অফিসে আমার এক সহকর্মী ছিল, সে খেত মুখ ডুবিয়ে, কিন্তু দেহটা ছিল তার একদম পেন্সিলের মত। আর কী অদ্ভুত ছিল তার খাওয়ার স্টাইল! সবগুলো ব্যঞ্জন একত্র করে সে মুখে পুরে দিতে গোল গোল দলা বানিয়ে। ওর সাথেই ছিল আমার দৈনন্দিন কর্মজীবনের বড় একটা সময় বাঁধা। আমরা একই সাথে বেরুতাম অফিস থেকে; একজনের কাজ আগে শেষ হয়ে গেলেও আরেকজন অপেক্ষা করে থাকতাম- যেন এটা একটা নিয়ম, আর এর বাইরে যাওয়াটা এক শাস্তিমূলক অপরাধ!
তো সেদিন রনিকে নিয়ে বেরুতে যখন বেশী দেরী হয়ে যাচ্ছিল, আমি রাগে কড়মড় করছিলাম। কে জানে, হাবিজাবি গিলে আবার বাথরুমে ঢুকেছে কিনা! এক সময় হেলেদুলে বান্দা হাজির হলেন। রাগের পারদটা ঊর্দ্ধমুখী ছিল, আমি জোর করে নামিয়ে আনলাম, আর অফিসের সামনে রনির সাথে বিদায়-হ্যান্ডশেকটা একটু জোরেই করলাম। তারপর দুজন দুদিকে; সে ডানের গলি ধরল, আর আমি বাঁয়ে নাক বরাবর। আমাদের দুজনেরই বাসা হাঁটার দূরত্বে, কিন্তু দুপ্রান্তে হওয়ায় একসঙ্গে গল্প করতে করতে ফেরার সুযোগটা কখনোই হত না। বাসা অব্দি রিকশা-টিকশা যে মিলত না, তা না। কিন্তু দিনভর ঋণ তদারকির ফেরি করতে করতে হাঁটার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল আমাদের; হাঁটা কমে গেলেই বরং শরীর ভার ভার লাগতো, আর মাথাটা টনটন করে উঠতো!
এমনিতে আমি খুব দ্রুত হাঁটি, যখন ভিজিটে বেরুতাম দুজন একত্রে, রনি প্রায়ই পেরে উঠত না আমার সাথে, আর বয়সে আমার চেয়ে তরুণ হওয়ায় লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে পড়ত। আমি অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার পর একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম, আর একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করতাম ওর জন্য। কিন্তু সেদিন কেন জানি খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম। আর ফুটপাত জুড়ে বসে থাকা দোকানগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। এত বিচিত্র সব দোকান রয়েছে এখানে যে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আগে সেভাবে খেয়াল করিনি। হয়ত দৌঁড়ে দৌঁড়ে হাঁটাই অন্ধ করে রেখেছিল আমায় সবকিছু থেকে।
চলতে চলতে একটি পুরনো ঘড়ির দোকানের সামনে থেমে গেল পা দুটো, একটি মাত্র টেবিল নিয়ে ছিল দোকানটি, আর তাতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল বিচিত্র সব নকশার ঘড়ি। তাদের ছিল আলাদা রং, আকার, আর আকৃতি! এর মধ্যে একটি ঘড়ি তো আমায় চুম্বকের মত টেনে ধরল। ডায়ালটি নীল বর্ণের ছিল, আর তার ঘন্টা নির্দেশক চিহ্নের অর্ধেকটাই মুছে গিয়েছিল! আশ্চর্য হল, তাও সময়টা ঠিকঠাক পড়া যাচ্ছিল! ঘড়িটা হাতের উপর রেখে নেড়েচেড়ে দেখলাম অনেকক্ষণ। এক পর্যায়ে ডায়ালটোনটা পরীক্ষা করতে কানের কাছে চেপে ধরলাম! কিন্তু আমার কানের পর্দা বেশ কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করেও কোন টিকটিক ধ্বনির কম্পন টের পেল না। এরপর টোনের যন্ত্রটা বিগড়ে গেছে মনে করে যেই নামাতে গেছি ঘড়িটা কান থেকে, এমন অদ্ভুত স্বরে কিচিরমিচির করে উঠল সে যে, আমার হৃদপিন্ডটা থেমে যাবার উপক্রম হল, মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যেতে লাগল শীতল স্রোত!
