পুজোর চালচলন যে বদলাচ্ছে এ আর কোন নতুন কথা নয়। অতিমারি এই বদলানোর পালে বাতাস লাগিয়েছে। তবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চালচিত্র বদলালেও প্রতিমার পিছনে চালচিত্র এখনও একইরকম। থিম, টিম, স্পনসর, মেন্টরদের ধামাকার সামনে দাঁড়িয়ে সে এখনও আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতিকে। চালচিত্র যেন বাংলার প্রাচীন সামাজিক জীবনের এক রেট্রসপেকটিভ, অতীতের এক ঝাঁকি দর্শন। প্রতিমার পিছনের অর্ধচন্দ্রাকৃতি পরিসরে দাঁড়িয়ে সে বলে অসুর বিনাশের জন্য সমস্ত দৈবশক্তির মহামায়ার রূপ নেওয়ার কাহিনি; দেবীর গার্হস্থ্য জীবন; ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ছাড়াও নানা দেবদেবীর ছবি ও কাজকর্মের চিত্রকল্প। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায়, “ক্রমে দুর্গার গায়ে রঙ উঠিল, রঙ শুকাইল, চালচিত্রে ঘরবাড়ি, সাজসজ্জা ক্রমে যেন ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। বোধ হইতে লাগিল মহাদেব যেন সত্যসত্যই ষাঁড়ের উপর বসিয়া বিবাহ করিতে যাইতেছেন।”
সাবেক একচালা প্রতিমাতে আমরা দেখি চার পুত্রকন্যা সহ দেবীর অসুর নিধন। চালচিত্রে ফুটে ওঠে তার পটভূমি। দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্য চালচিত্রে থাকে নানা লৌকিক অলৌকিক কাহিনি। ভারতের মন্দির গাত্রে বা স্থাপত্যে দেবদেবীর পিছনে জ্যোর্তিবলয় বা চক্রের মাধ্যমে তাদের দেবীয়ানা বা দেবত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালচিত্রে এসে যেন এক ঘরোয়া চেহারা পেয়েছে। পটভূমিটিতে এসেছে এক নিখাদ বাঙালিয়ানা। মন্দিরে দেবদেবীর পিছনের বৃত্তটি দুর্গাপ্রতিমায় এসে হয়ে উঠেছে কাঠ আর বাঁশের বাখারি দিয়ে তৈরি করা একটা অর্ধবৃত্ত। তার ওপর চট কিংবা মোটা কাগজ দিয়ে তৈরি হয় চালি। কেউ বলেন চালা, কেউ বলেন চাল। চালচিত্র আঁকা হয় এর ওপর। আঁকার উপযোগী করে তুলতে চালার ওপর দেওয়া হয় এঁটেল মাটি, বেলে মাটি, গোবর জল আর তেঁতুলবিচির আঠা মেশানো চুন কিংবা খড়িমাটির প্রলেপ। অনেকে তার ওপর খবরের কাগজের প্রলেপও দেন।
অনেকটা এই কায়দাতেই পট আঁকার ক্যানভাসটি তৈরি করেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়াগ্রামের পটুয়ারা। প্রাকৃতিক রঙ আর উপকরণ ব্যবহার করে আগে তো এই চালচিত্র আঁকতেন তারাই। চালচিত্রের অঙ্কনরীতিতে এখনও পটুয়াদেরই প্রভাব। এখনও দরকার পড়লে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মৃৎশিল্পীরা চালচিত্র আঁকাতে পিংলা অথবা কৃষ্ণনগরের পটুয়াদের দ্বারস্থ হন। কখনও বা খোঁজ পড়ে বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে থাকা গ্রহবিপ্র, সূত্রধর, মিস্ত্রি ও ফৌজদার সম্প্রদায়ের চালচিত্র শিল্পীদের। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃৎশিল্পীরা নিজেরাই নানা জায়গা থেকে শিল্পী যোগাড় করে কাজ চালিয়ে নেন।
বাড়ির ঠাকুরদালানের চালচিত্র আঁকা শুরু হতেই বোঝা যায় পুজো প্রায় দোরগোড়ায়। খড়, মাটি, কাঠামো ততদিনে অনেক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আঁকিয়েদের চারপাশে ভিড় করে এসে দাঁড়ায় ছোটরা। তাদের গাদাগুচ্ছের প্রশ্ন – ষাঁড়ের পিঠে চড়া কিংবা ভূতপ্রেত ঘিরে থাকা ঐ মোটা লোকটা কে? ওর গলায় সাপ কেন? দুর্গা মন্ডপে শিব তেমন পাত্তা না পেলেও চালচিত্রে তিনিই মধ্যমণি। কোথাও তিনি করছেন চাষবাস, কোথাও গাঁজা বা ধুতরো খেয়ে তিনি নেশায় চুর। সত্যি বলতে কি, দুপাশে সরু থেকে আস্তে আস্তে মোটা হয়ে ওঠা অর্ধবৃত্তাকার এই চালা মহিষাসুরমর্দিনীকে বানিয়ে দেয় একেবারে ঘরের মেয়ে। কখনও বা প্রাঞ্জল করে তার আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট। আটচালার মন্দির, বাড়িঘর আর ধানের গোলা দেখতে অভ্যস্ত বাঙালি জ্যোর্তিবলয় আর ঘূর্ণায়মান চক্রের চেয়ে বাংলা চালের এই আটপৌরে অর্ধবৃত্তকেই সহজে গ্রহণ করেছে।
