সময় যত এগোচ্ছে, বিবর্তনের নিয়ম মেনে মানুষের আরো বুদ্ধিমান, আরো সপ্রতিভ হয়ে ওঠারই তো কথা? সেই গানটা? মানুষ মানুষের জন্যে? এখন সবসময়ই ধন্দে থাকি। এতো ডিগ্রী। এতো প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। কিন্তু এই যদি সপ্রতিভতা হয়, এই যদি আধুনিকতা হয়, তবে এসবের সংজ্ঞা যা জানতাম, তা কি সব ভুল? স্মার্টনেস মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে চমৎকার সেল্ফি তোলা। তারচে ভালো এডিট করা। সেল্ফি তোলা বিন্দুমাত্র দোষের বলছি না, তবে পাগলামি সদৃশ মাত্রাধিক্যে গণ্ডগোল তো বটেই। তারচেয়েও বড় স্মার্টনেস হড়বড় করে কিছু পারি ছাই না পারি নিজেকে সবার সামনে এগিয়ে দেওয়া। এটার ভদ্র নাম নিজেকে প্রেজেন্ট করা। মানে প্ল্যাটফর্ম ক্যাপচার করা আর কি! এ কাজ যে যত অনায়াসে করতে পারে সে তত্ত স্মার্ট। ট্র্যাডিশনাল মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনতেরাস। কড়ওয়া চৌথ। (আমাদের মায়েদের কস্মিন কালে এসব করতে দেখিনি। ভালোই তো ছিলেন!) তার সঙ্গে জুটেছে বিয়েতে মেহেন্দি বা সঙ্গীত। টাকার শ্রাদ্ধ। যার আছে, সে করছে। যার নেই সে দুঃখে মরছে। সিঁদুর-মাহাত্ম্য, মেয়েদের পতিভক্তি আর ত্যাগ মহিমান্বিত হয়ে ভার্চুয়াল জগত আলোকিত করছে। আমরা কতো আধুনিক অথচ দ্যাখো কতো "ট্র্যাডিশনাল"! এই তকমা গায়ে লাগানোর জন্য সবাই হা পিত্যেশ করে ডোভার লেন কনফারেন্স শুনতে চলে যাচ্ছে। এথনিক হচ্ছে। যেতে হয়, খেলতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি।
রেবা রায়চৌধুরীর নাম কতো জনপ্রিয়, তাঁর কাজকর্ম কোন মাত্রার ছিল, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। তবে বলে রাখা ভালো যে রেবা গৌতম ঘোষের "পার"-ছবিতে নাসিরুদ্দিনের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর লেখা বই পড়ে, আপাদমস্তক এক আধুনিক মানুষকে আবিষ্কার করলাম। যার অন্য নাম সপ্রতিভতা। তাঁর জীবনসঙ্গী সজল রায়চৌধুরী। তিনি "পার"-ছবিতে নাসিরুদ্দিনের বাবার ভূমিকাতে ছিলেন। রেবা অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের "পরশুরাম" এবং অজয় দত্তগুপ্তর "দেবীগর্জনের" মতো ছবিতে।
দেশভাগ দেখেছেন রেবা। মধ্যবিত্ত কৃষক মহিলাদের সংগঠিত করার কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন, গান করেছেন গলা ছেড়ে গণনাট্য সংঘে। কাজকে জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়েছেন, যে রোগশয্যাতেও ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই তাঁর। হাংরি বেঙ্গল, দুর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেছে তাঁর অস্তিত্ব। উনিশশো আটচল্লিশ সালে একটি সালোয়ার কুর্তা পরিহিত মেয়ের ছবি। বাংলাদেশের রংপুরে তাঁর জন্ম। পুতুলখেলা দিয়ে জীবন শুরু বটে কিন্তু প্রসার অন্যরকম। অনেক বাঁধা। শরীরচর্চার সুযোগ শুধু দাদাদের। গানবাজনা চলবে না। সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ পড়াশোনা। বাড়িতে পুলিশ এলে দিদি দ্রুত রিভলভার লুকিয়ে ফেলেন বুকের মধ্যে। ছোড়দা লুকিয়ে গান শেখান। গল্প শোনান। কলেজে উঠে ছাত্র আন্দোলন। সাম্যবাদ তেতাল্লিশের মহামন্বন্তর। রেবা লঙ্গরখানাতে কাজ করছেন। গান গেয়ে তারপর বক্তৃতা দিচ্ছেন। গড়ে তুলছেন মহিলা সংগঠন। ফ্যাসিবিরোধী গান গাইছেন সেই মেয়ে যার বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা। গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের পুরোধা।