শব্দটা যে কিসের তা ব্যাখ্যা করতে পারব না, তবে আমি নিশ্চিত এমন শুনিনি আগে! তবে আমি তো কত কিছুই শুনিনি এই পৃথিবীর – এরকম একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ঘড়িটাকে জায়গামত জমা দিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলাম। আর তারপর হাঁটার গতিটা বাড়িয়ে দিলাম, এতটা যে আবার আমি অন্ধ হলাম, আশেপাশের কিছুই চোখে পড়ছিল না, শুধু হেঁটে যাচ্ছিলাম, নাক বরাবর! হঠাৎ মনে হল, কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। তারপর চোখ তুলে তাকাতেই যা দেখলাম, পিলে চমকে উঠলো আমার! রনি দাঁড়িয়ে আছে সামনে, আর বড় বড় চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। আমি মনের অজান্তেই পেছন ফিরলাম আর চোখটাকে জাহাজবাতির মত চারদিকে ঘুরিয়ে আনলাম। যদিও তার কোন যৌক্তিকতা ছিল না, কারণ রনির কোন চিহ্ন থাকার কথা না এতক্ষণে, পেছনের ডাইনের ছোট্র কোনাটা দিয়ে পুরো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা তার অনেকদূর। রনিকে দেখে মনে হল, সেও ঠিক আশা করেনি আমায়। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলে সে কিছুটা আড়ষ্টভাবেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও নিতান্ত অভ্যেসবশে হাতটা উঠানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে সাড়া দিচ্ছিল না কিছুতেই। অন্য হাতটা তুলতে গেলাম, দেখলাম সেও বিদ্রোহ করছে! আমার মাথা ঠিক কাজ করছিল না তখন। সামনের মূর্তিটির অস্তিত্ব অস্বীকার করে একটা সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা জোড়াও মাটির সাথে গেঁথে গেছে ততক্ষণে! তারও কিছুটা পরে, পুরো শরীরটাই অবশ হয়ে গেল আমার!
রনি যেদিকে গিয়েছিল, সেই গলি দিয়ে পেছনের আরো আরো গলি পেরিয়ে একটা অর্ধবৃত্তাকার পথে আমার সামনের রাস্তার একটি গলি দিয়ে যে উঠে আসা যায় না, তা না। কিন্তু সে তো কমছে কম আধ ঘন্টার মামলা। ওদিকে আমি রনিকে বিদায় জানিয়েছি তা কিছুতেই দশ মিনিটের বেশী হতে পারে না। এমন হতে পারে যে, সামনে এমন কোন সরু গলা-চিপা পথ আছে, যা আমার অজানা এবং রনি সেটিই ব্যবহার করেছে। কিন্তু এ সম্ভাবনাটিকে খারিজ করে দিতে হচ্ছে, কারণ, প্রথমত, প্রতিদিন এ মহল্লার গলিতে গলিতে ঘোরাই আমার কাজ, তাই সবকিছু ঠাঠা মুখস্ত। আর যদি ধরে নেই, সত্যি সত্যি এমন কোন গলি ভোজবাজির মত গজিয়ে উঠেছে আমার অলক্ষে, তাহলেও রনি আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে যে পথে হেঁটে গিয়েছিল, সে পথেই তো আসতে পারতো, অর্ধেক সময় ও শ্রম ব্যয়ে, যদি সত্যিই তার সাধ জাগতো আমার মুখোমুখি হওয়ার! আর এখানেই এসেই আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা! তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, সে রকেট গতিতে গাড়ি ছুটিয়েই ধরতে এসেছে আমায় অর্ধবৃত্তাকার পথটি দিয়ে, তাহলেও প্রশ্ন উঠছে, কেন? কেন এই অভিমন্যু অভিযান? তাও আবার বিজ্ঞানের সূত্র ও স্বাভাবিক যুক্তিজ্ঞানকে তস্নস্ করে দিয়ে? ৩য় বিশ্বযুদ্ধটা তো শুরু হয়ে যায়নি আর পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যায়নি যে মিনিট দশেকের মধ্যেই আমাদের আবার মোলাকাত ঘটতে হবে?
