখতে পারছি নিজের নারীসত্তাকে। উত্তর দিতে হচ্ছে নারীদের হয়ে, নারী কবিদের হয়ে, এই সব প্রশ্নের। এই সব বিতর্কে অবধারিতভাবে থাকতে হচ্ছে মেয়ে কবিদের পক্ষে। যেরকম কালো মানুষদের থাকতে হয় অ্যাপারথিডের একদিকে। দলিতদের থাকতে হয় জাতপাতের প্রশ্নে দলিতদের পক্ষেই। সেরকমই নিজের লিঙ্গচিহ্ন কীরকম অনিবার্যভাবে তাড়িত করছে আমাকে। নির্ধারিত করছে আমাকে। ঠেলে দিচ্ছে প্রতিবাদের দিকে।
আর, আমিও আবার অপমানের জন্য ফিরে আসছি”। (সংরক্ষণের তেত্রিশ শতাংশ, না সুস্থিতির বাহিকা। কৃত্তিবাস, মে, ২০১৭)।
ওই লেখাতেই তিনি কবিতা সিংহকে উদ্ধৃত করেছেন,
“অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে আসি
আমার অপমানের প্রয়োজন আছে!
ডাকেন মুঠোয় মরীচিকা রেখে
মুখে বলেন বন্ধুতার … বিভূতি …
আমার মরীচিকার প্রয়োজন আছে।
অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে আসি
উচ্চৈঃশ্রবা বিদূষক-সভায়
শাড়ি স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে
আমার যে
কার্পাসের সাপ্লাই মেলে না।
অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে আসি...
(অপমানের জন্য ফিরে আসি, কবিতা সিংহ, ১৯৩১-১৯৯৯)
এই কবিতার সঙ্গে তুলনা করেছেন নিজের অনুবাদ করা এলিজাবেথ বার্টলেটের (১৯১১-১৯৯৪)কবিতা “স্ট্রেচ মার্ক”
“ছোট শহরে জেগে শুয়ে শুয়ে
কবিদের কথা ভাবি। বেশিরভাগ কবিই
পুরুষ। অথবা আইরিশ। হলুদ ফোটো
হয়ে থাকেন, চার অক্ষরের গালি দেন
শিকে গেঁথে শুয়োর খান, অথবা দুবার বিয়ে করেন
বেশিরভাগ বই ও পত্রিকা
সম্পাদনা করেন।
অধিকাংশ কবি, যাঁরা পুরুষ, তাঁরা
কবিতা পাঠের সময়ে আগে ডাক পান
আমাদের মধ্যে যারা হুরিপরি তাদের পছন্দ করেন না,
নারীবাদীদেরও না। হয় বেশি বয়স্ক নয় বেশি কাঁচা
নয় বেশি আবেগসর্বস্ব। মাসিক পত্রিকার সময়ে
একমাত্র আমাদের দরকার পড়ে,
তাও ওঁদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনেরই...”
অর্থাৎ দুটো আলাদা দেশের বিভিন্ন সময়ের তিনজন কবির লেখালেখির অভিজ্ঞতা কোথাও গিয়ে একই জায়গায় দাঁড়াচ্ছে। তাঁরা শুধু মহিলা হওয়ার জন্য মননশীল পাঠকের কাছে পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছেন। দুঃখটা এইখানেই। এই দুঃখ অনেকবার বেরিয়ে এসেছে নবনীতা দেবসেনের লেখায়। সেইসব জায়গায় নিজের লেখার পাশাপাশি উনি আশাপূর্ণা দেবী, বাণী বসু, কণা বসুমিশ্র, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কথাও বলেছেন। লেখক হিসেবে জনপ্রিয় হলেও যাঁদের মূল্যায়ন মূলতঃ মেয়েদের লেখক হিসেবে। কিন্তু কেন, এঁদের লেখা নিয়ে সমস্যাটা কোথায় ? সেটা নিয়েই আজ একটু ভাবতে বসেছি।
প্রাথমিকভাবে সমস্যাটা হয়ত এখানেই যে সেই আদ্যিকাল থেকে আমরা ঘর ও বাহিরকে যথাক্রমে মেয়েদের ও ছেলেদের সমার্থক করে তাদের মধ্যে একটা মাত্রাগত তফাত রেখে চলেছি। আমাদের কাছে কাজ মানে বাইরের কাজ, সমস্যা মানে বাইরের জগতের সমস্যা। তাই সেইসব কাজ, সেইসব সমস্যা নিয়ে বা সেইসব বিষয়ের মধ্যে যারা আছে তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোটা আমাদের কাছে গ্রহণীয়। কিন্তু সংসারের হাতা-খুন্তি-নুন ও পান্তার (সেসব ব্যতীত যদিও আমাদের দিন চলে না) গল্প আমাদের কাছে একান্তই মেয়েলি এবং অকিঞ্চিৎকর। তাই