ঈদের ছুটিতে বন্ধুরা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে; কেউ আছে সিডনি, কেউ কেউ বা গ্রীসে। আর আকাশে ওড়ার ডানা গজাতে পারেনি যারা, তাদের জন্য রয়েছে কক্সবাজার, রাঙামাটি, সিলেট। এদিকে আমি পড়ে রয়েছি গ্রামের বাড়ি। ফেইসবুকের কোলে ভেসে আসা বন্ধুদের ছবি দেখতে দেখতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছি, এমন সময় কামাল ভাই কাধের উপর হাত রেখে বলল, “চল, ঘুরে আসি।“ কামাল ভাই আমার গ্রাম সম্পর্কের কাজিন। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাতটা সরিয়ে রেখে বললাম, ‘কই যাবেন ঘুরতে? আছে তো ঐ এক নদীর পাড়!’ সত্যি বলতে কি, আমাদের গাঁয়ের নদীটা অসুন্দর নয়; স্নিগ্ধ, ছোট্র নদী। কিন্তু স্বয়ং বিধাতাও এক জায়গায় দিনরাত পড়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেন নিশ্চিত, না হলে বিশ্বজুড়ে এত রং,রূপ ও রসের বৈচিত্র্য কেন গড়তে গিয়েছেন তিনি!
‘না, না, আজ তোকে নিয়ে যাব একটি রাজবাড়ি, কাছেই আছে রামসাধুর এক পুরনো মন্দির। আরো যদি একটু দম যদি ধরে রাখতে পারিস, তাহলে ঘুরিয়ে আনবো পন্ডিতসারের দরগা।‘ কামাল ভাই যখন বলছিলেন, বলতে কি, আমার মনে খুব একটা রোমাঞ্চ জাগল না। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, ঘরে বসে যেহেতু কোন কাজ নেই, তো একটু ঘুরেই আসা যাক না!
বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ে অবস্থিত শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলায় আমাদের গ্রামের বাড়ি। আর আমাদের গন্তব্য পদ্মা বিধৌত প্রতিবেশী নড়িয়া উপজেলা, যার পিচঢালা রাস্তা ধরে যখন যাছিলাম, দু’ধারের গাছেরা রাজার শিয়রে দাঁড়ানো সান্ত্রীদের পাখার মত দুলে দুলে বাতাস বিলোতে লাগল আমাদের! পদ্মার পললে গড়ে উঠা এলাকাটিকে মনে হচ্ছিল সমুদ্র পাড়ের এক সবুজ দ্বীপ!
জমিদারবাড়িটা ছিল কার্তিকপুরে। রহিমের কাছে উত্তর দিকে, করিমের কাছে দক্ষিণ দিকে শুনতে শুনতে সব দিকে পাঁক খেয়ে এক সময় আবিষ্কার করলাম, জমিদারবাড়িটিতে যেতে হবে এলাকাটির প্রধান স্কুল মাঠের সীমানা পেরিয়ে, আর সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে একটা সাইনবোর্ড।
সাইনবোর্ড ছিল বটে, কিন্তু তা কোন সীমানা পাঁচিল নির্দেশ করছিল না। গ্রামের বাড়িঘরকে ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই চোখের সামনে দেখতে পেলাম একটা পুরনো দালান, দেখতে জমিদার বাড়ির মতই, কিন্তু ক্ষতচিহ্ন সারা শরীরে! বাড়িটির সামনেই এক চিলতে উঠোন, আর তার সাথেই হাল আমলের বাড়িঘর এমন করে ঢেকে রেখেছিল দালানটিকে যে, বোঝার উপায় নেই তার জমিদারিত্ব! কিন্তু পেছনে যেতেই বৈভব ফুটে উঠল বিশাল পসরা নিয়ে, প্যাঁচানো সিড়ি উঠে গেছে পুরো ছাদ পর্যন্ত। এই পেছন দিকটিতেই রয়েছে বিশাল প্রান্তর, যা থেমেছে একটি শান বাঁধান পুকুর ঘাটে।
আমরা পুকুর ঘাটে একটু খানি বসলাম। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, আর আমাদের ভেতরে একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল। যেন কয়েক শতাব্দী আগের কোন জমিদার তার গিন্নিকে নিয়ে বসে আছেন, আর উপভোগ সামনের আদিগন্ত নৈসর্গিক শোভাকে!