আমার হৃদপিন্ডটা সজোরে লাফাচ্ছিল! আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল! চোখে রীতিমত অন্ধকার দেখছিলাম! কিন্তু তারপরো মুরব্বিদের দোয়ায় হোক, অথবা, খোদায় দয়ায় হোক, আমার চেতনাটা অক্ষত ছিল! আমার মস্তিষ্ক আমাকে বলতে লাগল ধৈর্য্য না হারাতে, আর বিপদ কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে! কিছুটা সময় গড়িয়ে গেলে, আমি যেন সত্যি সত্যি কিছুটা বল ফিরে পেলাম, আর প্রাণপণ চেষ্টায় ঘাড়টা সোজা করে মাথাটা উপরে তুলতে পারলাম! এতক্ষণ আমি একবারের জন্যও তাকানোর সাহস করিনি রনির দিকে! কিন্তু এখন না চাইতেও চোখ জোড়া সরাসরি স্থাপিত হল ওর উপর, আর ভয়ে কুকরে গেলাম আবারো! বলতে কী, আমার স্বাভাবিক যুক্তিবোধই পরিস্থিতিটাকে ভীতিকর করে তুলেছিল। না হলে একজন সাদামাটা রনিই দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে, আর তার পাশ দিয়ে ব্যস্ত সড়ক দিগবিদিক ছুটছিল গাড়ি, ঘোড়া, মানুষ আর মালামাল নিয়ে।
পরিস্থিতিটা আরো কিছুটা সয়ে এলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি রনিকে। অফিসিয়াল সাদা শার্টখানা আগের মত চাপানো নেই শরীরে। একটা রঙ জ্বলে যাওয়া টিশার্ট সেখানে। তবে হাই পাওয়ারের চশমাটা ঠিকই রয়েছে। রনি যখন কোন অফিসিয়াল ডকুমেন্ট পড়তে থাকে, তখন ওর দূর্বাঘাসের চুলের নীচের মুখখানা হুবহু শেয়াল পন্ডিতের মত দেখায় ঐ চশমাজোড়ার কারণেই। আমার চোখের কার্সরটা আরো কিছুটা নীচে নামাতেই নজরে এল ঝুলে থাকা বিশ্রী নখগুলো। রনির এই নখগুলো উঠতি তরুণীদের যে নখ চোখে পড়েছে আমার, তার থেকেও দীর্ঘ ছিল। আমার বিশ্বাস, সুডেন্টদের শাস্তি দেয়ার জন্যই নখগুলো রেখেছে ও; হোমওয়ার্ক না করলে, বা, ঠিকমত পড়া বলতে না পারলে নখগুলি দিয়ে সে আঁচড়ে দেয় স্টুডেন্টদের কোমল বাহুগুলি। তবে কিনা ওর স্টুডেন্টরা কেউই নীচের ক্লাসের নয়। অধিকাংশই ইন্টার পাস, কেউ কেউ তো অনার্সে উঠেছে। আর তারা সবাই-ই ছাত্রী। এ নিয়ে যখন ওকে ছেঁকে ধরি আমরা, তখন সে শুধু মুখের অভিব্যক্তি বদলায়, কোন শব্দ বা আওয়াজ যথারীতি বের হয় না। অবশ্য ওর নখগুলো ঠিকই সচল থাকে, শুড়ের মত কিলবিল করতে দেখা যায় তাদের!
‘ভাই, আমি তাহলে আসি। আমার কাজ আছে।‘ এই বলে একটা সময় রনি দূরে সরে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। ওর ছবিটা যত ছোট হতে থাকে, আমার মাংসপেশীগুলো ততই জীবন ফিরে পেতে শুরু করে, রক্তকণিকাগুলোর ক্রম-উষ্ণায়ন ঘটতে থাকে, আর তব্ধা খাওয়া স্নায়ুগুলো লাইন ও লেংথ ঠিক করে নিতে থাকে। কিন্তু ‘কি হয়ে গেল’, ‘কি হয়ে গেল’ – টা ভীষণ করে জুড়ে বসে, আর তাতিয়ে দিতে থাকে মস্তিষ্কের সবগুলো কুঠরি! যতই তাকে নামাতে চেষ্টা করি, গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই, সে ততই আসন গাড়ে আরো পাকাপোক্ত হয়ে! একটা সময়, তাকে আর সরানোর চেষ্টা না করে কি করা উচিৎ, আর কোন পথেই বা আসবে মুক্তি, তা নিয়ে পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করি। এবং তাতে কাজও হয়।
যুক্তি-তর্কের একটা বিশাল ঝড় পার করার পর আমার মাথা সিদ্ধান্ত প্রদান করে, বিষয়টা পুরো চেপে যেতে হবে। আর রনিকে ঘুনাক্ষরেও কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। যদি ও নিজে থেকে কিছু বলে, তাহলে আলাদা কথা। আসলে এমনো তো হতে পারে, হ্যালুসিনেশান হয়েছিলা আমার! যদিও রনিকে নিয়ে বিভ্রমে ভোগার কোন বাত্ থাকতে পারে না আমার, তবু এরকম একটা সিদ্ধান্ত টানার পরেই কেবল বিছানায় গা পেতে দেয়া সম্ভব হয় আমার পক্ষে। কিন্তু ঐ পেতে দেয়া পর্যন্তই! রাতটা মোটেও সহজ যায়নি আমার; কতবার যে চোখ খুলেছি আর বুজেছি, তা বলতে পারব না; ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়েছে, এই বুঝি রনি দাঁড়িয়ে আছে আমার শিয়রে, হাত থেকে বেরিয়ে পড়েছে সেই ঝোলানো নখরগুলো। আমি বুঝতে পারি, আমার সিদ্ধান্ত টানাটা ভুল ছিল; বরং এটাই সত্য যে, আমায় কিছু একটা ধরেছে, পিছু নিয়েছে আমার! আর এ থেকে সহসাই মুক্তি নেই!