লেখক মহিলা হলে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয় (মানে মাথার মধ্যে ভাবনাটা চলে আসে) যে তিনি হয় ঘরের কথাই লিখবেন নাহলে নারীমুক্তি বা মেয়েদের সমস্যা নিয়ে লিখবেন। আর তাতেই তাঁর লেখার ওপর আগ্রহ আদ্ধেক হয়ে যায়। তার ওপর যদি তিনি সত্যিই মেয়েদের অন্তরমহলের কথাই বেশি লেখেন তাহলে তাঁর লেখাকে মেয়েদের লেখা বলে দাগিয়ে দিয়ে আমরা মানে মননশীল পাঠকেরা পাঠযোগ্যতার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিই অক্লেশে। কারণ আমরা মনে করি ওসব আমাদের না জানলেও চলবে। তাই যে পাঠক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে গুলিয়ে ফেলেন না, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখাকে তারাপদ রায়ের বলে উল্লেখ করেন না তাঁরা কিন্তু বাণী বসুর সঙ্গে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখাকে হামেশাই গুলিয়ে ফেলেন। তার একটা কারণ তাঁরা কাছাকাছি সময়ের দুজন লেখিকা (লেখক নন), আর একটা কারণ তাঁরা দুজনেই সংসারের খুঁটিনাটি, সম্পর্কের ওঠাপড়া নিয়ে লেখেন যার অনেকটা জুড়ে থাকে মেয়েদের কথা। ওইসব ‘প্যানাপ্যানানি’ কি মন দিয়ে শোনার মত কিছু !
আবার উল্টোটাও সত্যি, যেটা ঘটেছিল রাধারাণী দেবীর সঙ্গে; যেকালে রবীন্দ্র অনুসারী কবি লেখক নেহাৎ কম ছিলেন না বরং মহিলা কবি ছিলেন সংখ্যালঘু, সেইকালে লিখতে শুরু করে রাধারাণী দেবীকে রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করার (মানে ‘ছেলেদের মত’ করে লেখার) বদনাম সইতে হয়েছিল। বলা হয়েছিল ‘মেয়েদের কথা’ নাকি কবিতার উপযুক্ত নয়, তাই মেয়েরা ছেলেদের মত করে কবিতা লেখেন (সঠিক কী বলা হয়েছিল সরাসরি খুঁজে পাই নি, তবে এই ধরণের কথাই যে বলা হয়েছিল তা নবনীতা দেবসেন সম্পাদিত ‘অপরাজিতা দেবী রচনাসমগ্রে’র ভূমিকায় আছে)। অর্থাৎ মেয়েদের কথা মানে তা স্রেফ হেঁসেলের কথাই হতে হবে। প্রতিবাদে তিনি অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে এক্কেবারে মেয়েদের হেঁসেলের কথা, সংসারের কথা, শাড়ি-গয়না-সন্তানপালনের খুঁটিনাটি কথা নিখুঁত ছন্দে গেঁথে কবিতা লিখে চলেন বছরের পর বছর। তখন আবার কে সেই অপরাজিতা দেবী, ইনি ছদ্মনামে কোনও পুরুষ কিনা তাই নিয়ে জল্পনার শেষ ছিল না। কিন্তু এটা নিশ্চিত বোঝা গেল যে মেয়েদের লেখাকে পাঠকসমাজ (নারী-পুরুষ উভয়পক্ষই)কখনই যথাযথ গুরুত্ব দিতে চায় না। বা নিরপেক্ষভাবে বললে মননশীল পাঠকসমাজের কাছে তা যথাযথ গুরুত্ব আদায় করে নিতে পারে না। হয় তা ‘প্যানপ্যানানি’ হয়ে থাকে, নয় তা ‘ছেলেদের মত’। কিন্তু তাতে শ্লীলতার মাত্রা যথাযথ হল কিনা তা নিয়ে সমাজের মাথাব্যথা কিছু কম নয়।
কিন্তু আসলে তো মেয়েদের মত লেখা ছেলেদের মত লেখা বলে কিছু হয় না, হয় ভালো লেখা আর খারাপ লেখা আর সেই বিচারও আপেক্ষিক। পুরুষের রচনাতেও অজস্র নারীচরিত্র আসে যায়, সংসারের কথাও থাকে, মেয়েদের হয়েও কলম ধরেন অনেক পুরুষ। মননশীল পাঠক সেসব লেখা পড়েন, মূল্যায়ন করেন নিরপেক্ষভাবে। আমাদের দুই দিকপাল সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তো চিরদিন মধ্যবিত্ত সংসারী মানুষের কথাই লিখে গেলেন। তাহলে আবারও আমড়াতলার মোড়ে ঃ মেয়েদের লেখা নিয়ে সমস্যা কিসের ?