"আমাদের সময় মেয়েদের প্রতিপদে লড়তে হত। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধিতাই শুধু নয়, কুৎসা মাড়িয়েও চলতে হত। মেয়েদের নামের কুৎসা করে পোস্টার পড়ত। আমার নামেও কুৎসা করা পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোকের বাঁধাও কম ছিল না। কিন্তু আদর্শের প্রতি এমন দুর্ধর্ষ নিষ্ঠা ছিল যে কোনো কিছুই তোয়াক্কা করিনি।" পুলিশ তাড়া করলে দৌড়ে পালিয়েছেন। রেবা তাঁর বইতে টেররিজম এর অ্যাডভেঞ্চার যাঁরা করেন তাঁদের সমালোচনাও করেছেন। নিজের দিদিকেও বাদ দেন নি। এই প্রকৃত আধুনিকতা। ভয়েস অফ বেঙ্গল মানে রেবা। নাটক, নাচ, গান, ব্যালে। সাধারণ জীবনযাপন আর উঁচুমানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারা ভারত জুড়ে কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যালে ট্রুপ তৈরি হল। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলা। সেই জীবনের কথা পড়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে হবে এমনটিও হয়?পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণাও ছিলেন তাঁদের স্কোয়াডে। সারা রাত রেওয়াজ করতেন। রবিশঙ্কর আসার পর কিভাবে আবহে লোকসঙ্গীত থেকে অধিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এলো, তাও সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন রেবা। গণনাট্য আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ অতি সুদক্ষ ভাবে দিয়েছেন। খুব সাধারণ ভাবে বিবাহ করেছেন। তিনি কোন রাজনীতি করতেন সেটা তাত্ত্বিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বইটির মজা তার ন্যারেটিভে। এত সহজভাবে এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা লিখেছেন! যখন গণনাট্য শিল্পীদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, দেবব্রত বিশ্বাস একা গাইছেন, মাউন্টবেটন সাহেব ও! ভাবা যায়! জেলে গেছেন। অনশন করেছেন। ফোর্সড ফিডিং হয়েছে। রাজবন্দী হয়েছেন। ছাড়া পেয়ে আবার নাটক। গান। জেনিভাতে বিশ্বনারী সম্মেলনে গিয়ে লালপাড় সাদা শাড়ি পরে সলিল চৌধুরীর গান করে দর্শক মাতিয়েছেন। বিনা প্রস্তুতিতে। থিয়েটার জীবন নিয়ে লিখেছেন আলাদা অধ্যায়। সে এক মহার্ঘ জীবন। শম্ভু মিত্রের বাড়িতে দুজন কর্মী নিয়ে গিয়ে বলেছেন, এদের রাখতে হবে। শেল্টার। নাটক আর ছবিতে অভিনয়ের ভাঁটা পড়েনি। গান শিখিয়ে জীবিকা অর্জন করেছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত। কোনো অভিযোগ নেই। হাঁটতে পারেন না। বলছেন, এখনও অভিনয় করতে ইচ্ছে করে! নতুন হাতিয়ার তুলেছেন হাতে। লিখন।
রেবা বাংলাদেশের রংপুরের মেয়ে। জন্মেছিলেন রাজশাহীতে। মা হারা রেবা বড় হয়েছেন তাঁর বাবার কাছে। বইয়ে পেয়েছি ১৯৪৮ সালে সালোয়ার কামিজ পরা ঝকঝকে একটি মেয়ের ছবি, যে নিজের দিদিকে দেখেছে বুকের মধ্যে রিভলভার লুকিয়ে ফেলে দারোগাকে বলেছে, সার্চ করে দেখুন! ৪৩ এ রেবা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে লঙ্গরখানা তৈরি করে আর্তের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। গান গেয়ে লোক জড়ো করেছেন। তারপর বক্তৃতা। তারপর সাহায্য চাওয়া। গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের কর্মী রেবা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলার কন্যা। গান গাইতেন। নাচতেন। আবার "ফ্যান দাও" আর্তনাদ শুনেছেন, ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে বক্তৃতা করেছেন। লিখেছেন কীভাবে তাঁদের সময়ে মেয়েদের প্রতিপদে লড়তে হত। মাড়িয়ে চলতে হত কুৎসা। তাঁর নামে কুৎসাপর করে পোস্টার পড়েছিল। বাড়ির আপত্তি ছিল। কিন্তু কাজের প্রতি নিষ্ঠাবশত কিছুই তোয়াক্কা করেননি। মেয়েদের রাজনীতি করাতে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁদের বাবার। রেবা তাঁর লেখায় মেয়েদের রাজনৈতিক জীবনের একটা পরিবর্তন দেখেছেন তাঁর দিদির মধ্যে টার্ণিং। যেমহড়াত দিদি রিভলভার রাখতেন, তিনি পরে একেবারে অ্যান্টি কম্যুনিস্ট হয়ে গেছিলেন। তারপরেই যেই নাট্য বিয়ে হল, রাজনীতির সঙ্গে আর সম্পর্ক থাকল না। দিদির ছেলেমেয়েরা আমেরিকা চলে গেলেন। দিদি হয়ে গেলেন ঘরোয়া মেয়ে। মেয়েদের জীবনের এই এক আশ্চর্য দিক পরিবর্তন। সঙ্গে তেন রেবার পরবর্তী জীবন মুম্বাইতে। নাচ আর নাটকের মহড়াতে। এটা তাঁর জীবনের টার্ণিং পয়েন্ট। মহড়া করেছেন চলেছে'রতের ভয়েস অব বেঙ্গল' এর। "ভুখা বাঙ্গাল" নৃত্যনাট্য। ১৯৪৪ সালে পৃথ্বীরাজ কাপুর, হারীন চট্টোপাধ্যায়, ভি শান্তারাম, শোভনা সমর্থের সঙ্গে অনুষ্ঠান করেছেন। শুধু হল নয়। শো করেছেন বিজনেস, এলাকাতেও। পার্টির সিদ্ধান্তে গড়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ব্যালে ট্রুপ। বাঘা বাঘা কম্যুনিস্ট নেতারা সবার সঙ্গে বসে একই খাবার খেতেন। আন্ধেরীপর্বে তাঁদের সঙ্গে যোগ আর দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। সারা ভারতের প্রায় সর্বত্র শো করেছেন রেবা। আসামে যখন শো করেছেন তখন দলে ছিলেন সলিল চৌধুরী, খালেদ চৌধুরীর মতো মানুষ। সকালবেলার ঝকঝকে রোদ্দুর লাল রঙের পাহাড়ি রাস্তায় ছোটো ছোটো দোকানে তৈরি গরম গরম বেগুনি আর ব্যাসন দিয়ে লঙ্কাভাজা খেতে খেতে গান গাইতে গাইতে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যেতেন তারা। বসে থাকতেন উৎসারিত জলপ্রপাতের সামনে। সলিলের বাঁশির করুণ রঙ্গিণী পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে আমাদের হৃদয়স্পর্শ করতো।
রেবার বিবাহ হল সজল রায়চৌধুরীর সঙ্গে। রেবার থিয়েটার জীবন কাজে ঠাসা। আশ্চর্য প্রাণবন্ত। গণনাট্যসংঘের কাজকর্মের বিবরণ দিয়েছেন তিনি বইতে। সে এক আশ্চর্য অজানা জগত। গোটা ভারতের সাংস্কৃতিক জগতকে দেখেছেন কাছ থেকে। পরিচিত' হয়েছেন মৃণাল সেন, তাপস সেনের সঙ্গে। লিখেছেন' গণনাট্য সংঘের দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের কথা। তাঁদের জীবনযাত্রার কথা। এত বিস্তৃত তাঁর পরিচিতির পরিধি যে নিজেও সব জানেন না। চিত্রা সেন। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। ছবি করেছেন গৌতম ঘোষের সঙ্গে। স্পষ্ট কথার মানুষ। বলেছেন উৎপলেন্দুর খারাপ ব্যবহারের কথা। চিঠি এসেছে 'সিটি অব জয়' তে অভিনয় করার জন্য। প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। আদর্শ সবচেয়ে বড়ো। টাকা রোজগারের প্রলোভন টলাতে পারেনি।
রেবার জীবনে সব আশ্চর্য খুঁটিনাটি নিয়ে এই বই।
হাতের লেখা নিরেস হচ্ছে ক্রমশই। চোখের আলো কমে আসছে। প্রায়শই শরীরমন অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু নিরাশ হন না। লিখে যাবেন যতদিন বাঁচেন।
কি বলবো! পড়ে অভিভূত হয়ে যাই। এমন মানুষ! আধুনিকতার নির্মাণ করতে পারেন এঁরাই। এবং পারেন ঐতিহ্য বাঁচাতে।
বইঃ জীবনের টানে, শিল্পের টানে
লেখকঃ রেবা রায়চৌধুরী
প্রকাশকঃ থীমা
মুদ্রিত মূল্যঃ ৭০ টাকা