পরের দিন এক রৌদ্র করোজ্জ্বল সকাল ভাঙ্গিয়ে দিল পৃথিবীর ঘুম। রোদের আঁচটা এত প্রখর ছিল যে, আগের রাতের সব কিছু ভুলিয়ে দিল! ভয়ানক ক্লান্তিকর এক কাজের পর বিশ্রাম যেরূপ স্বর্গীয় আনন্দ নিয়ে আসে, সেরকম অনুভূত হচ্ছিল আমার। দেহমনে এক অন্যরকম ফুরফুরে ভাব টের পাচ্ছিলাম অফিস যেতে যেতে। রনি যথারীতি আগে এসেছিল আর মাথাটা ডেস্ক অব্দি ঝুলিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছিল। আমি সামনে দিয়ে যেতেই নখসমেত বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। এটা ওর একটা নিজস্ব স্টাইল, কাউকে অভ্যর্থনা বা বিদায় জানাতে, এমনকি কারো সাথে একমত বা দ্বিমত হলেও এই নখ ঝোলানো আঙ্গুলের বার্তা সে দেয়, বেশীরভাগ সময়েই মুখ দিয়ে কিছু বলে না, বা, কোন প্রকার আকার ইঙ্গিতও প্রকাশ করে না। মনে হয়, পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা তার ঐ নখগুলোতে পোরা!
তো রনিকে দেখে সব মনে পড়ে গেল আমার, আর বুক ধুকধুকানিটা শুরু হয়ে গেল! ওর রোবটের মত দেখতে কাঠামোটার দিকে আমার চোখ ইচ্ছের বাইরেই বারবার চলে যাচ্ছিল, গতকালের শার্টটাই আবার পরেছে! আমার জানামতে, দুটো শার্ট রয়েছে ওর অফিসে পরার জন্য, এগুলি সে একদিন অন্তর অন্তর পরে থাকে, কিন্তু আজ সে নিয়মের ব্যত্যয় করে আগের দিনেরটাই পরে এসেছে। অন্তত এ নিয়েও তার সাথে কথোপকথন শুরু করা যায় এবং তারপর আস্তে আস্তে গতকালের কথাটা পাড়া যায় - সে কেন বাসা থেকে শার্ট বদলে ঘুরে এসেছিল আমার সাথে হাত মেলাতে? আর এত তাড়াতাড়ি প্লেনের মত এলই বা কি করে? অথবা, ঘুরতি পথ না ধরে, সোজা পথ ধরে এল না কেন? কিন্তু যদি সে বলে যে সে আসেই নি! অস্বীকার করে সব কিছু! ভাবতেই অন্তরাত্বা কেঁপে উঠে আমার, আর নতুন করে শীতল স্রোত বয়ে যেতে থাকে আমার ইতোমধ্যে আহত মেরুদন্ডটা দিয়ে! একটা সময় খেয়াল করলাম, আমার হাত পাও কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে এই ভরদুপুর! আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি, নিজের ডেস্কটায় মুখ গঁজে দিতে!