আসলে সমস্যাটা ঠিক ঘোষিত সমস্যা নয়, সরাসরি প্রশ্ন করলে উত্তর কেউ দিতে পারবেন না, স্বীকারও করবেন না কারণ সীমারেখাটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের মতামত পড়ে যেটা মনে হয় সেটা এইরকম ঃ মেয়েদের কথা পুরুষ লেখেন আউটসাইডার বা দর্শক হিসেবে। সেই দেখায় অনেকটা কল্পনা, অনেকটা বাইরের কথাও মিশে থাকে। তাই যখনই মেয়েদের কথা / ঘরের কথা ছেলেরা লেখেন তখন তা আর মেয়েলি থাকে না। কিন্তু চরিত্রের ভেতর থেকে তার সূক্ষ্ণ টানাপোড়েন যা একজন নারীর ভালোমন্দে মেশানো মানবী চেহারাটা ফুটিয়ে তোলে, নারীর সত্যিকারের অপ্রাপ্তিগুলোকে কিম্বা নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষের ছবিটা তুলে ধরে সেটা স্বভাবতঃই একজন নারী অনেক বেশি ভালো পারেন। আর এই ‘ডিটেইলিংটা’ই অনেকের কাছে হয় ‘ঘ্যানঘ্যানানি’ নয়তো ‘পুরুষবিদ্বেষ’ হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষতন্ত্রের চেহারাটা পুরুষের কলমে উঠে এলে সেটা হয় সহমর্মিতা আর নারীর চোখ দিয়ে দেখালে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ‘নারীবাদী লেখা’ যেন সেটা শুধু মেয়েদের জন্য। মেয়েদের চোখে পুরুষের ভালোমন্দ যেভাবে ধরা দেয়, সেটা মেয়েদের কলমে উঠে এলেও সেটা অনেক সময় পুরুষের কাছে হয়ে দাঁড়ায় পুরুষবিদ্বেষ।
একটা উদাহরণ দিই। চাকুরে মেয়েদের সমস্যা বলতেই এখনও যে ছবিটা ভেসে ওঠে তা এইরকম যে উচ্চশিক্ষিতা মেয়েটিকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সে চাকরি করতে গেলে বা লিখতে বসলে বা গান গাইলে সংসারের দায়িত্ব নিচ্ছে না বলে বা সন্তানের দেখ্ভাল ঠিক মত করতে পারছে না এই অভিযোগে তাকে উত্যক্ত করা হচ্ছে। এই ছবি সত্যি হলেও একমাত্রিক। কিন্তু দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে এর বাইরে আরও সূক্ষ্ণ বহুমাত্রিক টানাপোড়েনের ছবিও তৈরি হয়। একটা সুখী পরিবারের বউ, নিজেও মা-বাবার একমাত্র মেয়ে, কলেজে পড়ায়, স্বামী উচ্চ মাইনের সফল কর্পো-চাকুরে, শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক, মা-বাবার দেখাশোনাও করে, একটি বাচ্চা আনন্দে বড় হয় যৌথ পরিবারে। এহেন পরিবারের চাকুরে ছেলেটি যদি দূর শহরে উচ্চতর পদে বদলি হয়ে যায়, তাহলে সেই আনন্দের খবরটি আস্তে আস্তে এই পরিবারে, তার ভেতরে ওই স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের ছোট্ট পরিবারের ওপর কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে তার হিসেবটা কিন্তু অনেক মাত্রিক। মেয়েটা কি নিজের কাজটা ছেড়ে দেবে ? তাহলে আর আদ্যিকালের মেয়েদের সঙ্গে তফাৎ কী রইল ! কিন্তু মেয়েটা চাকরিটা ধরে রাখতে গিয়ে আস্তে আস্তে স্বামী-সন্তান-পরিবার সকলের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, আর ভেতরে ভেতরে কিভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে এই ছবি কিন্তু খুব সহজলভ্য নয়। আর এই ছবির (লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য) সেই অর্থে মেয়েলি মনে হওয়াও উচিৎ নয়, কারণ এতে বিদ্বেষ নেই, অসহায়তাই আছে। পরিবারের সকলের অসহায়তা। তবু এই ছবি সকলের হয়ে ওঠে না।