এই চালা আবার দেবীর মূর্তিতে এনেছে একটা ভারসাম্য। মনসা অথবা শ্রীকৃষ্ণের কালীয়দমন মূর্তিটি দেখলেই বোঝা যায় এখানে সাপ কাজ করেছে চালি অর্থাৎ দেবীমূর্তির পিছনের একটা পটভূমি হিসেবে। কিন্তু শুধুমাত্র অর্ধবৃত্ততেই শেষ হয়ে যায়নি চালচিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতেও চলেছে অনেক ভাঙচুর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুপাশে থাম দিয়ে তৈরি হয়েছিল মার্কিনি চাল, তারপরে এল চারকোণে বেশ কয়েকটি থাম দিয়ে তৈরি সর্বসুন্দরী চাল। এরপর এল তিনটি চুড়োওয়ালা তিনচুরি চাল। সাহেবদের গির্জার চুড়োর মত চালচিত্র আঁকা হয়েছিল বাংলায়। কিন্তু কোনটাই তেমন দাঁড়ায়নি। উপযুক্ত শিল্পী ও অঙ্কন দক্ষতার অভাবে প্রায় বিলুপ্ত দোথাকি চালচিত্র। এই চালচিত্রে দুটিভাগে দেবী দুর্গার মহিমার দুটি আলাদা কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়। অসাধারণ এর অনুপুঙ্খ ও অঙ্কনরীতি। পিংলার রঞ্জিত চিত্রকরের মত কিছু পটুয়া এখনও এই ধরণের পট আঁকেন। এই পটে মূল কাহিনির ফ্রেমের দুপাশে বর্ণিত হয় সম্পূর্ণ আলাদা একটা কাহিনি।
মন্ডপে অসুর নিধনেই দুর্গার ডিউটি শেষ। চালচিত্রে কিন্তু যাকে বলে একেবারে ঘটনার ঘটঘটা। নানা রূপে দানব দলনে ব্যস্ত দেবী। কোথাও সিংহের পিঠে চড়া পীতবর্ণা দেবী কৌশিকী শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করছেন; কোথাও বা চন্ড-মুন্ড বধে ব্যস্ত দেবী কালিকা। বিষ্ণুর দশাবতার, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, রামায়ণের কাহিনির পাশাপাশি ব্রাহ্মণী, বৈষ্ণবী, গনেশজননী ইত্যাদির মত দুর্গার স্নিগ্ধ রূপগুলিও জায়গা পেয়েছে চালচিত্রে। থিমের পুজো একটা বিশেষ পরিস্থিতি, অবস্থা বা ভাবনার একটা চিত্রকল্প নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু চালচিত্রের বিশালত্ব এখানে অনুপস্থিত। ছবিগুলির মধ্যেই যেন ধরা পড়ে দেবীমহিমা। তা হয়ে ওঠে প্রকৃতঅর্থেই একটা বিগ পিকচার! আমাদের তাবৎ দুর্বিপাক থেকে উদ্ধারকারী দেবীর দেবীয়ানা এখানে আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। দুর্গা ছাড়া আমরা চালচিত্র দেখি বাসন্তী আর জগদ্ধাত্রী প্রতিমায়।
গৃহস্থদের পুজোমন্ডপ, ঠাকুরদালানের সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেবীর এত রূপ ও ভূমিকা দেখানো দুষ্কর। এই সমস্যা মেটাতে বাংলার লোকশিল্পীরা তাদের অঙ্কনরীতির দ্রুতির সাহায্যে ক্ষুদ্রেই ধরতে চেয়েছেন বৃহত্বের আভাস। খুব সামনে থেকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য না করলে তাদের অনুপুঙ্খ বর্ণনা করার এই দক্ষতা বোঝা যায়না। বিশালাকার ও বিচিত্র বিভঙ্গের প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলো ও শব্দের ধামাকা আমাদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়েছে বলে হয়তো তা আমরা সবসময় লক্ষ্য করি না। তবে শিল্পকর্মটির গুরুত্ব তাতে খাটো হয়না।
একচালার প্রতিমায় মৃৎশিল্পীর তেমন কোন কেরামতির সুযোগ ছিল না। অন্তত প্রতিমার শারীরিক বিভঙ্গে তো নয়ই। সেখানে দুর্গা যেন একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসা এক গিন্নিবান্নি মহিলা। নিছক ডিউটি হিসেবেই যেন তিনি পথের মাঝখানে তাদের বিরক্ত করতে আসা দুষ্ট লোকটিকে বধ করছেন। এবং এটা এমন একটা রুটিন ব্যাপার যে তার ছেলেমেয়েদেরও এ নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ নেই। মনে হয় গোটা বিষয়টিকে একটু ঘটনাবহুল, আকর্ষণীয় এবং রঙিন করে তুলতে চালচিত্র ছাড়া শিল্পীদের সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। তাতেই তারা দ্যুলোক-ভূলোক-গোলক একাকার করে নানা থিমের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। অঙ্কনরীতির দ্রুতিতে জীবন্ত করে তুলেছেন দেবতা ও দানবদের। ক্ষুদ্রে এই বৃহৎ -এর আভাসটাই চালচিত্রকে এগিয়ে রেখেছে।