সাম্প্রতিক সময়ে আউটডোর কাজই বেশী হয়েছে, ফলে ব্যাক অফিসে কাজের পাহাড় জমে ছিল। আজ সেগুলোর উপর মনের অজান্তেই হামলে পড়ি, আর মুহূর্তের মধ্যেই ডুবে যাই। একটানা কাজ করে কখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই! একটা সময় ক্ষুধাটা চিতিয়ে উঠে, আর মাথাটা ঘুরতে শুরু করে। হাতের কাজগুলোকে তাই আধাপেটা রেখেই ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াই আমি। সেখানে ইতোমধ্যেই রনি অবস্থান গ্রহণ করেছিল, আর খাবারগুলি প্লেটে সাজিয়ে নিচ্ছিল। আশ্চর্য হলেও সত্যি, রনিকে দেখে একটুও ধাক্কা খেতে হল না আমাকে। কাজের চাপ, না কি ক্ষুধা – কোনটির ভূমিকা ছিল সেখানে, জানি না, তবে আমার স্মৃতি থেকে আগের দিনের ও আজকের সকালের ঘটনাগুলো সব কর্পূরের মত উবে গিয়েছিল।
দুপুরে খাবার টেবিলে রনির সাথে দেখা হওয়াটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক ও রুটিন একটা ঘটনা আমার জন্য। ও যথারীতি স্পিকটি নট থাকে, আর আমি একা একাই কথা কইতে কইতে আহার-পর্বটা সারি। এবং অফিসে একমাত্র আমিই এ কাজটা করি, অন্য কারোই আগ্রহ নেই একটা সাক্ষাৎ এলিয়নের সাথে খেজুরে আলাপ করে সম্পর্ক পাতাতে। কিন্তু আজ ক্ষিদের তাড়া থেকেই হয়ত চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আর রনিও স্বভাবসুলভ প্লেটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক মনে খেয়ে যাচ্ছিল, মুখোমুখি বসলেও চোখাচোখি পর্যন্ত হচ্ছিল না আমাদের। প্রতিদিনের মত আজও আগেই খাওয়া শেষ করে যখন উঠে যাচ্ছিল, তখন মনের অজান্তেই আমার চোখ চলে গেল ওর পেটের দিকে, আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল! রনি চিরকালই চিমসে ছিল, আর পেটটা খাদে নামানো ছিল, এজন্যই কিনা, এক কাস্টমার তো এক সাক্ষাতে টিপ্পনি কেটেছিল, ‘এইডা কি পুরুষ পুলার প্যাড, না অন্য কিছু!’ কিন্তু আজ সেই চিমসে পেটই বিভৎস আকার ধারণ করেছিল, পেটের নীচের দিকটাতে একটা অর্ধবৃত্তাকার গহবরের মত সৃষ্টি হয়েছিল, চামড়াটার নীচে আগুনের ফুলকি ঝিলিক মারছিল, আর তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল! একটা সময় আমার মনে হল, গহবরটা আমায় আকুল হয়ে ডাকছে, আর টেনে ধরতে চাইছে! আমার সারা দেহ আবার অবশ হতে শুরু করল; প্রায় মূর্ছা যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ই আমার দিকে এক ঝোলা নখের অভিবাদন ছেড়ে সে ডাইনিং রুম থেকে বিদেয় হল।
সেই দিন কাজ শেষে রনি এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, এক সাথে যাবে বলে। ওর সেই নখগুলো সাঁড়াশির মত খামচে ধরেছিল আমার ডেস্কের উপরের স্টেইনলেস পাতটা! নখগুলো ভীষণ রকমের কাঁটা দিয়ে গেল আমার গায়ে, যেকোন দিনের থেকে ধারালো দেখাচ্ছিল সেগুলোকে, মনে হচ্ছিল মরুভূমির বালিতে শান দিয়ে আনা হয়েছে!। আমি একবারই তাকিয়েছিলাম ওর দিকে, আর টেবিলের উপর গাদা গাদা ফাইলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাথা নেড়ে সাংকেতিক বিদায় জানিয়েছিলাম। এরপর বাক্য ব্যয় না করে সে যখন সিড়ি দিয়ে নেমে যেতে শুরু করল, আমি এক লাফে পশ্চিম দিকের উইন্ডো ওয়ালের ধারে চলে গেলাম। যেদিকটা দিয়ে রনি বেরুবে, তার সাথের রাস্তার ডান ও বাম বাহু বেশ কিছুটা ধরতে পারে এই উইন্ডো। এমনকি গতকাল যেখানে রনির সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সে জায়গাটাও ছোট করে হলেও মিস্ হওয়ার কথা না! আমি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম লাগলাম। বুকের হৃদ কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে! রনি যথারীত ডানের বাহু ধরে এগুতে এগুতে এক সময় ডানের গলিতে উধাও হল। অন্যদিকে, বাম বাহুটা লোকে গিজগিজ করছে, কিন্তু রনির চিহ্ন নেই কোথাও! এমনকি আধঘন্টা পার হয়ে যাবার পরেও! আজ সে আর অর্ধবৃত্তাকার পথটা ব্যবহার করেনি!!