তেমনি মাসের প্রথমে মাইনে পেয়ে সকলের জন্য নানারকম উপহারের সঙ্গে মায়ের জন্য একটি মেয়ে কিনছে শাড়ি নয়, গহনা তো নয়ই, স্রেফ সুন্দর দেখতে কয়েকটা বাটি কারণ পরের দিন বাড়িতে অতিথি আসবে আর মা নতুন বাসন ব্যবহার করতে ভালোবাসেন। এই ছবি এঁকেছেন তিলোত্তমা মজুমদার, একজন মহিলার মনের এই ছোট্ট কথাটুকু বোধহয় শুধু একজন মহিলাই জানতে পারেন। তরুণী বয়সে বিধবা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে ছেলের মাষ্টারমশাইয়ের; পাঠকও চাইছেন তাঁদের বিয়ে হোক কিন্তু সবাই চাইলেও ছেলের আপত্তিতে কেন সেই মা পিছিয়ে গেলেন, তা হয়তো শুধু একজন মহিলাই (মা) বুঝতে পারেন। এই সাংসারিক সমস্যাগুলোর বা বিষয়গুলোর আঁচ যে পুরুষের গায়েও লাগে না তাও নয়। কিন্তু একজন পুরুষ সেটা যেভাবে দেখান একজন মহিলা হয়তো কিছু আলাদাভাবে দেখান। এই অন্যভাবে দেখানোটার সঙ্গে হয়ত পুরুষ(পড়ুন পিতৃতান্ত্রিক পাঠকমন) রিলেট করতে চান না। তাই এই লেখা সকলের হয়ে ওঠে না। সব লেখিকাই এই রকম সমস্যার কথা যে সমান দক্ষতার বা নিরপেক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তা নয়। সেখানেই লেখকে লেখকে তফাত। কিন্তু সেই তফাত করতে গেলে যতটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়, পাঠকের সেই মনোযোগটা লেখিকারা পান না। প্রত্যেক লেখকও অনেক কিছুই লেখেন যার সবটাই ছেলেদের নিয়ে লেখা কিন্তু মেয়েদের কাছেও তা কখনও ‘ছেলেদের (জন্য) লেখা’ বলে আলাদা হয়ে ওঠে না। অথচ মেয়েদের ক্ষেত্রে এইটা হয়ে থাকে।
তবে মেয়েদের লেখাও পাঠকের মনোযোগ পায় যখন তা অন্য একটা জগতের কথা বলে। লেখিকা যদি আদিবাসীদের কথা বা অনাবাসীদের কথা লিখতে পারেন, যে কথায় আমাদের চেনা জীবনটা নেই, সেই লেখার একটা আলাদা মাত্রা আছে। কারণ মানুষ অজানা জগতের কথা জানতে চায়, কিন্তু তার নিজের ঘরেই যে একটা আস্ত অজানা জগত লুকিয়ে আছে তার খবর তো সে জানেই না ! তাই ডাকসাইটে অধ্যাপিকা নবনীতা দেবসেন কি করে নিজের দুই মেয়ে-মা আর সংসার নিয়েই নিত্যনতুন রসে টইটম্বুর লেখা লিখে যেতে পারেন, তাই ভেবে অনেকেই কূলকনারা পান না। তাই যে পাঠক মন দিয়ে ঝুম্পা লাহিড়ি পড়েন, গোয়েন্দা গল্পের জন্য আগাথা ক্রিস্টি বা শিশুসাহিত্যের জন্য লীলা মজুমদার পড়েন, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়া দুই বাঙালী লেখিকার মধ্যে একজন (মহাশ্বেতা দেবী) তাঁর কাছে বহুলপঠিত ও চর্চিত হলেও আর একজন (আশাপূর্ণা দেবী) তাঁর কাছে মূলতঃ ‘মেয়েদের লেখক’ হয়েই থেকে যান। সে লেখিকারা যতই পুরস্কার পান না কেন !
