হিন্দু ধর্ম বলে যাকে জানি, সেটি আদ্যন্ত প্রতীকী একটি ধর্ম। সেখানে বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি কণাকেই যেমন প্রতীকে-রূপকে ঈশ্বররূপে উপাসনা করা হয়েছে, তেমনি এই বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি অংশের সুখ-সমৃদ্ধি-নিরাময়-শান্তি কামনা করা হয়েছে।
‘সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,ওম শান্তি শান্তি শান্তি - অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে আরোগ্য লাভ করুক, সকলে অপরের মঙ্গলার্থে কাজ করুক, কখনো কেউ দুঃখ ভোগ না করুক, জগতের সকল প্রাণী শান্তি লাভ করুক।
মহালয়ার তর্পণ অর্থাৎ স্মরণ-মন্ত্রগুলি আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির মৌলিকতম চরিত্রের পরিচায়ক। আজ এদেশে যে স্বঘোষিত 'হিন্দুত্ববাদী'রা ক্রমবর্ধমানহারে আস্ফালন করে চলেছেন, তাঁরা কোথাও এতটুকুও কি জানেন? এই ধর্ম-সংস্কৃতি শুরু থেকেই এক উদারতম ভালোবাসা বোধে জারিত - এই সংস্কৃতি সকলের সহাবস্থানে - সকলের আনন্দে - সকলের তৃপ্তিতে-সকলের মুক্তিতে সম্পৃক্ত। 'সকল' অর্থে যে সংস্কৃতিতে কেবল মানব নয়, 'সকল' সর্বার্থেই যে সংস্কৃতিতে এই মাটি পৃথিবীর প্রাণ-অপ্রাণ; প্রতিটি অংশ…। সেই 'সকল'কে 'সবাই'কে অসীম শুভেচ্ছা- অন্তহীন স্নেহের দৃষ্টিতে দেখার নামান্তর মহালয়ার তর্পণমন্ত্র।
"যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু" - অর্থাৎ যাঁদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই,
"যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ" - যে আমার বন্ধু বা যে বন্ধু নয়, যে আমার অপরজন্মে বন্ধু ছিল,
"ওঁ নমঃ দেবা যক্ষাস্তথা নাগা, গন্ধবর্বাপ্সরসোহসুরাঃ।
ক্রুরাঃ সর্পাঃ সূপর্ণাশ্ঢ, তরবো জিহ্মগাঃ খগাঃ ।।
বিদ্যাধরা জলাধারা-স্তথৈবাকাশগামিনঃ ।
নিরাহারাশ্চ যে জীবাঃ পাপে-ধমের্ম রতাশ্চ যে ।
তেষাং আপ্যায়নায়ৈতৎ, দীয়তে সলিলং ময়া ।।"
- দেব, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, ক্রুরস্বভাব জন্তু, সর্প, সুপর্ণ অর্থাৎ গরুড়জাতীয় পাখি , বৃক্ষ, সরীসৃপ, সাধারণ পাখি, বিদ্যাধর অর্থাৎ কিন্নর, জলচর, খেচর, নিরাহার অর্থাৎ প্রেতাত্মা, এমনকি পাপকাজ ও ধর্মকাজে রত এই ভূলোকের যত জীব আছে, তাঁদের তৃপ্তির জন্য আমি এই জল দিচ্ছি।
কাল থেকে দেবীপক্ষ শুরু হলো। আর কি অদ্ভুত সমাপতনে কাল ছিল অন্তর্জাতিক কন্যাসন্তান দিবসও। মেনকার কন্যা দুর্গার গল্প আসলে প্রতীকে-রূপকে দুষ্টের পরাজয় আর শিষ্টের জয়ের গল্প…ইরানেও আজীবন গুটিয়ে থাকা মায়েদের মেয়েরা সেটাই তো করছেন গত ক'দিন ধরে, তেমন বাংলাদেশের মেয়ে ফুটবলাররা রক্ষণশীলতার চোখরাঙানিকে মাঠের ভাষায় প্রতিরোধ করছেন, তাঁদের গ্রামদেহাতের আম্মি-নানীমা-দাদীমা সক্কলকে সঙ্গে নিয়ে।
ভারতে-ইরানে-বাংলাদেশে-আফ্রিকায়, এই গোটা পৃথিবীর সর্বত্র ধর্ম- সমাজ-সংস্কৃতি-পুরুষতন্ত্রের অজুহাতধারী অন্যায়রূপী সমস্ত অসুরদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সকল দুর্গতিনাশিনী কন্যার জয় হোক।