কিছু একটা নেই; ছিল, কিন্তু নেই! আচ্ছা, রনিকে আজও উল্টো দিকে দেখা গেলে কি হত আমার মনের অবস্থা? মূর্ছা যেতাম? না কি, নীচে নেমে জিজ্ঞাসা করতাম, সে কে? আসলে কি হত, তা আমার সত্যি জানা ছিল না। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম, আতঙ্কের ঘরটা বেশ ভাল করেই দখলে নিয়েছে অতৃপ্তি, আরে সেই দমবন্ধ ঘরেই পার করে দিলাম দ্বিতীয় রাতটা। পরদিন সকালে বিষয়টা মনে পড়লেও কেন জানি, খুব একটা ধরে বসল না। বরং মনের কোনে শক্তিশালী হতে লাগলো ভাবনাটা - সবই আমার দুর্বল মনের দুর্বল সময়ের ফন্দিফিকির। বাস্তবে এসব কিছুর কোন অস্তিত্ব নেই। সেদিন অফিসে গিয়েই রনির পিঠে চাটি মারি, ‘কি রে, ব্যাটা! কয়টা আন্ডা গিললি আজ?’ আগে হয়ত বলা হয় নাই আপনাদের। বয়সে ছোট হওয়ার জন্য না, আসলে চিকনাচাকনা হওয়ার কারণেই ‘ব্যাটা’ বলে থাকি ওকে। রনি আমার কথা শুনে ডান হাতের কিছু আঙুল উঁচু করে ধরলো। ডিমের সংখ্যার যে বার্তাটি সে দিতে চাইলো, তা বোঝা কষ্টকর কিছু ছিল না। কিন্তু একটা ইলেকট্রিক শক্ আমার সারা দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেল! রনির আঙুলের নখগুলো আরেকটু বেড়ে জ্যামিতি বক্সের চাঁদার আকার ধারণ করেছিল! আমার কেন যেন মনে হল, সূর্যের আংশিক গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে, পুরো গ্রাসে আর দেরি নেই!
দুপুরের পর ভয়টা কেন জানি কেটে গেল, কাজের চাপেই হবে হয়ত। ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তদারকির কাজে। একটা কথা, ওর শীতল চোখ-মুখ আমার তদারকির কাজটা অনেক সহজ করে দিত, বদ লোকেরা একটা অশরীরী বার্তা পেয়ে যেত ওকে দেখেই, মুখ ফুটে কথা বের করার কোন দরকারই পড়ত না। কেন জানি না, চলতে চলতে উত্তরপাড়াটায় এসে পড়লাম, এ সেই অর্ধবৃত্তাকার পথ, মেইন রাস্তার পেছনে পেটের মত বেরিয়ে জড়িয়ে রয়েছে যে, যেদিক দিয়ে একমাত্র টেকনিক্যালি সম্ভব ছিল সেদিন রনির আমার সামনে আবির্ভূত হওয়ার। লোভটা সামলাতে পারলাম না, কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে ফেললাম “এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা আছে রনি?’’ সে মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। আমার যেন দমবন্ধ হয়ে এল, সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, “শেষ কবে গেছিলি?” রনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে, “প্রায় মাসখানেক হবে।“আমার মনে হতে লাগলো, ও মিথ্যে বলছে! মাসখানেক আগের ঘটনা মনে করতে কারো এক মিনিট লাগে! মেজাজটা গরম হয়ে গেল হঠাৎ, চিৎকার করে উঠলাম আমি, “এইতো দুইদিন আগেই গেলি এদিক দিয়া, অফিস থেকে বিদায় নেয়ার পর আবার ঘুইরা আইলি। কেন আইছিলি? ভং ধইরা মজা নেস, না?” আশেপাশের কিছু মানুষ থমকে গিয়েছিল, আর রনি এক নাগাড়ে অনেকটা সময় চেয়ে ছিল আমার দিকে, তারপর কোন কথা না বলে গটগট পায়ে হাঁটা দিয়েছিল, আমাকে ছেড়ে। যাওয়ার সময় ওর মুখটা চোখে পড়েছিল আমার; সেখানে ক্রোধ, উত্তেজনা বা ঘৃণার কোন চিহ্ন দেখতে পাইনি আমি, ওসব সে আমায় দিয়ে গিয়েছিল।
পরের দিনগুলো রনির সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি, কথা কওয়াকওয়ি বন্ধ হয়ে গেল আমার। আমি কয়েকবার বরফ ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, ওর হিমশীতল অর্ধবৃত্তাকার নখগুলোকে ভয় না করেও। কিন্তু সে কোন ধরণের সাড়া দিল না। ওর মধ্যে তো রাগ-অনুরাগের কোন বিষয় কখনো দেখিনি, তাহলে কেন জেদ দেখাচ্ছে? আমার কিছুটা খারাপ লাগতো না, তা না। কিন্তু ব্যাপারটা আমায় অবাক করতো তার থেকেও বেশি। কেন ওর বয়সী একজন ছেলে এমন হবে? প্রায় অনুভূতিশূন্য! কোন কিছুতেই রা নেই! শুধু যন্ত্রের মত কাজ করে যাওয়া! শুনেছি, অফিসে বেগার খাটার পর সে বাসায় যায় না, আটটা টিউশানি চলে তার একই সাথে। কি করে সম্ভব! একটানা কি করে এমনভাবে কাজ করতে পারে মানুষ! একটা যন্ত্রকেও তো স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য বিরতি দিতেই হয়। কিন্তু রনি যে বিরতিহীন চলে, তার পেছনের রহস্যটা কী?