-----------------------------------------------------------------
এই লেখার পরিসর খুব বিস্তৃত নয়। মূলতঃ বাঙলা সাহিত্যে মহিলা লেখক ও কবিদের কথা আর তাঁদের লেখা বিষয়ে পাঠককুলের মনোভাব যেটুকু চোখে পড়েছে, সেইটুকুর ওপরেই নির্ভর করে লেখা। এর বাইরে লেখালেখির যে জগত, সেখানে মহিলাদের মূল্যায়ন কেমন হয় তা এই লেখকের জ্ঞানের বাইরে তবে অনুমান করা যায় যে তাঁদের অভিজ্ঞতাও বিশেষ আলাদা নয়। তবে এই লেখা ঠিক মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, মেয়েদের লেখা বিষয়ে পাঠকের অবস্থানটা কিছুটা বিশ্লেষণের জায়গা থেকে দেখা।
যে দুটি ঘটনা থেকে এই লেখার সুচনা সেই দুটি এবার উল্লেখ করি। নবারুণ ভট্টাচার্য্য যেদিন প্রয়াত হলেন সেদিন ফেসবুকে একজন লিখেছিলেন, আজ অন্ততঃ সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যকে তুলে রেখে নবারুণ ভট্টাচার্য্য পড়ুন। ধাক্কা লেগেছিল, জানতে চেয়েছিলাম কেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যকে তুলে রাখতে হবে আর কেন সুনীল-শীর্ষেন্দু-তারাপদ সব ছেড়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যকেই তুলে রাখতে হবে ? উত্তর পাইনি। সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য যেদিন প্রয়াত হলেন, সেদিন ফেসবুকে একজন নামকরা তরুণ লেখকের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটিই হয়েছিল কারণ উনি সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যকে পুরুষবিদ্বেষী বলেছিলেন, ছেলেদের ‘খারাপ’ দেখানোর অভিযোগ করেছিলেন। আট-দশটা পুরুষ চরিত্রের নাম তুল জানতে চেয়েছিলাম এরা খারাপ কোথায়, এদের কেন দোষে-গুণে মেশা বাস্তব চরিত্র বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না ! এবারও উত্তর পাইনি। তাই বলে শুধু ফেসবুকের পাঠকূলই নন নয়, এরই কাছাকাছি মতামত পাওয়া গেছে বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার পাঠকদের থেকে যারা সবাই কিন্তু পুরুষ নন।
এই লেখা পড়েই যাবতীয় পাঠক মেয়েদের লেখালেখিতে উপযুক্ত মনোযোগ দিতে শুরু করবেন এমনটা মোটেই আশা করা যায় না। কারণ সাহিত্যপাঠ তো সমাজ সেবা নয়, যার যা ভালো লাগবে সে তাই পড়বে। কিন্তু এই বৈষম্য যে আছে সেটা মেনে নিলে এবার নিজেকেই প্রশ্ন করতে হয় যে বৈষম্য কি একেবারেই অমূলক নাকি মেয়েদের লেখা সত্যিই যথেষ্ট প্রসারিত নয় !