আমাদের আরো দুটো জায়গায় যেতে হত, তাই ফেরার যোগাড়যন্ত্র করতে লাগলাম। আর তখুনি দেখা হল এক আশি বছরের বৃদ্ধকে। তিনি জানালেন, তার যৌবনে এখানে আরো অনেক প্রাদাদ দেখেছেন, কিন্তু এই একটিই টিকে আছে! মূল রাস্তা থেকে ৮০ মিটার দূরত্বে অবস্থিত ৪০০ বছরের পুরনো এই দ্বিতল বাড়িটি মুঘল আমলে নির্মিত। বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায় মুঘল সেনাপতি মান সিংহের হাতে বন্দী হলে, তার স্ত্রী মহারাণীর নেতৃত্ব এক দল সেনা বিদ্রোহ অব্যহত রাখে। পরে মুঘল আনুগত্যের শর্তে জমিদারি ফিরে পেলেও জমিদারিটি ভাগ হয়ে যায় সেনাদের মধ্যে; জনৈক শেখ কালুর ভাগ্যে পড়ে কার্তিকপুরের জমিদারি।
আমরা যখন ওখান থেকে বেরিয়ে আসে, তখনো বিকেলের আলো পূর্ণ যৌবনাবেগে লুটুপুটি খেলছে! শত বছর পুরনো রামসাধুর মন্দিরে ঢোকার পরেও তা অটুট রইল। তবে মন্দির বলা ভুল; এ তো এক আলাদা রাজ্য। এখানে মন্দির, আশ্রম, আশ্রয়কেন্দ্র সব রয়েছে।
আঙিনায় ঢুকতেই কয়েকজন পুজারির সাথে দেখা হয়ে গেল। আলাপ করে জানা গেল, তারা ভারত থেকে এসেছেন। শুনে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া! আমাদের বাড়ির কাছেই এত খ্যত একটা পুণ্যধাম আছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের, জানাই ছিল না! একজন পুরোহিত আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখালেন সব কিছু। এখানে না কি প্রতি শীতে মেলা হয়! হঠাৎ একটি দালান চোখ আটকে দিল আমার। পুরোহিত জানালেন, এটিই আদি মন্দির। আমার মনটা কেঁদে উঠল, পোড়ামাটিতে গড়া সুন্দর এই মন্দিরটা অল্পকিছুদিনেই ধ্বসে পড়তে পারে জেনে! আমাদের উপস্থিতকালেই সান্ধ্যঘন্টা বেজে উঠল, আর প্রদীপ প্রজ্বলন শুরু হল। অচিরেই পুরো আঙ্গিনাটি পূজারীদের নৈবেদ্যে অলৌলিক সুন্দর হয়ে উঠল! কাছেই চোখে পড়ল একটি কষ্টিপাথরে শ্রী শ্রী রাম ঠাকুরের অমৃত বাণী, বেদবাণী প্রথম খন্ড হতে’ এর মধ্যে একটি ছিলঃ ‘সত্যধর্ম পরিচর্যাই পরমানন্দ উৎপাদন করিয়া থাকে।‘
সেই অসাধারণ পরিবেশে আরো কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম, কারণ তখনো আর একটা সাইট বাকী ছিল, ওদিকে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছিল। কিন্তু আমাদের আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করে আজমীর শরীফের অনুসারী শ্যামপুরী হুজুরের চিশতিনগর দরগাহ শরীফটি খোলাই দেখতে পেলাম। শুধু তাই না, পেয়ে গেলাম গদীতে আসীন বর্তমান হুজুরকেও। লোকটিকে আমার একটু আগেই দেখে আসা পুরোহিতদের থেকে আলাদা কিছু মনে হল না। একই রকম শান্ত, সৌম্য, ও ঋদ্ধ অবয়ব; জ্ঞান ও নিবেদনের দ্যুতি ছড়ানো চারদিকে। আমরা যখন তার সাথে আলাপ করছিল, তখন তার চেয়ারের পেছনের দেয়ালেই চোখে পড়ল একটি মসজিদের ছবি, যার এক কোণে উৎকীর্ণ ছিল রবীন্দ্রনাথের বাণী – ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’। আমি অবাক নয়নে তাকালে হুজুর জানালেন, তিনি একজন রবীন্দ্রপ্রেমী! আমি ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি কি ম্যাজিকাল যে একজন মুসলিম ধর্মগুরুকেও কাছে টেনেছে! আর ঐ ধর্মীয় নেতাই বা কী অসামান্য দূরদর্শী যে রবীন্দ্রনাথকে অন্তরায় না ভেবে তার প্রতিষ্ঠানের মতাদর্শ প্রচারে একজন সহায়ক শক্তি হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন!
হুজুর জানালেন, ধর্মীয় ওরস, জিকির, আসগর ছাড়াও তার এই দরগাহ ব্যবহৃত হয় চিকিৎসা ও বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে। হুজুর আমাদের নিয়ে গেলেন তার লাইব্রেরীতে, যেখানে ধর্মীয় পুস্তকের সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যের মণিমানিক্যও শোভা পাচ্ছিল। পুরো প্রাংগন ফুলে ফুলে শোভিত ছিল, যার মধ্যে ডায়ান্থাসের গালিচা চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল! পুরোটা ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে যাচ্ছিল, তাই মসজিদে দু’রাকাত নফল নামায আদায় করে, সেই আশ্চর্য দরগাহটি থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
আমি আরো অনেক জমিদার বাড়ি ও ধর্মীয়কেন্দ্র দেখেছি। কিন্তু সেদিন যে জায়গাগুলি দেখেছি, সর্বত্র যেন একটা অসম্ভব মায়া ও আশ্চর্য আন্তরিকতার ছোঁয়া লেগে ছিল! ছোঁয়াটি এমন শক্তিশালী ছিল যে, আজ এতদিন বাদেও আমায় শিহরিত করে!
(সমাপ্ত)
……………………………………………………….
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।