একদিন আমাদের অফিসের বুড়ো দারোয়ান এমন একটা বোমা ফাটালো যে আমার হাতে রহস্যের সবগুলো সুত্র এসে গেল। কথা হচ্ছিল রনিকে নিয়ে, ওর অপূর্ণাঙ্গ, বা, কখনো অতিমানবিক বিষয়-আশয়গুলো নিয়ে। দারোয়ান চাচা অনেকটা জোর করে ঢুকে পড়লেন আমাদের কথায়, “উনার যমজ ভাইডার হালত পুরাই অন্য কিসিমের! হেও তো একটা হুনছি একটা ব্যাংকে কাম করে!’ আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তা না; কিন্তু যতই ভাবছিলাম, ক্ষুদ্ধ হচ্ছিলাম নিজের মোটা মাথাটার উপর! একবারও কেন মনে হয় নাই! রাস্তার সমীকরণ মিলে গেলেও নতুন কিছু সমীকরণ তাতিয়ে দিতে লাগলো আমায়। আচ্ছা, ওরা জামা অদল বদল করার মত করে নিজেদের অফিসের চেয়ার অদল বদল করে না তো? আমার ধারনা অমূলক ছিল না! কারণ যমজেরও তো একটা লিমিট আছে, কিন্তু ওরা একদম কার্বন কপি ছিল; আমার ঘোর সন্দেহ ছিল, ওদের বাবা-মা আলাদা করতে পারতো কিনা! আমার তো এখন মনে হয়, ছয়মাস বয়সী আরো একটা জটিল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি! আপাত চিন্তা ও অনুভূতিশূন্য রনি, যার একমাত্র যোগ্যতা যন্ত্রের মত কাজ করা, সে-ই কিনা পদোন্নতির পরীক্ষায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল সেকেন্ড হয়ে! আমার কেন জানি মনে হয়, ওর ভাই বসেছিল সেদিন এক্সাম বোর্ডের স্যারদের সামনে!
এরপর কি কারণে জানি না, প্রায়ই দেখা হতে লাগলো ওর ভাইয়ের সঙ্গে, যদিও কথা হয়নি, ইচ্ছে হলেও পারিনি, কারন দেখাগুলো হয়েছে দূরত্ব রেখে, মাঝে মানুষ ও যানের ঘেরাটোপ রেখে। একদিন আমি বাসে করে যাচ্ছি মিরপুর স্টেডিয়ামের দিকে, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান খেলা ছিল। সেদিন দেখি স্টেডিয়ামের বাইরের গেট দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসছে সে। আরেকদিন দেখি, সিডি ব্যাংকের এটিএম বুথে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে উদ্বেগের ঘন কালো ছায়া। আবার একদিন আমাদের অফিসের কাছের আল শামস্ হাসপাতালে সামনে মতিচ্ছন্নের মত ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। মজার ব্যাপার হল, ও আমাকে দেখেছে প্রতিবারই। আর আমি তো এখন ওকে চিনি, তাই হাত নেড়েছি। কিন্তু কি যেন একটা কিছু তাড়া করে ফিরছে তাকে, কিসের যেন ব্যস্ততা! নিশ্চয় ওর কোন ঘটনা আছে!