প্রতিটি লেখকই আসলে একজন সামাজিক মানুষ। সত্যি কথা বলতে কি সামাজিকভাবে আমাদের মহিলাদের ছোট থেকেই যেরকম বাধা-নিষেধের মধ্যে বড় হতে হয় লেখার মধ্যেও সেই অদৃশ্য বেড়াজাল জেগে থাকে যা লেখায় প্রাণসঞ্চার করতে বাধা দেয়। সেই প্রাণের অভাব কিম্বা সেই জাল কেটে বেরোনোর মরিয়া চেষ্টাটুকু হয়তো পাঠকের অনুভূতিতে ধরা পড়ে, যা তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখে। অর্থাৎ কী লেখা যাবে না, এই হিসেব অবচেতনে জেগে থাকে বলে মহিলাদের লেখা কোথাও এক অদৃশ্য লক্ষণরেখা পেরোতে পারে না কিম্বা সেটা পেরোবার চেষ্টায় এমন কিছু দেখিয়ে ফেলে যা আরোপিত মনে হয়। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে জীবনকে অবাধে উপভোগ করার স্বাদ মেয়েদের লেখায় পাওয়া যায় না। মেয়েরা একজন প্রীতম বা একজন নীলু বা একদল ফ্যাতাড়ু দিতে পারেন না। স্বল্পপঠিত হওয়ার চাপ নিতে পারেন না বলেও হয়তো মেয়েরা নিজের দেখা জীবনের ছবি আঁকতে বেশি স্বচ্ছন্দ, ভাষা বা গদ্যরীতির দিক থেকে পরীক্ষানিরীক্ষার রাস্তায় হাঁটেন না বড় একটা। সেটাও দিনের শেষে তাঁদের পিছিয়ে থাকার কারণ হয়ে ওঠে।
এখানে একটা স্বীকারোক্তি করে রাখি। শুধু পাঠকই তো নয় পড়তে বসে এমনকি লিখতে বসেও একসময় নিজেও ভেবেছি গল্প-উপন্যাসই হোক বা কবিতা, যেকোন লেখা নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিক হওয়া চাই; পড়েই যেন বোঝা না যায় কোনও মেয়ের লেখা। যশোধরা রায়চৌধুরীও বলেছেন তাঁর লেখা নির্লিঙ্গ; অর্থাৎ লেখাকে নির্লিঙ্গ করে গড়ে তোলার চাপ তিনিও সয়েছেন / সইছেন। যে চাপ থেকেই হয়তো সুচিত্রা ভট্টাচার্য নিজেকে লেখিকা নয়, লেখক বলতেন। মেয়েদের ঘরের কথা নিয়েও কবিতা হয়, এই সত্য যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর কন্যা নবনীতা দেবসেন অবশ্য নিজেকে লেখিকা হিসেবেই উল্লেখ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু মোটের ওপর লেখায় লিঙ্গপরিচয় নিয়ে লেখিকাদের ভাবতে হয়েছে, হয়। কিন্তু লেখকদের ভাবতে হয় না / হয়নি।
সেদিক থেকে দেখলে ব্যতিক্রমী বলতে হবে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নিজেকে লেখক বা লেখিকা কী বলেন সেটা বড় কথা নয়। ইনি এই নির্লিঙ্গ হওয়ার চাপ নেন না। ইনি সব লেখাতেই মেয়েদেরই এক্সপ্লোর করেন বিভিন্ন দিক থেকে, মেয়েদের মনস্তত্ত্ব তো বটেই, ব্লাউজ-এর মত এক্কেবারে মেয়েলি একটি বস্তুও (না না প্যান্টি নয়, উহা রূপক মাত্র) বিষয় হিসেবে উঠে আসে এঁর লেখায়। এতে কার মনোযোগ পাওয়া গেল না গেল তা নিয়ে ইনি চিন্তিত নন। এবং স্বীকার করতেই হয়, এঁর লেখায় যদিও সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর মহিলাদেরই তুলে ধরা হয়, কিন্তু তার মধ্যে কোনও কিছুর তোয়াক্কা নেই বলে সেই তুলে ধরাটুকু একেবারে আবাধ। নিজে যখন খেয়াল করে দেখি পুরুষের লেখায় তো পুরুষচিহ্ন স্পষ্ট বোঝাই যায়, তখন সাহিত্যমূল্য যাই হোক, সঙ্গীতার অবস্থানটাকেই পছন্দ হয়। মনে হয় মেয়েদের লেখাকে মেয়েদের লেখা বলেই বোঝা গেলে ক্ষতি কিসের ? বরং সমস্ত নারীচিহ্ন বজায় রেখেই মেয়েদের লেখালেখি এগিয়ে চলুক। বুদ্ধদেব গুহ বা নবারুণ ভট্টাচার্য্য তো ছেলেদের লেখক হয়ে থাকেন না তবে বাণী বসু কেন মেয়েদের লেখক হয়ে থাকবেন, এই প্রশ্ন হাওয়ায় আপাততঃ ভাসিয়ে মেয়েদেরই বলতে হবে ‘আমি আমার মত লিখব, তা যদি শুধু মেয়েরাই পড়ে তাই পড়ুক !’। এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে মেয়েদের লেখা গল্পগুলো কিছুতেই সকলের হবে না, আর রান্নাঘরের তাকে শাড়ির আলমারির কোণে লুকিয়ে থাকা কান্নাহাসির গল্পগুলোও আমাদের অজানাই থেকে যাবে।