আমি ছিলাম অদ্ভুত রনির সব থেকে কাছের লোক, অন্য লোকদের টিপ্পনী-বিদ্রুপ- শাসন থেকে ওকে আমিই বাঁচাতাম, সাপোর্ট করতাম। কিন্তু বিষয়টা বেশীদিন চলা উচিৎ নয়, দুই ভাই মিলে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে, এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া উচিৎ। রনির এক পাড়াতো ভাই একবার একটা সার্ভিসের জন্য এসেছিল আমার কাছে, রনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। অনেক দিন আগের কথা। কার্ড অ্যালবাম থেকে নামটা খুঁজতে বেজায় কষ্ট হল। অবশেষে প্রায় উঠে যাওয়া বিবর্ণ নাম্বারটি ধরে টিপে টিপে যখন ওপ্রান্তে রিংটোনকে আওয়াজ করতে শুনলাম, জানে পানি পেলাম মনে হল। পরিচয় পর্ব সারার পর ভণিতায় না গিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম, ‘’আচ্ছা, রনির যমজ ভাইয়ের কোন ঘটনা আছে?’’ লোকটি যেন অবাক হয়ে গেল আমার কথায়, “সবাই জানে, আর আপনি জানেন না?” প্রথমে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো, তারপর আমার চাপাচাপি আর পীড়াপীড়িতে বলতে শুরু করলো…রনির যমজ ভাইটা একদিন ব্যাংকের ডেস্কে কাজ করছিল, ঐ সময় ব্যাংক থেকে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের টিকেট বিক্রি হচ্ছিল। অল্প সময়েই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাংকের লোক অধিকাংশ টিকেট ধরে রাখবে। টিকেটের লাইনটা অস্বাভাবিক স্লো এগুচ্ছিল। আর যায় কোথায়! মুহূর্তেই রক্ত চড়ে যায় পাব্লিকের! জানালার কাঁচ ভাঙতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে গেলে, লেগে যায় কুরুক্ষেত্র; টিয়ারগ্যাস, ইট পাটকেল, ধোঁয়া। এরই মাঝে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে থাকে ব্যাংকের লোকজন; সে সময় রনির ভাই গোলমালের মধ্যে পড়ে যায়। পরে তো তাকে উদ্ধার করে কাছের আলশামস হাসপাতালে নিয়া যাওয়া হয়েছিল।
আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে! গলা শুকিয়ে যায়! আর আমি ভাবছিলাম অন্য কেইস! “আচ্ছা, সে কতদিন আগের কথা?” লোকটি বলে উঠল, “এই ধরেন, বছর পাঁচেক তো হইবই!” অপরাধবোধটা আস্তে আস্তে চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে আমার মধ্যে। এই অফিসে সংসার শুরুরও আগের ঘটনা! লোকটিকে জিজ্ঞাসা করি, “হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে কয়দিন লাগছিল? এরপর কি আর কোন সমস্যা-টমস্যা হইছিল? থানা-পুলিশ করতে হইছিল না কি? কাজে যোগ দিতে ঝামেলা হয় নাই তো আবার?”
‘কি জিগাইতেছেন বোকার লাহান? হাস্পাতাল থেকে যে লাশ হইয়া ফিরে, সে আবার জয়েন করে কি কইরা?’ লোকটার কণ্ঠে বিষ্ময়, না শ্লেষ মেশানো ছিল, তা আমি ধরতে পারি না। কিন্তু আমি ফোনটা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকি; কিছুক্ষণ আগে যা ছিল মৃদু কাঁপুনি, এখন তা পরিণত হয়েছে প্রবল ভূমিকম্পে! আমার আশেপাশের সব কিছু নড়ছিল, আমার চেয়ার-টেবিল, খাতা-পত্র সব কিছু উড়তে শুরু করেছিল! চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, দেয়াল বেয়ে নেমে আসছিল অন্ধকার! ওরই মাঝে হঠাৎ রনিকে দেখতে পাই আমি, আমার ডেস্কটা খামচে দাঁড়িয়ে আছে, ওর নখগুলো ঝুলে আছে আগের মতই বিশ্রীভাবে! তবে ওর হাতে আরো একটি জিনিস ছিল, যা ওর কাছে নতুন হলেও আমার জন্য ছিল না। ঘড়িটা চিনে নিতে একটুও কষ্ট হয় না আমার, বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে থাকি আমি ওটার দিকে! আমি আস্তে আস্তে বোধশূন্য হতে থাকি রনির মত, আমার অনুভূতিগুলোও যেন উধাও হয় নিমিষেই! একটা শূন্যতা অর্ধবৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে, আমায় বেষ্টন করতে করতে!
(সমাপ্ত)
………………………………….
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।